উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৮
রাত ৯টার কাছাকাছি সময়। সারাদিন একটানা খাটাখাটনির পর সেতু সবেমাত্র নিজের ঘরে এসে বিছানায় গা এলাতে পারল। শরীরে প্রচন্ড ব্যথা তার। ক্লান্ত শরীর। ঘুমে চোখ লেগে আসছে। সেতু রোজ ভোরে ফজরের নামাজের পর কাজ শুরু করে আর রাতে গিয়ে শেষ হয়। বাড়ির উঠোন ঝাড়া থেকে শুরু করে রান্নাবান্না ছাড়াও বাড়ির সকল যাবতীয় কাজ সেতু একা হাতেই করে। এখন ধানের মৌসুম চলছে। লোকেরা রোজ ধান কেটে বাড়ি অবধি দিয়ে যায়। এতটুকু কাজের জন্য তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। ৫টা লোককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ধান কাটার কাজে। তাদের জন্য সেতুকে আলাদা করে রান্না করতে হয়। নাহিদ পুরো দিন ব্যবসা নিয়েই পড়ে থাকে। বাজারে খুব নামকরা শাড়ির দোকান আছে তার। মাঠে ঘাটের কাজ সে ছোট থেকেই পারেনা। অবশ্য করার চেষ্টাও করেনি কখনো। সেতুকে বিয়ে করে আনার আগে যেকোনো ফসলের যাবতীয় সব কাজ টাকা দিয়ে লোক রেখে করানো হতো। সেতু আসার পর থেকে মছিদা বেগম সব কিছু সেতুকে দিয়েই করায়। তার বক্তব্য, বাড়ির বউ থাকতে শুধু শুধু লোক লাগিয়ে টাকা নষ্ট করার কোন মানেই হয়না। ধান ঝাড়া, সিদ্ধ করা, রোদে শুকানো সব সেতু নিজ হাতে করে। বাড়ির বউকে দিয়ে ধান কাটানোর নিয়ম নেই বলে মছিদা বেগম সেতুকে মাঠে পাঠান না। নইলে এই কাজটাও সেতুর ঘাড়ে গিয়েই পড়তো। ভারী কাজ করতে করতে সেতুর হাতদুটোয় ফোসকা পড়ে গেছে। বাবার বাড়িতে দুমুঠো ভালো মন্দ না খেতে পারলেও এত খাটনির কাজ সেতু জীবনেও করেনি। আবুল কালামের নিজের কোন ক্ষেত নেই। তাই ফসলের কাজ তাদের করতে হয়নি কখনো। রুপালি যা একটু অন্যের বাড়ির ফসলের কাজ করে, ব্যাস ওইটুকুই। সেতুর বাবা-মা মেয়ের সুখের জন্যই ভালো পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কে জানতো, সেতুর কপালে সুখের বদলে এমন দূর্দশা নেমে আসবে? চোখের পানিও দিন দিন বিরক্ত হয়ে এসেছে সেতুর। আর কত চোখের পানি ফেলবে সেটা তার জানা নেই। তবে যত যাই হয়ে যাকনা কেন, সে মরতে রাজি তবুও স্বামীর ঘর ছাড়তে রাজি না। চাইলে সে অনেক আগেই চলে যেতে পারতো। সেতুকে বিয়ে করার পর নাহিদ আরও তিনটে বিয়ে করেছে। কিন্তু তারা একজনও টেকেনি। সেতুই সব সহ্য করে এখনো পেট কামড়ে পড়ে আছে। নাহিদের কুকর্মের কথা মাথায় রেখে সেতু চাইলে অনেক আগেই তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতো। সেতুর রূপ গুণ তো কম না। কিন্তু কোথায় যাবে সে? বাপের বাড়ি? সেতু বোঝে,বিয়ের পর বাপের বাড়ি মেয়েদের আসল ঘর নয়। ঠিক এইজন্যই সে আর যাই করুক, বাপের বাড়ি কখনোই যাবে না। আরও একটি কারণ রয়েছে। আর সেটি হলো অসচ্ছলতা। বাপের বাড়ি গিয়ে বাবা-মায়ের ঝামেলা বাড়াতে চায়না সে। সে জানে তার বাবা-মা নিজেদের সংসার চালাতেই হিমশিম খায়। এমতাবস্থায় তাদের ঘাড়ের বোঝা হলে মানসম্মান তো যাবেই, সেই সঙ্গে বাড়তি ঝামেলা হয়ে দাঁড়াবে সে। তাছাড়া গ্রামের মানুষের কানাঘুষো তো আছেই। এসব চিন্তা করেই সেতু নাহিদকে তালাক দেয়নি। এমনকি বিয়ের প্রায় পাঁচ বছরেও দু থেকে তিনবার ছাড়া সেতু বাপের বাড়ি বেড়াতে পর্যন্ত যায়নি।
রাবেয়া পুরো উঠোনের পাইচারি করছে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ। মছিদা বেগম খানিক বাদে বাদে মেয়ের কাহিনি দেখে আবার ঘরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছেন। আজ রাবেয়া প্রতিজ্ঞা করেছে এ বাড়িতে হয় সে থাকবে, আর নয়তো সেতু। পুরো উদ্যমে সে নাহিদের আসার অপেক্ষা করছে। নাহিদ আসলে যেকোনো একটা ফয়সালা করবে তারপরই রাবেয়া ধাতস্থ হবে।
মছিদা বেগম এবার জিজ্ঞেস করেই ফেললেন,
‘কি হয়েছে তোর বলবি আমাকে? এভাবে উঠোন জুড়ে কি লাগিয়েছিস বলতো?’
‘তোমার ছেলে আসুক আজকে। একটা বিহিত করুক, তারপরই আমি শান্ত হবো মা।’
‘কি বলছিস তুই? কিসের বিহিত?’ খানিক চকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন মছিদা বেগম।
‘কিসের আবার? তুমি আজকে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলে ওই মূর্খ মেয়েটাকে পাহারা দেওয়ার জন্য।’
‘হুম তো?’
‘তুমি ওকে কাজ শেষ না হওয়া অবধি আরাম করতে মানা করেছিলে কিন্তু ও তা করেনি। কাজ শেষ করার আগেই ছায়ায় গিয়ে বসেছিলো। আমি বাঁধা দিয়েছি বলে আমাকে খোটা দিয়েছে তোমাদের এখানে পরে থাকি বলে।’ রাবেয়া শেষ বাক্যটা বলে উচ্চস্বরে কেঁদেই দিল।
‘কি! আমার মেয়েকে আমার বাড়িতেই খোটা দেওয়া? এত সাহস কি করে হলো ওই ফকিরের মেয়েটার? তুই আমাকে এ কথা আগে বলিসনি কেন? আমি যখন বাড়ি এসেছিলাম তখনই বলতি। সেই সময়ই ধরতাম ফকিরের মেয়েটাকে। আজ হচ্ছে ওর। দেখাচ্ছি মজা ওকে।’
মছিদা ভীষণ রাগে জ্বলে উঠে সেতুর ঘরের দিকে যাবার তোড়জোড় পাকানো মাত্র রাবেয়া বাধাসমেত বলল,
‘না মা, তুমি কিছুই বলবে না। এখন যা বলার বা করার নাহিদ করবে। আজ আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো। এ বাড়ি থেকে আজ নাহিদ ওর বউকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবে, নয়তো আমাকে।’
কিছুক্ষণ বাদে নাহিদ আসলে মছিদা বেগম ও রাবেয়া ওকে ঘিরে ধরল। সবটা শুনে নাহিদের মাথায় রক্ত চড়ে বসে। তিনি রক্তচক্ষু নিয়ে নিজের ঘরের দিকে তেড়ে গেল। গিয়ে সেতুকে শোয়া অবস্থাতেই চুলের মুঠি ধরে টেনে নিচে ফেলে দেয়। ঘুমের মধ্যে এমন কিছু হওয়ায় সেতু বেশ ভয় পেয়ে গেল। সাথে আশ্চর্যও কম হলো না। সেই আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টি বিশাল কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইল নাহিদের মুখপানে।
সহসা নাহিদ চেঁচিয়ে বলল,
‘তোর এতো বড়ো সাহস কি করে হলো? আমার খেয়ে, আমার পরে, আমার আপাকেই বাপের বাড়ি পরে থাকার খোটা দিস তুই!’
সেতু যেন আন্দাজ করতে পারলো দুপুরের কথাগুলো নিয়ে রাবেয়া এইসব ঝামেলা পাকিয়েছে। এমনিতেই ওর শরীর ভালো লাগছে না, তার উপর চুল ধরে টানায় মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। সেতু মাথা চেপে ব্যথাতুর স্বরে বলল,
‘আমি কহন খোটা দিলাম আপারে? আমি তো কেবল বাস্তবতা তুইল্যা ধরছিলাম। কাউরে ছোডো করার জন্য কিছুই কই নাই আমি।’
সেতু বলার পর পরই রাবেয়া ক্ষিপ্ত হয়ে বলে ওঠে,
‘তুই সরাসরি আমাকে খোটা দিয়েছিস। দুপুরের কথাগুলো কি ভুলে গেলি নাকি? তুই আজ দুপুরে আমাকে খোটা দিসনি? আমাকে বাপের বাড়ি পরে থাকা নিয়ে কোনো প্রকার কথা শোনাসনি বলছিস?
‘আপা,, আপা আপনি এইসব কি কইতাছেন? আমি আপনারে খোটা দিয়া কিছুই কই নাই। আমি শুধু কথার কথা কইছি মাত্র।’
‘কথার কথা হোক,আর যাই হোক তুই বাপের বাড়ি পরে থাকা নিয়ে কথা বলেছিস তো। আমি অবাক না হয়ে পারলাম না! এত বড় কলিজা কোথায় পেয়েছিস তুই? আমার মেয়েকে তুই খোটা দিস! বলি তোর কামাই খায় নাকি আমার মেয়ে?’ মছিদা বেগম বললেন।
‘বিশ্বাস করেন আম্মা, আমি আপারে সেইভাবে কিছুই কই নাই।’
রাবেয়া নাহিদের নিকট কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘দেখলি নাহিদ তোর বউ কত বড়ো মিথ্যাবাদী! শুনে রাখ, তুই যদি তোর বউকে আজ এ বাড়ি থেকে বের না করিস তাহলে কিন্তু আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবো।’
‘কাউকে কোথাও যেতে হবে না। সেতু আপনার পায়ে ধরে মাফ চাইবে এখন। আর প্রতিজ্ঞা করবে আর কোনদিনও যেন ও আর আপনাকে খোটা দেওয়ার দুঃসাহস না দেখায়।’ নাহিদ বলল।
‘কিন্ত আমি ক্যান মাফ চামু আপার কাছে? আমার দোষ কি? ভুল কি কইছি আমি? আমি শুধু কইছি মাইয়াগো আসল বাড়ি তার শ্বশুরবাড়ি। বাপের বাড়ি না। এই জিনিসখানই বুঝাইতে চাইছিলাম আপারে।’
‘দেখেছিস তোর বউয়ের মুখে এখনো বুলি ফুটছে! আমি থাকবো না এই বাড়িতে। এটা আমার নিজের বাড়ি না। তোর বউ সাফ বলে দিয়েছে, আমার নাকি এই বাড়ির কোনো বিষয়ে কিছু বলার অধিকার নেই। তুইও তোর বউয়ের মতো আমাকে খোটা দে। গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দে আমাকে এ বাড়ি থেকে।’ বলেই রাবেয়া মরাকান্না জুড়ে দিল। তা দেখে নাহিদ এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। ও গিয়ে সেতুকে একের পর এক লাথি চর মারতে শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে আঘাত সহ্য করতে না পেরে নিজের দোষ না থাকা সত্ত্বেও সেতু রাবেয়ার পা ধরে মাফ চাইল। সেই সময়টা ছিল রাবেয়ার জন্য আনন্দদায়ক সময়। সেতুকে ব্যথায় কাতরাতে দেখে রাবেয়ার ঠোঁটের কোণে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠল। অতঃপর রাবেয়ার অশান্ত মন শান্ত হলো।
***
স্কুল ছুটির ঘন্টা বেজে উঠল। সকল ছাত্র/ছাত্রীরা সারিবদ্ধ হয়ে স্কুলের বিশাল বড়ো লোহার গেইট দিয়ে বের হচ্ছে। মিতু আর নয়না দুজন দুজনের হাত ধরে স্কুলে যাবে। ফেরার সময়ও হাত ধরেই বাসায় আসবে। গ্রামের সরু পথ দিয়ে হেলতে দুলতে হাঁটছে দুজন। আকাশে এক ঝলক রোদের রেশ মাত্র নেই। চারিদিকে মৃদুমন্দ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা আছে। কারণ আকাশ তখন কালো মেঘের ছায়ায় একটু একটু তলিয়ে যাচ্ছিলো। দুই বান্ধবী নিজেদের মধ্যে সংলাপ অব্যাহত রেখে পা চালিয়ে যাচ্ছে। অকস্মাৎ নয়নার মাথায় একটা বিষয় উঁকি দেয়। সে বিলম্ব করে না বিষয়টি তুলে ধরতে।
‘তোরে তো একটা কথা কইতে ভুইল্যাই গেছিলাম রে মিতু।’
‘কি কথা?’
‘পলি দাদী আছে না, হেয় কাইল সন্ধ্যায় আমাগো বাইত্তে আইছিলো।’
শুনে মিতু চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। আর বলে, ‘বিচার দিতে আইছিলো নাকি তোর নামে?’
নয়না বলল, ‘হ, গাঙের হেই ব্যাপারখান লইয়া।’
‘সেইডা তো বুঝছি আমি। কিন্তু, তোর মায় কি তোরে বকছিল পলি দাদীর কথা হুইন্যা?’
‘হ বকছিল। আমি যে দাদীর লগে ছোডো হইয়াও তর্ক করছি, বুড়ি কইছি তার লাইগ্যা বকছে। আমারে দাদীর কাছে মাফ চাইতেও কইছে। আম্মুর রাগতো জানোসই। আমি অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাফ চাইছিলাম। প্রথমে কষ্ট পাইছিলাম ঠিকই কিন্তু পরে ভালোই লাগছিল।’
‘বকা হুইন্যাও ভালো লাগছে তোর? আজব জনগণ তো তুই!’
‘আরে পুরাডা হুন না ভাই।’
‘আইচ্ছা ক হুনি। হগলের মত প্রকাশের অধিকার আছে। স্যারে তো আইজকে খুব ভালো কইরা বুঝাইলো পরমতসহিষ্ণুতার অধ্যায়খান।’
নয়না রাগী চোখে তাকায়। ঈষৎ রাগী কন্ঠে বলে,
‘তুই যে কি মিতু? কোথায় কি ঢুকাইয়া দেছ! যাজ্ঞা, আমি উচিত কথা কইছি, তারপরও মায় আমারে বকলো। এই ভাইব্যা তো আমার খুব মন খারাপ হইয়া গেছিলো। কিন্ত মায় যহন পলি দাদীরে উচিত কথা কইছে, তহন গিয়া মনখান ভালো হইয়া গেছিলো। মনডা চাইছিল মায় যদি পলি দাদীরে আরও চাইরখান কথা হুনায় দিতো, তাইলে কলিজাখান ঠান্ডা হইয়া যাইতো।’
‘কি এমন কইছে তোর মায়, যার লাইগ্যা তুই বকা হুইন্যাও খুশি হইছোস?’
‘কইছে গ্রামের হগল মহিলা, মাইয়ারা তোর যেইটা হইছে সেইডা লইয়া গাঙে নামলে পানির কিচ্ছু হয় না, আর তুই নামছোস দেইখ্যা পানি নাপাক হইয়া যায় কেমনে? মায় এই কথাখান জিগানোর পর,পলি দাদী আর একটা কথাও কয় নাইকা। দুমদুমাইয়া পালায় গেছে। তুই যদি তহন পলি দাদীর মুখখান দেখতি তাইলে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাইতি। আমি মার ভয়ে হাতে চিমটি কাইট্টা বহুত কষ্টে হাসি থামাইয়া রাখছিলাম কোনমতে।’
‘সবই ঠিক আছে। কিন্তু তুই কিন্তু একটা জিনিস ভুল করছোস রে নয়না।’
নয়না ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ভুল রে?’
‘পলি দাদীর লগে বেয়াদবি করাডা ঠিক হয় নাই। বড়ো মানুষের লগে খারাপ ব্যবহার করা জঘন্যতম অপরাধ। এতে পাপ লাগে। মানুষ খারাপ কয়। বড়োরা যদি ছোডোগো দ্বারা আঘাত পায়, তাইলে অভিশাপ দিয়া দেয়। তাগো অভিশাপ লাইগ্যাও যায় জলদি। সমবয়সী হইলে সেইডা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু বড়ো মানুষের লগে বেয়াদবি করাডা খুবই খারাপ একখান কাজ। ভদ্র পোলা মাইয়ারা এই কাজ কহনোই করব না। আমি জানি যে তুই আমারে অনেক ভালবাসোস। আমারে কেউ কিছু কইলে আমার থেইক্যাও তোর বেশি মনে লাগে। কিন্তু তার লাইগ্যা মুরুব্বিগো সাথে ঝগড়া করতে হইবো না। তুই আমারে আইজকে ছুঁইয়া প্রতিজ্ঞা কর যে, তুই আর জীবনেও বড়ো মানুষের লগে বেয়াদবি করবি না। আমারে যে যাই কোক, তুই বড়ো মানুষের লগে আমার হইয়া ঝগড়া করবি না। কর প্রতিজ্ঞা।’
‘আইচ্ছা তোরে ছুৃঁইয়া কইলাম। আমি আর বড়ো মানুষের লগে বেয়াদবি করুম না। তাগো লগে ঝগড়া, তর্ক কোনটাই করুম না। কিন্তু তারা যদি অন্যায় করে তাইলে?’
নয়নার প্রশ্নের পৃষ্ঠে মিতু বলল, ‘তোর মায় আছে, আমার বাজান আর মায় আছে। তাগোরে বিচার দিয়া দিমুনে। আমরা প্রতিবাদ করতে গেলে সেইডা খারাপ হইয়া যাইবো। আর আমাগো বাপ-মায় গুছাইয়া কইতে পারবো একটা কথা। আমরা কিছু কইলেই হেইডা বেয়াদবি হইয়া যাইবো। হেই জন্য আমরা কিছুই কমু না কাউরে। মনে থাকবো তো?’
‘তুই কবি আর আমার মনে থাকবো না, হেইডা কেমনে হয়? আইচ্ছা, আমি আর কোনদিনও বড়ো মানুষের মুহে মুহে তর্ক করুম না।’
মিতু একগাল হাসিসমেত বলল,
‘এইতো গুড গার্ল। আইজ কিন্তু আমরা বৃষ্টিতে গোসল করমু। মনে হইতাছে ঝাঁইপ্যা বৃষ্টি নামবো।’
‘তোরে কে কইছে বৃষ্টি নামবো?’ নয়না জিজ্ঞেস করল।
‘দেখোস না চারপাশে শীতল পরিবেশ। রোইদের চিহ্নমাত্র নাই। এর থেইক্যা বুঝতাছি আইজ বৃষ্টি নামতে পারে। আবহাওয়াই কইতাছে।’
‘তাইলে বৃষ্টিতেই গোসল করমু আইজ আমরা।’ কথার মাঝে নয়নার চোখ গেল সামনের দিকে। কাব্য তার বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। কাব্যকে দেখামাত্র নয়না মিতুর বাহু ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, ‘ওই দেখ মিতু তোর কাব্য ভাই আমাগো এইদিকেই আইতাছে।’
কথাটা শুনে মিতু চরমভাবে চমকে উঠল। চকিত কন্ঠে বলল,’কি, কাব্য ভাই! চল লুকাই।’
বলে নয়নাকে নিয়ে বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে গেল। নয়না মিতুর এরূপ কান্ডে হতভম্ব না হয়ে উপায় পেলনা।
নয়না বলল, ‘তুই কাব্য ভাই কইতে খুন, আর তারে দেইখ্যাই লুখাইলি! ব্যাপারখান কি কতো মিতু?’
‘হেয় আমাগো দ্যাহে নাইতো নয়না?’
‘না দ্যাহে নাই। তার আগেই তো তুই আমারে টাইন্যা নিয়া এইদিকে লুকাইয়া পরলি। কি হইছে কবি আমারে? কাব্য ভাইর লগে ঝগড়া করছোস নাকি?’
‘আরে না, ঝগড়া করুম ক্যান?’
‘তাইলে রাগ করছোস?’
‘হেইডাও না।’
‘তাইলে কি হইছে? কইলে ক নাইলে আমি যাইতাছি বাইত্তে।’
মিতু দাঁত কিরমির করে বলল, ‘খাড়া না মাইয়া। কইতাছি তো। কাইল বাজান আমারে অনেক বকছে। কইছে কাব্য ভাইর লগে যেন আমি না চলি। কাব্য ভাইরে তো বাজান দুই চোক্ষের এক চোক্ষেও দেখতে পারেনা। তার লাইগ্যা কয়দিন কাব্য ভাইয়ের লগে দেখা করুম না। বিকালে আর গাঙ কূলে যামু না কয়দিন।’
‘তুই না যাইয়া থাকতে পারবি তো? একদিন তোর কাব্য ভাইরে না দেখলে তোর দুনিয়াডাই লাগে আন্ধার হইয়া আহে। হের পরের দিন তুই আমারে জ্বালাইয়া মারোস এইডা হেইডা কইয়া। মনমরা হইয়া থাকোস। আমার হেইডা ভালো লাগে না দেখতে। তার থেইক্যা তুই বিকালে দশ মিনিটের লাইগ্যা হইলেও গাঙে যাবি। তোর মনও ভালো থাকবো তাইলে। আমি তো তোরে চিনি। তার লাইগ্যাই কইতাছি।’
‘তুই কথাখান ঠিক কইছোস রে নয়না। কিন্তু কয়দিন আমারে যেমন কইরাই হোক গাঙ কূলে যাওয়া থেইক্যা বিরত থাকতে হইবো। নাইলে বাজান আমারে মাইরা কিছু রাখবো না। মাইরের লাইগ্যা না, আসল কথা হইল বাজান যদি আমার লগে কাব্য ভাইরে দেইখ্যা ফেলায়, তাইলে আমারে আর ঘর থেইক্যা বাইরাইতে দিবো না। ইশকুলেও যাইতে দিব না৷ একবারে ঘরবন্দী কইরা রাখবো। তার লাইগ্যাই আমি এই সিদ্ধান্তখান নিছি। কয়দিনে বাজান কাব্য ভাইর বিষয়ডা ভুইল্যা যাক, তারপর আবার যামু গাঙ কূলে।’
‘তুই পারবি তো তোর কাব্য ভাইরে না দেইখ্যা থাকতে?’
‘না পারলেও পারতে হইবো আমারে। কয়দিন কষ্ট করলে বাকী দিনগুলা ভালো যাইবো। ঝামেলা হইবো না। খালি আমার কাব্য ভাই বুঝলে হয়।’
চলবে ইনশাআল্লাহ….