#ক্যানভাস_
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৮)
সামি বুকের ব্যথাকে তেমন পাত্তা দিল না। শুধু ইরার হাসির মাঝে নিজেকে মিশিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়।
১৯!!
মেঘ শ্রাবণকে ওই একইভাবে ধরে আছে। আদনান গলা দিয়ে একটু আওয়াজ তুলতেই শ্রাবণ তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শ্রাবণের চেহারায় এমন লজ্জা লজ্জা ভাবটা মেঘকে ভীষণ হাসাচ্ছে। মেঘ শ্রাবণের সামনে না হাসলেও মুখ চেপে ঠিকই হাসছে। শ্রাবণের নার্ভাসনেসটা কাটাতে মেঘ আদনানকে ডেকে বলল,
_আদনান ভাইয়া আমাকে কেন খোঁজা হয়েছে?
_তোমার মুখে একটা গান শোনার জন্য।
_কী! আমি আর গান!
_হ্যাঁ, আজকে তোমার অনুভূতি থেকে একটা গান শেয়ার করবে সবার মাঝে।
_কিন্তু আমি তো!
মেঘ শ্রাবণের দিকে অসহায়ভাবে তাকায়। শ্রাবণ মেঘলে চোখ নেড়ে আলতো স্বরে বলল,
_আমার জন্য তো গাইতেই পারো।
_তোমার জন্য গান কেন মরতেও রাজী।
_ইনাফ! মরতে হবে না ডিয়ার হবু বউ, আপাতত গানটা গাও।
_সত্যি গাইবো!
_হ্যাঁ গাইবে।
_শুধু তুমি বলছো বলে।
_এতো গুরুত্ব কেন দিচ্ছো আমাকে?
_তোমাকে গুরুত্ব না দিলে আর কাকে দিব?
_জানিনা, তবে এতো গুরুত্ব দিও না আমি তাঁর সঠিক মর্যাদা রক্ষা করতে পারবো না রাত্রি।
_সব দায়িত্ব যে রক্ষা করতে হয় তার তো কোনো মানে নেই। শুধু আমার পাশে থাকলেই হবে। আর সব দায়িত্ব কেন ছেলেদের রক্ষা করতে হবে, মেয়েরা কিছু দায়িত্ব নিতে পারে না?
_কিন্তু আনু!
_ভুলে যেতে পারবে না।
_চেষ্টা করব, যদি না পারি।
_আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করেই যাব, তবুও হার মেনে নিব না।
_এখনই এতো অধিকার!
_সময় থাকতে অধিকার না কাটালে পরে আমাকেও পস্তাতে হবে তোমার মতো।
_সেটা ঠিক, আমি তো নিজের অধিকার খাটাতে পারলাম না বলে আজকে আনিকার জায়গায়…
_ব্যস! আর একটা কথাও না। আমি গান গাইবো কিন্তু তুমিও আমার সাথে সুর মেলাবে।
_আবার আমি কেন?
_যা করবো দুজনে একসাথে করবো।
_ওকে যাও তুমি রেডি হও।
সামি মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে বলল,
_এখন যৌথ কন্ঠে গান গাইবে আমাদের আজকের জনপ্রিয় জুটি। যারা নতুন জীবন সাজাতে নিজেদেরকে প্রতিটা ধাপে ধাপে এগিয়ে নিতে যাচ্ছে একে অপরের মাঝে, একে অপরকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার প্রধান মাধ্যমই হলো এইভাবে একসাথে থাকা। সর্বদা একজন অন্যজনের ইচ্ছাকে প্রায়োরিটি দেওয়া। আমরা আমাদের এই কাপলদের জন্য সুখ কামনা করছি। তো চলুন এবার তাঁদের দুজনের কন্ঠে একটা চমৎকার গান শুনে আসি। কাম-অন শ্রাবণ মাহমুদ এন্ড মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড রাত্রি হাসান (ভুল নাম না বললে ধরা খাওয়ার চান্স বেশি)।
সামির এনাউন্সমেন্ট শেষ হলে মেঘ শ্রাবণ একে অপরের হাত ধরে স্টেজে গিয়ে উঠে। দুজনের হাতে দুটো মাইক্রোফোন। প্রথমে মেঘ গাইতে শুরু করল,
★মায়াবন বিহারিণী…
মায়াবন বিহারিণী হরিণী,
গহন স্বপন সঞ্চারিনী,
কেন তারে ধরিবারে করি পণ?
অকারণ, মায়াবন বিহারিণী…
★থাক থাক নিজ মনে দূরেতে,
আমি শুধু বাসরীর সুরেতে,
পরশ করিব ওর তন মন!
অকারণ, মায়াবন বিহারিণী…
★চমকিবে ফাগুনেরো পবনে,
বসিবে আকাশবাণী শ্রবনে,
চিত্ত আগুনে হবে অনুভব!
অকারণ, মায়াবন বিহারিণী…
মেঘ টাইট করে শ্রাবণের হাতটা ধরে। শ্রাবণ ভয় ভয় চোখে মেঘের দিকে তাকায়। কেমন যেন একটা দ্বিধা কাজ করতে লাগল শ্রাবণের মনে। মেঘ মাথা নাড়িয়ে শ্রাবণকে বুঝালো, ‘একদম ঘাবড়ানোর দরকার নেই, এইভাবেই হাতে হাত রাখো।’ মেঘের ইশারা শ্রাবণকে একটু শক্তি দিলেও ভেতরের সংকোচ থামছে না। মেঘ মাইক্রোফোনের দিকে নজর দিয়ে গাইতে লাগল,
★দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহ ডোরে বাধিব,
বাধনবিহীন সেই যে বাধন!
অকারণ, মায়াবন বিহারিনী…
মেঘ শ্রাবণের ঠিক চোখের মাঝে ডুবে থেকে গানের প্রত্যেকটা লাইন গাইছিল। এই চোখের ভাষা শ্রাবণ বেশ লক্ষ্য করে বুঝতে চাইছে, কিন্তু কোনো এক কারণে পারছে না। মেঘ শ্রাবণকে আবারও ভরসা দেয়। শ্রাবণ সাহস নিয়ে গাইতে লাগল,
★মায়াবন বিহারিণী হরিণী,
গহন স্বপন সঞ্চারিনী,
কেন তারে ধরিবারে করি পণ?
অকারণ, মায়াবন বিহারিণী…
শ্রাবণ এই দুইলাইন গান খুব ভয়ে ভয়ে গাইল। মেঘ শ্রাবণের এমন চেহারা দেখে নিজেই আবারও গাইতে লাগল। মেঘকে তাল দিয়ে শ্রাবণ নিজেও মাইক্রোফোনে গলা মিশালো। এরপর দু’জনে আবার একসাথে অন্তরা মিলিয়ে গানগা শেষ করল।
লাস্টের অন্তরা গুলো একসাথে গাওয়ায় সবাই ওদেরকে বেশ উৎসাহ দিতে লাগল। দুজনে গানটা শেষ করে নিল। গান শেষ হতেই মেঘ সামান্য নড়ে শ্রাবণকে আস্তে করে একটা হাগ দিলো। শ্রাবণ একটু অবাক হলেও পরক্ষণেই সবার দিকে তাকিয়ে মেঘের পিটে আলতো করে হাত ঠেকিয়ে একটু জড়িয়ে ধরে।
রবীন্দ্র সংগীত বাংলা গানের প্রাণ। মানুষের প্রাণ। প্রতিটা মানুষের হৃদয়ের ফুটন্ত ভালোবাসার প্রতিটা কলিকে রবী ঠাকুর তাঁর মনের মাধুরি মিশিয়ে যেভাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। কবির এই গান গুলোর মাঝে গান-অন্ত মানুষ গুলো খুঁজে পায় নিজেকে। খুঁজে পায় গানের আসল মর্ম। এই গান শুধু দুজনের ভেতরে আকুতি, অনুভূতি প্রকাশ করেনি বরং এখানে উপস্থিত সকলের অন্তরে গিয়ে নাড়া দিয়েছে। এজন্য রবীন্দ্র সংগীত সবাই খুব যত্নের সাথে গেয়ে থাকে।
গান শেষে সবার চিৎকারের আওয়াজ শোনা যায় চারিদিকে। দুজনে একসাথে হাতে হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে আসে। এরপর শুরু হয় ডিনারের আয়োজন। আগে সব মেহমানদের খাওয়া দাওয়া হবে তারপর মেঘের বাড়ির লোকেরা খেতে বসবে।
২০!!
রাত প্রায় ১২ টা বাজে। ততক্ষণে সবার খাওয়া দাওয়া কমপ্লিট। বাসায় আসা সব গেস্টরাই চলে গেছে শুধু শ্রাবণের বন্ধু সাকিব, আদনান, সামি আর শ্রাবণ বাদে শ্রাবণের বাসার সবাই চলে যায়। মেঘ, নওরিন আর ইরা এই তিনজন আর শ্রাবণের সব বন্ধুরা মিলে মেঘদের বাসার ছাদে আড্ডা জমায়। ছাদে মাদুর পেতে সবাই মাদুরে বসে। শ্রাবণের পাশে মেঘ, আদনানের পাশে নওরিন, ইরার পাশে সামি আর সাকিব একলা। সবাই কাপল নিয়ে বসে আছে আর সাকিব বেচারা সবার এই অবস্থা দেখে হিংসেতে জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাকিবের মুখ অনেক ভারি ভারি লাগল সবার কাছে। শ্রাবণ সাকিবের এই অবস্থা দেখে ভীষণ মজা পায়। সাকিবকে বলল,
_চিন্তা করিস না দোস্ত আমার, আগামী বছর তোর পাশেও কাউকে আনার ব্যবস্থা করবো।
শ্রাবণের কথা শুনে সবাই হাসা শুরু করে। সাকিব রাগী চোখে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল,
_সিংগেল দেখে খুব মজা নিচ্ছিস তোরা?
_মোটেও আমরা কেউ মজা নিচ্ছি না।
_ভুলে যাস না আমাদের রবী ঠাকুর আরেকটা গান লিখে গেছেন।
_গান!
_হ্যাঁ….
★যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,
তবে একলা চলো রে…
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো,
একলা চলো রে…
★যদি কেউ কথা না কয়,
ওরে, ওরে ও অভাগা কেউ কথা না কয়…
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়,
তবে পরান খুলে…
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে…
★যদি সবাই ফিরে যায়,
ওরে, ওরে ও অভাগা সবাই ফিরে যায়…
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়,
তবে পথের কাঁটা…
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা চলো রে…
★যদি আলো না ধরে,
ওরে, ওরে ও অভাগা আলো না ধরে…
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে,
তবে বজ্রানলে…
আপন বুকের পাঁজর জ্বেলে একলা জ্বলো রে…
_ক্যায়া বাত হে ইয়ার, এতো সুন্দর গান তুই গাইলি!
সবাই সাকিবের গান শুনে বাহবা দিতে লাগল। তারপর মেঘ আড্ডা দেওয়ার প্ল্যান বের করল। আড্ডার কথা শুনে সবাই একটু ভাবনায় পড়ে। ইরা তখনই বলে উঠল,
_আমরা কি কিছু খেলতে পারি? যাতে এই নির্জন পরিবেশটা জমে উঠে।
ইরার কথায় সবাই একসাথে ‘ইয়েস’ বলে উঠে। কিন্তু কিভাবে এই নির্জন পরিবেশটাকে জাগ্রত করা যায় সেটাই ভাবছে? চট করেই আদনানের মাথায় একটা আইডিয়া আসে। আদনান বলল,
_সবাই সবার প্রথম ভালোবাসার ছোট একটা অনুভূতি শেয়ার কর। এতে এই পরিবেশটা বেশ জমে উঠবে। প্রথমে সামি, তুমি শেয়ার করো তোমার প্রথম ভালোলাগা অথবা প্রথম ভালোবাসার সংজ্ঞা।
_আমি!
_হ্যাঁ তুমি।
_আদনান তুমি আমাকে আবারও ফাঁসিয়ে দিলে।
_আরে ইয়ার এটা কোনো ব্যাপার না। তাড়াতাড়ি শেয়ার করো।
মেঘ, ইরা, নওরিন সবাই মিলে সামিকে জোর করতে থাকে। কিন্তু সামি কি শেয়ার করবে ভেবে পায়না? কিছু তো একটা শেয়ার করে এদের মুখ বন্ধ করা দরকার। নয়তো এরা আরো কি না কি চাপিয়ে দেয় কে জানে? সামি বলা শুরু করল,
_আমার কাছে ভালোলাগা মানে, প্রথম দেখায় যখন কাউকে খুব ভালো লাগে, তাঁর প্রতি অসম্ভব একটা অনুভূতি তৈরি হয়। তাকে দেখলে মনে হয়, এই সেই মানুষ যাকে ভালোবাসলে পৃথিবীর সব সুখ তুচ্ছ মনে হয়। আসলে এটা সামান্য ভালোলাগার মাঝে অতিরিক্ত আবেগ। আবেগে মানুষ অনেক কিছুই ভাবে, তেমনি আমিও ভেবেছি। আর ভেবেছিলাম বলেই আজ বুঝতে পারছি ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা হয়না। ভালোবাসা হয় ছোট মনে যখন একবিন্দু অনুভূতির জন্ম নেয়, জন্ম নেয় সামান্য অধিকার, জন্ম নেয় একটুখানি সুখের, জন্ম নেয় হাজারো কষ্ট ভুলে থাকার উপায়, আর সেই অল্প অল্প অনুভূতির মাঝেই যাকে মানুষ প্রথম ধাক্কাতেই মনে করে। যার কথা মনে পড়লে মুছে যায় সমস্ত বেদনা। সেই কষ্ট ভুলে টুকরো টুকরো অনুভূতি গুলোকে জাগিয়ে তুলার নামই হচ্ছে ভালোবাসা। ভালোলাগা ক্ষণিকের মোহ, আর ভালোবাসা সে তো সারাজীবনের। তাই আমি মনে করি ভালোলাগা আর ভালোবাসা দু’টোর সংজ্ঞা সম্পূর্ণ আলাদা।
সামির কথা শুনে সবাই হাততালি দিয়ে উঠে। ইরা যেন মুগ্ধ হয়ে যায় সামির কথায়। ইরা মনে মনে ভাবে, এই ছেলে ভার্চুয়াল জগতে একরকম আর বাস্তবে একরকম। সামনা-সামনি না দেখলে বুঝাই হতোনা এই ছেলের ভেতরে এতো ইমোশন। আসলে মানুষ এমনই, ভার্চুয়াল জগৎ আর বাস্তব জগৎকে সর্বদা আলাদা ভাবেই দেখে। ভার্চুয়াল জগতে অনুভূতি প্রকাশ করলেও তাঁর সত্যিকার অর্থ প্রকাশ করা যায়না। আজ সামনে থেকেই বুঝতে পারলাম একটা মানুষের ভেতরে ঠিক কতটা সৌন্দর্য থাকতে পারে? সামি তো আমার সব ধারণাকেই বদলে দিল।
আদনান এবার নওরিনকে বলল যেন নওরিন জীবনের প্রথম কোনো স্মৃতির কথা বলে। নওরিন ভাবনায় পড়ে যায় কি বলবে? অনেকক্ষণ ভেবে একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ে নওরিনের। নওরিন বলতে শুরু করল,
_খুব ছোটবেলায় যখন মায়ের সাথে ঘুমাতাম তখন মাকে বলতাম, ‘আচ্ছা মা মেয়েরা বিয়ের পরে স্বামীর বাড়ি চলে যায়, কিন্তু ছেলেরা কেন বউয়ের বাড়ি আসেনা?’ মা আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘আরে বোকা মেয়ে জন্মসূত্রে এটা হয়ে আসছে যে, মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে যায়। আদিকাল থেকে এটা হয়ে আসছে। আদি পিতা আর বিবি হাওয়া তাঁদের বিয়ের পরেও বিবি হাওয়া সব ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে পা রেখেছিলেন, সেই থেকে এটাই নিয়ম হয়ে গেছে।’ তারপর মাকে বলেছিলাম ‘তুমি দেখে নিও, আমি এই বাড়ি ছেড়ে যাব না, প্রয়োজনে তোমার মেয়ের জামাইকে ঘরজামাই করে এই বাড়িতে আনবো, তবুও তোমাদের ছেড়ে যাবোনা।’ আমার কথা শুনে মা খিলখিল করে হাসতে লাগল। হেসে হেসে মা বলল, ‘আচ্ছা দেখবো কেমন পারিস?’ এই একটা স্মৃতি মনে পড়লে আমি অজান্তেই হেসে উঠি। আসলেই যদি এমন হতো তাহলে কোনো মেয়েকে বাবার বাড়ি ছাড়তে হতোনা।
নওরিনের কথা শুনে সবাই হাসতে হাসতে পাগলপারা। আদনান নওরিনকে রাগাতে বলল,
_দেখব কোন ছেলে ঘরজামাই সেজে তোমাকে বিয়ে করে? এমন চিন্তা তাড়াতাড়ি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল, নয়তো সারাজীবন আইবুড়ো হয়ে থাকতে হবে। অতঃপর তোমার ফিউচার বর, বউয়ের শোকে দেবদাস হয়ে যাবে। যেমনটা দেবদাস হয়েছিল চন্ডিদাস তাঁর রজকিনীর বিরহে।
_একদম রাগাবে না বলে দিলাম।
_আমি কখন রাগালাম। যা সত্যি তাই বলছি।
_দেখে নিবো তোমাকে।
নওরিন আর আদনান রীতিমতো ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলবে এটা মেঘ বেশ বুঝতে পারছে। তাই ওদের থামাতে মেঘ ইরাকে বলল,
_ইরা তুই তোর জীবনের একটা সুন্দর মোমেন্ট বল।
_ওকে।
ইরা সামির দিকে তাকায়। সামির দিকে তাকাতেই সামি চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল। সামির এমন কান্ড ইরাকে আবারও হাসিয়ে দিল। ইরা বলল,
_আমি বন্ধুদের সাথে অনেক সুন্দর মোমেন্ট কাটিয়েছি, কিন্তু আজকের মোমেন্টটা ছিল বরাবরই আলাদা। আমি ভাবতাম মানুষ মনের অনুভূতি গুলো সবসময় স্ট্যাটাসের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে আনন্দ লাভ করে। রিলেক্স বোধ করে। মনের যত রাগ আছে সেটা স্ট্যাটাসের মাধ্যমে প্রকাশ করে ঝেড়ে ফেলে, কিন্তু আসলে ঠিক তা নয়। স্ট্যাটাস ছাড়াও মানুষ নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে। আজ এই মুহূর্তটা সামনে থেকে উপলব্ধি করতে না পারলে হয়তো আমার অনেক কথা অজানা থেকে যেত। আজকে এখানে এসে সবটা না জানলেও এইটুকু বুঝতে পেরেছি কীভাবে সেক্রিফাইস করা যায়? আর কিছু পারি আর না পারি, কাউকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবো না। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে হলেও তাঁর কষ্ট মুছার কারণ হব।
ইরার কথা শুনে সবাই ভীষণ রকম টাস্কি খায়। শ্রাবণ হালকা কাশি দিয়ে ইরাকে ধাক্কা মেরে ইরার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
_শালিকা ছেলেটা কে আমাকে একটু বল, দেখবো আমি কিছু করতে পারি কি না?
_ইশ! আর ঢং করা লাগবে না।
_আমি ঢং করছি না গো। আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কারো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো। কে সে আমি তো সেটা জানার অধিকার রাখি?
_যাকে বললাম তাকেই এখনও এর মানে বুঝাতে পারলাম না৷ আর তোমাকে কী জানাবো?
_বা রে আমি কি জানতে পারি না!
_অবশ্যই পারো, তবে আগে তাকে সবটা জানাই পরে তোমাকে জানাবো।
_তোমার ইচ্ছা, কোন হেল্প লাগলে বল?
_সে তুমি না বললেও জানাবো।
আদনান এবার সাকিবকে বলল,
_সাকিব তোর কোনো বেষ্ট অনুভূতি শেয়ার কর।
_দূর আমায় ছাড়, আমার মতো সিংগেলের অনুভূতি কেউ বুঝবে না, তুই বরং শ্রাবণের অনুভূতি জানার চেষ্টা কর।
_শালা সিংগেল, তুই ডাবল হবি কবে? একটু আগেই তো একলা বলে কী সাহসের সাথে গান গাইলি। তাহলে এখন?
_গান গাওয়া আর ডাবল হওয়া এক না কি? যেদিন আমার বউ আমার খোঁজে আমার কবরে শিরির মতো প্রবেশ করবে সেদিন আমিও ফরহাদের মতো ডাবল হবো।
_বাহবা, কি হিংসে ওনার?
_হয়েছে থাক। তোরা তোদের অনুভূতি শেয়ার কর, আমি শুনেই নিজেকে ধন্য করি।
_আচ্ছা।
আদনান এবার শ্রাবণকে উদ্দেশ্য করে বলল,
_শ্রাবণ তুই কিছু বল,
_কী বলব?
_তোর জীবনের স্মরণীয় ঘটনা।
_আমার জীবনের সব ঘটনার সাথেই তোরা জড়িয়ে আছিস। আমার সুখে, দুঃখে তোরাই পাশে ছিলি, জানি তোরাই থাকবি৷ তাই আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করছি না।
_তবুও শেয়ার কর, যদি কোনো চাপা কষ্ট থাকে সেটা বেরিয়ে আসবে? আর মনটাও একটু হালকা হবে।
শ্রাবণ দু’হাঁটু একসাথে করে হাঁটুর উপর হাত রাখে। একহাত দিয়ে অন্যহাতকে চেপে ধরে বলতে শুরু করল,
_আমার জীবনের সবচাইতে স্মরণীয় ঘটনা কিছুদিন আগে ঘটে। জীবনে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু দেখেছিলাম আমি। পেয়েছিলাম অজানা একটা সুখের আভাস। কিন্তু সেই সুখটা ছিলো ক্ষণিকের, আসতে না আসতেই হারিয়ে গেল আমারই কাছের কেউ। যখনই কোনো সুখের ছোঁয়া পেয়েছি তখনই কোনো না কোনো ভাবে হার্ট হয়েছি। যতবারই যা পেয়েছি তাঁর থেকে দামী কিছু হারিয়েছি। সেদিন যখন আমার নিজের স্কেচটা ইন্টারনেটে দেখলাম খুব খুশি হয়েছিলাম। আমি একেবারে পাগল হয়ে গেছিলাম সেই মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখার জন্য। মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকি তাকে। কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম আমি সেই চিত্রশিল্পীকে খুঁজতে গিয়ে আমারই কাছের একজনকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি যার ফলে সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তাঁর যাওয়াটা আমাকে বুঝিয়ে দিল, সে কখনই আমার ছিল না। হয়তো আমি বোকা ছিলাম, বোকা আছি, আর বোকাই থাকব। তাইতো আজও তাকেই ভালোবাসি। পারিনি মুছে দিতে তাঁর কোনো স্মৃতি।
শ্রাবণ কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। শ্রাবণের কান্না দেখে মেঘ স্তব্ধ হয়ে গেছে। মেঘ আজ বুঝতে পারছে পরিচয় লুকিয়ে কত বড় ভুল মেঘ করেছে? মেঘ শ্রাবণের কাঁধে হাত রাখে। শ্রাবণ চোখের জল মুছে মেঘের দিকে তাকায়। মেঘ বলে উঠল,
_তুমি সত্যি বড্ড বোকা। বোকা না হলে কেউ নিজের হবু বউয়ের সামনে এক্স গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে কথা বলতে না।
_সরি, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।
_আমি তোমার মতো এতো দুর্বল নই যে সামান্য ব্যথাতে ভেঙে পড়বো। আমি অনেক ধৈর্য্য ধরতে পারি আর আমার এই ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে আমি একদিন তোমার মন থেকে সব চাপা যন্ত্রণাকে মুছে দিব। শুধু তুমি আমাকে একটু হেল্প করলে সব আবার ঠিক হয়ে যাবে।
২১!!
মেঘ শ্রাবণকে একটু ভরসা দেয়। শ্রাবণ কান্না মুছে একটু স্বাভাবিক হয়। শ্রাবণের সামান্য ইমোশন সবাইকে মুহুর্তেই কাঁদিয়ে দিল। সামি চুপ হয়ে গেছে শ্রাবণের নিষ্পাপ মনের ভালোবাসাকে দেখে। আদনান শ্রাবণকে স্বাভাবিক করতে টপিক অন্যদিকে টানে। আদনান এবার মেঘকে বলল,
_ভাবি এবার তুমি কিছু বলো।
_আমি কি বলবো?
_জাস্ট তোমার কিছু কথা শেয়ার করো। এই মুহূর্তে তুমি ঠিক যা ভাবছো তা।
_ওকে।
মেঘ নিজেকে একটু ঠিক করে নেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে আজকের পুরো দিনটার কথা কল্পনা করে। মনের সাতরঙা রঙতুলি দিয়ে একটা সুন্দর ক্যানভাস আঁকতে শুরু করে কল্পনার মাঝে। তারপর সবাইকে বলতে লাগল,
চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।