গল্প: আগামী (শেষ পর্ব)

0
1930

গল্প: আগামী (শেষ পর্ব)
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।

‘দেখা হয়ে গেলো আপনাদের সঙ্গে এখানেও।’

এহসান সাহেবের কথা শুনে হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ। তাই তো দেখছি।’

‘এশা কিন্তু বাসায় আপনার কথা খুব বলে। সারাদিন আমাকে নিয়ে ওর যতটা না কথা থাকে তারথেকে বেশি কথা থাকে আপনাকে নিয়ে।’

হেসে উঠলাম।
‘তাহলে তো বলতে হবে শিক্ষক হিসেবে আমি সফল।’

‘তা তো অবশ্যই।’

‘এখানে রোজ আসা হয় নাকি?’

‘রোজ সময় করতে পারি না। প্রায়ই আসা হয় আরকি।’

এশার সাইকেলটা নিয়ে মিরাণ চালানোর চেষ্টা করতেই ধপ করে পড়ে গেলো। এহসান সাহেব দৌঁড়ে গিয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে শুরু করলেন। আমি চুপ করে এই দৃশ্যটা দেখতে লাগলাম। এহসান সাহেবের জায়গায় আজ ওদের বাবা হলেও এই একই কাজ করতো। এখন আমিও দিনে দিনে একটু একটু করে বাচ্চাদের পাশে ওদের বাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করি। মাঝেমধ্যে যখন হাঁপিয়ে উঠি, তখন মনে হয় একজন কেউ থাকলে বোধহয় ভালোই হত।

‘সাইকেল চালাতে শিখতে চাও?’

এহসান সাহেবের কথায় মিরাণ আর মেহরিমা মাথা নেড়ে বললো, ‘হুম।’

‘আচ্ছা আমি এখন থেকে তোমাদের তিনজনকেই একসঙ্গে সাইকেল চালানো শিখাবো৷’

বাচ্চারা খুশি হয়ে বললো, ‘সত্যি?’

‘সত্যি।’

‘কিন্তু মা তো আমাদের সাইকেল কিনে দেয়নি।’

আমি কিছু বলার আগেই এহসান সাহেব বললেন, ‘তাতে সমস্যা নেই৷ একটা সাইকেল তো আছেই। আগে এটা থেকে চালানো শিখে ফেলো এরপর মা অবশ্যই সাইকেল কিনে দিবেন।’

তারপর এহসান সাহেবের পরামর্শ অনুযায়ী প্রায়ই নদীর পাড়ে বাচ্চাদের নিয়ে আসতে শুরু করলাম। বাচ্চারা এহসান সাহেবের কাছে সাইকেল চালানো শিখতে শুরু করেছে।

দিন যাচ্ছে দিনের মতো। এহসান সাহেবের সঙ্গে বাচ্চাদের ঘনিষ্ঠতাও দিনকে দিন বেড়ে চলছে। ওরা যেন এহসান সাহেবের সঙ্গ পেলে বাবার অপূর্ণতা ভুলে যায়। এহসান সাহেবও খুব সুন্দরভাবে বাচ্চাদের সামলে নিতে পারেন। আমাকে এই বন্ধনটা ইদানীং খুব ভাবিয়ে তুলছে।

এহসান সাহেবের সঙ্গ আমারও দিনে দিনে প্রিয় হয়ে উঠেছে। মেহরিমা, মিরাণ আর এশাকে নিয়ে আমার আর এহসান সাহেবের কাটানো মুহুর্তগুলো প্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে ভেতরে।

বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ এহসান সাহেব। এশাকে রোজ স্কুলে নিয়ে আসা আর নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা আমিই নিলাম। মা মাঝেমধ্যে এটা ওটা রান্না করে এহসান সাহেবের জন্য আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। মায়ের এমন আতিথেয়তায় ভীষণ খুশি তিনি। এই শহরে তার আপন বলতে আমাদের পরিবার। এই কথাটা এবার তিনি প্রতিমুহূর্তে আমাকে মনে করিয়ে দিতে লাগলেন।

‘আপনি অনেক করেছেন আমার জন্য। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা এভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয় যদিও। তারপরেও অনেক ধন্যবাদ।’

আমি হেসে বললাম, ‘আপনি আমাদের পরিচিত। এতদিন ধরে আমাদের পরিবারের সঙ্গে আপনার চেনা জানা। এতটুকু তো করতেই পারি।’

এহসান সাহেব চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, ‘সবথেকে বড় কথা এতদিনে আপনি আমার একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছেন৷’

বন্ধু শব্দটা শুনে এহসান সাহেব খুশি হয়ে বললেন, ‘যাক এতদিন বাদে আমাদের এই সম্পর্কের একটা নাম দাঁড়ালো তবে।’

হেসে উঠলাম আমি৷

সাফিনের করা হুটহাট ফোনকলগুলো আমাকে বারবার বিষাক্ত অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তার দ্বিতীয় স্ত্রী লতাও আমাকে বেশ কল করতে শুরু করেন। তার ধারণা আমিই তার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে চলছি আগের সব ফিরে পেতে।

‘আমাকে বারবার কল না দিয়ে আপনি বরং আপনার স্বামীকে বোঝান যে সে যা চাচ্ছে তা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কখনো সম্ভব নয়। তাকে বলেন যে আমার বাচ্চার বাবা হিসেবে তাকে কখনো আমি বাচ্চাদের সামনে নিয়ে আসব না।’

লতা ওপাশ থেকে বললেন, ‘আপনি আশকারা দেন বলেই সে আপনার কাছে ছুটে যায়।’

‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে লতা। আপনি আমাকে এখনো চিনতে পারেননি। চিনলে এ কথা বলতে পারতেন না। আমি কোনো সস্তা রমণী নই যে কোনো বিবাহিত পুরুষ এসে বললেই গলে পড়ব।’

বেশ অপমানিত হয়ে ফোনটা কেটে দিলেন লতা। কেনাকাটার উদ্দেশ্যে আমি বেড়িয়ে পড়লাম।

শপিংমলে আবার দেখা সাফিনের সঙ্গে।

‘জুলিয়া আমাকে তুমি ঘৃণা করা কবে বন্ধ করবে? পুরাতন সব ভালোবাসার কথাই তুমি এভাবে ভুলে গেলে?’

‘দুধের মধ্যে বিষ ঢেলেছিলেন আপনি। ছোট্ট ময়লা ফেলেননি যে ওটা আঙ্গুল দিয়ে তুলে ফেলে দুধটা খেয়ে ফেলব।’

‘আমাকে প্রয়োজনে আদালতের কাট গোড়ায় দাঁড় করাও। তবুও বাচ্চাদের থেকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিও না।’

‘আপনি আপনার বিবেকের কাট গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। আপনাকে আর আদালতের কাট গোড়ায় দাঁড় করাতে হবে না৷ বিবেকের থেকে বড় আদালত আর কিচ্ছু হতে পারে না।’

‘আমাকে এভাবে আর ফিরিয়ে দিও না।’

‘লতার বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে আপনি আর জুলিয়ার কাছে আসতেন না৷ তাই না? আপনার শাস্তি আপনাকে আজীবন ভোগ করে যেতে হবে।’

সাফিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। যন্ত্রণায় ছটফট করা সাফিনের চুপসে যাওয়া মুখটা দেখতে আমার ভালোই লাগছে।

এহসান এসেছে বাসায়৷ পাশের রুমে বাচ্চারা টিভিতে শব্দ বাড়িয়ে কার্টুন দেখছে। মা এহসানের সঙ্গে তার আত্মীয় স্বজনদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন। নায়লা বাচ্চাদেরকে নাস্তা দিয়ে এহসানের জন্য কফির মগ নিয়ে এলো।

মা চলে গেলে আমি এহসান আর নায়লা বসে রইলাম।
নায়লা এহসান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি এহসান ভাই?’

কফির মগে চুমুক দিয়ে এহসান সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো নায়লা।’

‘আপনি কী আমার আপাকে বিয়ে করবেন?’

নায়লার এমন হঠাৎ প্রশ্নে আমি থ হয়ে গেলাম। এহসান সাহেব কফির মগে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। আমি নায়লার দিকে ধমকের চোখে তাকিয়ে রইলাম।

নায়লা এ সবকিছু উপেক্ষা করে বললো, ‘আপা তোর পাশে আসলেই একজনকে খুব দরকার। যে তোকে আর বাচ্চাদেরকে ভালোবাসা দিয়ে আপনের মতো আগলে রাখবে, সব দায়িত্ব পালন করবে। বাচ্চারাও যাকে ভালোবাসতে পারবে৷ আর এহসান ভাইকে তো বাচ্চারা খুব পছন্দ করে, তোদের দু’জনের সঙ্গেও বন্ধুত্ব আছে। তাহলে সমস্যা কী?’

‘তুই থামবি নায়লা।’ ধমকের স্বরে বললাম আমি।

এহসান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে দুঃখিত গলায় বললাম, ‘আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না।’

নায়লা এসব কথা পাত্তা না দিয়ে বললো, ‘ভুল কিছু বলিনি তো আমি। এশারও তো একজন মায়ের প্রয়োজন। মেয়েটা তোকে কতটা ভালোবাসে। আর এহসান ভাইয়ের পাশেও একজন দরকার। এভাবে একা একা হতাশা নিয়ে জীবন পার করার কোনো মানে হয়! যেখানে চাইলেই সুখে থাকার অপশন রয়েছে।’

আমরা চুপ করে রইলাম। নায়লা কথা থামাচ্ছে না। বলেই যাচ্ছে। আজ যেন ও পরিকল্পনা করেই এখানে বসেছে এসব বলবে বলে।

‘বাচ্চারা তাদের বাবা মায়ের অপূর্ণতা অনুভব করে এটা স্বীকার না করে পারবি তোরা আপা? ওদের জন্য এবং তোদের নিজেদের জন্য আমার মনে হয় তোরা এই বিষয়টা নিয়ে এবার ভাবতে পারিস৷’

এহসান সাহেব কোনো কথা না বলে চুপচাপ এশাকে নিয়ে চলে গেলেন। আমিও চুপ হয়ে বসে রইলাম। এই মুহুর্তে নায়লার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। হঠাৎই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। যেন সব স্তব্ধ হয়ে আছে।

বাচ্চারা এহসান আর এশাকে খুব মিস করছে। অনেকদিন এহসান সাহেবের সঙ্গে কথা বা দেখা হয় না৷ এশাও আর বাড়িতে আসে না। সেদিনের পর আমি কিংবা এহসান কেউ আর যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। এশাকে প্রতিদিন ড্রাইভার এসে স্কুলে দিয়ে যায় আবার নিয়ে যায়। অনেকবার ভেবেছি মেয়েটাকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করব, কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন আটকে যাই। জিজ্ঞেস করা আর হয়ে ওঠে না।

লতা এবার নতুন সুর ধরেছেন। সাফিন তাকে পটিয়ে ফেলে নরম করতে সক্ষম হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।

তার কথা, ‘বাচ্চারা তো আপনার একার নয়, সাফিন আর আপনার দু’জনের। আর বাচ্চাও তো একটা নয়, দুইটা। তাহলে একজনকে আপনি রাখেন আর বাকি জনকে আমাদেরকে দিয়ে দিন। সেক্ষেত্রে আপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আপনি মিরাণ মেহরিমা যাকে পছন্দ রাখতে পারেন। আপনার বাছাই শেষে যে থাকবে তাকে আমরা নিয়ে আসব।’

আমি চটে গেলে তিনি বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, বাচ্চাকে আমরা আপনার থেকে কোনো অংশে কমে বড় করব না। বরং আরও ভালোভাবে মানুষ করব।’

মহিলার কথা শুনে গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো৷
‘নিজের বাচ্চা হারানোর শোকে আপনি বাচ্চা আর মা এই দুইটা জিনিসের মর্মার্থ ভুলে গিয়েছেন। আপনার মাথা আসলেই খারাপ হয়ে গিয়েছে। তা না হলে এমন একটা প্রস্তাব আপনি আমাকে দেওয়ার সাহস করতেন না।’

‘আপনি চাইলেই কী বাচ্চা জোর করে রাখতে পারবেন?’

‘আমিও দেখতে চাই আপনারা কীভাবে আমার থেকে আমার বাচ্চাদের আলাদা করেন।’

লতার কথায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছে বাসার সবাই। বাচ্চারা এখনো তাদের বাবার বিষয়ে কিছুই জানে না। আমি আমার একটা বাচ্চাকেও দূরে রাখতে পারব না৷ আমি ওদেরকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসি।

বাচ্চাদেরকে এখন চোখের আড়াল করতেই ভয় হয়। ওদেরকে সারাদিন চোখে চোখে রাখতে পারলেই যেন স্বস্তি পাই। দুইজনের কাউকে আমি কম ভালোবাসি না। দু’জনকেই সমান ভালোবাসি। কেউ কারো থেকে কম নয় আমার কাছে।

মা বারবার বলছেন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে। আমার হাতটা শক্ত করে কেউ ধরে রাখলে দুশ্চিন্তা থেকে কিছুটা মুক্তি মিলবে বলে নায়লার ধারনা। বেশ কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাবও মা আর নায়লা মিলে জোগাড় করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এহসানকে খুব মনে পড়ছে৷ তিনি আমার সব বিষয়ে জানতেন৷ আমাকে সবসময় নানান পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। তার বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ আমার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাতে সক্ষম হতো। কিন্তু আজ সে পাশে নেই। তাকে ফিরিয়ে আনাও সম্ভব নয়। নিজের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করতে আমি পারব না।

তবুও এশার কাছে তার বাবার কথা জানতে চাইলাম। এশা বললো তার বাবা নাকি অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত থাকে। আমি আর কিছু বললাম না৷ নায়লার সেদিনের কথায় তিনি নিশ্চয়ই খুব রাগ করেছেন। নায়লাটা যে ওভাবে বলে বসবে, এটা জানলে আমি সেদিন এহসান সাহেবকে দাওয়াতই করতাম না।

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই বাচ্চারা তাদের আঁকা কতগুলো ছবি আর লেখা চিঠি হাতে ধরিয়ে দিলো। তারপর চিৎকার করে বললো, ‘মা দিবসের শুভেচ্ছা তোমাকে।’

এখন বুঝতে পারলাম যে আজ মা দিবস। গতকাল স্কুলে যাইনি তাই আজকের দিবস সম্পর্কেও জানা হয়নি৷ বাচ্চাদেরকে কাছে ডেকে গালে চুমো খেলাম। ওরা আমাকে এতটা ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে যে সব কঠিন পথ পাড়ি দিতেও সাহস পাই।

তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। স্কুলে পৌঁছাতেই দেখি এশা সেই লাল টুকটুক জামাটা গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতেই খিলখিল করে হেসে উঠে ছুটে এলো।

ওর হাসি আমার মুখেও হাসি এনে দিলো। মেয়েটা আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলো।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী আছে ভেতরে?’

‘খুলে দেখ।’

‘এখনই খুলব?’

মেয়েটা বললো, ‘হ্যাঁ।’

আমি খামটার ভেতর থেকে একটা চিরকুট বের করলাম। এশা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর সামনে বসেই চিরকুটটা পড়তে শুরু করি।

‘শুভ মা দিবস। তোমাকে মা দিবসের শুভেচ্ছা। তুমি কী আমার মা হবে?’

পড়েই থমকে গেলাম। এইটুকুন মেয়েটার মাথায় এসব কথা ঢুকিয়েছে কে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এহসান সাহেব জানলে নিশ্চয়ই খুব অখুশি হবেন, এশার উপরে রেগেও যেতে পারেন।

তাড়াতাড়ি করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাবা দেখেনি তো এটা তুমি লিখেছো?’

মেয়েটা চুপ করে তাকিয়ে রইলো। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম, ‘এই চিরকুটের কথা একদম বাবাকে বলো না। বাবা কিন্তু খুব রাগ করবে তবে।’

এশা খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

হাসি থামিয়ে ও বললো, ‘বাবা রাগ করবে কেন? বাবা’ই তো বলেছে এই চিঠিটা লিখে তোমাকে দিতে।’

এই মেয়েটা বলে কী! অবাক হয়ে হা হয়ে রইলাম আমি। এহসান সাহেব এটা দিতে বলবে! বিশ্বাসই হচ্ছে না।

আচমকা তাকিয়ে দেখি এহসান সাহেব এদিকেই আসছেন। মনে হচ্ছে আমার শরীরটা যেন শীতল হয়ে আসছে।

সময় যাচ্ছে আনন্দে আনন্দে। এশা, মিরাণ আর মেহরিমাকে নিয়ে আমি এবং এহসান এসেছি নদীর পাড়ে ঘুরতে। বাচ্চারা সাইকেল চালাতে শিখে গিয়েছে। তিনজনের এখন তিনটে সাইকেল।

আমরা হেঁটে চলছি ফুরফুরে শীতল বাতাস গায়ে মেখে। লতা এবং সাফিনের সঙ্গে দেখা হতেই বাচ্চারা দৌঁড়ে গেলো। আমি আর এহসান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।

এহসানকে দেখিয়ে বাচ্চারা সাফিনকে বললো, ‘সাফিন আঙ্কেল ওই যে আমাদের বাবা।’

সাফিনের আনন্দিত মুখটাতে নিমিষেই অন্ধকার নেমে এলো।

বাচ্চারা আবার খেলতে শুরু করলো৷ আমি এগিয়ে গেলাম সাফিন আর লতার দিকে।

সাফিন আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

‘আপনার বাচ্চারা আপনারই চোখের সামনে আপনাকে আঙ্কেল আর অন্য একটা মানুষকে বাবা বলে ডাকার দৃশ্যটা হজম করতে বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে! তাই না সাফিন?’

সাফিন চুপ করে রইলো৷ আমি চুপ হলাম না।

‘নিজের বাচ্চাদের মুখ থেকে কখনো বাবা ডাক শুনতে পারবেন না আপনি৷ যে অন্যায় করেছিলেন আমাদের সঙ্গে, এটাই তার উপযুক্ত শাস্তি। এই যন্ত্রণায় আজীবন আপনি ছটফট করবেন।’

লতা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘অন্যের সন্তানকে জোর করে ছিনিয়ে এনে কখনো মা হওয়া যায় না৷ মা আলাদা একটা শব্দ। মা হওয়া এত সহজ না।’

লতা চুপ করে রইলেন।
পেছন থেকে এশা ডাক দেয়, ‘মা। আমি আইসক্রিম খাব। দেখ, বাবা কিনে দিচ্ছে না।’

আমি হাসিমুখে বাচ্চাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। এশাকে বললাম, ‘তোমার ঠান্ডা লেগেছে মামুনি। আইসক্রিম খাওয়া একদম ঠিক হবে না।’

মেয়েটার গোমড়া মুখটা দেখে হেসে বললাম, ‘বাসায় গিয়ে আমি তোমাদেরকে একটা দারুণ চকলেট কেকে বানিয়ে দিব। ঠিক আছে?’

এবার বেশ খুশি হয়ে উঠলো বাচ্চারা।

এহসান আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে৷ বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে।

আমি এহসানের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘একা লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তুমি পাশে সাহস আর শক্তি নিয়ে দাঁড়ালে। আমার জীবনটা আবার সুন্দর হয়ে উঠলো।’

এহসান আবেগময় চেহারায় তাকিয়ে বললো, ‘তুমি আমার অগাছালো জীবনটা গুছিয়ে দিয়েছো, আমার বাচ্চার মা হয়ে উঠেছো, তোমার ওই নিষ্পাপ বাচ্চা দু’টোর বাবা হওয়ার সুযোগ দিয়েছো। আমার জীবনের অপূর্ণতাগুলোকে তাড়িয়ে রঙহীন জীবনটাকে তুমি রঙিন করে তুলেছো জুলিয়া।’

‘বাকি জীবনটা আমরা একসঙ্গে বেশ সুখে কাটিয়ে দিব তাই না এহসান?’

‘অবশ্যই। আমি পেয়ে আর কিছু হারাতে চাই না। আমাকে এক বাচ্চা থেকে তিন বাচ্চার বাবা বানিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোমায়।’

হাসিমুখে বললাম, ‘আমাদের এখন তিনটে বাচ্চা। ওরা আমাদের সন্তান।’

এহসান হেসে বললো, ‘তিন বাচ্চার মা, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।’

‘কতটা?’

‘বাসায় গিয়ে মেপে বলবো।’

হেসে উঠলাম আমি। হেসে উঠলো এহসানও।

আগের পর্বের লিঙ্ক:

https://www.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3127966337432097/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here