গল্পের নাম: বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব ৪২: বিয়ের_শাড়ি
লেখিকা: #Lucky_Nova
মিঠি ভ্রুকুটি করে পা থেকে মাথা অব্দি একবার চোখ বুলিয়ে বলল,”গলায়, হাতে, পায়ে, আবার কোমড়েও লাগিয়ে বসে আছিস! এ কেমন ফেইসপ্যাক!”
থতমত খেয়ে গেল মিহি। শুকনো মুখে মেকি হেসে গালে গলায় হাত বুলিয়ে বলল, “আ..আমি.. মানে..।নিতে গিয়ে দেখলাম অনেক বাকি আছে। প..পরে ভাবলাম সারা গায়েই লাগাই। হে হে।”
মিঠি ভ্রু আরো কুচকে ফেলল। মিহি ঢোক গিলেলো। বলা কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হবে কিনা কে জানে!
মিঠি কিছু বলার আগেই নিচ থেকে ডাক পড়লো। দিপালি খেতে ডাকছে মিঠিকে।
মিহি যেন প্রাণে বাঁচলো। সুযোগটা কাজে লাগাতে হড়বড়িয়ে বলল, “তুই তো এখনো না খাওয়া। যা যা খেয়ে আয় আগে।”
মিঠি আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। দিপালি ডেকেই যাচ্ছেন। তাই মিঠি মায়ের ডাকে সারা দিয়ে চলে গেল নিচে।
মিঠি যেতেই হাফ ছাড়লো মিহি। কী একটা অবস্থা! একটুর জন্য ধরা পরে নি!
মিহি দরজা আটকে দ্রুত বাথরুমে এলো। দাঁড়ালো আয়নার সামনে। নিজের দিকে তাকাতেই লজ্জায় মিইয়ে গেল সাথে সাথে। সারা শরীরে হলুদের মাখামাখি। সব তার হাতের ছোঁয়ানো হলুদ।
ধুয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এভাবে তো থাকাও যাবে না। সবাই দেখলে হাসাহাসি করবে। তার উপর কাজিনগুলো যা! তা বলার বাহিরে। ওদের বুঝতে একটুও সময় লাগবে না। আর বুঝলে যেসব কথা বলবে তা শোনার যোগ্য হবে না।
?
“রেডি তুমি? আমি চলে এসেছি।” বলল এরোন।
“আপনি এসেছেন মানে? শাড়ি কিনতে আপনার মায়ের না আসার কথা?” অবাক হয়ে বলল মিহি।
“কথা থাকলেই হবে? বউ আমার তারমানে শাড়িও তো আমিই কিনবো তাই না? এখন জলদি নিচে চলে আসো।” কটাক্ষ করে বলল এরোন।
“বাবা বলেছিল আপনাকে বিয়ের আগ অব্দি দেখা না করতে।” মিনমিনে কণ্ঠে বলল মিহি।
“তোমার বাবা তো কত কী বলে! তাকে আমি ম্যানেজ করে নিয়েছি। এখন আসো জলদি।”
মিহি হাসলো নিঃশব্দে।
“আসছি।”
ফোন কাটলো মিহি। হলুদ ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে আয়নার নিজেকে দেখলো। আজ ওর পরনে সবকিছুই হলুদ। তাই কপালেও একটা হলুদ টিপ না পড়লেই নয়। মিহি একটা হলুদ টিপ বের করে কপালে দিয়ে দিলো।
“এখন ঠিক আছে।” স্বগোতক্তি করে নিচে নেমে গেল মিহি। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই এরোনের চোখে চোখ পড়লো। সাথে সাথে চোখ সরালো মিহি।
সবগুলো কাজিন ঘিরে ধরে আছে এরোনকে। তারাও যাবে এমন বায়না ধরেছে হয়তো।
মিহি নিচে আসতেই প্রেমা বলল,”জিজু আমাদের সাথে নিতেই চাচ্ছে না। কাহিনী কী বল তো? তুই মানা করেছিস?”
“আমি কেন মানা করব?” রিনরিনে গলায় অবাক হয়ে বলল মিহি।
“তাহলে?” কটাক্ষ করে বলল ওরা।
এরোন মুচকি হাসলো।
“কেউ মানা করে নি। আরেকদিন নিয়ে যাব সবাইকে।” বলেই মিহির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ধরলো এরোন। বলল,”দেরি হচ্ছে আমাদের।”
সবাই হাসতে লাগলো মিটমিটিয়ে।
মিহি লজ্জায় পড়ে গেল।
“চলো।” বলে এরোন হাত ধরেই বেরিয়ে এলো মিহিকে নিয়ে।
“সবার সামনে এভাবে আপনি…।”
“এভাবে না আনলে সারাদিন ওখানেই কাটাতে হতো।”
এরোন গাড়িতে বসালো মিহিকে। পাশের সিটে এসে বসে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিহির দিকে।
মিহি এলোমেলো দৃষ্টিতে খেয়াল করল। অগোছালো চুলগুলো কানের পিছনে গুজতে গুজতে বলল, “এভাবে কী দেখছেন?”
“তোমাকে।” বলে মিহিকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে এলো এরোন।
মিহি চোখ পিটপিটিয়ে তাকিয়ে বলল,”কেউ দেখলে কি ভাববে?”
“কী ভাববে? আমার বউকে আমি ধরেছি এতে কার কী?” দায়সারাভাবে বলল এরোন।
মিহি এরোনের বুকে কিল বসিয়ে বলল,”হয়েছে। ছাড়ুন এখন।”
?
“শুধু শাড়ি কেনার কথা ছিল আপনি তো পুরো দোকান কিনে ফেলেছেন।” ভ্রুকুটি করে বলল মিহি।
“এটুকুকে পুরো দোকান বলে?”
“তো কি বলে?” সরু চোখে তাকালো মিহি।
“ভালোবাসা বলে।”
হাসি আটকে রাখতে পারলো না মিহি।
“পাগল আপনি একটা।”
এরোন লাল-খয়রী শাড়িটা খুলে মিহির মাথায় খোমটার মতো করে টেনে দিতেই এদিক ওদিক তাকাতে লাগল মিহি। নিচু গলায় বলল,”দেখছে সবাই।”
এরোন আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, “কেউই তো নেই। কে দেখবে? তাছাড়া আমি তো খারাপ কিছু করছি না।”
“ধ্যাৎ।” কপট চোখ রাঙানি দিয়ে এরোনকে সরিয়ে দিলো মিহি।
এরোন নিঃশব্দে হাসল।
“এতোগুলো শাড়ি কেন নিচ্ছি? আর এই হলুদ শাড়ি আরেকটা কী হবে? একটা তো আছেই।” বলল মিহি।
এরোন পিছন থেকে মিহির গা ঘেঁষে দাঁড়াতেই হকচকিয়ে গেল মিহি।
“আপনার কি বিন্দুমাত্র লজ্জা…!”
“হুশশশশ। শোনো। এটাও হলুদের।” হলুদ শাড়িটা দেখিয়ে বলল এরোন।
“হলুদের একটা আছে। ভুলে গেছেন?”
“ওটা পরে হলুদ হবে। আর এটা হলুদের শেষে পরবা।
কপাল চাপড়ালো মিহি।
“আর এই বাকিগুলো?”
“গোলাপিটা মেহেন্দির। লাল-খয়েরিটা বিয়ের। নীলটা রিসিপশনের। হালকা কমলাটা বউ ভাতের।”
“আর এই আকাশীটা কিসের? আর কালোটা?” এরোনের কথার মাঝে ফোড়ন কাটলো মিহি। ভারি অবাক হচ্ছে সে।
এরোন মিহির কানে কানে বলল, “আকাশীটা বাসর রাতের।”
চোখ প্রসারিত হয়ে গেল মিহির। গাল লাল হয়ে গেল লজ্জায়।
“আর কালোটা সিক্রেট। এখন বলা যাবে না।”
“বুঝেছি আমি। আপনাকে আর বলতে হবে না। অসভ্য লোক।” কপট চোখ রাঙানি দিয়ে বলল মিহি।
এরোন হাসলো।
“বাহ! কত বুদ্ধি তোমার।”
মিহি লাজুক হেসে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো এরোনকে।
সব কিনতে কিনতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
সব প্যাক করে নিয়ে গাড়িতে উঠল ওরা।
মিহি ঝালমুড়ির প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল,”আপনি খাবেন না?”
“না। তুমি খাও।”
“আপনি কী খাবেন তাহলে?”
“তোমাকে।” সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলল এরোন।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মিহি। তাকালো চোখ বড়সড় করে।
এরোন দুষ্টু হাসি হাসলো।
মিহি লজ্জায় মুখ দিয়ে কিছু একটা বিড়বিড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
“খাও চুপচাপ।”
এরোন গাড়ি স্টার্ট দিলো।
“আচ্ছা আপনাকে বাবা ওইদিন কি বলেছিল কিছুই তো বললেন না।” প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো মিহি।
“নীতিবাক্য দিয়েছিল সারারাত।” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল এরোন।
“কী নীতিবাক্য?” হাসলো মিহি।
এরোন সংকুচিত চোখে তাকালো মিহির দিকে।
“মজা লাগছে?”
“বলুন না কী বলেছিল।”
“অনেক কিছু।”
“অনেক কিছু কী?”
“সেটা আমার আর আমার গ্রেট শ্বশুরের ব্যাপার।”
“বলবেন আপনি?” চোখ পাকালো মিহি।
এরোন গাড়ি থামালো আচমকা।
“কী হলো?” বোকা বনে গেল মিহি।
এরোনের শক্তপোক্ত দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালো মিহি।
কয়েকটা ছেলে মিলে উত্যক্ত করছে একটা মেয়েটাকে। রাস্তাটা ফাঁকা বলেই সুযোগ পেয়েছে।
“গাড়িতে বসে থাকবা। নামবা না।” মিহির উদ্দেশ্যে বলেতে বলতে সিট বেল্ট খুলল এরোন।
মিহি খামচে ধরলো এরোনের হাত। বলল,”আপনার যদি কিছু..।”
“কিছু হবে না আমার।” হাসিমুখে বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল এরোন।
মিহি আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। কিন্তু ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো ওর। মন যে মানছে না।
এরোন এগিয়ে গেল ছেলেগুলোর দিকে। তিনজন মিলে একটা মেয়ের ওড়না ধরে টানাটানি করছে।
এরোনকে এগিয়ে আসতে দেখে ওদের একজন বলল,”কি রে? কি চাস?”
“ওকে ছাড়।” বলল এরোন।
“তোর কী লাগে যে ছাড়তে হবে?” ত্যাড়া কথাটা শেষ হতে না হতেই মুখ বরাবর ঘুষি পড়ল একটা। ছিটকে পড়লো ছেলেটা। বাকি ছেলেগুলো ঘাবড়ালো।
জড়সড় হয়ে সরে গেল মেয়েটা।
“এসব করতে ঘর থেকে বেরোস?” বলেই এরোন ওর কলার ধরে টেনে তুলে আরো কয়েকটা বসালো।
মিহি মারামারি হতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত সিটের পাশ থেকে এরোনের ফোন নিয়ে ফোন করলো এরোনের বাবার নম্বরে। তিনি হয়তো পুলিশকে জানাতে পারবেন।
নাম্বার ডায়াল করতে না করতেই বিপদ ঘটে গেল। উচ্চ আর্তনাদ ভেসে আসতেই থমকে গেল মিহি। বুকে মোচড় দিয়ে উঠল ওর।
“এরোন” বলে চিৎকার করে উঠলো মিহি। ফোন ফেলে দ্রুতগতিতে গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গেল এরোনের দিকে। ছেলেগুলো পালিয়েছে ততক্ষণে।
এরোন মাথা ধরে আধশোয়া হয়ে বসে পড়েছে প্রায়। মাথায় ধাতব কিছু দিয়ে প্রচন্ড জোরে কয়েকবার আঘাত করছে ওদের একজন।
মিহি বসে পড়ে কাঁপা হাতে ধরলো এরোনকে। ইতিমধ্যেই রক্তে ভেসে গেছে পুরো শরীর। এত রক্ত দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লো মিহি। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর।
“এই এই, আপনি ঠিক আছেন?” সজোরে কেঁদে উঠল মিহি।
এরোন শুধু তাকালো একবার মিহির মুখের দিকে। মৃদু হাসার চেষ্টা করলো। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রক্তাক্ত মুখটা। মিহি বুঝলো ঠিক নেই সে। ব্যাকুল হয়ে উঠলো মিহি।
ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো। চেঁচিয়ে উঠে কোনমতে মেয়েটাকে বলল, “আপনি একটু এম্বুল্যান্সে ফোন করুন প্লিজ। জলদি।”
মেয়েটা কাল বিলম্ব না করেই ফোন দিল।
অস্থির হয়ে উঠলো মিহি। পাগল পাগল লাগছে। লোকটার কিছু হলে মরেই যাবে ও।
“আপনার কিছু হবে না। আপনার কিছু হবে না। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না।” হিঁচকি উঠে গেল মিহির।
পুরো শাড়ি রক্তে মেখে গেছে মিহির। প্রচন্ড ভয় হচ্ছে।
এরোন রক্তে মাখা ডান হাতটা তুলে মিহির চোখ মুছে দিয়ে অস্ফুটে বলল,”কেঁদ না এভাবে। আমি ঠিক আছি।”
মিহির কান্না বেড়ে গেল আরো। হাতটা ধরে চুমু খেয়ে বলল,”আমি সহ্য করতে পারবো না একদম। আপনি কথা দিয়েছেন আমায় ছেড়ে যাবেন না। প্লিজ যাবেন না।”
এরোন আরো কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। সারা শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে তার। নিভু নিভু চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে।
“আ..আপনি চোখ খুলে রাখবেন প্লিজ। শুনছেন আপনি? দয়া করে আমাকে ছেড়ে যাবেন না।” আহাজারি করে উঠল মিহি।
এরোন বুজে আসা চোখদুটো বন্ধ করে ফেলতেই “না” বলে চিৎকার করে উঠলো মিহি। নিস্তব্ধ পরিবেশটা ভরে উঠলো ওর হাহাকারে।
(চলবে…)