গল্পের নামঃ #প্রণয় #পর্বসংখ্যা_১২+১৩

0
866

গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_১২+১৩
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত

মারুৈদের বাসায় বড়সড় ঝামেলা লেগেছে।মারুফ-পৃথিশা এনগেজমেন্টের খবর এখন প্রায় সবাই জানে।দুপুরের দিকে ঘুম থেকে বাসায় বিয়ের তোড়জোড় দেখে একজনকে জিজ্ঞেস করলে সে বিয়ের খবর বলে দেয়।ব্যস,তখন থেকেই শায়েলা রহমান চিল্লিয়ে সবার মাথা খেয়ে ফলেছেন।

রিনা খাতুন বাহিরে গেছে কিছু কাজের জন্য। মারুফ বসার ঘরে টিভিতে খবর দেখছে।শায়েলা রহমান তার সামনে এসে রাগী স্বরে বললেন,”তুই জানতি না তোর সাথে আমি অনামিকার বিয়ে ঠিক করেছি।তবুও কেন তুই অন্য কাউকে বিয়ে করছিস?”

মারুফ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, “কাকী, প্রথমে তুমি মায়ের ব্রেন ওয়াশ করে নিহার সাথে বিয়ে ঠিক করলে।আমি চলে যাওয়া বিয়েটা হলো না।পরে জানা গেলো নিহার অন্যান্য ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো।এরপর আবার তুমি অনামিকার সাথে বিয়ে ঠিক করলে হুট করে।অধৈর্য হয়ে
বিয়েটা আমার,তাই আমার পছন্দটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অনামিকাকে আমি বোনের চোখে দেখি।সেখানে আমি তাকে কি করে বিয়ে করবো?”

শায়েলা রহমান বলেন, “বিয়ের পর ঠিকই অভ্যাস হয়ে যেতো।”

মারুফ বিরক্তি স্বরে বলে উঠল, “আমিতো বললাম আমি অনামিকাকে বিয়ে করব না।তাও কেন জোর করছো কাকী?প্লিজ কোন ঝামেলা করো না।আমার ভালো লাগে না।”

শায়েলা রহমান কিছু না বলে চলে গেলেন।মারুফ বিরক্তি নিয়ে বসে থাকে। রিনা খাতুন পৃথিশাকে নিয়ে বিয়ের গয়না কিনতে গেছেন।মারুফকেও যেতে বলেছিলো,কিন্তু ঘুমিয়ে থাকায় মারুফ যেতে পারেনি।যদি জানতো পৃথিশা যাবে তাহলে ঠিকই যেতো।
অধৈর্য হয়ে রুমে গিয়ে পৃথিশাকে ফোন করলো।প্রথমবার ফোন ধরলো না,দ্বিতীয়বার প্রথম রিং হতেই ফোন ধরে ফেলল।

অপরপাশ থেকে পৃথিশা মিষ্টি স্বরে বলল,”আস্সালামু আলাইকুম!”

গমগমে স্বরে মারুফ বলল, “ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ। কি করছিস?”

পৃথিশা ধীর কন্ঠে বলে, “খালা আর আম্মু বিয়ের গয়না দেখছে।আমিও তাদের সাথেই আছি।”

মারুফ জিজ্ঞেস করলো, “পছন্দ হয়েছে?”

পৃথিশা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে উঠল, “আপনি তো জানেন আমি গলার হার পড়তে পারি না গলায় টান লাগে বলে।আমার আংটি পড়লে আঙুল ভারি লাগে তাই আংটি পড়তে পারি না।কানের দুল পড়তে পারলেও তা হিজাবের জন্য দেখা যায় না।চুড়ি প্রচন্ড পছন্দ হলেও চুড়ি পড়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না।আমি কি করে গয়না পছন্দ করবো?”

মারুফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “গয়না দেখতে থাক।আমি আসছি।”

পৃথিশা তড়িঘড়ি করে বলে উঠে, “আপনি কেন আসবেন?আম্মু – খালা দেখলে কি বলবে?”

মারুফ কোন কথা না বলে ফোন রেখে দেয়।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

?

রিনা খাতুন ও সুমিতা বেগমের সাথে গোমড়া মুখে বসে আছে পৃথিশা।তারা নানা গয়না দেখাচ্ছে তাকে কিন্তু পৃথিশার একটাও ভালো লাগছে না।অনেক কিছু দেখার পর তার চোখ পড়ল দোকানের এক কোণায় থাকা লাল চুড়িগুলোর দিকে।
সুমিতা বেগমের ওড়নার এক কোণা টেনে ধরে তাকে চুড়িগুলোর দিকে ইশারা করল।সুমিতা বেগম বুঝতে পারলপন মেয়ের মুড ফিরেছে কেনাকাটার জন্য।দোকানিকে বলে চুড়িগুলো নামিয়ে পৃথিশার হাতে পড়িয়ে দিলেন।চুড়িগুলো পৃথিশার হাতে পড়িয়ে দিলে একেবারে ঠিকমতো হলো।
এরই মধ্যে মারুফ এসে উপস্হিত হলো। পৃথিশা অতি আগ্রহ নিয়ে তাকে চুড়িগুলো দেখালো।মারুফ হেসে সায় দিলো।
এক এক করে পৃথিশার জন্য গলার হার,কানের দুল সবকিছুই পৃথিশার সুবিধামতো চুজ করে দিলো মারুফ।পৃথিশা যেন এতে স্বস্তি পেলো।

শাড়ির দোকানে যেয়ে পৃথিশা প্রথমেই বললো লাল শাড়ি বের করতে।পৃথিশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একেকটা শাড়ি গায়ে ধরে দেখছে।কিন্তু একটাও পছন্দ হচ্ছে না।হুট করেই একটা সোনালী পাড়ের লাল শাড়ি গায়ে ধরলে মারুফ বলে উঠে, “পার্ফেক্ট!”
পৃথিশা মুচকি হাসে।মানে তারও পছন্দ হয়েছে। সুমিতা বেগমকে বলে দেয় সে এটাই নিবে।
সুমিতা বেগমরা অন্যদিকে চলে গেলেন, আরো কিছু কেনাকাটা বাকি আছে।

?

মারুফ পৃথিশার জন্য শাড়ি দেখছে।সবগুলো শাড়িই কালো আর সাদার মধ্যে। অনেকক্ষণ দেখেশুনে ছয়টা শাড়ি নিলো।পৃথিশা বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি কি শোক পালন করবো এই শাড়ি পড়ে?এতগুলো শাড়ি নিচ্ছেন কেন?”
মারুফ গম্ভীর স্বরে বলল, “তা পরেই দেখা যাবে।এখন চল ওদিকে।”

পৃথিশা সুমিতা বেগম আর রিনা খাতুনকে নিজের টাকায় দু’এটি শাড়ি কিনে দিলো।লুকিয়ে মারুফের জন্য একটা পান্জ্ঞাবিও কিনলো।আসার সময় বুদ্ধি করে পান্জ্ঞাবির প্যাকেটটা মারুফের ব্যাগে দিয়ে দিলো।
জোর করে সুমিতা বেগম ও রিনা খাতুনকে মারুফের সাথে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো পৃথিশা।বাচ্চাদের একটা শপিং মলে ঢুকে অনেকগুলো ড্রেস কিনে নিলো।এগুলো সব এনজিও-র বাচ্চাগুলোর জন্য।ব্যস্ততার কারনে তাদের এখন পর্যন্ত কিছু দিতে পারেনি।তাই আজ যেহেতু সুযোগ পেয়েছে তা মিস করবে কেন?

রিকশা করে এনজিও-তে পৌঁছাতেই মাঠে থাকা বাচ্চাগুলো ঘিরে ধরলো তাকে।পৃথিশা তাদের আঁকড়ে ধরেই ধীরে-সুস্হে ভিতরে ঢুকলো।এখানকার সবাইকেই তার ভালোমতো চেনা হয়ে গেছে। বাচ্চাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোট হলো পিউ,বয়স মাত্র তিন বছর।কিন্তু খুব দুষ্ট,সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে পুরো এনজিও মাতিয়ে রাখে।পৃথিশার সাথেও তার বেশ ভাব।পৃথিশাকে আম্মুমা বলে ডাকে।পৃথিশা এলেই তার জন্য চকলেট নিয়ে আসে।অন্যান্য খাবার না খেলেও চকলেটটা খুব পছন্দ করে মেয়েটা।
পৃথিশা আসার খবর পেয়েই গুটিগুটি পায়ে এসে পৃথিশার কোলের উপর বসে পড়লো।মিষ্টি হেসে পৃথিশা তাকে জড়িয়ে ধরলো।পিউয়ের শরীরটা বেশ গরম মনে হচ্ছে তার। ফারুকী খালাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন পিউয়ের শরীর নাকি আজ সকাল থেকেই বেশ গরম। ফারুকী এখানে বাচ্চাদের দেখাশুনা করেন।পৃথিশা বুঝতে পারল পিউয়ের জ্বর আসতে পারে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ধীর কন্ঠে বলল, “পিউ সোনা তোমার জন্য চকলেট এনেছি।খাবে না?”

পিউ ক্লান্ত স্বরে উত্তর দিলো, “উমমম,পরে খাবো আম্মুমা।তুমি এতদিন আসোনি কেন?

পৃথিশা একহাত দিয়ে কান ধরে বলল,” সরি মা,অসুস্হ ছিলাম তো তাই।”

পিউকে জোর করে কয়েক লোকমা ভাত খাওয়ালো পৃথিশা।তারপর ঔষুধ খায়িয়ে কোলে নিয়ে হেঁটে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।এখন মনে হয় আর জ্বরটা আসবে না,গায়ের তাপমাত্রাটা আগের চেয়ে কম। পিউকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে পৃথিশা উপরের তলায় চলে গেল।সেখানে একজন স্পেশাল চাইল্ড থাকে,নাম সায়শী। মেয়েটা পৃথিশার চেয়ে বয়সে বড়,কিন্তু সমস্যার জন্য আচরণ একটু বাচ্চাদের মতো।পৃথিশার অন্যতম কাছের একজন হলো সে।চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে এখানে রেখে দিয়ে গেছে তার পরিবার। এমন মেয়েকে নাকি তারা গ্রহণ করতে পারবে না। সায়শী একটা বিশেষ গুণও আছে।সে খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে। পৃথিশার সাথে সায়শীর সম্পর্ক সাত বছরের। পৃথিশা উপরে গিয়ে দেখলো সায়শী মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে আর তার সামনে এনজিও-র একজন মহিলা তাকে ধমকাচ্ছে।পৃথিশা দৌড়ে সেখানে গেল।
পৃথিশা সায়শীকে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে বুবু?”

মহিলাটি বিরক্তি নিয়ে বলল,”তাকে কতবার নিষেধ করেছি এসব রং-টং না করতে।তাও প্রতিদিন বসে বসে রং করে।পরে তো আমাকেই এসব গুছাতে হয়।”
এসব বলে মহিলাটি চলে গেল।পৃথিশা সায়শীর দিকে তাকিয়ে দেখলোমেয়েটা ঘাড় বাঁকা করে তার দিকে অশ্রুশিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে।পৃথিশা ধীর স্বরে বলল, “মন খারাপ করো না বুবু। দেখো আমি তোমার পছন্দের কালো মিষ্টি এনেছি।”
মূহুর্তের মধ্যেই সায়শীর ভাব-ভঙ্গির পরিবর্তন হয়ে গেলো।খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, “সত্যি এনেছ?”
পৃথিশাও হাসি মুখে বলল, “সত্যি সত্যি এনেছি।তার আগে বলো তুমি দুপুরে ভাত খেয়েছ?”
মুখ কালো সায়শী না বোধক মাথা নাড়লো।পৃথিশা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, “আমি ডাল দিয়ে মাখিয়ে খায়িয়ে দিলে খাবে তো?”
সায়শী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।পৃথিশা হাসিমুখে উঠে গিয়ে ভাত নিয়ে আসলো তার জন্য।মেয়েটা ঘন ডাল দিয়ে ভাত খেতে প্রচুর পছন্দ করে কিন্তু এনজিও-তে সবসময় এমন করে ডাল রান্না হয়না।তাই পৃথিশা আজ বাহির থেকেই তার জন্য খাবার কিনে এনেছিল।খাওয়া শেষ হতেই পৃথিশা তাকে আলাদা বাটিতে মিষ্টি এনে দিলো।বাচ্চাদের পুরো মুখ মাখিয়ে মিষ্টিটা খেলো সায়শী। পৃথিশা তার মুখ ধুয়িয়ে দিলো।পিঠ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলোতে তেল দিয়ে বেণী করে দিলো।সায়শী পুতুলের গোল গোল চোখ করে পৃথিশার দিকে তাকিয়ে আছে।পৃথিশা প্রচুর কষ্ট হয় সায়শীর জন্য,মেয়েটা একেবারে পুতুলের মতো দেখতে।কিন্তু…
সায়শীকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো পৃথিশার।যদিও এনজিও তার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়।তাও কেমন যেনো ভয় লাগে। ঔষুধের দোকানের সামনে মারুফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পৃথিশা হাঁটা থামিয়ে দিলো।
মারুফের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বাসার কেউ কি অসুস্হ? এখানে যে আপনি?
মারুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলো, ” কাকীমা ঘুমের ঔষধ খেয়ে বিছানায় পড়ে আছে।”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here