ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০২
খোলা জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকে ঘরটাকে হিমশীতল করে তুলেছে। গায়ে একটা সুতোও না থাকায় ঠান্ডায় মেয়েটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। হঠাৎই ওর জন্য কেমন মায়া অনুভব করলাম আমি। সাদা লেপটা ওর গায়ে আলতো করে জড়িয়ে দিলাম। ও ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। আমার ওর মুখটা ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করল। আমি উঁকি মারলাম ওপাশটায়। এই প্রথম ওর চুল আমার নজর কাড়ল। কাঁধ অব্দি ঘন কালো চুল। কিছু চুল মুখে লেপ্টে আছে। আমি হাত দিয়ে সেগুলো ওর কানের পাশে গুঁজে দিলাম। ও মৃদু নড়ে উঠল। আর আমার টনক নড়ল। এসব আমি কী করছি! এত বড় মোক্ষম সুযোগটাকে আমি এসব করে নষ্ট করছি! আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করলাম না।
ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নামলাম। নিঃশব্দে বেডরুমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আবার দরজা লাগিয়ে দিলাম। যাতে মেয়েটা সুযোগ পেয়ে পালাতে না পারে। মা’কে, অহনা’কে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম একটা জিনিস দেখাবো বলে। মা, অহনা তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। অহনা চিৎকার – চেঁচামেচি করতে লাগল। ‘এই রাত দুটোর সময় তুই আমাদের কোন আক্কেলে ঘুম থেকে ডেকে তুললি ভাইয়া? ‘
আমি বললাম, ‘আরে চুপ করে আয় তো। তোদের একটা ম্যাজিক দেখাব!’
মা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি। এই আটাশ বছর বয়সে এসে উনি আমাদের পাঁচ বছরের বাচ্চাদের মতো ম্যাজিক দেখাবেন।’
আমি কারো কথাই কানে তুললাম না। কিছুক্ষণ পরে কী হতে যাচ্ছে ভেবে উত্তেজনায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মা বলল, ‘কী হল? খুলছিস না কেন দরজা?’
আমি দরজা খুললাম। ডিম লাইটের আবছা আলোয় দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরের কিছু স্পষ্ট দেখা গেল না। আমি সুইচ চেপে আলো জ্বালালাম। মেয়েটা লেপ গায়ে বাকা হয়ে শুয়ে আছে। ওকে দেখে বিস্ময়ে মা’র আর অহনার মুখ হা হয়ে গেল। মনে মনে ওরা কী ভাবছে কে জানে!
হঠাৎই মা ‘আল্লাহ গো’ বলে জোরে চিৎকার দিল। আচমকা অজ্ঞান হয়ে গেল। আমি দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম। অহনা মা’কে নিজের কোলে শুইয়ে দিয়ে ডাকতে লাগল। ‘মা! মা! চোখ খুলো।’
আমি মায়ের হাত ধরে বললাম, ‘কী হল মা! মা গো তোমার কী হল!’
অহনা এক ঝটকায় আমার কাছ থেকে মায়ের হাত সরিয়ে নিল। আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তুই ছুবি না আমার মাকে! খবরদার! তোর মতোন নোংরা ছেলে যেন আমার মাকে না ছোয়!’
আমি ওর কথার পাত্তা না দিয়ে দৌড়ে পানি আনতে চলে গেলাম। ফিরে আসতেই অহনা ছো মেরে আমার হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে নিল। মায়ের মুখে পানির ছিটা দিতেই পা পিটপিট করে চোখ খুলল। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে যেতে বলল। আমি মায়ের কাছে গেলাম। মা অহনাকে ধরে উঠে বসল। বসেই ঠাস করে আমার গালে চড় মেরে দিল। লজ্জায় আমার ইচ্ছে করল মাটির নিচে ঢুকে যেতে। এই বয়সে এসেও মায়ের হাতে মার খাচ্ছি।
মা হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল, ‘কোন কুলাঙ্গারকে পেটে ধরেছি আমি! এতদিন ভাবতাম আটাশ হয়ে গেল ছেলের বাচ্চামি এখনো যায়নি! আর আমাদের চোখে ধূলো দিয়ে তলে তলে এত কিছু! ছি ছি ছি। পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি যদি একবার জানতে পারে পুরো ঢাকা শহর ছড়িয়ে যাবে এ খবর। হায় আল্লাহ! এগুলো দেখার জন্য তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছো!’
আমি মাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘মা তুমি এসব কী বলছ? আমার কথাটা তো শুনবে একটাবার!’
অহনা চেঁচিয়ে বলল, ‘কী শুনবে মা? তুই শোনার মতো আর কী বাকি রেখেছিস? রাত-বিরেতে একটা পরনারী তোর বিছানায়…ছিহ!’
আমি অনুরোধের স্বরে বললাম, ‘আমার কথাটা তোরা বিশ্বাস কর প্লিজ! ওই মেয়েকে আমি চিনি না!’
মা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসল। ‘দেখ ছেলে কী বলছে! ওর বেডরুমে শুয়ে। আর ও না কি চেনেই না!’
আমি হাত জোড় করে বললাম, ‘মা প্লিজ আমাকে বিশ্বাস কর! ওই মেয়ে গত তিনদিন যাবৎ রোজ মাঝরাতে কোত্থেকে যেন উদয় হয়। আর আমি ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি আমার পাশে শুয়ে। তাইতো তোমাদের ঘটনাটা জানানোর উদ্দেশ্যে নিয়ে আসলাম!’
আমার কথা শেষ না হতেই অহনা মা’কে বলতে লাগল, ‘মা তুমি ওর কথায় কান দিও না তো। ধরা পড়ে গেছে তো তাই ভুলভাল বকছে।’
মা অহনাকে নিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। যাবার আগে আমাকে বলে গেল, ‘কাল সকালেই তোদের আমি বিয়ে দেবো। তারপর দুটোকে এক কাপড়ে ঢাকা শহর ছাড়া করব।’
আমি হাজার চেষ্টা করেও মা’কে সত্যিটা বোঝাতে পারলাম না।
মা চলে যেতেই আমি মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লাম। কী হল এটা আমার সাথে! মেয়েটাকে ফাসাতে গিয়ে সে ফাঁদে আমি নিজেই ফেসে গেলাম। আমি তো কোনো দোষ করিনি! তাহলে ওর স্থানে আমার কেন এগুলো শুনতে হচ্ছে!
বসা থেকেই আমার চোখ গেল বিছানার ওপর। কী সুন্দর আরামে ঘুমোচ্ছে দেখো! ওর ঘুমের যদি আমি বারোটা না বাজাই! তবে আমার নামও আহান না।
বসা থেকে উঠে ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগালাম দরজায়। তারপর ওয়াশরুমে চলে গেলাম। এক বালতি ঠান্ডা পানি নিয়ে বেরোলাম। উদ্দেশ্য মেয়েটার গায়ে ঢালা। তাহলেই আমার পরাণ জুড়োবে। ওর মোক্ষম শাস্তিই এটা। এই শীতে ওর গায়ে ঠান্ডা পানি ঢাললে ওর কেমন অনুভূতি হবে ভেবেই আমার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে।
পানি নিয়ে বিছানার কাছে পৌঁছাতেই দেখি মেয়েটা উধাও! আশ্চর্য! এই মাত্রই শুয়ে ছিল এখানটায়। কোথায় চলে গেল। দরজাও ভেতর থেকে লাগানো। এই মেয়ে কি জাদু জানে! ঘরে কোথাও লুকিয়ে আছে ভেবে সারাঘর খুঁজে তন্নতন্ন করলাম। কোথাওই নেই।
ওহহো! খাটের নিচটায় চেক করতে ভুলে গেছি। খাটের তলায় উঁকি মারতেই দেখলাম মিথি দলা পাকিয়ে বসে আছে। হাত দিয়ে টেনে ওকে বের করে আনলাম। কিন্তু ও আমার কাছে এল না। উল্টো হাতে কামড়ে দিল। আর আমার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রুক্ষ স্বরে মিউ মিউ করতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম না হঠাৎ ও এমন ব্যবহার কেমন করছে! ও তো এমন স্বভাবের মার্জার নয়! ওর মতো নম্র, মিশুক বিড়াল আমি আর দুটো দেখিনি। আজ ওর কী হল!
আচ্ছা ও কী কিছু দেখেছে! ওই মেয়েটার ব্যাপারে! যার কারণে ভয়ে কিংবা রাগে এমন রূঢ় আচরণ করছে!
আমি নিচু হয়ে বসে মিথিকে কাছে ডাকলাম। ও এল না। হেঁটে ঠান্ডা পানির বালতির কাছে চলে গেল। বালতির দিকে মুখ করে বসে আবারও রুক্ষ স্বরে মিউ মিউ করতে লাগল। আমার মাথায় কিছুই খেলছে না।
সকালে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। রোজ এলার্ম বাজার আগেই মা আমাকে ঘুম থেকে তুলতে আসে। আজ আসেনি। বোধহয় কালকের বিষয়টা নিয়েই রেগে আছে। হাত মুখ ধুতে গিয়ে খেয়াল করলাম হাত আচড়ে ভর্তি। মিথির কাজ এটা। কাল যখন বালতির কাছে বসে মিউ মিউ করছিল। তখন ওকে জোর করে কোলে তুলতে গিয়েছিলাম। তবুও কোলে আসেনি। উল্টো রেগে হাত আঁচড়ে রক্ত বের করে দিয়েছে। বাহ! বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যই আমার ওপর রেগে। কোনো দোষ না করেও সবার রাগ সহ্য করতে হচ্ছে আমার।
আমি না খেয়েই অফিসে চলে গেলাম। মা একবার পেছন ফিরে ডাকলও না।
অফিসে বসে কাজ করছি। হঠাৎ বস নিজে এসে বলল, আমার ছুটি। বাসায় চলে যেতে। একরাশ কৌতুহল নিয়ে বাসায় ফিরলাম। ঘরে ঢুকতেই মা ‘ওই মেয়েটা কই?’ বলে চেঁচামেচি শুরু করল। আমি বললাম, ‘আমি কীভাবে জানব মা? ওই মেয়েকি আমাকে বলে যাওয়া আসা করে?’
মা আরো রেগে গেল। বলল কেমন মেয়ের সাথে সম্পর্ক রেখেছি যে আমার কথা শোনে না!
হায়রে! মা’কে আমি আর কীভাবে বোঝাবো!
আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম। ‘মা তুমি ওই মেয়েকে দিয়ে কী করবে?’
মা ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ‘তোদের বিয়ে দেবো।’
আমি একপ্রকার চিৎকার করে বললাম, ‘অসম্ভব! ওই মেয়েকে আমি কেন বিয়ে করতে যাব?’
মা কঠোর গলায় বলল, ‘নিজের শোবার ঘরে নিয়ে শুয়ে থাকার সময় মনে ছিলনা?’
লজ্জায় আমার চোখে পানি চলে এল। মা প্রচন্ড রেগে গেলে বিশ্রী ভাবে কথা শোনায়। তারই নমুনা এটা। বুঝলাম এখন আর মায়ের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। চুপচাপ এখান থেকে কেটে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। দরজা আটকে টাইটা ঢিলে করতে করতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
সকাল থেকে কিছুই খাইনি। রাতেও মা খেতে ডাকল না। আমিও রাগ করে না খেয়েই রইলাম।
রাত বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। সেই কখন শুয়েছি। এখনো ঘুম আসছে না। পেটে খিদে থাকায় বোধহয়। আমার রুমের দরজা খোলা। ইচ্ছে করেই খুলে রেখেছি। মনে মনে ঠিক করে রেখেছি যেভাবেই হোক আজ ওই মেয়ের পরিচয় জানবোই! কে সে! কোথায় থাকে! কেন রোজ মাঝরাতে আমার ঘরে আসে! আমার কাছে কী চায়!
রাত দুটো বেজে পনেরো মিনিট। আমি বিছানায় কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। হঠাৎ ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। পা টিপে টিপে হেঁটে কেউ বিছানার কাছে এগিয়ে আসছে। আগন্তক আমার পাশে শুয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি চোখ না খুলেই বুঝে গেলাম আগন্তুক আসলে কে!
আমি ধীরে ধীরে চোখ খুলে আমার পাশে তাকালাম। আমি যেটা ভাবছিলাম সেটাই। সেই মেয়েটা! আমি জলদি ওর ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। আজও নগ্ন হয়ে আছে মেয়েটা। অসভ্য মেয়ে কোথাকার! ওর কি কোনো জামাকাপড় নেই না কি? আদিমকাল থেকে উঠে এসেছে?
আমি লেপ দিয়ে ওর শরীর ঢেকে ওর হাতদুটো চেপে ধরলাম। মেয়েটা আৎকে উঠে বলল, ‘কী হল! কী হল আহান!’
আমি আরো জোরে ওর হাত চেপে ধরলাম। ‘তুমি কে?’
মেয়েটা আমার বুকের বাম পাশে ওর হাত রাখল। মৃদুস্বরে বলল, ‘আমি তোমার ক্লিওপেট্রা! ‘
চলবে…
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা
(পরের পর্ব লিখবো? আপনাদের রেসপন্স আশা করছি।)