খোঁজ পর্ব ৯

0
412

#খোঁজ ৯ম_পর্ব
লেখক মোঃ কামরুল হাসান

লিটুর কথাটা শুনে আমি ভাবতে লাগলাম, সে কি বোঝাতে চাইছে আমাকে? অদিতি নিখোঁজ নয়, পালিয়ে বেড়াচ্ছে!

তাও আবার আমাদের কাছ থেকে? সত্যি বলতে আমার ওর কথা শুনে এতো কষ্টের মাঝেও হাসি পাচ্ছে! আমার বিশ্বাস আর যাইহোক, অদিতির পক্ষে আমার সাথে এমন বেঈমানী করা কখনো সম্ভব নয়।

পুলিশ অদিতি কে রীতিমতো অক্লান্ত ভাবে খোঁজে যাচ্ছে। যে কোন সময় তার খোঁজ পাওয়া যাবে এটাই পুলিশের ধারণা। এমন সময় আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল। মিথিলার বাবার জন্য মুক্তি পণ দাবি করা হয়েছে। তাও আবার পঁচিশ লক্ষ টাকা! যা তাদের দ্বারা কখনো পূরণ করা সম্ভব নয়।

হঠাৎ করে এতোদিন পরে মুক্তি পণ দাবি করাতে পুলিশ কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেল। তারা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। যদি মুক্তি পণ দাবি করবেই তবে এতো দেরি করার কারণ কি?

আর তাদের দাবিটাও তো যুক্তিসঙ্গত নয়! তারা নিশ্চয়ই ভালো করে জানে মিথিলার পরিবারের পক্ষে এই দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে কি অপরাধীদের এটা একটা চাল! যাতে করে কেসের মোড়টা অন্য দিকে ঘুরে যায়? আর মুক্তি পণ তিন দিনের মধ্যে পরিশোধ না করলে।মিথিলার বাবাকে তারা মেরে ফেলবে।

সেই চিরকুটের মধ্যে একটা ঠিকানাও লেখা আছে। সেই ঠিকানা অনুযায়ী মিথিলাকে একা যেতে বলা হয়েছে। পুলিশ মিথিলার সাথে যোগাযোগ করে সবকিছু বুঝিয়ে বলে। তাদের প্ল্যান অনুযায়ী ঐ ঠিকানা মতো মিথিলা কাগজের নকল নোট ভর্তি ব্যাগ নিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হবে। আর অপহরনকারীরা যখন টাকাটা নিতে আসবে। তখন আগে থেকেই নিরাপদ দূরত্বে উৎ পেতে থাকা পুলিশ তাদেরকে কৌশলে বন্দী করে ফেলবে। এটাই পুলিশের কাছে সবদিক দিয়ে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে।

এদিকে এতো খোজাখুজি করেও অদিতির আর কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। পুলিশ এখন সন্দিহান! সেই দোকানির বর্ণনা অনুযায়ী অদিতির খোঁজ পাওয়া গেলেও তার বাস্তব কোন প্রমাণ তাদের হাতে নেই। তাই বলা যেতেই পারে লোকটা যার বর্ণনা দিয়েছে। সে অদিতি নাও হতে পারে? শুধুমাত্র একজনের মুখের কথার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া একেবারেই বুদ্ধিমানের মতো কাজ নয়।

তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো। সেই এলাকায় চিরুনি অভিযান চালিয়ে অদিতির খোঁজ করবে। ঠিক এমনি সময় মিথিলার বাবার জন্য মুক্তিপণ দাবি করা হয়। যার ফলে পুলিশের নজর সাময়িক ভাবে অদিতির উপর থেকে সরে গিয়ে সেখানে গিয়ে পড়ে।

তাদের ধারণা এই ব্যাপারটা সুরাহা করতে পারলে। অদিতির খোঁজ পাওয়াটা তাদের জন্য আরও সহজ হয়ে যাবে। আর অপহরনকারীও খুবই দূর্ত ও সতর্ক। এখনো পর্যন্ত তারা কোন প্রমাণ ছেড়ে যায়নি, যা দিয়ে তাদের নাগাল পাওয়া যাবে।

এমনকি মুক্তিপণের দাবিতেও তারা কোন রিস্ক নেয়নি। কোন মোবাইলের সাহায্য নেওয়া থেকে বিরত থেকে তারা চিঠির সাহায্য নিয়েছে। যাতে করে তাদের টিকিটিও পুলিশের লোকজন ছুঁতে না পারে। বর্তমানে মোবাইল ফোন ট্রেকিং করে অনেক সহজেই অপরাধীর কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। তাই হয়তো তারা এই পথ বেছে নিয়েছে।

আপাততঃ পুলিশ অদিতির ব্যাপারটা ভুলে মিথিলার বাবাকে উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তারা মিথিলা কে আগেই ব্যাগ ভর্তি নকল নোট দিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী পাঠিয়ে দিলো।

পুলিশের কয়েক জন লোক আগে থেকেই সেখানে পজিশন নিয়ে রেখেছে। সেই সমন্ধে মিথিলাও কিছু জানে না। মিথিলা সেই কলেজের পাশে ভাঙা বাড়িতে টাকা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে হাজির হলো। চারপাশে তাকিয়ে সে কাউকেই দেখতে পেলো না। সন্ধ্যা নামার আগে পর্যন্ত সে ওখানেই তার বাবাকে ফিরে পাবার আশায় অপেক্ষা করলো কিন্তু কেউ টাকা নিতে এলো না।

অবশেষে সন্ধ্যা নেমে এলে মিথিলা টাকা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। টাকা ভর্তি ব্যাগ বারান্দায় রেখে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে সে। দরজা লাগিয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় উপর ছেড়ে দিয়ে সে যখন ভাবছে, লোকগুলো তার সাথে এমন কেন করলো? তাদের তো কোনভাবেই বোঝার কথা নয় ব্যাগের ভেতর নকল নোট আছে! তবুও কেন তারা এলো না?

হঠাৎ এমন সময় মনে হলো বাইরে নকল নোট ভর্তি ব্যাগটা রেখে এসেছে সে। তাই তারাতাড়ি উঠে সেটা আনতে গিয়ে দরজা খুলে মিথিলা অবাক হয়ে যায়। সেখানে কোন ব্যাগ নেই! মিথিলা দ্রুত বাইরে বেরিয়ে দৌড়ে রাস্তার কাছে পৌঁছে দেখতে পেলো একজন মোটরসাইকেলের পিছনে টাকা ভর্তি ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সে বুঝতে পারে দৌড়ে গিয়ে কোন লাভ নেই। তার আগেই মোটরসাইকেল চলে যাবে। তাই নাম্বার দেখতে যাবে কিন্তু তাতে অন টেস্ট লেখা। আর মোটরসাইকেল আরোহী হেলমেট পড়ার কারণে চেহেরাটা আড়ালেই রয়ে গেল।

একটু পরেই পুলিশের এক লোক টাকার ব্যাগটা নিতে আসে। কিন্তু মিথিলার মুখে এমন কথা শুনে সে ফিরে যায়। পুলিশ মিথিলার আড়ালে লুকিয়ে কাজ করেছে। তাই তারা মিথিলার কাছ থেকে ব্যাগটা ইচ্ছে করেই নেয়নি। ভেবেছে রাস্তায় যদি কেউ ব্যাগটা ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে? তাহলে তাঁকে পাকড়াও করতে সুবিধা হবে।

তাই তারা একজনকে মিথিলার পিছনে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেই লোকটা যখন দেখলো মিথিলা বিনা বাধায় বাড়িতে প্রবেশ করেছে। তখন সে ভাবে এক কাপ চা পান করে পরেই না হয় ব্যাগটা নেওয়া যাবে। আর তার এই কিঞ্চিৎ ভুলের কারণেই টাকা নিয়ে লোকটা পলকের মধ্যে হাওয়া হয়ে যায়।

পুলিশ মিথিলার কথা অনুযায়ী সেই মোটরসাইকেল আরোহীর খোঁজ করতে মরিয়া হয়ে উঠে। তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেলেই সব রহস্যের জট খুলবে। অদিতির খোঁজও তখন নিশ্চয়ই জানা যাবে। পুলিশের এখনো ধারণা অদিতির নিখোঁজ হওয়ার পিছনে ও মিথিলার বাবার অপহরণের জন্য একজনই দায়ী!

তাই রাস্তার পাশের সকল দোকানের সি সি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করে দেখার নির্দেশ জারি করা হলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় মিথিলার বর্ণনা অনুযায়ী তেমন কোন মোটরসাইকেল আরোহীর কোন ফুটেজ পাওয়া গেল না।

এমন সময় তদন্ত অফিসার লিটুর কাছে একজন ফোন করে বলে, তারা যাকে খুঁজে চলেছে তার সন্ধান সে জানে। তার পরিচয় সে গোপন করে বলে, আকরাম খান এই সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী। তার পূর্ব ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই সব জলের মতো পরিস্কার হয়ে যাবে। আর এই আকরাম খান হচ্ছে স্বয়ং মিথিলার বাবা!

এই কথা বলে লোকটা ফোন কেটে দিলো। লিটু আমাকে ফোন করে একথা জানালো। আমি কথাটা শুনে ভীষণ আশ্চর্য হলাম। মিথিলার বাবার সাথে অদিতির এমন কি শত্রুতা থাকতে পারে? যার কারণে অদিতি কে তিনি কৌশলে জিম্মি করতে পারেন!

পুলিশ কোন তথ্য কে উড়িয়ে দিতে পারে না। তাই আকরাম খানের অতীত সমন্ধে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পারে, তিনি একসময় এলাকার নাম করা সন্ত্রাসী ছিলেন। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে এমন কোন অপরাধ নেই যে সে করেনি। কিন্তু গত দশ পনের বছর ধরে সে আর সেই সব কাজের সাথে জড়িত নয়। কিন্তু লোকে বলে সে সরাসরি কোন কাজে জড়িত না থাকলেও। তলেতলে কে কি করছে, তা তো বলা যায় না? লোকে বলে স্বভাব সহজে পাল্টে না। তার বেলায় ব্যাতিক্রম হবে এতোটা আশা করা হয়তো ঠিক নয়।

পুলিশও একটা জিনিস ভেবে দেখে মিথিলা হঠাৎ করেই মুক্ত হয়ে ফিরে এলো। তার বেলায় কোন মুক্তিপণ দাবি করা হলো না কেন? আর আকরাম খানের জন্য মুক্তিপণ দাবি করা হলেও সেটা অনেক পরে। এই জিনিসটা তাদের মনের মধ্যে প্রভাব ফেলে। কিন্তু আকরাম খান অদিতি কে কৌশলে অপহরণ করবে তার জন্য নিশ্চয়ই কোন কারণ লাগবে। কিন্তু সেই কারনটা কি? সেটা কিন্তু এখনো পুলিশের সামনে আসেনি।

আরেকটা বিষয় অদিতির জন্যও কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোন মুক্তি পণ দাবি করা হয়নি। এই বিষয় গুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন না কোন যোগসূত্র রয়েছে? কিন্তু কি সেই যোগসূত্র? সেটাই পুলিশ হঠাৎ করে পুলিশের হাতে এসে লাগলো। এক সময়ে আকরাম খানের বিশ্বস্ত সহচর ছিলো নিতাই। সে এখন শাস্তি হিসেবে যাবত জীবন জেলের ঘানি টানছে।

তদন্ত অফিসার তার সাথে কথা বলতে সেখানে গিয়ে পৌঁছালো। নিতাই বলে আকরাম খানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একসময় কেউ তার সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু স্যার সিংহও একসময় বুড়ো হয়ে যায়। তার তেজও কমে আসে। তখন তাঁকে সিংহাসন ছেড়ে দিতে হয় আরেক জনের জন্য।

আকরাম খানের বেলায়ও এর ব্যাতিক্রম হলো না। আসলাম নামে একজন তার জায়গা ধীরে ধীরে দখল করতে থাকে। একসময় যে আকরাম খানের শিষ্য হয়ে দলে আসে। সেই আসলাম একদিন দলের নেতা হয়ে উঠে। একটা খুনের মামলায় আসলাম আকরাম খানেকে ফাঁসিয়ে দেয়। যদিও পরে আকরাম খান নির্দোষ প্রমাণ হয়ে জেল হাজত থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ততদিনে আকরাম খানের অতীত শুধু অতীত হয়েই রইলো।

কেউ আর তাকে দেখে আগের মতো সমীহ করে না। আর এই আকরাম খানের মেয়ে মিথিলার সাথে একটা মেয়ে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। সেই বান্ধবীর সাথে আবার আসলামের গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা সময় আসলাম আর আকরাম খানের সাথে আবার সরাসরি শত্রুতার সূচনা হয়।

শুনেছি স্যার আসলাম কে আকরাম খান চড় মেরে ছিলেন। চড় খেয়ে আসলাম সরাসরি আকরাম খান কে হুমকি দিয়েছিলেন। মিথিলার সেই বান্ধবী কে আকরাম খান অনেক বুঝিয়েও আসলামের কাছ থেকে আলাদা করতে পারেনি। তারপর তাদের আর কি হয়েছে আমি আর বলতে পারবো না স্যার।

লিটু নিতাই কে জিজ্ঞেস করে, তবে আসলাম এখন কোথায়? নিতাই জবাব দেয় আমি আর কিছু জানি না স্যার। শুনেছি আসলাম কে কেউ মেরে গুম করে ফেলেছে! কথাটা কতটুকু সত্যি! সেটা আমি বলতে পারবো না, স্যার! তা আসলামের সেই প্রেমিকার কি নাম? এখন আর মনে করতে পারছি না। এই বলে নিতাই কাশতে কাশতে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে চায়। তাই দেখে লিটু বলে, আচ্ছা ঠিক আছে।

পরে দরকার হলে আবার আসবো। আপনি এখন শান্ত হয়ে বসুন গিয়ে।

এর পরের দিন আবার সেই লোকটা ফোন করলো। খুব দ্রুত সে বলে গেলো। আকরাম খান অদিতি নামের মেয়েটাকে নিয়ে একট বাড়িতে লুকিয়ে আছে। সেখানে এখনই গেলে তাদেরকে খোঁজে পাবেন। কক্সবাজারের রামু তে একটা নির্জন বাড়িতে আছে তারা। সাথে আরও লোক থাকতে পারে।

পুলিশ ঠিকানা অনুযায়ী সেই বাড়ির সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। দরজাটা ভিতর থেকে শক্ত করে লাগানো। পুলিশের লোকজন বাড়িটাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আকরাম খান কে দরজা খোলার জন্য অনেক অনুরোধ করা হলো। কিন্তু তিনি এসে দরজা খুলে দিলেন না।

তখন পুলিশ বাধ্য হয়ে দরজা ভাঙার আদেশ দিলো। কয়েকজন মিলে প্রচন্ড শক্তিতে দরজায় আঘাত করে দরজাটা ভেঙে ফেললো।

আর দরজা খুলে যেতেই পুলিশ দেখতে পেলো আকরাম খান একটা পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে রক্তে মাখামাখি অবস্থা। সামনেই পড়ে আছে একটা মহিলার লাশ! মহিলার মুখে অনেক বারবার আঘাত করা হয়েছে। যার কারণে মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে আসলে কে এই মহিলা কিন্তু পুলিশ পড়নের কাপড় দেখে বুঝতে পারলো এটাই অদিতির লাশ!

আকরাম খান কে গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু বারবার সে নিজেকে নির্দোষ দাবী করতে লাগলো। চিৎকার করে বলতে লাগলো অদিতি কে আমি কিছু করিনি। আপনারা দয়া করে বিশ্বাস করুন। কিন্তু তার সেই কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারলো না।

তিনি যেহেতু ঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন খুনটা আর কে করবে?

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here