গোধূলিলগ্ন ৩৮

0
265

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৩৮

পরদিন মিতুর গন্তব্যস্থল ফাইভ-স্টার হোটেল। মিতুর মুখে কৃত্রিম প্রসাধনী, পরনে লম্বা কুর্তি, চোখে গোগাল, চুল স্ট্রেইট করে বুকের দুপাশ দিয়ে মেলে রাখা। নাবিলা বেশ সময় নিয়ে মিতুকে সাজিয়ে তুলেছে। সাজানোর সময় নাবিলার বিরক্তি ছিল শেষ প্রান্তে। মিতু আঁড় নজরে চারিদিকে চোখ বুলাচ্ছে। তার কপালে কৌতূহলের গভীর ভাজ স্পষ্ট প্রতীয়মান। নাবিলা ওয়েটারের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত। খাবারের অর্ডার শেষ হলে নাবিলা মিতুর মুখের ভাষা বোঝার প্রয়াস করে। বুঝে উঠে প্রশ্ন ছুড়ে, ‘ভাবছো কোথায় এলাম?’
মিতু একটানে গোগাল খুলে বিকৃত মুখশ্রীতে বলল, ‘যাই দেহি কালা,কালা লাগে। এডি মাইনষে চোখে লাগায় থাহে কেমনে? চশমাডার লাইগ্যা ভালো কইরা কিছু দেহাও যায়না। নিজেরে অন্ধ অন্ধ লাগে।’
নাবিলার রাগ চড়া কন্ঠ, ‘একটা চড় দেব পাবলিক প্লেসে আমার মান-সম্মানের বারোটা বাজালে!’
‘আমি আবার কি করলাম আপনারে?’
মিতুর প্রশ্ন নাবিলার রাগ সীমাহীন ক্রোধে পরিণত করলেও সে তা চেপে নিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘কি করোনি? আমি বলেছি, বসার সময় এক পায়ের উপর আরেক পা রেখে নম্র হয়ে বসতে। সেটা তো করছোই না সাথে পাবলিক প্লেসে অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলছো! এতে করে নিজেকে জোকার বানাচ্ছো সাথে আমিও জোকারের সঙ্গী হচ্ছি। তোমার জন্য আমি কেন নিজের প্রেস্টিজ খোয়াবো? এটা ফাইভ-স্টার হোটেল, এখানে তোমার মতো গেঁয়োরা মেথরগিরি করারও যোগ্যতা রাখে না।’
মিতুর বিস্ময়পূর্ণ চাউনি। এদিক-সেদিক তাকিয়ে সে বলে, ‘ফাইভ-স্টার মানে পাঁচ-তারকা না? এইডা পাঁচ-তারকা হোটেল তাইলে। তয়, মানুষ এই জায়গায় পাঁচ রকমের তারা না দেইখ্যা খাইতাছে ক্যান আপা?’
নাবিলা কপাল চাপড়ায়। নাকিসুরযুক্ত কন্ঠে অস্পষ্ট উচ্চারণে বলে,
‘কিভাবে যে বিশিষ্ট ফ্যাশন ডিজাইনার বাদশা শেখের মাথায় এর মতো আনকালচারড মেয়েকে মডেল বানানোর ভূত চাপলো? আমি পাগল হয়ে যাব।’
মিতু উৎকন্ঠিত হয়ে বলল, ‘পাগল হইবেন ক্যান আপা?’
‘প্লিজ, আমাকে ম্যাম বলে ডাকো। আর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো। আমি আর পারছি না তোমাকে নিয়ে।’ নাবিলার নাক ফ্যাং-ফ্যাং করে বলা কথায় মিতু খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল। পরক্ষণেই নাবিলার রোষাবিষ্ট মুখটি দেখে হাসি থামিয়ে বলল, ‘ওকে ম্যাম, আমি সুন্দর করে কথা বলমু এখন থেকে।’
‘বলমু?’ নাবিলার চোখ সংকুচিত হয়।
মিতু জিভে কামড় বসিয়ে মাথা দুদিকে নেড়ে বলে, ‘না,না বলবো হবে।’
_____
‘তোশকের তলে যে রাত্রি আপার নাম্বারখান ছিল, সেইডা দেহি না ক্যান?’
বাড়িতে পা পড়তেই সেতুর গম্ভীরকন্ঠে বলা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো নাহিদকে। নাহিদ সেতুর পাশ কেটে কাপড় রাখার তাক থেকে লুঙ্গি হাতে নিল। সেতু এবার তির্যক ভঙ্গিতে বলে ওঠে, ‘কি কইতাছি কানে যায়না? নাকি না হুনার ভান ধরেন?’
নাহিদের সোজা বাক্য, ‘হুম ভান ধরি। কি করবি?’
‘নাম্বারখান দেন কইতাছি!’
নাহিদ আশ্চর্যের বাঁধ ভেঙে বলল, ‘দেব না। যা করার করতে পারিস।’
‘ভালো হইব না কিন্তু!’
‘খারাপই হোক।’
‘আমারে তালাক দেন, আমি আপনার লগে আর এক ছাদের তলায় থাকতে চাইনা। ঢাকায় যাইয়া রাত্রি আপার সাহায্য নিয়া আমার মায়া আর মিতুরে খুঁইজ্যা বাইর করমু।’
নাহিদ ভ্রুযুগল কুচকে প্রশ্ন ছুড়ে, ‘কি বললি?’
সেতুর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, ‘আপনার লগে থাকতে চাইনা। দম বন্ধ লাগে আমার।’
নাহিদ চড় বসাতে সময় নেয়না সেতুর গালে। সঙ্গে সঙ্গে সেতু দুহাত বাড়িয়ে নাহিদের পাঞ্জাবি খামচে ধরে বেশ শক্তপোক্ত ভাবে। নাহিদ হতবুদ্ধিভাব নিয়ে চেয়ে থাকল সেতুর লেলিহান শিখার ন্যায় দৃষ্টিপানে। সংসার জীবনে এই প্রথম সেতু এমন এক দুঃসাহসিক কান্ড দেখিয়েছে। নাহিদ সেতুর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা না চালিয়ে সরু দৃষ্টি মেলে চেয়ে থেকে সেতুর কথা শুনল। সেতু বলছে, ‘আমারে আইজ জীবনের মতো শেষ কইরা ফালান। মাইরা ফেলান আমারে। খুন করেন যেমনে ইচ্ছা। পরাণখান বাইরাইলেই বাঁচি আমি। মারেন আমারে, খাড়ায় আছেন ক্যান? আমি আমার শেষ নিশ্বাস আপনার হাতে তুইল্যা দিলাম, মারেন আমারে!’
পাঞ্জাবির দু-তিনটে বোতাম ছিটকে পড়তেই নাহিদের সম্বিৎ ফেরে। সে এবার জোর খাটিয়ে সেতুকে নিজের থেকে আলাদা করে ছিটকে ফেলে দিল। ক্ষুব্ধ চোখে বলল,
‘আর বাড়িতেই আসব না কখনো। তোর ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যানানি আর নিতে পারি না অসহ্য! দুনিয়ায় আর কারো বউ নেই, আমার কপালেই জুটেছে এমন বিদ্রোহী বউ।’
নাহিদ রুষ্টভাবাপন্ন মনে প্রস্থান করল সেখান থেকে। সেতু মেঝেতে গা-ঘেঁষে পড়ে রইল উবু হয়ে। তার সর্বস্ব কাঁপিয়ে কান্নার ফোয়ারা নামতে থাকল দলবেঁধে।
_____
বিভিন্ন রকম খাবারের সমন্বয়ে টেবিল ভর্তি। কোথাও আঙুল রাখার ফাঁক অবধি নেই। এতসব খাবার দেখেও কোনরূপ আগ্রহ জন্মালো না মিতুর মনে। বরং অনীহা নিয়ে সে বলল, ‘এইগুলা আমি খামু না।’ কথা মাটিতে পড়ার আগেই আবার বলে ওঠে, ‘এগুলো খাব না আমি।’
নাবিলা চোখ ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাসে বিরক্তি প্রকাশ করে। কঠোরভাবে বলে, ‘খেতে হবে; এবং আমি যেভাবে বলবো সেভাবে।’
‘আমি খাইনি কখনো এসব।’
‘খাওনি তো কি? এখন থেকে খাবে। এইযে কাটা চামচ আর ছুরি দেখছো আমার হাতে, এগুলো দিয়ে আমরা প্রত্যেকটা খাবার আইটেম টেস্ট করবো। তুমিও হাতে নাও আর আমার মতো খাবার চেষ্টা করো।’
মিতু ইতস্ততবিক্ষিপ্ত মনে নাবিলার দেখাদেখি বাঁ হাতে ছুরি এবং ডান হাতে কাটা চামচ তুলল। নাবিলাকে অনুসরণ করে পেস্ট্রিতে ছুরি বসিয়ে কাটা চামচ দ্বারা পেস্ট্রির কাটা অংশটা মুখের কাছে ধরল। সাথে সাথে নাবিলা বলে উঠল, ‘কম করে মুখে নিয়ে আস্তে আস্তে নাড়বে। আমি খেয়ে দেখাচ্ছি তারপর তুমি খেও।’
মিতু মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। নাবিলা পেস্ট্রি মুখে নিয়ে খেয়ে দেখালে মিতুও সেভাবেই খেল। মিতুর ছোট বেলা থেকে অনুসরণ করে কাজ করার একটি বিশেষ গুণ রয়েছে। যার প্রভাবে মাত্র তিন মাসেই সে দর্জির কাজ শিখে ফেলেছিল। সে কেবল অনুসরণ করতে পারে তা কিন্তু নয়। অনুসরণের পাশাপাশি নিখুঁতভাবে নকল করাটাও অনায়াসে নিজ আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারে যদি মনস্থির করে কোন কাজে হাত দেয় তবে। নাবিলার ঠোঁটে সন্তুষ্টির হাসি বিস্তার লাভ করছে। তুষ্ট মনে সে মিতুর উদ্দেশ্যে বলল, ‘আই অ্যাম স্যাটিসফাইড! তবে যা যা শেখাচ্ছি, এগুলো কিন্তু সবসময়ই মেনে চলার চেষ্টা করবে। তাহলে অভ্যাসে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না। বুঝলে?’
মিতু হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ে। এরপর বলে,
‘কিন্তু হাত দিয়া খাওনের মজাই আলাদা।’ এতটা বলে একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের পিস হাতে নিয়ে সামনের দিকে ঝুকে নাবিলার মুখে ঠেসে ধরল। বিস্ময়ে হতবাক নাবিলার কান গরম হলো মুহুর্তেই। তিনি মুখের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই থু মেরে ফেলে গলায় সমস্ত জোর ফেলে ‘মিতু!’ বলে চিৎকার করে উঠল। মিতু কানে হাত ঠেসে টেবিলের নিচে ঢুকে গেল। আশেপাশের লোকজন তাদের বিস্ময়াহত চোখজোড়া নাবিলাকে মূখ্যমণি বানিয়ে রেখেছে। নাবিলা সেসব তোয়াক্কা না করে দ্রুত পদক্ষেপে সেখান থেকে বেরিয়ে আসল। মিতু ‘ম্যাম, ম্যাম’ বলে ডাক ছেড়ে নাবিলার পিছু ছুটল।
____
দেখতে দেখতে তেরোটা দিন সময়ের ধাক্কায় অতিবাহিত হয়ে গেল। এই কয়দিন কাব্য এমন কোন উপায় খাটানো বাদ রাখেনি মিতু ও মায়াকে খোঁজার। প্রতিনিয়ত দাবানলে জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে তার ভগ্নহৃদয়। বেশ কয়দিন ঠিক করে কথা বলেনা কারো সাথে। তৌসিফ, শিখা, রাত্রি এবং সাজিদের অতিরিক্ত প্রশ্ন কাব্যকে আরও অধৈর্য করে তোলে। ফলে তাদের সবসময় এড়িয়ে চলে কাব্য। অফিসে কাজ চলাকালীন রাত্রি তার ক্যাবিনের দরজায় নক করলে কাব্য প্রথমেই ঢুকতে নিষেধ করে দেয়। রাত্রি বেশ কয়েকবার অনুরোধ করার পর বাধ্য হয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করল। রাত্রি চেয়ারে বসার প্রস্তুতি নিলে কাব্য বলল,
‘কাজের কথা ছেড়ে অন্য প্রসঙ্গে কথা না বললেই খুশি হবো। আমার বিরক্তি লাগে খুব।’
রাত্রি বলল, ‘স্যার আমি অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে আসিনি। জানি আপনি অন্য বিষয়ে কথা বললে বিরক্ত হন, এইজন্যই এখন আর বলিনা। আমি এসেছি অন্য কারণে, তবে কাজ রিলেটেড নয়।’
‘তাহলে?’ উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল কাব্য।’
রাত্রি কিছু সময় নিতিবিতি করে বলল,
‘আমার আগামীকাল ছুটি লাগতো। তবে বিকেলের দিকে। আপনি যদি ছুটি মঞ্জুর করতে সাহায্য করেন, তাহলে বড়োই উপকার হয়।’
‘হঠাৎ কিসের ছুটি?’
‘আসলে আগামীকাল বিশাল বড়ো একটা ফ্যাশন-শো আছে। আমি তেমন একটা যাইনা। তবে শুনেছি এবার নাকি গ্রাম্য প্রেক্ষাপটে শো-টা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এইজন্যই মূলত দেখার ইচ্ছে প্রবল। যদি ছুটি দিতেন!’
রাত্রির আকুতি কাব্যকে রাগিয়ে তুলল,
‘কাজের থেকে এসব দেখা কি বেশি জরুরি, রাত্রি?’
রাত্রির মুখ ভার হলো। মাথা নুইয়ে বলল,
‘মাফ করবেন স্যার। ভুল হয়েছে। আসি।’
রাত্রি দরজায় গিয়ে নব ঘোরাতেই কাব্য বলল,
‘ঠিক আছে যান। তবে সকালের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে পারলে তবেই। কাজ নিয়ে কোন কম্প্রোমাইজ আমি পছন্দ করি না।’
রাত্রির চওড়া হাসিতে অনাবিল উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। আমি চেষ্টা করবো দুপুরের মধ্যে সমস্ত কাজ শেষ করার।’
রাত্রির কৃতজ্ঞতা স্বীকারোক্তির পিঠে কাব্য রা-শব্দ করল না। নিজের কাজে মন দিল প্রবল আগ্রহে।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
বিঃদ্রঃ বেশি পর্ব নেই আর উপন্যাসের৷ সবাই ধৈর্য নিয়ে পড়ুন এটাই চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here