গোধূলিলগ্ন ২৩

0
355

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ২৩

গতকাল কাজ শেষে আর বাড়ি ফেরা হয়নি কাব্যর। ইচ্ছে করেই ফেরেনি। মোবাইল ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছিল। চিন্তায় উদ্বিগ্ন কাব্যর বাবা-মা। সকাল আটটা নাগাদ কলিং বেল বেজে ওঠে। হন্ন হয়ে ছুটে যান রেখা। সদর দরজা খুলতেই কাব্যর ক্লান্ত মুখটা আবিষ্কার করলেন চোখের সামনে। দেখে মনে হচ্ছে সারারাত নির্ঘুম কেটেছে। হয়তো কেঁদেছেও। রেখা স্বর ভাঙা গলায় শুধায়, ‘কোথায় ছিলি বাবা? এমন তো কখনো করিসনি। আমরা কত আয়োজন করলাম তোর জন্মদিন উপলক্ষে, কিন্তু তুই কোথায় চলে গেলি! মাকে কষ্ট দিয়ে সুখ পাস তুই?’

কাব্য রেখার পাশ কেটে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘কিসের জন্মদিনের আয়োজন? আমার জীবনে কোন উৎসব নেই। যা আছে, সবই ঘুটঘুটে আঁধারে নিমজ্জিত দুফোঁটা চোখের পানি।’

রেখা পেছন পেছন কাব্যর রুম অবধি যায়। বিচলিত স্বরে বলে, ‘সারারাত কেঁদেছিস তাইনা? কাঁদলেই কি সব ঠিক হয়ে যায়? ছেলেরা কাঁদে নাকি?’

‘চোখ যে কথা শোনে না, মা। ছেলেরা কি মানুষ না? তাদের কি রক্ত,মাংস নেই? তারা কি পাথরের তৈরি?’

রেখা কিছুক্ষণ মৌনতা ধরে রেখে বলল, ‘তা অবশ্য না, তবে পেছনের অতীতকে আঁকড়ে ধরে বর্তমানকে পানসে করা বোকামি ছাড়া আর কি!’

কাব্য হাসল। সাথে বলল, ‘অতীত অন্যরকম হতো যদি না তুমি আর আব্বু মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আমাকে দিনের পর ঠকাতে। তোমরা দায়ী আজকের এই দিনের জন্য।’

‘সত্যি বললে মিতুকে পেতি?’

‘অন্তত পক্ষে সাজানো দিনগুলো গড়ে উঠতো না, যা গত সাত বছর ধরে বুনে এসেছি। আর বাকী এক বছর ধরে পুড়ে চলেছি। আগে জানলে স্বপ্ন দেখতাম না। তিল তিল করে গড়া স্বপ্নগুলো যখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, তখন মানুষ আর নিজেকে সহজভাবে খুঁজে পায়না। আর সেই স্বসপ্নগুলো যদি হয় অহেতুক, তাহলে সেই আফসোস কোথায় রাখা হয় জানো কি মা? জানলে বলো আমায়। আমি যদি আগে থেকেই জানতাম, মিতুবুড়ি আর আমার নেই। হবার আশা নেই, তাহলে সাত সাতটা বছর স্বপ্নের আশায় বসে থাকতাম না মিতুর পথ চেয়ে।’

‘তাহলে কি করতিস তুই? যদি মিথ্যে না বলে সত্যি বলতাম, তাহলে তুই কি করতি? মিতুকে পেতি?’

‘তা পেতাম না। তবে হারিয়ে যেতাম।’ কাব্যর সোজা স্বীকারোক্তি।

‘বাহ! হারিয়ে গেলে সব মিটমাট হতো? আজ সাংবাদিক তকমাটা গায়ে লাগতো? কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না। ভুলে যা বাবা।’

‘আমার শেষ নিশ্বাসটাও মিতুর জন্য কাঁদবে। আমার রুহু কেঁপে উঠে ওকে হারানোর যন্ত্রণায়৷ জানো মা, আমার জীবনে সেরা খলনায়ক আব্বু আর সেরা খলনায়িকা হচ্ছো তুমি। আমাকে এভাবে জ্যান্ত খুন না করলেও পারতে। রাত যখন গভীর হয়, তখন আমার নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় মা। এর থেকে হৃদযন্ত্রটা অকেজো হয়ে গেলেই পারে। আমার দেহের প্রতিটি অংশ যদি অচল হয়ে যেত, তাহলে বুঝতাম ভালবেসে শ্রেষ্ঠ উপহারটা পেয়ে গিয়েছি। আরেকটা কথা বলি মা! আমার ঘুম অসহ্য লাগে। এমন একটা ঘুম নেই, যেই ঘুমে মিতুবুড়ির দেখা না মেলে৷ আমার জেগে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। চোখ ঝাপসা হয় একটু একা নির্জন সময় কাটালেই।’

রেখার হাত-পা কাঁপছে। আদুরে ছেলের কষ্টগুলো যদি তার কাঁধে এসে পড়তো, তাহলে সে হাসিমুখে তা সাদরে গ্রহণ করে নিত। তবে তা হবার নয়৷ তিনি গলায় আটকে থাকা কথাগুলো জোরপূর্বক বাহিরে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। চুপ থেকেই ছেলের ভেজা চোখ দেখে গেলেন। রেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে কাব্য আবার বলল,
‘হয়তো তোমরা সেদিন দায়িত্বশীল বাবা-মায়ের কর্তব্য পালন করেছিলে৷ কিন্তু সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাকেই কোরবানি দিয়ে দিলে! আমার শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে অদৃশ্য আগুনে। আমি শান্তি চাই। মনের শান্তি। দিতে পারবে? আমার শান্তি দুটো জিনিসে৷ হয় মৃত্যু নয় মিতুবুড়ি।’ বলতে বলতে কাব্য ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। দুহাতে জোরে চুল টেনে কাঁদতে থাকে অঝোরে। রেখা কাব্যর ভয়ানক কান্না বেশিক্ষণ দেখার সাহস পেলেন না। তাই না চাইতেও সে কাব্যর রুম ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।

কাব্য ফ্লোরে হাত ঠেসে ধরে। খামচে ধরার চেষ্টা করে। সহসাই কিছু দৃশ্য স্মৃতিচারণ হয়ে ভেসে ওঠে চোখের কার্ণিশে।

‘কাব্য ভাই, তুমি আইজ এত তাড়াতাড়ি আইলা যে? অন্যদিন তো এত তাড়াতাড়ি আহো না।’

কাব্যর হাতে একটা টিফিনবাক্স। সে মিতুর পাশ ঘেঁষে সবুজ ঘাসের উপর বসে৷ হাসিমুখে বলে, ‘গতকাল আমার জন্মদিনে তুই আসলি না কেন? তোকে আর নয়নাকে না দাওয়াত দিয়েছিলাম!’

মিতুর চোখ ছোট হয়ে আসল। কন্ঠ নিচুস্তরে ফেলে বলল,
‘বাজানে মারছিল কাইল। আইতে দেয় নাই আমারে। রাইতে কান্তে কান্তে ঘুমায় পড়ছিলাম হের পরে।’

কাব্যর মুখে মলিনতা। উপচে পড়া হতাশা। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘যাজ্ঞে সেসব কথা। তোর ভাই, নয়না আর তোর জন্য মা কেক,পায়েস, মিষ্টি আর কি কি যেন দিয়েছে। ওদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খেয়ে নিস কেমন?’

মিতু অস্ফুটে বলল, ‘আইচ্ছা।’

কাব্যর কেমন একটা খটকা লাগে মিতুর চাহনি দেখে। ফলে ভাবান্তর ঘটে মস্তিষ্ক জুড়ে। সে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি নিয়ে মিতুর উদ্দেশ্যে বলে,
‘মনে দ্বিধাবোধ রাখবি না কখনো। অন্তত আমার সামনে। আমি তোর সমস্যার সমাধান হতে চাই সবসময়। কিছু হয়ে থাকলে বলে ফেল।’

মিতু পলাশ ফুল ছিড়ে এনেছে কাব্যকে দেবে বলে। কিন্তু দেবে কি দেবে না এই ভেবে না/হ্যাঁ এর মধ্যে বিশাল এক দ্বন্দ্ব হচ্ছিল। দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ফুল কাব্যর দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘তোমার লাইগ্যা ফুল আনছি। গতকাইল কইছিলা দেইখ্যা জানতে পারছিলাম তোমার জন্মদিনের ব্যাপারখান। তারপর তো আর দেহা হয় নাই। তার লাইগ্যা দিতেও পারি নাই।’

মিতু কথা শেষ করে কাব্যর মুখপানে চায়। কাব্য পলকহীন তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে বিস্তর হাসি। চোখও হাস্যজ্বল। মিতু অকপটে জিজ্ঞেস করল,
‘এমনে চাইয়া আছো ক্যান কাব্য ভাই? জন্মদিন কাইল চইল্যা গেছে আর আইজ উপহার দিছি দেইখ্যা?’

‘তা না, আমি তো আমার মিতুবুড়িকে দেখছি। বড়ো হচ্ছিস দিন দিন।’

‘ছোডো থাকলে ভালো লাগে আমারে?’

‘তোকে আমার সব ভাবেই ভালো লাগে। আচ্ছা আমার ফুল দে।’ কাব্য মিতুর হাত থেকে ফুল নিয়ে তাতে নাক ডুবিয়ে লম্বা করে টান দেয়। বলে, ‘আজ থেকে আমার প্রিয়ফুল, পলাশফুল। আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ উপহার। কিন্তু তুই ফুল আনতে গাছে উঠিসনি তো আবার!’

কাব্য চোখ পাকাতেই মিতুর দৃষ্টি এলোমেলো হলো। আমতাআমতা করে বলল, ‘আইজই শেষবারের মতো উঠছি, আর জীবনেও উঠতাম না।’

‘কতবার বলবো গাছে উঠবি না! কথা শুনিসনা কেন? হাত-পা ভাঙ্গলে কি অবস্থা হবে ভেবেছিস কখনো?’

‘আর উঠমু না কইছি তো। উঠলে আমারে মাইর দিও।’

‘তার মানে তুই আবারও উঠতে চাচ্ছিস?’ কাব্যর কন্ঠ কঠিন।

‘আমি কি সেইডা বুঝাইলাম? ধুর, তুমি খালি এমন করো ক্যান? আইচ্ছা আর জীবনেও উঠমু না গাছে।’

কাব্য হেসে বলল, ‘এবারের মতো ছাড় দিলাম।’
এই বলে পলাশফুলের আগা দিয়ে ভেজা মাটিতে কাব্য+মিতু লিখে সেটাকে লাভের ভেতর আটকে দিল। এরপর বলল, ‘এই দেখ মিতুবুড়ি, তোকে আর আমাকে লাভের মধ্যে বন্দী করে দিলাম। এখানে শুধু তুই আর আমি বসবাস করবো। আমাদের রাজত্ব এখানে, আর কারো না।’

মিতু চোখ কুঁচকে বলল, ‘আর নয়না কই? ওর নাম দেওনাই ক্যান?’

কাব্য মুখ হা করে চাইল। তারপর বলল, ‘এখানে ওর কাজ নেই। যখন আমরা লাভের ভেতর থাকবো, তখন আমাদের মাঝে কেউ থাকবে না। কিন্তু যখন বের হবো, তখন সবাই থাকবে। এই জায়গাটা শুধু তোর আর আমার জন্য। বুঝলি?’

মিতু অস্ফুটে বলল, ‘হুঁ।’……….

বর্তমানে,
অতীত ঘাটতে ঘাটতে ক্লান্ত চোখজোড়ায় ঘুম জেঁকে বসে। এরপর মেঝেতেই শরীর ছেড়ে ঘুমিয়ে গেল কাব্য।
চলবে ইনশাআল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here