উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ২২
‘চোর,চোর,চোর। সেগুন গাছের গোড়। সেগুন গাছ ভাইঙ্গা গেলে, চোর দিল দৌঁড়।’
মায়া উঠোন জুড়ে দৌঁড়াচ্ছে আর বাক্যগুলো ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা আওড়ে যাচ্ছে। রৌদ্রজ্বল দিন। উত্তপ্ত মাটি। খাঁ খাঁ প্রকৃতি। মধ্যাহ্নের সময়টা ধরণী চুইয়ে ভ্যাপসা গরমের মিছিল নামে। এমন একটা পরিস্থিতিতে অনায়াসে এক জায়গা অন্য জায়গায় নিরন্তর দৌঁড়ে চলেছে মায়া। মিতু দেখামাত্রই ডাক ছাড়ল,
‘মায়া! রোইদের মইধ্যে দৌঁড়াদৌঁড়ি করিস না মা।ছায়ায় গিয়া খেল। মায় একটু পুকুর পাড় হইয়া আহি, তারপর খাইতে দিমু তোরে।’
মায়া এক ছুটে মিতুর কাছে চলে গেল। প্রচন্ড ঘেমে যাওয়ায় হাত-মুখ তৈলাক্ত হয়ে ঝলমল করছে। মায়া মিতুর কোমড় জড়িয়ে বলল, ‘আমিও যাই মা?’
মিতু কাখের কলছি মাটিতে রেখে মেয়ের কপালে দলা হয়ে থাকা চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল,
‘কি করতাছিলি ক তো! এই ঠাডা পড়া দুপুরে কেউ দৌঁড়ায় এমনে?’
‘আমি তো খেলতাছিলাম মা। আমার লগে মণি ছাড়া কেউ তো খেলেনা। মণির বাপ-মায় ওরে আমার লগে এহন আর মিশতে দেয়না। সবাই আমারে দেখলে কয়, আমার বাপ নাকি জুয়া খোর। তার লাইগ্যা নাকি আমার লগে খেলোন যাইতো না। সবাই আমারে এইগুলা কয় ক্যান মা? জুয়াখোর মানে কি?’
মিতুর মুখে নিমিষেই নিকষকালো অন্ধকার নেমে এলো। মেয়ের প্রশ্নের পৃষ্ঠে কি বলবে ভেবে না পেয়ে উত্তর খুঁজে বেড়ায়। মায়া কিঞ্চিৎ ধাক্কা দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে,
‘ও মা, কও না ক্যান? আমার লগে কেউ মিশতে চায়না। কাইল থেইক্যা আমি আর ইশকুলে যামু না। কেউ আমার লগে বইতে চায়না। ইশকুলের সবাই আমারে কালা ভূত কয়। আমার লগে বইলে নাকি ওরাও কালা হইয়া যাইবো। ওমা আমি কালা ক্যান? তোমার লাগান বানাও নাই ক্যান আমারে?’
মিতু তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বলল,
‘ইশকুলে যাবি না ক্যান? ইশকুল কি করছে?’
‘সবাই খালি আমারে চ্যাতায়। জুয়াইট্টার মাইয়া কয়, কালা পাতিল ডাকে, কালা কাউয়া ডাকে। আমার হুনতে মন চায়না হেইগুলা।’
কথাগুলো বলার সময় মায়ার ঠোঁট উল্টে আসছিল।
মিতু মায়াকে বুকের সাথে চেপে ধরে। চোখ মিতুরও ভিজে আসল। মায়া মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে, ‘মা, বাজান আমারে দেখলে যে ঝারি দেয়,তারপর মাঝে মাঝে মারেও। আমি তো দেহি মণির বাজান ওরে কত আদর করে। মেলায় নিয়া যায়। আমার বাজান আদর করেনা ক্যান মা? আমারে মণির বাজানের লাগান একখান বাজান আইন্যা দেও। বাজান পাল্টাপাল্টি কইরা আনো৷ এমন খারাপ বাজান আমার চাইনা। তুমি আমারে নতুন একখান ভালো বাজান আইন্যা দেও। যে আমারে মারবো না। অনেক আদর করবো। তোমার আর বড়ো মার লাগান। আমার এমন খারাপ বাজান লাগবো না। খালি মারে আর ধমকায় আমারে।’
মায়া নিজের মনের কথা বলছে আর মিতু চোখ বুজে শুনে যাচ্ছে। একই কথা বহুবার বলেছে মায়া। প্রতিবার মিতু মৌনতা ধরে এড়িয়ে গিয়েছে। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটছে না। মিতু বির্বাক, নির্লিপ্ত, হতবাক হয়ে চোখের পানি ফেলছে অঝোরে।
হঠাৎ সেতুর উপস্থিতি টের পেয়ে মিতুকে ছেড়ে মায়া সেতুকে জড়িয়ে ধরে। সেতু মিষ্টি করে হেসে বলে, ‘মায়া সোনা কইরে! আমার আম্মুডা কি করতাছে?’
মায়ার তেলতেলে মুখটায় একরাশ হাসি। সে বলল,
‘বড়ো মা তুমি আইছো আমার ধারে? আইজ দুই দুইবার তোমাগো ঘরের বাইরে দাঁড়াইয়া উঁকি দিছিলাম। কিন্তু কাকায় আমারে দেইখ্যা ভাগায় দিছে। তারপর আমি চইল্যা আইছিলাম।’
নাহিদ মায়াকে তাড়িয়ে দিয়েছে, কথাটায় মিতু ও সেতু কারোরই ভাবান্তর ঘটেনি। কারণ এটা রোজকার কাহিনী। নাহিদ মায়াকে দেখলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। মিতুর সামনেও বেশ কয়েকবার এমন করেছিল। যেখানে নিজের বাবা, দাদীই মায়াকে দেখতে পারে না,সেখানে কাকা কি করে পারবে?
সেতু জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা চালিয়ে বলল, ‘আমার মাইয়ার লাইগ্যা আমি পায়েস বানাইয়া আনছি। দেহি খাওয়াই দেই আমার হাত দিয়া।’
মায়া সাদা ফকফকা দাঁত ভাসিয়ে হেসে দিয়ে বলল,
‘দেও বড়ো মা। তোমার পায়েস আমার অনেক মজা লাগে। জলদি দেও।’
সেতুর মন মায়ার মুখের মিষ্টি হাসিটা দেখেই প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। রোজ এই হাসিটা দেখার জন্য কতই না ফন্দি আঁটে সে! প্রতিদিন সুযোগ বের করে সকলের দৃষ্টিগোচরে এভাবেই মায়াকে খাইয়ে দেয়। আর মিতু অপলক তাকিয়ে মায়া ও সেতুর আহ্লাদে ভরা দৃশ্যের সাক্ষী হয়। মাঝে মাঝে মিতু ভুলেই যায় সে মায়ার আসল মা। ভোলারই কথা। কারণ সেতু মায়াকে এতটাই স্নেহ করে যে মিতু ভুলে যেতে বাধ্য হয়।
***
শিমুলতলী গাঁয়ের চেয়ারম্যানের ছেলে বাদশা শেখ দুইদিন হলো গ্রামে পা ফেলেছে। তিনি বউ-বাচ্চা নিয়ে শহরেই স্থানীভাবে বসবাস করেন। ঈদ ব্যতীত খুব একটা গ্রামে আসেন না। তিনি পেশায় একজন নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার। তার ডিজাইন করা পোশাক মডেল নির্বাচন করে বিরাট র্যাম্প-শোয়ের মাধ্যমে হাজারো দর্শকের মধ্যে তুলে ধরা হয়। এবার তার প্রয়োজন গ্রাম্য এলাকার কিছু রূপসী। যাদের সে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। গ্রাম্য প্রেক্ষাপটে তৈরি কিছু কস্টিউমস এর প্রতি ঝোঁক থেকে এই ইচ্ছে। তার অসময়ে গ্রামে আসার মূল কারণ এটাই। কাজ সহজের জন্য শিমুলতুলী গ্রাম বিখ্যাত ঘটক আনিসুল মিয়াকে ডাক পাঠান। বিষয় টা আশ্চর্যজনক হলেও সত্য। মডেল খুঁজতে ঘটককে তলব দেওয়া বোধয় বিচিত্র ধাঁচের এক ইতিহাস!
আনিসুল মিয়ার মাধ্যমে বেশ কয়েকজন মেয়েদের ছবি ইতোমধ্যে সংগ্রহে চলে এসেছে। সেসব মেয়েরা ইচ্ছুক মডেলিং এর জন্য। পরিবার থেকেও সম্মতি এসেছে। খুব দ্রুত ব্যবস্থা হওয়ায় বাদশা অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন আনিসুলের প্রতি। পুরস্কার হিসেবে মোটা অংকের টাকা বখশিশ ছুড়েন আনিসুলের দিকে।
আজ কোন মনে পাখি শিকারের তৃষ্ণা জাগল বাদশার মনে। দুইদিন পর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। একদিকে গ্রামে আসার উদ্দেশ্যটাও হাসিল হয়ে গেছে। ফলে তেমন চাপও নেই। এই ভেবে মনের সুখে বন্ধুক হাতে বেরিয়ে পড়েন। ঘন্টা খানেক সময় ব্যয় করেও পাখি শিকারে ব্যর্থ হন। এরপর হতাশা মনে যখন বাড়ি ফেরার জন্য উদযোগ পাতেন, তখন দূর থেকে কলসি কাখে হেঁটে আসা ধারালো চেহারার এক অপরূপার দিকে চোখ আটকে যায় বাদশার। তার ভাবনা দখল করে মেয়েটি তার দিকেই এগিয়ে আসছিল৷ একটা সময় বাদশার পাশ ঘেঁষে চলেও যায়৷ তখনও বাদশা গভীর ধ্যানমগ্ন৷ মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ জুড়ে মেয়েটির প্রতিচ্ছবি৷ তার বানানো পোশাক শরীরে জড়িয়ে এই অপার সৌন্দর্যের অধিকারিণী হাজার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে। সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে তার নামের জয়জয়কার হয়ে চলেছে চারপাশ জুড়ে। বাদশা আনন্দে আবেগাপ্লুত! সহসাই তার টনক নড়ে। ভাবনার সুতো ছিড়ে সে মেয়েটাকে অনুসরণ করে তার বাড়ি অবধি পৌঁছে। এরপর ফিরে এসে পুনরায় আনিসুল মিয়াকে তলব পাঠান৷ ঘটক আনিসুল মিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, মেয়েটি দেওয়ান বাড়ির বড়ো বউ। নাম মিতু। মিতু বিবাহিত জেনে বাদশার মগজ উল্টায়। সে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে৷ তবে একবার যখন মিতুকে মডেলের আসনে বসিয়ে ফেলেছেনই, তখন সেখান থেকে নামিয়ে ফেলা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায় বাদশার পক্ষে। এছাড়াও যখন জানলেন মিতুর স্বামী সংসার নিয়ে উদাসীন, তখন অন্য কোন দিক না ভেবে আনিসুলকে আদেশ দেন মিতুর নিকট প্রস্তাব পাঠানোর। সাথে বলেন,
‘আনিসুল মিয়া, তুমি যদি ওই মেয়েকে রাজী করাতে পারো, তাহলে আগের বারের চাইতেও এবার দশগুণ বেশি বখশিশ উপহার হিসেবে পাবে৷’
বাদশার চুক্তি হাসিমুখে গ্রহণ করে নিলেন ঘটক আনিসুল মিয়া। তিনি রাত পোহাতেই দেওয়ান বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।
জোর করে নানা কথার ছলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে মায়াকে স্কুলে পাঠাতে সফল হয় মিতু। এরপর কিছু জরুরি কাজ সেড়ে সেলাইমেশিন নিয়ে বসল কি অমনি কর্ণকুহরে আনিসুল মিয়ার কন্ঠ আবিষ্কার করে। আনিসুল বলছেন, ‘কেউ বাসায় আছো নাকি? নুরুল ভাই, ও নুরুল ভাই।’
মিতু বেরিয়ে এসে রাগচটা মেজাজে বলে, ‘হেয় বাইত্তে নাই। রাইতে আইয়েন। আর দেনাপাওনা নিয়া আমারে কিছু কইয়া লাভ নাই, আমি দিতে পারুম না। অনেক দিছি, এহন আর না।’
আনিসুল ছাতা বন্ধ করে হাসল। রসিকতার সুরে বলল, ‘নুরুলের বউ দেখতাছি দিন দিন আগুন সুন্দরী হইতাছে। ওইযে সিনেমায় দেখা যায়, কি যেন নাম? দেখছো কারবার! কাজের সময়ই মনে থাকে না।’
মিতু অসীম রাগে কিড়মিড় করছে। বছর খানেক আগে আনিসুল প্রায়ই মিতুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব আনতো। যেহেতু স্বামী উচ্ছনে গিয়েছে, সেহেতু অনেকেই সুযোগ পেয়েছে মিতুকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার। বেশির ভাগই বিয়ের প্রস্তাব আসতো। তবে মিতু বরাবরই নাকচ করতো সেসব প্রস্তাব। বহুদিন পর আবারও আনিসুলের সেই একই গলার সুর উপলব্ধি করতে পেরে মিতুর সারা শরীরের রক্ত টগবগ করে ওঠে। পাশেই একটা শলার ঝাড়ু অলসভাবে পড়েছিল। উল্কা গতিতে মিতু ঝাড়ুটা মাথায় তুলে নিয়ে বলে, ‘আইজকে ঝাড়ুর বারি একটাও মাটিতে পড়বো না কইরা রাখলাম। জীবনের ভয়ডর থাকলে বাইরাইয়া যান। এহনই বাইরাইয়া যান!’
আনিসুল উশখুশ করে বলল, ‘আরে আরে, নুরুলের বউ খালি চ্যাতে! আমি আজকে বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আসিনাই। অন্য একটা কাজ আছে, মাথাঠাণ্ডা করো।’
‘আমার লগে কি কাজ আপনার?’
‘ভেতরে বসে কথা বলি চলো।’
‘যা কওয়ার এইহানে দাঁড়াইয়াই কন। নাইলে ভাগেন।’
মিতু আজ পান আনতে চুন খসলেই বেধম পিটানি দিতে পারে, এই ভেবে আনিসুল কৌশল খাটিয়ে বলল, ‘তোমার স্বামীর এত এত যে ঋণ জমছে, ওইগুলা শোধ দেওয়ার একটা মোক্ষম উপায় নিয়া আসছি৷ না শুনলে আমার কিছু করার নাই। মানুষের ভালো করলেও ঝাড়ু উঠে, হায় কপাল!’
মিতু দুর্নিবার কৌতুহল নিয়ে শুধায়, ‘কেমন ভালো করবেন আপনি?’
আনিসুল হেসে বলল, ‘তোমার জন্য একটা কাজ আনছি। টাকার উপরে শুয়ে থাকতে পারবা মেয়েটারে নিয়া।’
‘আপনি হেয়ালিপানা না কইরা যা কওয়ার তাড়াতাড়ি কন, আমার মেলা কাজ পইড়া আছে। আপনার বেলেল্লাপনা দেহার সময় নাই হাতে।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা। তোমার ভাগ্য অনেক ভালো বুঝলা নুরুলের বউ, নইলে চেয়ারম্যান স্যারের ছেড়ায় এত মেয়ে রেখে তোমার মতো বিবাহিত মেয়েরে কিনা মডেল হওয়ার সুযোগ দেয়! রাজ কপাল তোমার।’
‘মানে কি? কিসের মডেল? কি এইডা কি?’ মিতুর এমন প্রশ্নে আনিসুল শব্দ করে হাসে। বলে,
‘রঙের রঙের জামাকাপড় পরে মঞ্চে হাটাহাটি করা। মেলা টাকা পাইবা রাজী হইলে।’
মিতু তেড়ে গিয়ে দুটো ঝাড়ুর বারি বসায় আনিসুলের পিঠ ও কাঁধ বরাবর। ঝাড়ুর বারি পড়তেই সাধের ছাতা ফেলেই আনিসুল ভৌ-দৌড়ে নিরুদ্দেশ হলো। মিতু দৌঁড়ে ধরতে না পেরে ঝাড়ু ছুড়ে মারে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
‘ভন্ড ঘটক! আনিস্যার ঘরের আনিস্যা! ছাগইল্যা দাঁড়ি, চর্বিয়ালা পেট মোটা! আইছে আমারে দিয়া যাত্রাপালা করাইতে। এর পরেরবার তোরে হাতের নাগাল পাই, চুল ছেটে ন্যাড়া যদি না করছি, তাইলে আমার নামও মিতু না!’
চলবে ইনশাআল্লাহ….