ক্যানভাস_পর্ব : (২)

0
1708

ক্যানভাস_পর্ব : (২)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

কখনও ছবিটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। আবার কখনও চুমু খেতে থাকে। এরপর ছবিটা বুকে নিয়েই ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় মেঘ। সকাল ন’টায় ঘুম থেকে উঠে নাশতা করে বাবার সাথে ভার্সিটি যায়। ক্লাস শেষ করে নওরিনকে আর্ট কলেজে থাকতে বলে। নওরিন আজকে ক্লাস করেনি শুধু নিজের আনকমপ্লিট আর্ট’টা শেষ করবে বলেছে মেঘকে। মেঘ অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্রী পাশাপাশি আর্টের ক্লাসে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। সেই সুবাদে আর্ট কলেজে নাম লিখিয়েছে যাতে পড়ালেখার পাশাপাশি একজন ভালো আর্টিস্ট হতে পারে। মেঘ ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আর্ট কলেজে যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠে। রিকশায় যেতে যেতে মেঘ নওরিনের সাথে কথা বলছিল। হুট করে মেঘ খেয়াল করে রাস্তা দিয়ে প্রাইভেট কারে যাওয়া একটা ছেলেকে। মেঘ বেশ অবাক হয়। কেমন যেন চেনা চেনা লাগল মেঘের কাছে? মেঘ কিছু বুঝে উঠার আগেই গাড়িটা আড়াল হয়ে গেল। মেঘ মন খারাপ করে ফোন রেখে দেয়। আর্ট কলেজের কাছে যেতেই নওরিন দৌঁড়ে আসে মেঘের কাছে। মেঘের মনভার দেখে নওরিন জিজ্ঞেস করল,

_কী হয়েছে তোর? মন খারাপ কেন?
_একটুর জন্য হারিয়ে গেল?
_কী!
_হ্যাঁ,জানিস খুব চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি? কিন্তু; মনে করতে পারছি না।
_কাকে দেখেছিস?
_একটা ছেলে, খুব পরিচিত মনে হলো। হুট করেই আবার ভেনিশ হয়ে গেল।
_ছাড়তো এসব। রাস্তা-ঘাটে রোজ রোজ কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়, দেখা-সাক্ষাৎ হয়, কথা-বার্তা হয় তাই বলে কি সবাইকে মনে রেখে বসে থাকবি না কি বোকার মতো?
_না রে ঠিক তা নয়। আমার মন বলছে আমি তাকে কোথায় যেন দেখেছি? ছেলেটার মুখের সানগ্লাস ছিল বিধায় চেহারা স্পষ্ট করে মনে করতে পারছি না।
_আচ্ছা বাদ দে, পরে দেখা যাবে। যদি আর কোনোদিন দেখা হয় তো জেনে নিবি কে এই ছেলেটা?
_আচ্ছা, তোর ক্যানভাস কি কমপ্লিট?
_না, এখনও অল্প বাকি আছে।
_আচ্ছা আয় একসাথে যাই।

দু’জনে আবারও একসাথে ছবি আঁকাতে মনোযোগ দিল। মেঘের আজ আর্টের প্রতি একটুও মন নেই। কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি ছুঁয়ে গেল মেঘকে। এক পলকের একটু দেখাতেই অচেনা চেহারাটা বার বার মেঘের চোখের সামনে ভেসে ওঠতে লাগলো। মেঘ আর্টে মন দিতে পারলো না। এইভাবে প্রতিদিন আর্টের সাথে সময় কাটাতে কাটাতে এক সপ্তাহ কেটে যায়। এগিয়ে আসে প্রতিযোগিতার দিন।

৪!!
আজ শুক্রবার।
আজ আর্ট কলেজের সব আর্টিস্টদের নিয়ে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। যে ফার্স্ট হবে, সে গোল্ড মেডেল পাবে। সকাল দশটার দিকে মেঘ আর নওরিন এসে কম্পিটিশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই একটা খোলা মাঠে স্যান্ড আর আর্ট পেপার নিয়ে রেডি প্রতিযোগিতার জন্য। সময় হতেই সবাই শুরু করে যে যার মতো রঙের কারসাজি। মেঘ রঙতুলি হাতে নিয়ে নিজের কাজ করতে ব্যস্ত, মেঘ ছবি আঁকছে আর কল্পয়ায় ভেসে যাচ্ছে। এসব করতে করতে হুট করে মেঘের হাত থেকে সব রঙ ছিটকে পড়ে আর্ট পেপারে। সম্পূর্ণ পেপারটা নষ্ট হয়ে যায়।

একজন টিচার এসে মেঘকে কম্পিটিশন থেকে বাতিল করতে চান। টিচার মেঘকে নানারকম বকাঝকা করতে থাকেন। মেঘ হাতজোড় করে টিচারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছে কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। একসময় সেই টিচার গিয়ে প্রিন্সিপালকে ডেকে আনেন। প্রিন্সিপাল এসে মেঘকে প্রশ্ন করলেন,

_ভালো করে আর্ট করা না শিখেই কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করতে চলে এলে।
_সরি স্যার, আমি খেয়াল করিনি। কীভাবে যেন সব রঙ ক্যানভাসে লেপ্টে গেছে।
_এখন তো তোমাকে কম্পিটিশন থেকে বহিষ্কার করা হবে।
_প্লিজ স্যার এমন করবেন না। এই কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করাটা আমার ড্রিম। প্লিজ আমাকে আমার স্বপ্নপূরণের আর একটা সুযোগ দিন। আমি কথা দিচ্ছি একটা বেষ্ট ক্যানভাস আমি উপহার দিবো সবাইকে।
_এসব বলে কি পারবে তুমি? সময় তো আর আধাঘণ্টা।
_কোনো ব্যাপার না আপনি শুধু হ্যাঁ বলে দিন? আমি পারবই।
_আমি চাই না তোমার ড্রিম নষ্ট হোক। দিস ইজ ইউওর লাস্ট চান্স! ক্যারি অন…
_থেংক ইউ সো মাচ্ স্যার।

মেঘ তাড়াতাড়ি আর্ট পেপার চেঞ্জ করে অন্য একটা পেপার বের করে ক্লিপে আটকায়। এরপর অন্যদিকে মন না দিয়ে ক্যানভাসটা আঁকতে মনোযোগ দেয়। আধাঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই মেঘের ছবি আঁকা কমপ্লিট হয়ে যায়। সবার আগেই মেঘ স্যারের কাছে নিজের আঁকা আর্ট পেপারটা জমা দিয়ে ক্যাম্পাসের অন্যপাশে গিয়ে নওরিনের জন্য অপেক্ষা করে।

সময় শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবার আর্টগুলো জমা নেওয়া হয়। কিছুসময় পর নওরিন এসে মেঘের পাশে দাঁড়াল। মেঘের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,

_কী হয়েছিলো তোর? ছবিটা নষ্ট হলো কীভাবে?
_আমি জানিনা রে, অন্যমনস্ক ছিলাম।
_অন্যমনস্ক ছিলি না তুই, ইচ্ছে করেই অন্যমনস্ক হয়ে কাজ করেছিস।
_বাদ দে তো। জমা তো দিতে পেরেছি এটাই অনেক।
_এখন কি বাসায় যাবি?
_হ্যাঁ, সন্ধ্যেবেলা তো আসতে হবে। রেজাল্ট দিবে তো।
_হুম, আচ্ছা তোর কি মনে হয়, পারবি তো জিততে?
_আমি তো আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করলাম। এখন বাকিটা স্যারদের সিদ্ধান্তে নির্ভর করবে। তারা কীভাবে যোগ্যতা বিচার করবে সেটা তারাই ভালো বুঝবে।
_সেটা ঠিক। কিন্তু নিজের তো একটা কনফিডেন্ট থাকে।
_তুই খুব ভালো করেই জানিস আমি যা চাই তা পাই, আর যা পাই না তা জোর করে অর্জন করি তবে সৎ ভাবে নিজের বুদ্ধি কাটিয়ে।
_সেটা আমি জানি, আর জানি বলেই জানার আগ্রহটা বেড়ে গেল। সবসময় তো তোর জেদের কাছে সবার সিদ্ধান্ত আটকে গেছে। এইবার কী হয় আল্লাহ ভালো জানে।
_হয়েছে আর জ্ঞান দিবি না। বাসায় যাবো, অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।
_বাইরে কিছু খাবি?
_রোজ রোজ বাইরের খাওয়ার খেলে পেটে বদ হজম হবে, পরে ওয়াশরুম আর বেড রুম ছাড়া কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না।

হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে বাসার দিকে রওয়ানা দেয়।
বাসায় এসে গোসল করে মাকে নিয়ে গল্প করতে করতে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। অন্যদিকে শ্রাবণ বন্ধুদের নিয়ে এখানে সেখানে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কম্পিটিশন চলা অবস্থায় ডিপার্টমেন্টের কাছেও যায়নি ওরা কেউ। এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে দিয়েছে।

সবাই মিলে একটা ক্যান্টিনে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কফি খেতে খেতে সবাই মিলে হৈচৈ করছে একপর্যায়ে শ্রাবণ সাকিবকে বলল,

_আচ্ছা আজকে যে কম্পিটিশন হয়েছিল তাঁর রেজাল্ট তো সন্ধ্যায়?
_হ্যাঁ, কেন?
_ওখানে যে বেষ্ট ক্যানভাসটা হবে সেটা আমি কিনব।
_পাগল না’কি, ওটা তো প্রতিযোগিতার একটা অংশ এটা তোকে কেউ বিক্রি করবে কেন?
_আমার তো বেষ্ট ক্যানভাস লাগবেই।
_আচ্ছা বাবা দেখা যাবে আনা যায় কিনা?
_থেংক ইউ দোস্ত আমার।

এরপর সবাই আবারও হৈচৈ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেঘ বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে আবারও বাসা থেকে বের হলো রেজাল্ট জানবে বলে। নওরিনকে বের হতে বলে মেঘ নিজের ব্যাগটা নিয়ে ক্যাম্পাসে যায়। কলেজের ক্যাম্পাসে বিশাল মাঠ আর সে মাঠেই আয়োজন করা হয়েছে রেজাল্ট প্রকাশের। চারদিকে প্যান্ডেল বেঁধে শেষ মাথায় একটা বিশাল স্টেজ। স্টেজটা নানারকম ফুল আর নকশা দিয়ে সাজানো। মেঘ নওরিনকে নিয়ে মধ্যসারিতে বসে।

রেজাল্ট শুরু করার আগে কয়েকজন স্টুডেন্টকে দিয়ে কিছু সুরা-ক্বেরাত আর হামদ-নাতের কাজ শুরু হয়। মেডেল পাবে তিনজন, ফার্স্ট, সেকেন্ড এন্ড থার্ড। প্রিন্সিপাল স্যার আর আরো কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে কিছু বক্তব্য প্রকাশ করলেন। এরপর বিচারক মন্ডলীদের কাছ থেকে রেজাল্ট এনে মাইকে এনাউন্সমেন্ট শুরু করেন। প্রথমে থার্ড প্রাইজ দেওয়া হবে। প্রিন্সিপাল বললেন,

_কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করে থার্ড অর্থাৎ তৃতীয় স্থানে আছে চিত্রশিল্পী ঈশানা নওরিন।

ঈশানা নওরিন নাম শুনে নওরিন খুশিতে মুখে হাত চেপে ধরে। মেঘকে জড়িয়ে ধরে। মেঘ নওরিনকে বলল,

_কংগ্রেচুলেশন নওরিন!
_থেংক ইউ মেঘ।

স্যার আবার বললেন,
_আমরা আমাদের তৃতীয় স্থান অধিকারীনিকে তাঁর সম্ভাব্য পুরষ্কারটি নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

নওরিন এগিয়ে গিয়ে সবার সাথে হাত মিলিয়ে নিজের অর্জিত ব্রোঞ্জটি আনতে যায়। প্রধান অথিতি নওরিনের গলায় ব্রোঞ্জ মেডেলটি পড়িয়ে দেন। একটি কাগজে কী যে লেখা সেটা নওরিনের হাতে তুলে দেন। মাথায় সুন্দর একটা তাজ পরিয়ে দেন। নওরিন প্রাপ্য কৃতিত্বটা নিয়ে সবাইকে পুরষ্কার দেখিয়ে থেংক্স জানিয়ে সালাম দিয়ে চলে আসে মেঘের কাছে।

স্যার আবারও বলতে শুরু করলেন,
_কম্পিটিশনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করছেন সামি চৌধুরী।

সামি দৌঁড়ে গিয়ে সবাইকে সালাম করে। তারপর একজন মহিলার কাছে থেকে গ্রহণ করে রৌপ্যের মেডেল। সাথে একটা কাগজ যাতে কিছু লেখা আছে তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলের বার্তা হিসেবে। আরও দেন মাথার তাজ। সামি পুরষ্কার নিয়ে সবাইকে হাত উঠিয়ে পুরষ্কার দেখিয়ে সবাইকে থেংক্স জানিয়ে নেমে আসে স্টেজ থেকে। তারপর বন্ধুদের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বন্ধুদেরকে।

এইবার স্যার আবারও এনাউন্সমেন্ট করতে যান প্রথম বিজয়ীর নাম ঘোষণার মাধ্যমে। আমাদের এই কম্পিটিশনের বেষ্ট আর্টিস্ট একজন মেয়ে, যার আর্টে ফুটে উঠেছে এক অসাধারণ প্রতিভা। আমাদের আগামীর চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে তাঁর মতো হাজার হাজার প্রতিভাবানদের চায় আমাদের এই আর্টসকেন্দ্র। আগামী প্রজন্ম এগিয়ে নিতে এরকম বেষ্ট চিত্রশিল্পী খুঁজছে আমাদের দেশ। যে এগিয়ে নিবে আমাদের চিত্রশিল্পকে অনেক দূর। দেশ থেকে বহুদেশে ছড়িয়ে পড়বে তাঁর খ্যাতি। আজ তাঁর নাম ঘোষণা করব৷ সে এই কলেজের মুখ উজ্জ্বল করেছে সেই প্রথম স্থান অধিকারি আর্টিস্ট…

এইবলে স্যার একটু থামেন। সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে সেই সেরা আর্টিসকে দেখার জন্য। মেঘ দুহাত মুঠি করে প্রার্থনা করতে থাকে। নওরিন ও প্রার্থনা করছে মেঘের জন্য। স্যার নাম ঘোষণা করতে রেডি হয়ে বললেন,

_সেই সেরা আর্টিস্ট হলো কাশফিয়া হাসান মেঘ। স্যার এনাউন্সমেন্ট করার সাথে সাথে সবাই হাততালি দিতে শুরু করে। ঠিক সেই সময় ফোন আসে শ্রাবণের ফোনে। শ্রাবণ ফোনে কথা বলতে বলতে উঠে বাইরে চলে আসে। আদনান শ্রাবণের পিছু পিছু এসে শ্রাবণকে বলল,

_কী রে কই যাস?
_দুস্ত আ’ম সরি! আমাকে এখনি বাসায় যেতে হবে।
_এখন?
_হ্যাঁ, প্লিজ রাগ করিস না। আমি নেক্সট উইকে তোদের সাথে দেখা করব।
_কিন্তু বিজয়ীকে দেখবি না। যে আজ গোল্ড মেডেল নিবে?
_আজকে আর পারছি না। ওনার নাম তো শুনলাম। অন্য একদিন আসবো তাঁর কাছে এই আর্টের একটা ক্যানভাস চাইতে।
_আচ্ছা ঠিক আছে বাই। পৌঁছে ফোন করিস।
_ওকে, আসছি।

শ্রাবণ আদনানকে রেখেই চলে গেল বাসায়।
এদিকে স্যার তখন মেঘকে স্টেজে যেতে বলেন, মেঘ দৌঁড়ে যায় স্টেজে, সবাইকে সালাম করে, হাত মিলায়, তারপর প্রধান অতিথির হাতে গ্রহণ করে স্বর্ণের মেডেল, সাথে স্বর্ণের তাজ, আর একটা সিল্কের কাপড়ের উপর লেখা ‘সেরা বিজয়ী’ এরপর একটা শুভেচ্ছা চিঠি। স্যার মেঘকে বললেন,

_এই পেইন্টিং এর ব্যাপারে কিছু বলো।
_জ্বী স্যার।
_কীভাবে তুমি কারো চেহারা এতো সুন্দর করে আঁকলে? কে এই চেহারার মানুষ?

মেঘ মাইক্রোফোনটা হাতে নেয়, সবাইকে সালাম দেয়, সবাই সালামের জবাব দিলে মেঘ বলতে শুরু করল,

_এই পেইন্টিং আর্টের পিছনে বিরাট রহস্য। আমি
পেইন্টিং এর প্রথম অংশ অর্থাৎ এই মানুষটার দু’টো চোখ স্বপ্নে দেখতাম। রোজ দেখতাম, সে আমার স্বপ্নে আসতো আর আমার সাথে কথা বলতো,আবার কিছুক্ষণ পরেই চলে যেত। সাথে সাথে আমার ঘুমও ভেঙে যেত। ঘুম ভাঙার পর আমি চোখ বন্ধ করে এই ছবি আঁকতাম। ওই চেহারা সম্পূর্ণ আমার স্বপ্নে না আসলে ওই মানুষটার পুরো বডি আমার আইডিয়াতে চলে আসে। রোজ রোজ স্বপ্নে দেখা তারপর একদিন স্বপ্নে তাঁর সম্পূর্ণ চেহারা আবছা আসে, তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে আমি এই ছবিটা আঁকার চেষ্টা করি অবশেষে আমি সফল হই। ভেবেছিলাম আমার এই অচেনা দু’টো চোখকে আমি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিব যেন আমি এই চোখের আসল মানুষকে খুঁজে পাই। আমি জানি না এই চেহারার মানুষ আদৌ আছে কি’না তবে আমার মন বলছে এই স্কেচটাই আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবে। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন, যেন আমি এই মানুষটাকে খুঁজে পেতে সক্ষম হই। আসসালামু আলাইকুম।

৫!!
মেঘ স্টেজ থেকে নেমে সোজা নওরিনের কাছে আসে। নওরিন মেঘকে জড়িয়ে ধরে ইয়ায়াহু বলে চিৎকার দেয়। সবাই মেঘের কাছে এসে অটোগ্রাফ নিতে চায়, কেউ কেউ ফটোগ্রাফও নিতে। মেঘ সবাইকে অটোগ্রাফ দেয় কিন্তু ফটোগ্রাফ দেয় না কারণ সে চায় না তাঁর ছবিটা ইন্টারনেটে ভাইরাল হোক। তাই শুধু নিজের ট্যালেন্টটাকে তুলে ধরলো নিজের ফেইসটাকে নয়। সবাইকে অটোগ্রাফ দিয়ে মেঘ নওরিনকে নিয়ে স্টেজের বাইরে চলে আসে। লোকজনের অনেক ভীড়। মেঘ মুখ আড়াল করে সবাইকে লুকিয়ে বাইরে আসতেই পিছন থেকে সামি মেঘকে ডাক দেয়। মেঘ পিছনে থাকিয়ে দেখে সামি দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ একটু থামতেই সামি মেঘের কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বলল,

_হাই আ’ম সামি চৌধুরী,
_ আমি…
_জানি, কনগ্রেচুলেশন।
_থেংক ইউ।
_আমরা কি বন্ধু হতে পারি?
_অফকোর্স!
_আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি রাগ করবে না তো?
_মোটেও না।
_সত্যি কি ছেলেটা তোমার স্বপ্নে আসে? মানে, এতো সুন্দর স্কেচ, আমি জাস্ট ফিদা হয়ে গেছি।
_প্রশংসা একটু বেশি বেশি হচ্ছে।
_আরে না। এটা তোমার প্রাপ্ত অধিকার।
_থেংক্স এগাইন। হ্যাঁ ছেলেটা রোজ আমার স্বপ্নে আসে কিন্তু তাঁর আসল চেহারা আমি আজও দেখিনি। জানি না তাঁর নাম, তাঁর ঠিকানা, তাঁর আসল পরিচয়।
_যদি জানো তাহলে কী করবে?
_রোজ রোজ আমাকে বিরক্ত করার কারণ জানতে চাইব।
_ওয়াও! সে তোমাকে বিরক্তও করে
_হ্যাঁ করে তো, রোজ করে।
_আচ্ছা আজকে আসি, তোমার কন্টাক্ট নাম্বারটা কি পেতে পারি?
_শিওর।

মেঘ সামিকে নিজের কন্টাক্ট নাম্বার দিয়ে বিদায় নিয়ে রাস্তায় এসে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর আদনান এসে মেঘের পাশে দাঁড়ায়ে বলল,

_হাই মিস চিত্রশিল্পী মেঘ।
_হেই কেমন আছেন?
_ভালো, আপনি তো খুব ভালো স্কেচ আঁকতে পারেন।
_তেমন পারি না, তবে চেষ্টা করি।
_আপনি কি জানেন আপনি কার স্কেচ এঁকেছেন?
_না, আমি তাকে দেখিনি।

মেঘ আর কিছু না বলে চুপ করে থাকে। নওরিন আদনানকে বলল,

_আমার বেষ্টু আর স্বপ্নের রাজকুমারের স্কেচ তুলে ধরেছে। মেঘ নিজেও জানে না এই স্কেচ কীভাবে ওর কাছে এতো ইম্পর্ট্যান্ট হলো? আজ এই স্কেচটাই ওকে সবার সামনে তুলে ধরল। নতুন এক নামে আজ মেঘ সবার কাছে পরিচিত।
_আপনিও তো থার্ড হয়েছেন।
_আমি তো ওর মতো ভালো আর্ট করতে পারি না।
_তবুও আপনার আর্টটা অনেক সুন্দর হয়েছে। আমি যা জানতে আসছিলাম।
_কী জানতে চান?
_ওয়েট!

আদনান মেঘের পাশে গিয়ে নিজের ফোন বের করে গ্যালারি থেকে একটা পিক বের করে মেঘের চোখের সামনে তুলে ধরল। তারপর মেঘকে বলল,

_দেখুন তো এই মানুষটাকে চিনেন কি’না?

মেঘ আদনানের কথায় মোবাইলের দিকে তাকায়। চট করেই আদনানের হাতের ফোন নিজের হাতে আনে। দু’চোখ ভরে তাকিয়ে দেখছে ছবিটাকে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেঘের চোখ থেকে দু’ফোঁটা সুখের অশ্রু ঝরে পড়ে। মেঘের বিশ্বাসই হচ্ছে না মেঘ সামনে থেকে এই মানুষটাকে দেখবে। আদনান আবারও বলল,

_কী হলো? চুপ করে আছেন কেন? চিনতে পারেন নি তাকে?
_হুম, এটা তো আমার স্কেচে আঁকা মানুষটার ছবি।
_হ্যাঁ, আপনি জানেন ও কে?
_না! আমি তো আজকেই প্রথম দেখলাম।
_এই সেই ছেলে যে আপনাকে সেদিন পানির বোতল দিয়ে হেল্প করতে বলেছে, আমার বন্ধু।
_কী! ওনি?
_হ্যাঁ শ্রাবণ মাহমুদ। আজ এখানেই এসেছিল, পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কিন্তু তোমাকে দেখার আগেই জরুরি ফোনের টানে চলে যায়?
_ওহ,
_ওফস স্যরি, তুমি বলে ফেলেছি।
_ইট’স ওকে।
_আমার বন্ধুকে একটা হেল্প করবেন।
_কীভাবে?
_ও আপনার আঁকা কিছু বেষ্ট পেইন্টিং নিতে চায় আপনি কি তাকে দিতে পারবেন?
_দিবো, একটা শর্তে।
_কী শর্ত?
_আপনি যে আমাকে চিনেন সেটা তাকে বলবেন না। ওনি তো আমাকে দেখেননি, আমি ওনাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই।
_ওকে, আমি বলবো না। কবে পাচ্ছি সেই পেইন্টার গুলো?
_আগামী বৃহস্পতিবারে আমার ভার্সিটিতে গেলে আমাকে পেয়ে যাবেন। সাথে আপনার বন্ধুর জন্য পেইন্টার। আর হ্যাঁ আপনার বন্ধুকে সাথে আনতে পারবেন না।
_ওকে, থেংক ইউ।
_ওয়েলকাম! বাই।
_বাই, সি ইউ।

মেঘ আর নওরিন আদনানকে রেখে চলে আসে।মেঘকে নামিয়ে দিয়ে নওরিন চলে যায়। মেঘ বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। প্রাইজ গুলো বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিয়ে খুশিতে জড়িয়ে ধরে।

চলবে…

( ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here