গল্প: আগামী (৫ম পর্ব)
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।
‘আপনার ছাতাটা গাড়িতে রেখে গিয়েছেন৷’
আমি হেসে বললাম, ‘সমস্যা নেই। আগামীকাল ওটা এশার কাছে পাঠিয়ে দিবেন।’
এহসান সাহেব কলটা কেটে দিলেন।
আগামীকাল বাবা দিবস। বাবার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে, সেই চিঠি নিয়ে যেতে বলেছেন, বাচ্চাদের স্কুলের শিক্ষক।
বাচ্চারা মন খারাপ করে আমার কাছে এসে বললো, ‘মা, আমাদের বাবা তো আমাদের সঙ্গে থাকে না। আমরা তাকে নিয়ে কিভাবে চিঠি লিখব তাহলে?’
বাচ্চাদের মন খরাপ করতে দেখে বললাম, ‘তোমাদের বাবা তোমাদের সঙ্গে থাকলে কী কী করতেন, তোমরা কী করতে, বাবাকে কী কী বলার আছে তোমরা বরং সেটাই লিখে ফেলো।’
বাচ্চারা আমার পরামর্শে খুশি হয়ে লিখতে বসে যায়। আমি চুপচাপ বারান্দায় বসে আছি। নায়লা মায়ের সঙ্গে পাশের ঘরে গল্প করে চলছে।
রাতে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে আমি ওদের খাতাটা বের করে দেখি ওরা বাবা সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছে৷ বাবার কাছে ওদের চাওয়া পাওয়া, বাবার প্রতি ওদের ভালোবাসার অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে লেখায়।
নায়লা এসে পাশে দাঁড়ায়। মিরাণের খাতাটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে।
প্রিয় বাবা,
তুমি তো আমাদের সঙ্গে থাকো না। তুমি কেন আমাদের সঙ্গে থাকো না? থাকলে কত ভালো হতো! পাশের বাড়ির তুর্যের মতো তোমাকে রোজ চকলেট কিনে দিতে বলতাম না, আমাদের ক্লাসের জিসান আর রোহানের মতো আমি তোমার ফোনটাতে গেম খেলে নষ্ট করে ফেলতাম না, তুমি নিষেধ করলে সেই কাজ আর কখনো করতাম না৷ সবার বাবা সবার সঙ্গে থাকে। তুমি কেন আমাদের সঙ্গে থাকো না বাবা? রোহান বলে, তোদের বাবা তোদেরকে ভালোবাসে না তাই তোদের সঙ্গেও থাকে না। তাহলে ওর কথা কী ঠিক বাবা?
খাতাটা রেখে নায়লা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘দেখেছিস আপা, বাবাকে বাচ্চারা কতটা মিস করে। ওদের আসলেই বাবার প্রয়োজন।’
‘আমিই ওদের বাবা।’
‘ওটা মুখে বলা যায় আপা। কিন্তু বাবার সব দায়িত্ব মা হয়ে পালন করা যায় না।’
রেগে বললাম, ‘তো এখন কী তাহলে বাচ্চাদেরকে ওদের ওই দায়িত্বহীন বাবার কাছে পাঠিয়ে দিব?’
‘অবশ্যই না আপা। আমি চাই তুই আবার একবার নতুন করে ভাবতে শুরু কর।’
‘এত বছর যখন কাউকে প্রয়োজন পড়েনি, আগামীতেও পড়বে না।’
নায়লা চুপ করে চলে গেলো। আমি বাচ্চাদের পাশে শুয়ে পড়লাম। আমি আমার বাচ্চাদের জন্য আসলেই কী যথেষ্ট না? প্রশ্নটা ঘুরতে থাকে মস্তিষ্কের ভেতর। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমে তলিয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি।
স্কুলে গেলে এশা দৌঁড়ে এসে ছাতাটা হাতে দিলো। মেয়েটার চোখমুখ জুড়ে মায়ার ছড়াছড়ি। ওর মুখের দিকে তাকালে, তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। যখন মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ওঠে আমি তখন চুপ করে তাকিয়ে দেখি।
স্কুল থেকে বের হয়ে দেখি এহসান সাহেব আর এশা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, ‘আপনার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম।’
‘কেন?’
‘আজ এশার জন্মদিন। এশা চাচ্ছিলো আপনি মিরাণ আর মেহরিমাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসুন৷ আপনারা এলে আমরা খুব বেশি খুশি হতাম।’
আমি এশার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, ‘আজ এই মিষ্টি মেয়েটার জন্মদিন। আমাকে তো একবারও বললো না মেয়েটা।’
এশা খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমি বললাম, ‘শুভ জন্মদিন মামুনি।’
‘তুমি কিন্তু আসবে মিরাণ ভাইয়া আর মেহরিমা আপুকে নিয়ে। না এলে আমি খুব কষ্ট পাবো।’
মেয়েটার গাল ফুলিয়ে বলা কথা শুনে হেসে উঠলাম।
‘তুমি কষ্ট পাও সেই কাজ কী আমি করতে পারি! অবশ্যই যাব।’
‘সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে তাহলে।’ এহসান সাহেব কথাটা বলে চলে গেলেন।
আমি জন্মদিনে কী উপহার দেওয়া যায় সেটাই ভেবে চলছি।
এশা একবার আমায় বলেছিলো ওর লাল রঙ খুব পছন্দ। শপিংমল থেকে এশার জন্য লাল টুকটুকে একটা ফ্রক কিনলাম। সেই সাথে মিরাণ মেহরিমার জন্যও নতুন পোশাক কিনে নিলাম। এশার পোশাক দেখে ওদের মন খারাপ হোক এটা আমি চাইব না।
সন্ধ্যায় হাজির হলাম এহসান সাহেবের বাসায়। আমরা ছাড়াও এখানে বেশ অতিথি রয়েছেন৷ আমাদেরকে দেখতেই এশা ছুটে এলো। মেয়েটা আমাকে খুব পছন্দ করে, এই কারণেই বোধহয় মেয়েটার প্রতি আমার রোজ আরও বেশি মায়া জন্ম নেয়।
এহসান সাহেবের বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। স্ত্রীকে তিনি এখনো খুব ভালোবাসেন বোঝা যাচ্ছে। দেয়ালে তাদের দু’জনের ছবি ঝুলছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি। পাশে এসে দাঁড়ায় এহসান সাহেব।
‘এই ছবিটা আমাদের বিয়ের প্রথম বছরে তোলা। মনে হয় এই তো সেদিন। কিন্তু কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। তারপরেও মানুষটা একইরকম ভাবে বিস্তার করছে আমার ভেতর।’
স্ত্রীর প্রতি এহসান সাহেবের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করলেও একটা দীর্ঘশ্বাস জাগিয়ে দিয়েছে ভেতরে। আমাকেও যদি এতটা ভালোবাসতো সাফিন! তাহলে আজ আমাদের সন্তানেরাও তাদের বাবার সঙ্গে থাকতে পারতো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে দেখি এশা আমার দেওয়া লাল টুকটুকে জামাটা পড়ে মিরাণ আর মেহরিমার সঙ্গে ছুটে বেড়াচ্ছে। মেয়েটাকে পরীর মতো লাগছে দেখতে।
অনুষ্ঠান শেষ হলে এহসান সাহেব আমাদেরকে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে বাচ্চারা তাকে ভীষণ পছন্দ করতে শুরু করেছে। এহসান সাহেব আর এশাকে আমাদের বাসায় আসার জোরালো নিমন্ত্রণ দিয়ে এসেছে বাচ্চারা। আমিও সুর মেলালাল ওদের সঙ্গে। উপেক্ষা করতে পারলেন না আর তিনি। আগামী শুক্রবার আসবেন বলে নিশ্চিত করলেন এহসান সাহেব।
রাতে মুঠোফোনে অচেনা নাম্বার থেকে আসা ফোনকল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো, ‘আমি সাফিন বলছি।’
ক্লান্ত শরীরটা এবার বিরক্তিতে ছেয়ে গেলো।
‘কেন ফোন দিয়েছেন?’
‘বাচ্চাদের খবর জানতে।’
‘ওরা ভালো আছে।’
‘আমি কী আগামীকাল ওদের সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?’
‘অবশ্যই না।’
ফোনটা কেটে দিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়লাম। এই মানুষটা দিনে দিনে আরও বেশি অসহ্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে মা সাফিনকে নিয়ে কথা তুললেন। বাচ্চারা নায়লার বাসায়। এই সুযোগটাই মা কাজে লাগাতে চাচ্ছেন বুঝতে কষ্ট হলো না।
‘হঠাৎ সাফিনের কথাই বা কেন তুললে?’
‘গতকাল বিকেলে হাঁটতে বের হয়েছিলাম তখন ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।’
‘তো?’
‘আমি ওকে বলেছি আমার নাতি নাতনির প্রতি ওর উতলে ওঠা দরদের পরিমাণটা কমাতে। আরও বলেছি ……..’
কথাটা শেষ না করে মা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘আরও কী বলেছো?’
মা আমতা আমতা করে বললেন, ‘বলেছি আমি তোর জন্য পাত্র ঠিক করেছি, তোকে আমরা বিয়ে দিব।’
হাতে থাকা ভাতের লোকমাটা প্লেটে রেখে বললাম, ‘এসব কেন বলতে গেলে মা?’
‘যাতে ও তোর আশা ছেড়ে দেয়।’
‘সাফিন আমার আশা এমনিতেও করে না মা৷ কারণ ও ভালো করে জানে আমাকে আর ও কোনোদিন ফিরে পাবে না। কিন্তু তুমি এসব বলতে গেলে কেন!’
‘বলব না তো কী করব! আমি তো তোকে বিয়ে দিতেই চাই। শুধু তুই রাজি হোস না। কম পাত্র দেখেছি বল! এভাবে জীবন পার করা যায়? বাচ্চাদেরও তো বাবার সঙ্গের প্রয়োজন হয়। ওদের জন্য হলেও তোর বিয়ে করা উচিৎ।’
খাবার প্লেটটা সরিয়ে রেখে আমি উঠে পড়লাম। ইদানীং সবাই আমার বিয়ে নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ছে। এসবের কারণ ওই সাফিন। ওর এই হঠাৎ আগমন সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে।
বাসায় আজ রান্নার আয়োজন অনেক৷ সন্ধ্যায় এহসান সাহেব আর এশা আসবে। মা তো খুব উৎসুক হয়ে আছে এহসান সাহেবকে দেখার জন্য।
মায়ের এত আগ্রহ দেখে মনে সন্দেহ তৈরি হলে মা’কে সাবধান করতে বললাম, ‘খবরদার মা, এমন কোনো কথা বলো না যাতে আমি ছোট হয়ে যাই। উনি তার স্ত্রীকে এখনো খুব ভালোবাসেন কথাটা মাথায় রেখো কিন্তু।’
মা আমার কথাটা অতটা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবেছে বলে মনে হলো না। নায়লা রান্নাঘরে খাবারগুলো চেক করছে৷ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেখি মুহিত চলে এসেছে।
আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছি। এহসানকে পেয়ে বাচ্চারা খুব খুশি। মা বারবার এহসান সাহেবকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানান প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করে চলছেন। খেতে খেতে মুহিত আর নায়লার সঙ্গে এহসান সাহেবের আলাপটাও বেশ জমে উঠেছে৷
‘ছেলেটা খুব ভালো।’
মায়ের হাসিমুখের নিচে লুকিয়ে থাকা আসল উদ্দেশ্যের কথা টের পেয়ে বললাম, ‘বিয়ের আগে সাফিনকেও কিন্তু তোমার খুব ভালো ছেলে বলেই মনে হয়েছিলো।’
মায়ের হাসিমুখটা নিমিষেই চুপসে গেলো। মুখ গোমড়া করে রাগান্বিত গলায় বললেন, ‘সব সময় কী আর মানুষ চিনতে ভুল হয় নাকি।’
মায়ের কথায় সুর মেলাতে লেগে পড়লো নায়লা। এহসান সাহেবকে নিয়ে এবার কথা উঠতে থাকলো একের পর এক। আমি চাইলেও সে আলাপ বন্ধ করতে সক্ষম হলাম না।
ব্যালকনিতে বসে আছি৷ নায়লা এসে বসলো পাশে৷
ক্ষোভ নিয়ে বললো, ‘আপা ওই সাফিন নামের মানুষটা এত অন্যায় করার পরেও কেন কোনো শাস্তি পাচ্ছেন না বুঝি না৷ সেদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিলো। দেখে তো মনে হলো ভালোই আছে।’
আমি বললাম, ‘মুখে হাসি দেখলেই সে ভালো আছে, এমনটা ভাবা ঠিক না। আর কেউ না জানুক আমি জানি সাফিন ভেতরে ভেতরে কতটা যন্ত্রণায় ভুগছে। সন্তানদেরকে ও খুব ভালোবাসে কিন্তু সন্তানদেরকে সে কথা বলতে না পারার, নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা ওকে ভেতরে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খায়।’
‘সে যদি বাচ্চাদেরকে সবটা বলে দেয় তখন?’
নায়লার আতঙ্কিত স্বরে করা প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘সে সাহস নেই সাফিনের। থাকলে এতদিন চুপ করে থাকতো না৷ ওর অপরাধবোধ ওকে তাড়া করে বেড়ায় ভেতরে। নিজেকে মেলে ধরবে কোন সাহসে!’
নায়লা চুপ করে রইলো। প্রসঙ্গ বদলে আমি অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা তুললাম।
বাচ্চাদের নিয়ে অনেক দিন বাদে আবার ঘুরতে বের হয়েছি। নদীর পাড়ে গিয়ে বসতেই সাফিনের সঙ্গে দেখা। আমি বুঝি না এই মানুষটার সঙ্গে আচমকা এভাবে দেখা হয়ে যায় কী করে! যাকে সবসময় দূরে রাখতে চাই সে কেন বারবার সামনে চলে আসে এভাবে!
সাফিনের সঙ্গে আলাপ শেষে বাচ্চারা খেলতে শুরু করলো। সাফিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, ‘তুমি না চাইলেও আমাদের দেখা ঠিক হয়ে যায় জুলিয়া।’
আমি হেসে উঠলাম।
তারপর বিদ্রুপের স্বরে বললাম, ‘এই দেখা হয়ে যাওয়াটাই তো আপনার জন্য শাস্তি সাফিন। আপনার চোখের সামনে আপনারই বাচ্চারা আপনাকে আঙ্কেল বলে ডাক পাড়ে, আপনি আপনার বাচ্চাদেরকে কাছে পেয়েও বাবার আদরটা দিতে পারেন না, ওদের কাছে নিজেকে বাবা হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। এর থেকে বড় শাস্তি আর কী হয়?’
সাফিন চুপ করে রইলো। আমি আবার বলতে শুরু করলাম, ‘যত দেখা হয় তত আপনার মায়া বাড়ে আর ততই আপনি ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকেন অনুতাপে। বাচ্চাদের সঙ্গে কোনোদিন দেখা না হলে তো আপনি এই মানসিক অশান্তিটা পেতেন না সাফিন।’
সাফিন অপরাধীর মতো বললো, ‘আমি কেবল ভুলগুলো শুধতে নিতে চাই৷’
‘আপনি সব হারিয়ে এখন সব ফিরে পাওয়ার বৃথা স্বপ্ন দেখছেন। আপনি এখন চাইলেও সব ঠিক করে নিতে পারবেন না কারণ সেই উপায় আপনি রাখেননি।’
সাফিন চুপ করে রইলো। বাচ্চাদের নিয়ে আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। বাচ্চারা এই নদীর পাড়টাকে খুব পছন্দ করে৷
চারদিকে বাতাস বইছে। মনের মধ্যের সব ক্ষোভ চাপা দিতে চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে পাশে তাকাতেই দেখি এহসান সাহেব।
আগের পর্বের লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3126327967595934/