গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_১১
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
মারুফের কাকী শায়েলা রহমানকে দেখে রিনা খাতুনের মুখ পুরো শুকিয়ে গেল।দিশেহারা হয়ে অনেকটা মুখ লুকিয়ে তিনি বড় ফোনকে ফোন করলেন।বিভা খাতুন খবর শুনে নিজেই রওনা হয়ে গেলেন এখানে আসার জন্য কেননা তিনি জানেন বোনের ভালো মানুষি বিপদের কারন হবে।অতিরিক্ত দরদ দেখাতে গেলে গলায় ঝুলে পড়বে।
বুদ্ধি করে তিনি আগেই মারুফকে ফোন দিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা জানিয়ে দেন।সাথে তাকে সাবধানও থাকতে বলেন।মারুফ সবটা শুনে নিজের মাকে চেয়েও দোষ দিতে পারলো না।
শায়েলা রহমান নিজের মেয়েকে আগ বাড়িয়ে রান্না ঘরে পাঠিয়ে দিলেন রিনা খাতুনকে সাহায্য করার জন্য।অনামিকা সেখানে গিয়ে তরকারি দেখতে গিয়ে তা পুড়ে ফেলল।রিনা খাতুন তাকে জোর করে রান্না ঘর থেকে বের করে দিলেন।মারুফের ঘরে যাওয়ার জন্য মা বাড়াতেই দেখতে পেলো ইয়া বড় তালা ঝুলানো। মন খারাপ করে অনামিকা শায়েলা রহমানের কাছে চলে গেল।
অনামিকা দেখতে একটু খাটো,যার কারনে উপযুক্ত বয়স হয়ে যাওয়ার পরও তার বিয়ে হচ্ছে না।অপরদিকে প্রতিবেশী-আত্নীয়স্বজনের কথা তার কাছে বিষের মতো লাগে।সেই সাথে মায়ের এই উল্টাপাল্টা আচরণে সে বেশ বিরক্ত হয়।ইচ্ছা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সে চাকরি করতে পারেনি নিজের মায়ের বাঁধার কারনে।শায়েলা রহমান নিজের ইচ্ছায় একেকদিন তাকে একেকজনের গলায় ঝুলাতে চায়।আর সেই ইচ্ছায় বলির পাঠা বানানো হয় তাকে।
এই যেমন মারুফের সাথে বিয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে তার মা তাকে ধরে-বেঁধে এই ময়মনসিংহ এনেছে।কিন্তু এই বিয়েতে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।কিন্তু শায়েলা রহমান তো তার কোন ইচ্ছার দামই দেয় না।মাঝে মাঝে প্রচন্ড কান্না পায় অনামিকার।তার ছোট ভাইকে তার মা কত আদর-যত্ন করে।কিন্তু তার প্রতি সবসময় কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণা।অনামিকা বুঝতে পারে মেয়ে হওয়ার জন্যই মায়ের এতো আক্ষেপ!
মারুফ বাসায় আসার সাথে সাথেই অনামিকাকে শরবত দিয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন শায়েলা রহমান।গোসল করে বের হয়ে অনামিকাকে গুটিশুটি হয়ে রুমে এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মারুফের ভ্রু কুঁচকে আসে।টেবিলে শরবতের গ্লাস দেখেই বুঝতে পারে মূল বিষয়টা কি।
বিছানায় বসে অনামিকার উদ্দেশ্যে বলে, “দেখো অনামিকা আমি জানি কাকী কোন উদ্দেশ্যে তেমাকে এখানে এনেছে।কিন্তু একটা কথা তোমার জানা উচিত যে আমি বিবাহিত।আমার বিয়ে হয়ে গেছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা।আমি আশা করবো না তুমি অবুঝের মতো কাকীর কথা উল্টাপাল্টা কাজ করে যাবে।কোন ধরনের ঝামেলা না করার অনুরোধ করছি।”
মাথা নিচু করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে অনামিকা চলে যায়।
মারুফ ইচ্ছা করেই সরাসরি সব জানিয়ে দিয়েছে। কথা এড়িয়ে গেলে ঝামেলা আরও জট পাকাতো।তাই সরাসরি অনামিকাকে সব বলে দেওয়াটাই ভালো মনে করেছে সে।কিন্তু নিজের মায়ের এই অতিরিক্ত মহান হওয়ার জন্যও তাকে সবসময়ই বিপদে পড়তে হয়।
সব চিন্তা-ভাবনা একপাশে রেখে মারুফ পৃথিশাকে ফোন দেয়।দুইবার ফোন দেওয়ার পরও ফোন না ধরায় একটা মেসেজ দিয়ে ফোন রেখে দেয়।সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখে ঘুম ভর করেছে।ভেজা গামছাটা বিছানায় রেখেই শুয়ে পড়ে সে।
?
ভোরের আলো ফুরতেই পৃথিশা নামাজ পড়ে ছুটলো রান্নাঘরের দিকে। চা বানানোর পাতিলটা সাবধানে বের করে পানি গরম হতে বসিয়ে দেয়।এরপর পানির বুদবুদ ফুঁটলেই এক টুকরো আদা, দুই ইঞ্চি দারচিনি, তিনটা এলাচ, লবঙ্গ, তেজপাতা, সামান্য পরিমাণ জিরা,মৌরি, কালোজিরা, গোলমরিচ, সবকিছু একসাথে ফুটিয়ে সাথে তাতে লেবুর রস মিশিয়ে দেয়।মারুফ সবসময়ই এমন মশলা চা খায়।পৃথিশা এতদিনেও বুঝে উঠতে পারলো না মারুফ এমন চা কি করে খায়।পৃথিশার ঠান্ডা লাগলে তার মা রং চা জোর করে খাওয়ায়।কিন্তু অন্যান্য সময় পৃথিশা ইচ্ছামতো চিনি দিয়ে ঘন দুধ দিয়ে চা খায়।
চা হয়ে এলেই কাপে ঢেলে তা নিয়ে ছাদে চলে যায় পৃথিশা।সে জানে মারুফ মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ছাদেই থাকে।
মারুফের সাথে পৃথিশার দেখাটা কাকতালীয় ভাবে।পৃথিশাদের এ বাড়িতে উঠার কিছুদিন পরই মারুফেরা তাদের পাশের বাড়িতে উঠে।একদিন বান্ধবীর সাথে ছাদে গিয়ে ভুলবশত মারুফের সাথে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়।সেখান থেকেই শুরু,প্রায়ই সাধারণ বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতো তাদের।পৃথিশা ঝগড়া করতে পারতো না সংকোচে কিন্তু মারুফের উল্টা-পাল্টা কথায় রেগে-মেগে ছাদ থেকে চলে আসতো।তারপর আস্তে আস্তে কেমন করে যেন সম্পর্কের সমীকরণ পাল্টে যায়।মারুফের বাবা যাওয়ার পর মারুফ গম্ভীর আর রগচটা হয়ে যায়। মারুফ-পৃথিশার সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল এই ছাদে,সাময়িক বিচ্ছেদও এই ছাদেই।
পৃথিশা ছাদে উঠে মারুফকে ছাদের এক কোণায় মোবাইল টিপতে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায়।হাতের চা টা রেলিংয়ের উপর রেখে মারুফের দিকে এগিয়ে দেয়।মারুফের পৃথিশার না তাকিয়েই চা নিয়ে তাতে চুমুক দেয়।
পৃথিশা এক পলক মারুফের দিকে রেলিংয়ের বাহিরে পা ঝুলিয়ে বসে।দুই মিনিটের মধ্যেই চা শেষ করে মারুফ চলে যায়।পৃথিশা কিছু না বলে সেখানে পা ঝুলিয়ে সূর্য উঠা দেখতে থাকে।
আকাশের হাজারো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সূর্য ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুকে উঁকি দিচ্ছে। আকাশের আঁধার লুকিয়ে আলো বেরিয়ে আসতেই পৃথিশা খালি চায়ের কাপটা নিয়ে বাসায় চলে যায়।
নিজের রুমে ঢুকে পৃথিশা দৌড়ে নিজের ছোট বারান্দাটাতে চলে যায়।তার বারান্দায় কয়েক রকমের ফুলের গাছ আর সেই সাথে খাঁচায় থাকা একটা মেয়ে পায়রা।সাধারণত জোড়া পায়রা মানুষ পোষে।এই পায়রাটারও প্রথমে জোড়া ছিল কিন্তু পরে আলাদা হয়ে গেছে।পৃথিশার কাছে মেয়ে পায়রাটা আর মারুফের কাছে ছেলে পায়রা। পায়রা জোড়া মারুফই কিনে দিয়েছিল পৃথিশাকে।কিছুসময় পরই ছেলে পায়রাটা উড়ে এলো পৃথিশার বারান্দায়।পৃথিশা সাথে সাথে পায়রাটার পায়ে বেঁধে থাকা চিরকুটটা খুলে নেয়।
বারান্দা থেকে নিজের রুমে বোয়মে ভরে রাখে চিরকুটটি।এরকম আরো দুইটা বোয়ম ভর্তি চিরকুট আছে তার কাছে আর সবগুলোই মারুফের দেওয়া।নিজের মুখে অনুভূতিগুলো প্রকাশ না করে সেগুলো নিভৃতেই প্রকাশ করার অভ্যাস মারুফের।আর সেই অভ্যাসকেই পৃথিশা প্রচন্ড ভালোবাসে!
??
সকালের নাস্তার পর পৃথিশার মা এসে তাকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়। পৃথিশার হাত ভর্তি সাদা কাঁচের চুড়ি,পড়নে সাদা রঙের একটা শাড়ি আর চোখে গাঢ় করে কাজল দেওয়া।সুমিতা বেগম জোড় করেই তাকে এসব পড়িয়ে দিয়েছেন।পৃথিশা বারবার জিজ্ঞেস করার পরও কোন উত্তর দেন নি।অগত্যা বাধ্য হয়ে পৃথিশা মায়ের সাথে তাল মিলিয়েছে।
কিছুসময় পরই চাচাতো বোন আনিকা এসে পৃথিশাকে বসার ঘরে নিয়ে যায়।সেখানে মারুফ, রিনা খাতুন আর এক অপরিচিত মহিলা দেখে পৃথিশা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না ঠিক মতো।আনিকা তাকে মারুফের পাশে বসিয়ে দেয়।তাদের কথা-বার্তায় পৃথিশা বুঝতে পারে তারা আনুষ্ঠানিক ভাবে বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।কথা-বার্তা শেষে পৃথিশাকে একটা আংটি আর এক জোড়া চুড়ি পড়িয়ে দেয় রিনা খাতুন।
বড়রা যখন মিষ্টিমুখ করতে ব্যস্ত।সেই সময় পৃথিশার ডান হাত সবার আড়ালে চেপে ধরে মারুফ বলে উঠে,
-“বি রেডি পৃথিরানী,ফর বিয়িং মাইন!”
চলবে,,