খড়কুটোর বাসা পর্ব ১০

0
1124

#খড়কুটোর_বাসা
#পর্বঃ১০
#Jhorna_Islam

বর্তমানে ইরহান ও যুথি একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
যুথি ঘরটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলে উঠে,, বোকা পুরুষ এটা তো,,,, আর কিছু বলার আগেই ইরহান বলে উঠে,, এটা তোমার আর আমার নতুন ঠিকানা।

ইরহান যুথির পাশে নিজের ব্যাগ টা রেখে দেয়। তারপর যুথির হাত টা আলগোছে ছেড়ে দিয়ে ঘরের দরজার পাশে এগিয়ে যায়।

দরজার পাশে বসে পরে।কাঠের দরজার চৌকাঠের নিচ দিয়ে যে ফাঁকা জায়গা টা আছে সেইখান দিয়ে হাত টা একটু ভিতরে ঢুকায়।

যুথি চুপচাপ ইরহানের কাজ দেখছে।

ইরহান হাত দিয়ে দরজার নিচ থেকে কিছু একটা বের করে এনেছে। খুবই ছোট একটা জিনিস।যুথি বুঝতে পারলো না কি সেটা।ইরহানের হাতের দিকে তাকিয়ে মাথা উচিয়ে দেখার চেষ্টা করলো জিনিস টা কি।

যুথির উঁকি ঝুঁকি দেখে ইরহান নিজেই তার হাতে রাখা জিনিস টা যুথির সামনে তুলে ধরে ব্রু উচায়।

একটা ছোট চাবি।

বোকা পুরুষ কিসের চাবি এটা?

তোমার আর আমার খড়কুটোর বাসার চাবি এটা বুঝলে।

এই ঘরের চাবি?

হুম।

তারপর ইরহান চাবি দিয়ে খুব দ্রুত তালা টা খুলে ফেলে।দরজা না খুলেই পিছনে ফিরে যুথির দিকে তাকায়। তারপর কিছু একটা ভেবে বলে,,আমি দুই মিনিটে আসছি তুমি একটু দাঁড়াও যুথি রানী।এখানেই দাড়াবে ঘরে ঢুকবে না কিন্তু।

যুথি ইরহান কে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।

ইরহান কয়েক কদম গিয়ে ও আবার ফিরে তাকিয়ে বলে,, তুমি আবার ভ’য় পাবে না তো যুথি রানী?

ইরহানের কথায় যুথির মুখে হাসি ফোটে উঠে। আরে বোকা পুরুষ আপনি যান।আমি একটুও ভ’য় পাবো না। আপনার যুথি রানী এতো ভিতু না।

ইরহান একটা হাসি দিয়ে চলে যায়।

যুথি ইরহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আশে পাশে চোখ বোলায়।রাত প্রায় অনেক হয়েছে এদিক টাতে একটু অন্ধকার এতো সময় ইরহানের মোবাইলের আলো জ্বালানো ছিলো তাই সব দেখা গেছে। অন্ধকার দেখেই হয়তো তার বোকা পুরুষ টা ভেবেছে সে ভ’য় পাবে।

বেশি সময় অপেক্ষা করায়নি ইরহান।কিছু সময় পর ই ফিরে এসেছে। তবে এখন আর ইরহানের হাতের মোবাইলের আলো নেই।অন্ধকারে হালকা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ইরহানের হাতে কিছু একটা আছে। কিছু একটা এনেছে সে।তবে যুথি বুঝতে পারলো না ইরহান কি আনতে গিয়েছিলো।

আপনার হাতে কি বোকা পুরুষ?

আমার রানী কে তার খড়কুটোর রাজত্বে বরণ করার জন্য কিছু একটা। এখনই দেখতে পাবে।

আমি কিন্তু একটু একটু ধারণা করতে পারছি কি হাতে।মিষ্টি ঘ্রান টা কিন্তু নাকে লাগছে।

ইরহান যুথির কথার প্রতি উত্তরে কিছু না বলে,,দরজাটা কাধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকে যায়।

যুথিও ইরহানের পিছন পিছন এগিয়ে গিয়ে ঘরের ভিতর পা রাখবে ঠিক সেই মুহূর্তে ইরহান বলে উঠে,,, যুথি একমিনিট ঢুকো না।যুথি ইরহানের কথায় ভরকে যায়। (লেখিকা ঝর্ণা ইসলাম) কি করতে চাইছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

তার মধ্যে হুট করে চোখের সামনে আলো জ্বলায় যুথি চোখ মুখ কোচকে ফেলে। তারপর কিছু টা স্বাভাবিক হয়ে চোখ পিটপিট করে তাকায়।ইরহান ঘরে বাতি জ্বালিয়েছে।

তারপর ইরহান যুথির সামনে এসে দাঁড়ায়। ইরহানের হাত ভর্তি বকুল ফুল।ফুলের মিষ্টি ঘ্রান এসে নাকে বারং বার বারি খাচ্ছে।

“এই ছোট্ট খড়কুটোর বাসা তে তার রানী সাহেবা কে স্বাগতম। ”

ফুল গুলো ছিটিয়ে ইরহান যুথির উপর ফেলে তারপর বলে,,ভিতরে প্রবেশ করুন আমার গরিব রাজ্যের রানী সাহেবা। বলে হাত বাড়িয়ে দেয়,,,,,

যুথি মুচকি হেসে ইরহানের হাতটা ধরে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে।

প্রথম বার তো কিছুই করতে পারলাম না তোমার জন্য। তাই একটু ছোট্ট প্রয়াস চালালাম।

এটা ছোট্ট না বোকা পুরুষ। এটা আমার কাছে মহামূল্যবান।

যুথি ঘরের চার পাশে সব কিছু দেখতে থাকে।দুই রুমের ছোট্ট একটা দু-চালা ঘর। এই টা সেই ঘরটাই যেটা এই বাড়িতে ঢুকতে সর্বপ্রথম যুথি দেখেছিলো। কে জানতো এটাই যে তার ঠিকানা হবে?

ঐ বাড়িটা এই ঘর থেকে বেশ দূরে। এটা গেটের কাছাকাছি আর ঐটা অনেক টা ভিতরে। তবে এই ঘর উল্টো মুখি করে করা।এই ঘরের পিছন দিয়ে ঐ ঘরে যাওয়ার রাস্তা। এটা একটা ভালো ব্যাপার।ঐ লোক গুলো যাওয়া আসা দেখতে হবে না।

ঘরের ভিতর সংসারের প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস ই আছে দেখা যায়। ছোট ছোট হাড়ি পাতিল ও আছে। দুই জন বা তিনজনের সংসারের জিনিস পত্র।

সব কিছু খুব সুন্দর করেই সাজিয়ে রাখা। তবে অনেক দিন মনে হয় কেউ প্রবেশ করে নি তাই ধুলোবালি জমে আছে।

যুথি সব কিছু দেখার মাঝেই হুট করে হাতে টান অনুভব করে। ইরহান যুথির দিকে তাকিয়ে বলে,,, যুথি এটা আমার মায়ের ছোট্ট সংসার ছিলো। এই ঘরটায় আমার মায়ের ছোয়া রয়েছে।

আমার বাবা মায়ের ভালোবাসার সংসার ছিলো এই ঘরটায়।আমার ছোটোবেলা কেটেছে এখানে। আমরা তিনজন এখানে থাকতাম।আমার মা তার যত্ন ভালোবাসা দিয়ে এই ঘরটা সাজিয়ে ছিলো।এসব জিনিস পত্র আমার মায়ের করা।

বাবা যখন মা কে বিয়ে করে তখন বাবা তেমন কোনো কাজ করতো না।ছোট খাটো কাজ করে দুইজনের সংসার চালাতো।দাদা দাদি বাবার বিয়ের আগেই মা’রা গেছে। আত্নীয় স্বজন রা জোর করে বাবা কে মায়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়।নয়তো কে দেখবে বাবা কে? তেমন কেউ ছিলো না বাবার খেয়াল রাখার। আত্নীয় রা তো আর বাবার জন্য সব ছেড়ে এখানে পরে থাকবে না।আর বাবা কে যে ওদের সাথে নিয়ে যাবে সেই সামর্থ্য ও ছিলোনা।তখন সময়টা ই এমন ছিলো সকলের অভাবের সংসার। একজন মানুষ মানেই অনেক খরচা তার খাওয়া পড়ার।

তাই সকলে ভেবে চিন্তা করে মাকে পছন্দ করে বাবার সাথে বিয়ে দেয়।বাবা রাজি হতে চায় নি কারণ সে তখনো তেমন কোনো কাজই করতো না। কি খাওয়াবে বিয়ে করে? এক বেলা খাবার দিতে পারলে পরের বেলা দিতে পারবে কি না সন্দেহ তাই জন্য। পরে সকলের জোরাজোরি তে অবশেষে মা কে বিয়ে করে ঘরে আনে।

আমার মা তারপর বাবার পাশে থেকে হাতে হাত রেখে এই সংসারটার হা’ল ধরে।সব কিছু করে।বিয়ের কিছু দিন খুব কষ্টে পার করে দুইজন। তারপর বাবার কাজ হয়।দিন ঘুরতে থাকে।ভালো সময় আসতে থাকে। তখনই জানতে পারে আমার পৃথিবীতে আসার খবর।

বাবার হাতে টাকা হয়।ঠিক করে ছোট্ট দু-চালা ঘর থেকে চৌচালা ঘর দিবে। কিন্তু মা এই ঘরটা ভাংতে দেয়নি।যেহেতু বাড়িতে অনেক জায়গা আছে তাই বলেছে অন্য দিকে তুলতে এটা যেন না ভাঙে।এটা তার এই বাড়িতে আসার প্রথম স্মৃতি। কতো ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। নতুন ঘরে বেশি দিন থাকতে পারে নি মা তার আগেই,,,

কথাটা বলতে গিয়ে ইরহানের গলা টা ধরে আসে।

যুথি এগিয়ে এসে ইরহানের কাঁধে হাত রাখে। ইরহান যুথির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করে,,

বাবা মা কে অনেক ভালোবাসতো।আমার জন্য শুধু ঐ মহিলা কে বিয়ে করেছিলো।আমি তখন একা বাবা কাজে চলে গেলে আমাকে দেখার কেউ ছিলো না। তাই করেছে।বাবা থাকতে ঐ মহিলা কি যে ভালো ছিলো। তবে আমার ব্যাপারে সব সময় উদাসীন ছিলো কাউকে সেটা বুঝতে দিতো না। আমিও বলিনি ভেবেছি সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন ঠিক ভালোবাসবে। বাবা আমাকে প্রায় ই জিজ্ঞেস করতো উনি কেমন খারাপ ব্যবহার করে কিনা।আমি তখন বলতাম অনেক ভালো আমাকে খুব ভালোবাসে আদর করে। আমি এগুলো ই কল্পনা করতাম উনাকে নিয়ে। সেই কল্পনা থেকেই খুবই গভীর ভাবে কথা গুলো বলতাম।তাই বাবা ও ভেবেছে সত্যি বুঝি সব। হাহ্ বাদ এসব কথা।

এখন যে ঘর টা তুলেছেনা? ঐটার সামনেই ছিলো চৌ-চা’লা ঘর টা। ঐ ঘরের পিছন দিয়ে জায়গা কিনে ঘরটা তৈরি করা হয়েছে। আর বাবার বানানো চৌ-চা’লা টা ভেঙে ফেলে ঐখানে উঠুন বানানো হয়েছে।

মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ও এই ঘর টা ভাংতে দেয়নি। মায়ের হাতের সব জিনিস পত্র এই ঘরে সব যত্ন সহকারে রেখে দিয়েছে। নিজে সব কিছু পরিষ্কার করে রাখতো। তালা দিয়ে রাখতো কাউকে ঢুকতে ও দিতো না।আমি ছাড়া।

কে জানতো আমার মায়ের রেখে যাওয়া সেই ছোট্ট সংসার টা ই এখন আমাদের হবে? আমি বিদেশে যাওয়ার আগে সব পরিষ্কার করে রেখে গিয়েছিলাম।পরশুদিন ও ঢুকেছি।কিছু কিছু পরিষ্কার করলেও সব করা হয়নি।ধুলো বালি লেগে আছে।

আরে বোকা পুরুষ যুথি থাকতে চিন্তা কিসের? যুথি নিজের ওড়না টা কোমড়ে ভালো করে বেঁধে কাজে লেগে পরে।

সবকিছু ঝেড়ে ঝুড়ে পরিষ্কার করতে থাকে।

ততক্ষণে ইরহান তাদের ব্যাগের ভিতর থেকে একটা বিছানার চাদর বের করে।যুথিকে নিতে দেখেছিলো সে চাদর টা। হয়তো ভেবেছে রাস্তাতেই থাকতে হবে তাই নিয়েছিলো।ইরহান হাতে চাদর টা ধরে হাসে।

রুমে একটা আলমারি রয়েছে বেশ মজবুত ও দামি কাঠের তৈরি বোঝাই যায়। রুমে রাখা চৌকি টা ও আলমারির কাঠের তৈরি। যুথি বুঝতে পারলো।

ইরহান চাদর টা এনে বিছানায় বিছাতে গেলে যুথি টেনে নিয়ে যায় বলে,,আপনাকে কিছু করতে হবে না আমি একাই করতে পারবো।

মোটেও না আমি জ’ল’জ্যা’ন্ত মানুষ টা উপস্থিত থাকতে আমার বউ কে সব কাজে আমি সাহায্য করবো।

কেন? আমি একাই করতে পারি।

তোমার কথা কে শুনে? আমি তোমাকে সাহায্য করবো এর উপরে কোনো কথা হবে না।

তারপর আর কি সব কিছু দুইজন মিলে মিশে করে ফেলে।

আজকের জন্য আপাতত যা বেশি দরকার তা শেষ। দুইজনেই হাফ ছাড়ে। যুথি কোমড়ে বাঁধা ওড়না টা খুলে ফেলে।ইরহানের দিকে তাকিয়ে দেখে ইরহানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। যুথি এগিয়ে গিয়ে যত্ন সহকারে কপালের ঘাম টুকু ওড়না দিয়ে মুছে দেয়।

ইরহান যুথির দুই গালে হাত রেখে বলে,, আমি তোমার জন্য তেমন কিছুই করতে পারলাম না যুথি।তোমার কোথায় থাকার কথা ছিলো অথচ,,,,,
তোমাকে শ্বশুর বাড়ির যোগ্য সম্মান টুকুও দিতে পারলামনা।এই পুরনো ভাঙা ঘরে থাকতে হবে।।

এখন একটু মানিয়ে নাও।সব ঠিক হয়ে যাবে। এই ছোট্ট ঘরটায় কখনো ভালোবাসার অভাব হবে না। আর একদিন ওদের থেকে ও বড় বাড়ি করবো ইনশাআল্লাহ। সেই বাড়ির একমাত্র মালকিন হবে আমার যুথিরানী।এখন যেমন এই ছোট্ট ঘরের রানী সে।

যুথি ইরহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,,,,,,,,

” ও আমার বোকা পুরুষ গো!
আমার লাগি খড়কুটো দিয়ে বাঁধিলা তুমি ঘর!
জোসনার আলো গায়ে মেখে, তোমার বু’কে মাথা রেখে,,
কাটিয়ে দিবো সেথায় আমি জনম ভর! ”

#চলবে,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here