গল্পের নাম : বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব ৪১: হলুদ (প্রথম অংশ)
লেখিকা: #Lucky_Nova
এরোন তাকালো মিহির দিকে। এতটুকুতেই মুখ শুকিয়ে গেছে তার। আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। মনে হচ্ছে যেন পরপুরুষের সাথে এক ঘরে ধরা পড়ে গেছে সে।
“নামিয়ে দিন। এখনো ধরে আছেন কেন?” নামার জন্য ছটফট করতে করতে একদম ফিসফিসিয়ে বলল মিহি।
এরোন মিহিকে নামাতে না নামতেই দরজায় আবার টোকা পড়লো।
“মিহি? দরজা খোলো।” জোয়েল সাহেবের কণ্ঠস্বর শোনামাত্র আঁতকে উঠল মিহি। এরোনের এক বাহু খামচে ধরে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “এখন? বাবা আজও দেখেছে আপনাকে আসতে?”
এরোন বিরক্ত হয়ে তাকালো দরজার দিকে। সে বুঝে উঠতে পারে না যে এই শ্বশুরটার সমস্যাটা কী? রাত বিরেতে জালনার কাছে বসে থাকে কীসের জন্য?
“মিহি? আশ্চর্য?” জোয়েল সাহেব বিরক্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, “এরোন কোথায়? দরজাটা খোলো।”
থমকে গেল মিহি। বিস্ফোরিত চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কাঁদোকাঁদো চোখমুখে এরোনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়ালো,”ছিঃ! আমি মরেই যাব। কী ভাববে বাবা? বাকিরাও তো আছে!”
এরোন সরু চোখে তাকিয়ে আচমকা মিহির কোমড় আকড়ে ধরলো। শিউরে উঠল মিহি।
এরোন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “কী আর হবে! কলঙ্ক লেগে যাবে তোমার গায়ে। পবিত্র কলঙ্ক।”
রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো মিহির মুখ। লোকটা একটা নির্লজ্জ।
“যাও দরজা খোলো।” বলল এরোন।
মিহি দ্রুত বামে ডানে মাথা নেড়ে নাকচ করে দিলো।
“আ..আমি পারব না।”
“না পারলে বিছানায় চলো। আদর করি।” সহজ গলায় বলল এরোন।
কান গরম হয়ে গেল মিহির। এই সময়েও কী করে মজা করে মানুষ?
মিহি চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। গা, হাত-পা কখন থেকেই কাঁপছে মিহির। বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে কাঁপা হাতে ছিটকিনি নামিয়ে দরজা খুলল ও। একবারো তাকালো না। দরজার সাথে ঘেঁষে মাথা নুয়ে রইল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেছে সে।
জোয়েল সাহেব মিহির দিকে একপলক তাকিয়েই এরোনের দিকে তাকালেন। প্রতিবারের ন্যায় গম্ভীর একজোড়া চোখ।
এরোন দরজার সোজাসুজিই একটু দূরে দাঁড়ানো। যদিও সে জোয়েল সাহেবকে ভয় পায় না কিন্তু আজ কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। দৃষ্টি অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করছে লোকটার মতিগতি।
জোয়েল সরাসরি এরোনের উদ্দেশ্যে বললেন,”বৃষ্টি বাদলের মধ্যে এখানে এসেছ কেন? মায়ের কি টেনশন হয় না? তার ফোনও নাকি ধরছ না? কতটা চিন্তিত হয়ে এই মাঝরাত্তিরে ফোন করেছে সে!” হালকা শাসন জড়িত গম্ভীর গলায় বললেন জোয়েল সাহেব।
এরোন একটু থমকালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে চিন্তা করতেই মনে পড়লো ফোন ঘরেই ফেলে এসেছে। বাসাতেও বলে বের হয় নি।
এরোন কিছু বলতে যাওয়ার আগেই জোয়েল সাহেব বললেন,”ফোন করো এখনি। তারপর সোজা আমার রুমে আসো। বিয়ের আগে মিহির সাথে সাক্ষাৎ বন্ধ তোমার।”
শেষ কথাটাতে মনে মনে অসম্ভব বিরক্ত হলেও অভদ্রতা করলো না এরোন। চুপচাপ রইল।
জোয়েল সাহেব মিহির দিকে তাকালেন। মিহি মাথা একদম নুয়ে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে আছে। পারলে এখনি মাটি খুড়ে ভিতরে চলে যায় সে।
“এটা ওকে দেও।” জোয়েল সাহেব নিজের ফোনটা মিহির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মিহি থরথর করে কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে কোনমতে নিলো ফোনটা।
“কথা বলে সোজা আমার রুমে চলে আসো।” এরোনের উদ্দেশ্যে বলে চলে গেলেন জোয়েল সাহেব।
মিহি ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে হাঁপরের মতো শ্বাস নিতে নিতে দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিলো। এভাবে লজ্জায় পড়তে হবে জানলে মিহি পালিয়েই যেত যেভাবে হোক।
এরোন এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। মিহির হাত থেকে ফোনটা নিতে নিতে বলল,”এত লজ্জার কি আছে?”
মিহি কিছু বলল না। কারণ এই লোক এসব বুঝবে না। মিহি দুইহাতে নিজের গাল স্পর্শ করলো। গরম হয়ে গেছে পুরো।
এরোন আরোহীর নম্বরে ফোন দিতে না দিতেই তিনি ধরলেন। বিচলিত হয়ে বললেন,”হ্যালো?”
“হ্যাঁ, মা, আমি ঠিক আছি।”
ছেলের কণ্ঠ শুনে স্বস্তি পেলেন তিনি। নিঃশ্বাস ফেললেন সশব্দে। পর মুহূর্তেই গর্জে বলে উঠলেন,”বেহায়ামি আর কতো করবি? একবার বলে যাওয়া যেত না? ফোন করে করে অস্থির হয়ে তারপর দেখি ফোনই নিস নি। বেয়াদব হচ্ছিস দিন দিন। বাহিরে কি অবস্থা? ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। এরমধ্যে যাওয়া লাগলো?”
“সরি, আর হবে না।” শান্ত করার জন্য আশ্বস্ত করে বলল এরোন।
“বিয়ের আগে ও বাড়ি যাওয়া উচিত হয় নি তোর। যাওয়া যায় না। এটাই নিয়ম। দয়া করে একটু নিয়ম কানুন মেনে বিয়েটা কর।” থমথমে গলায় বললেন আরোহী।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল এরোন। এই নিয়মকানুন নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না।
“সকাল হতেই ফিরে আসবি। রাখছি।” থমথমে গলায় আদেশ জারি করে দিলেন আরোহী। রেগে আছেন তিনি। ঝড়বৃষ্টিতে বাহিরে যাওয়া কখনই পছন্দ করেন না তিনি।
“হু।” ফোন কাটলো এরোন।
মিহি এখনো জায়গায় দাঁড়িয়ে কাচুমাচু হয়ে আছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে আকাশকুসুম ভাবছে।
এরোন এগিয়ে গিয়ে মিহির দুইপাশে হাত রাখতেই চমকে উঠলো ও।
“বাবা ডেকেছিল তো! যান।” চকিত স্বরে বলতে বলতে বার কয়েক দরজার দিকে তাকালো মিহি। আবার এসে পড়লে কী একটা অবস্থা হবে!
এরোন তাকিয়ে রইল মিহির বিচলিত মুখপানে।
মিহি খেয়াল করে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো।
“যান। দেখলে…।”
“হুশশ..!” এক আঙুল ঠোঁটের উপর রেখে চুপ করালো মিহিকে।
এরোন আরো কাছে ঝুঁকতেই চোখ বন্ধ করলো মিহি।
এরোন সময় নিয়ে একে একে মিহির কপালে, চোখে, গালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিলো।
মিহি লাজুক হেসে চোখ খুলল। নত করে রাখলো দৃষ্টি। এরোনের দিকে তাকালো না।
এরোন মিহির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “ঠান্ডায় আজ মরেই যাব আমি।”
মিহি হাসিটা আরেকটু প্রসস্থ করে এরোনকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলল,”বুঝেছি। এখন যান আপনি। দেরি হচ্ছে।”
এরোন নিঃশব্দে হাসলো। ঘর থেকে বেরোনের আগে কপালে চুমু দিয়ে বলল, “গুড নাইট। মিস করবো তোমাকে।”
“আমিও।” বলল মিহি।
দিপালিকে মিহির ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। একদিকে মা মেয়ে একসাথে আর অন্যদিকে জামাই শ্বশুর একসাথে। অদ্ভুত! এরোন বুঝে পাচ্ছে না। এই লোক কী হিংসা করে এরোনকে? নাকি এখনো সহ্য করতে পারছে না নিজের হেরে যাওয়াটা? কোন জন্মের প্রতিশোধ নিচ্ছে সে!
এসেছিল বউয়ের সাথে ঘুমাতে, কিন্তু এসে ঘুমাতে হচ্ছে কার সাথে?
এমন ভিলেন শ্বশুর মনে হয় এজন্মে কেউ পায় নি! কপাল লাগে! কপাল!
?
গায় হলুদের শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখছে মিহি। হলুদ তিনদিন পরে। তারপর বিয়ে।
এরোন আজ একবার পরতে বলেছে এই শাড়িটা। কেন বলেছে মিহি জানে না। কিন্তু পরতে বলেছে বলেই মিহি পরেছে।
অনেক সুন্দর মানিয়েছে।
আয়নায় তাকিয়ে থেকে মিহি লাজুক হাসলো। প্রথম হলুদের কথা মনে পড়ে গেল ওর। ইস এবারো যদি একসাথে হলুদ হতো! তাহলে এরোনকে ইচ্ছামতো হলুদ লাগিয়েই ছাড়তো। চিন্তা করেই হেসে ফেলল মিহি।
“আসবো।”
চিন্তায় মগ্ন থাকায় হালকা চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালো মিহি।
ওর বড় বোন মিঠি দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে আগের চেয়ে। তাও চেহারার স্নিগ্ধতা রয়েই গেছে।
“পারমিশন নেওয়া লাগে?” অভিমানী স্বরে বলল মিহি।
মিঠি প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো। এগিয়ে এসে মিষ্টি হাসিসহ বলল,”খুব সুন্দর লাগছে।”
মিহির চোখ ছলছল করে উঠেছে ইতিমধ্যে। কত দিন পর আজ তার বোনটার সাথে দেখা। সে বাড়িতে আসে না বললেই চলে।
“বোকা। কাঁদিস কেন?” বলতে বলতে জড়িয়ে ধরলো মিঠি।
মিহি আঁকড়ে ধরলো মিঠিকে।
সময় নিয়ে আলিঙ্গন করলো দুজন দুজনকে।
“বাড়িতে থাকলেই পারিস। একা একা কেন পড়ে থাকিস ওদিকে?” ভেজা গলায় বলল মিহি।
“আরে! আমি তো ভালো আছি তাই না? কান্নাকাটি জুড়ে দিস না, প্লিজ।”
মিহি চোখ মুছে মিঠিকে ছেড়ে দাঁড়ালো।
মিঠি ঠোঁট প্রসস্থ করে হাসলো। বলল, “বাবার জেদ ভেঙেছে তাহলে! বেচারা কম করে নি তোর জন্য। অনেক চেষ্টা করেছে। অনেক ভালবাসে তোকে।” শেষে মিঠির কণ্ঠস্বর কেমন যেন শোনালো। হয়তো নিজের ফেলে আসা অতীত মনে পড়ছে।
মিহি বুঝতে পারলো। তবে কিছু বলার আগেই মিঠি প্রসঙ্গ বদলে বলল, “তারপর বল কীভাবে পটিয়ে নিলি এতো ভালো ছেলেটাকে? তুই তো প্রেম করা পাবলিকই না। হু হু?” ভ্রু উঁচু করে নামালো মিঠি।
লজ্জা পেল মিহি।
“পরে এসে সব শুনবো। এখন আগে ফ্রেশ হই। মাত্র এলাম। অনেক ক্লান্ত।” বলল মিঠি।
“আচ্ছা।”
বেরিয়ে গেল মিঠি। মিহি মৃদু হেসে আয়নার দিকে ফিরলো। শাড়ি যখন পরেছেই এখন পুরোপুরি সেজে দেখলে মন্দ হয় না।
মিহি সামনে বের করে রাখা আর্টিফিশিয়াল ফুলের গহনাগুলো তুলে তুলে পরতে লাগলো। যদিও হলুদের দিন পুরো আসল ফুল দিয়ে সাজবে মিহি।
দুই কানে দুল পরতে পরতে আয়নায় চোখ আটকে গেল মিহির।
এরোনকে পিছনে দাঁড়ানো দেখে মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেল ওর।
এরোন হাসলো৷ নিঃশব্দ সেই হাসি। চোখের দৃষ্টিতে অসীম মুগ্ধতা।
মিহি চট করে ঘুরে তাকালো। অবাক হয়ে বলল, “আপনি? আবার দেয়াল টপকেছেন? কেউ দেখে নি? এতো মানুষ!”
কথাগুলো এরোনের কর্ণগোচর হলো না। সে চেয়েই রইল একাধারে।
এরোনকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুকে দ্রিমদ্রিম আওয়াজ হতে লাগলো মিহির। লাজুক হেসে মুখ হালকা ঘুরিয়ে নিলো সে।
“দিন দিন আরো বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছ।” ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে কাছে এগিয়ে আসলো এরোন। দাঁড়ালো মিহির সামনে। খুব কাছে।
“দরজা কিন্তু খোলা…।” মিনমিনে গলায় বলল মিহি।
এরোন মুচকি হেসে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। বন্ধ করে দিলো দরজা।
মিহির দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে এলো। বলল, “আপনার লজ্জা লাগে না? এভাবে চলে আসেন হুটহাট!”
“চলে যাব?”
“না।” দ্রুত গতিতে বলে উঠল মিহি। বলার পরে নিজেই লজ্জা পেল।
এরোন হাসলো। মৃদুস্বরে বলল, “আমি নিজ হাতে হলুদ লাগাবো তোমাকে।”
হতবুদ্ধি হয়ে তাকালো মিহি। সাথে অবাকও হলো।
“মানে? হলুদ কোথায় পাবেন?”
এরোন হাতে থাকা হলুদের প্যাকেট মিহির সামনে ধরে দেখিয়ে বলল, “এইযে।”
হা হয়ে গেল মিহি। এইজন্যই শাড়ি পড়তে বলেছিল সে।
এরোন আশেপাশে তাকিয়ে বাটি খুঁজলো। বাটি বোধ হয় নেই। তাই সাজগোজের একটা বক্স বেছে নিলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে।
মিহি চুপচাপ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে যেতে লাগলো এরোনকে।
এরোন বক্সটায় হলুদ ঢেলে তার সাথে পানি মিশিয়ে নিতে লাগলো।
মিহি মুচকি হেসে এগিয়ে গেল এরোনের কাছে। এরোন বুঝে ওঠার আগেই মিহি বক্সে হাত ডুবিয়ে হলুদ নিয়ে গালে লাগিয়ে দিলো। এরোন তাকালো অবাক হয়ে।
“আমারো ইচ্ছে ছিল আপনাকে হলুদ লাগানোর। নিজের হাতে।” অনুভূতিপুর্ণ আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল মিহি।
(চলবে…)