ক্লিওপেট্রা পর্ব- ০৩

0
282

ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৩

ক্লিওপেট্রা!
নামটা শুনে বুকটা ধ্বক করে উঠল কেন যেন। ক্লিওপেট্রা! মেয়েটার নাম কি তবে ক্লিওপেট্রা?
আর কিছু ভাবার সুযোগ পেলাম না। দু চোখে আঁধার নেমে এল।

রোজ সকালে ঠিক আটটায় আমার ঘুম ভাঙ্গে। হয় মায়ের ডাকে। নয়তো এলার্মের শব্দে। হঠাৎ ব্যাতিক্রম হলো কেন জানিনা। আজ ভোর হতেই জেগে গেলাম। উঠে দেখি বরাবরের মতো মেয়েটা উধাও।
গতকাল সারাদিন পেটে কিছু পরেনি। খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। তাই আর দেরি করলাম না। রাগ বিসর্জন দিয়ে জলদি ব্রাশ করে খেতে চলে গেলাম। রান্নাঘরে ঢুকে দেখি মা রুটি বেলছে। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করল। মায়ের রাগটা এখনো পড়েনি। টেবিলে গিয়ে বসতেই অহনা প্লেটে করে রুটি – ভাজি নিয়ে এল। আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা তোকে খেয়ে বিদেয় হতে বলেছে।’

আমি বললাম, ‘এত সকালে কই যাব? আজ তো শুক্রবার। অফিসও নেই!’

অহনা ঝাড়ি দিয়ে বলল, ‘সেটা আমরা কীভাবে বলবো!’

আমি খেয়ে আমার শোবার ঘরে চলে এলাম। ওয়ালেটটা পকেটে ভরে শার্টটা বদলে ঘর থেকে বেরোলাম। খাবার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় শুনলাম মা আর অহনা খেতে খেতে আমার ব্যাপারে কিছু একটা বলছে। কান পাততেই শুনতে পেলাম মা বলছে, ‘আহান এমন একটা কান্ড ঘটালো আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার ছেলেটা তো অমন নয়! আমার মনে হচ্ছে মেয়েটাই ডাইনী। ওই ডাইনীই আমার সহজসরল ছেলেটাকে ফুসলিয়ে…! ‘

অহনা মায়ের কথা পুরো শেষ করতে দিল না। ‘আচ্ছা মা তোমার ছেলে কি কঁচি খোকা যে ওকে ফুসলিয়ে যেকোনো মেয়ে ওর বেডরুমে ঢুকে পড়বে?’

‘যেকোনো মেয়ে বলছিস কেন? বল ওই ডাইনীটা। ওই ডাইনীটা নিশ্চয়ই ওমন ধরনের মেয়ে। তাই আমার ছেলেকে বোকা পেয়ে!’

‘চুপ করো তো, মা! তোমার কথা আমার অসহ্য লাগছে। তোমার ছেলে যে কত দুধে ধোঁয়া তুলশী পাতা তা তো সেদিনই টের পেলাম।’

মা অহনার হাত ধরে বলল, ‘আচ্ছা তুইই বল। তোর ভাইটা কি অমন?’

অহনা কিছু বলল না। চুপ করে রইল।

আমি আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। বাইরে বেরিয়ে এলাম।

দু’ঘন্টা যাবৎ এখানে সেখানে ঘুরছি। কিছুই ভালো লাগছে না। আচমকা মনে পরল অহনার লিপস্টিক খুব পছন্দ। ও যদি আমাদের ফ্ল্যাট থেকে পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিদের বাসায়ও যায় তবুও লিপস্টিক দেবেই। লিপস্টিক আর অহনা একে অপরের বেস্টফ্রেন্ড।
তাই ঘুরতে ঘুরতে মার্কেটে ঢুকে পড়লাম। একটা কসমেটিকসের দোকানে গিয়ে তাদের সাজেস্ট করা ব্রান্ডের এক ডজন লিপস্টিক কিনে ফেললাম। ওরা বেশ সুন্দর করে প্যাকেজিং করে দিল। আমি বললাম প্যাকেটের উপরে বড় করে ‘টু মাই এডোরেবল সিস্টার’ লিখে দিতে। ওরা তাই করল। আমার বোন খুশিতে নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক করবে এতগুলো লিপস্টিক পেয়ে।
মার্কেট থেকে বেরোনোর সময় শাড়ির দোকানে চোখ পরল আমার। মায়ের জন্যও একটা ঘিয়ে রঙের শাড়ি নিয়ে নিলাম। ঘিয়ে মায়ের পছন্দের রঙ।

কেন জানিনা হঠাৎ আমার ওই মেয়েটার কথা মনে পরল। আচ্ছা মেয়েটা কি এতটাই গরীব যে শরীরে কখনো কাপড় থাকে না! আমার ইচ্ছে করল মেয়েটার জন্য কতগুলো শাড়ি কিনে নিয়ে যেতে। দোকানিকে একটা শাড়ি দিতে বলতেই বলল, ‘কোন কালার নিবেন ভাইজান?’

‘যেকোনো একটা দিয়ে দিন তাহলেই হল।’

‘যার লাইগা নিবেন তার বয়স কেমন?’

‘একুশ-বাইশ হবে বোধহয়! ‘

‘গায়ের রঙ কি ভাইজান?’

‘সাদা ফর্সা। এত কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না। যেকোনো একটা শাড়ি দিয়ে দিন।’

দোকানি আমার কথার কোনো পাত্তাই দিল না। একটা লাল শাড়ি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখেন তো এই শাড়িটা কেমন? তারে মানাইবো? ‘

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। এবার প্লিজ দয়া করে প্যাকেট করে দিন। আমি চলে যাই।’

বিকেলে মা নিজে থেকেই আমার সঙ্গে কথা বলল। আমি বই পড়ছিলাম। মা এসে বলল, ‘কাল সময় করে একবার ওই মেয়েকে এ বাড়িতে নিয়ে আসিস তো।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘আমি তাকে কোথায় পাবো মা?’

মা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো। ‘সেটা তো আমার দেখার বিষয় না। আমি আনতে বলেছি তুই আনবি।’

বলে মা এক মুহূর্তও দেরি করল না। চলে গেল।

রাতে ডিনারের সময় খাবার টেবিলে বসেই কথাটা তুললাম। ‘মা তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনেছি। তোমার ঘরে রেখে এসেছি। পছন্দ হয়েছে কি না আমাকে জানিও।’
মা কিছু বলল না। অহনাকে বললাম, ‘তোর প্যাকেটটা পেয়েছিস? তোর ঘরের ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা।’

অহনা মুখ বাঁকাল। ‘ঢং! অতগুলো লিপ্সটিক কে আনতে বলেছে তোকে?’

অহনা মুখে এসব বললেও ও যে ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হয়েছে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।

রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট। আজও ঘুম আসছে না আমার। যেদিন থেকে ওই মেয়েটার আগমন ঘটেছে ঠিক সেদিন থেকেই ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি। অকস্মাৎ কেউ একজন এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। চমকালাম না। কারণ আমি জানি কে হতে পারে।

আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠে বসলাম। বললাম, ‘কাল পুরো কথা শেষ না করে কোথায় চলে গিয়েছিলে?’

মেয়েটা বলল, ‘আমি কোথাও যাইনি আহান। তুমিই ঘুমিয়ে পড়েছিলে!’

আমি বললাম, ‘পরিষ্কার করে বলো তো তুমি কে?’

‘আমি ক্লিওপেট্রা। তোমার ক্লিওপেট্রা। ‘

আজও আমি আমার পুরো কথা শেষ করতে পারলাম না। তমিস্রায় তলিয়ে গেলাম। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ মূহুর্তে শুনতে পেলাম মেয়েটা বলছে, ‘তোমার বুকের বাম পাশটায় হাত রাখলেই তুমি এমন অজ্ঞান হয়ে যাও কেন বলো তো! ‘

পরেরদিন অফিস থেকে ফিরতেই মা আবার রাগারাগি শুরু করে দিল। ‘তোকে না কালকে বললাম মেয়েটাকে নিয়ে আসতে?’

আমি সোফায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘মা তোমাকে আর কতবার বলবো আমি ওই মেয়েকে চিনিনা! মাঝরাতে আসে। আবার সকাল হতে না হতেই উধাও হয়ে যায়।’

‘কেন ওই মেয়ে কি ভূত না কি পরী যে তোকে দেখা দিয়েই উধাও হয়ে যায়?’

‘সেটা তো ওই মেয়েই বলতে পারবে মা।’

মা টিভি দেখছিল। হঠাৎই রিমোটটা আছড়ে ভেঙে চলে গেল।
রেগে গেলে ভাঙ্গচূড় করা মায়ের অভ্যেস। আমি আর অহনা ছোটো বেলা থেকেই এতে অভ্যস্ত। তাই তেমন প্রতিক্রিয়া ঘটল না আমার মনে।

সন্ধ্যেবেলা মা ব্যাগ গুছিয়ে অহনাকে নিয়ে নানার বাড়ি চলে গেল। মা’র না কি আমার মুখ দর্শন করতেও ঘৃণা লাগে এখন। তাই কিছুদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যাবার আগে মিথিকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেল। আমি কত করে বললাম অন্তত ওকে রেখে যেতে। মা শুনলো না।

আজ সারারাত আমার বিন্দুমাত্রও ঘুম হল না। আশ্চর্যজনকভাবে মেয়েটাও এলো না আজ। আমি ভীষণ রকম অবাক হলাম।

এক সপ্তাহ যাবৎ আমি ছাড়া আর কেউই বাসায় নেই। মেয়েটাও আসেনি এ’কদিন।

প্রায় দু’সপ্তাহের পর মা, অহনা, মিথি ফিরে এল। মিথি ফিরে এসেই দৌড়ে আমার কোলে চলে এল। আমাকে মিস করেছে নিশ্চয়ই! আমারও ওর কথা রোজ অনেকবার করে মনে পড়েছে।
মা, অহনা নানার বাড়ি বেড়িয়ে আসাতে একটা উপকারই হলো। ওরা একদম স্বাভাবিক আচরণ করছে। যেন আমাদের মাঝে কোনো ঝঞ্জাটই হয়নি।

আমাকে অবাক করে দিয়ে আজ রাতে আবার মেয়েটা এল। মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি আমার পাশে শুয়ে। আমি ওকে জাগাই। মেয়েটা বিরক্ত হয় না। হাসিমুখে বলে, ‘কিছু বলবে আহান?’

আমি উত্তর দেই, ‘হ্যাঁ। এতদিন আসোনি ঠিক আছে। আজ আবার এসেছো কেন?’

মেয়েটা মৃদু হাসে। ‘তুমি কী রাগ করেছো আমি এতদিন আসিনি বলে?’

‘মোটেও না। আমি কেন রাগ করতে যাব!’

তারপর আবার বললাম, ‘তুমি কোথায় থাকো? তোমার পরিচয় কী?’

‘আমি ক্লিওপেট্রা আহান। তোমার ক্লিওপেট্রা। তুমি কি এখনো আমাকে চিনতে পারছো না!’

আমি মাথা নাড়লাম। ‘ না। আমি তোমাকে চিনতে পারছি না।’

মেয়েটি বোধহয় আশাহত হল। ডিম লাইটের আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম তার নিরাশ মুখখানা।

মেয়েটি উঠে বসতে বসতে বলল, ‘তুমি আমার জন্য যে জিনিসটা এনেছো সেটা দিলে না? ‘

আমি চমকে উঠলাম। মেয়েটা কি করে জানল আমি ওর জন্যে শাড়ি এনেছি!

ও আবার বলল, ‘ এত অবাক হচ্ছো কেন? আমি সব জানি।’

আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আর কী জানো তুমি?’

‘তোমার অফিসের একটা মেয়ে তোমাকে পছন্দ করে। সে গতকালকে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। তুমি আমার হাত থেকে বাঁচতে তাকে বিয়ে করে নিতে চাইছো। কারণ তোমার মা তোমাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চান।’

আমি বিস্ময়ের সপ্তম চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। মেয়েটা এগুলো কীভাবে জানলো! আমি তো কথাগুলো এখনো কাউকেই বলিনি! এমনকি আমার মাকেও না!

মেয়েটা আমার গালে ওর হাত রাখল। ‘আহান! তুমি যদি মেয়েটার ভালো চাও তবে ওর থেকে দূরত্ব বজায় রাখো। এতেই তোমার মঙ্গল।’

আমি শিউরে উঠলাম। ও কি আমাকে হুমকি দিচ্ছে?

চলবে…

লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

(আপনাদের রেসপন্স আশা করছি। আশানুরূপ সাড়া পেলে পরের পর্ব আরো জলদি লিখে ফেলব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here