#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_02
#Writer_NOVA
লম্বা লম্বা পা ফেলে উপরের কামরায় চলে এলো ফুল। শুভ তখনও পুরো রুম ওলট-পালট করে ফেলেছে তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটার জন্য। ফুলের বেশ রাগ হলো৷ এই মানুষটার লাজলজ্জা বলতে কিছু নেই। নয়তো নিজের গোপনীয় জিনিসকে কেউ মাইকের মতো হাঁক-ডাক ছেড়ে চেঁচিয়ে বলে। মনে মনে বললো, লোকটা আস্ত একটা খাটাশ। মানুষের পর্যায় পরে না।
‘কি হয়েছে এমন ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছো কেনো?’
‘তোর নানীর হা’ঙ্গা লাগছে তাই।’
‘ছিঃ তোমার মুখের কি ভাষা শুভ ভাই! তোমার আচার-ব্যবহার, কথা বলার ধরনে ছাতকুরা পরছে। এমন এমন কথা বলো যে রাগ উঠয়ি দাও। আক্কেল বুদ্ধি কি মাথা থেকে গলে পরেছে? সাবধান করে দিচ্ছি আমার নানীকে নিয়ে কিচ্ছু বলবে না।’
‘একশবার কমু। তুই জলদী আমার আন্ডারওয়্যারটা খুঁইজা দে। আমার দেরী হইয়া যাইতাছে।’
‘এমন করে বলছো যেনো তোমার ঐ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা আমি পরে বসে আছি।’
শুভ চেয়ারের জামাকাপড় ভুড়ের থেকে শার্ট বের করে পরতে পরতে বললো,
‘বসে থাকবি কেন দাড়ায় আছিস তো।’
‘ছিঃ বেশরম! মুখে কিছু আটকায় না।’
মুখ ভোঁতা করে ফুল চলে যাওয়ার পথ ধরলো ফুল।শুভ পেছন থেকে ডাকলো,
‘আরে আরে কোথায় যাস? খুঁজে দিয়ে যা।’
‘পারবো না। তোমারটা তুমি খুঁজে নাও।’
নাক ফুলিয়ে বললো ফুল। পেছন থেকে হু হা করে হাসির শব্দ পেয়ে একবার দাঁত কটমট করে তাকিয়ে প্রস্থান করলো সে।
মাটির উনুনের পাশে বসে রান্না করছে ফুল। মোটামুটি সব কাজ সে পারে। তবুও চাচীর কাছে সময়ে-অসময়ে কথা শুনতে হয়। সময়তে চুপ থাকে তো সময় তে আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দেয়। আনোয়ার সর্দার ভাতিজিকে ভীষণ ভালোবাসে। আর শুভ সে তো সুযোগ পেলেই ফুলের সাথে লাগবে। তবে ফুলের সবদিকে তার তীক্ষ্ণ নজর থাকে। মাঝে মধ্যে বাড়ির জন্য মন কাঁদে ফুলের। কিন্তু তার বাবা বলেছে আরো কিছু মাস এখানে থাকতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তবেই নিয়ে যাবে তাকে৷ ছোট ভাই-বোনদের জন্য রাতের আঁধারে ডুকরে কেঁদে উঠে। জ্বলন্ত আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে কতকি ভাবছিলো ফুল। হঠাৎ দাদীর গলা পেলো।
‘ঐ ছেমড়ি হা কইরা কি দেহস? লাড়কি ঠেলা দে। একটা কামও করতে পারে না। সব কাম দেহায় দিতে হয়। মায় শিগাইছে কি? পারোস খালি মায়ের মতো বড় ঘরের পোলা পটাইতে।’
বয়সের ভারে অনেকটা নুয়ে পরেছে সুফিয়া বিবি। তবুও রোগ-বালাই তাকে ধরতে পারেনি। এখনো লাঠিতে ভর করে টুকটুক করে সারা বাসায় হাটে। সবকিছু তার নখদর্পনে থাকা চাই। আগাগোড়া সবদিকে নজর তার। এখনও পরিবারের সবাই তাকে কম-বেশি মান্য করে। শুধু শুভ, ফুল তাকে এক প্রকার সহ্য করতে পারে না। কুটনামির করার কারণে।
ঝুমুর ছোট টেপের পানিতে ঝাঝড়ি দিয়ে ভাজি ধুচ্ছিলো। একবার সুফিয়া বিবির দিকে তাকিয়ে মুখ বাকালো। তারও ইচ্ছে করছিলো বুড়িকে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু সে বাড়ির কাজের মেয়ে বলে সাহস পায় না। তবে সোহেলী বেগম ও সুফিয়া বিবিকে দেখলে তার রাগে পিত্তি জ্বলে যায়। বিশেষ করে যখন তারা দুজন মিলে ফুলকে অপমান করে তখন।
লাঠি দিয়ে খোঁচা মেরে ফের জিজ্ঞেস করলো,
‘ঐ ছেমরি কি কই হুনোস না? ভালো কইরা কথা কইলে হুনবো না। যহন ধাওয়ানি দিমু তহন ভালো লাগবো।লাড়কি ঠেলা দে।’
ফুল ঠান্ডা দৃষ্টিতে দাদীর দিকে তাকালো। তাতে সুফিয়া বিবির কোন হেলদোল দেখা দিলো না। দন্তহীন মাড়িতে পান চিবুতে লাগলো। ফুল উঠে রান্নাঘরের বাইরে যেতে যেতে বললো,
‘এতই যখন কাজের তাড়া তাহলে নিজেই করুন। আমি পারবো না। যদি মন চায় নিজে বসে বসে জ্বাল করুন।’
তিরিক্ষি মেজাজে কথাগুলো বলে নিজের রুমের পথ ধরলো। উঠোনের মাঝে সোহেলী বেগমের সাথে দেখা হলেও সে কথা বললো না। পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
‘হে কতবড় সাহস, আমারে কয় চুলার জ্বাল ঠেলা দিতে। কিছু কই না দেইখা ও খালি বাড়তাছে। আমার বাড়িত থাইকা আমারে কামের হুকুম করে।’
‘কি হইছে আম্মা?’
‘কি হইবো আবার? ফকিন্নির নাতনীরে ঘরে তুলছি না। আর কি হইবো?’
ঝুমুর মুখ টিপে হেসে চেচিয়ে বললো,
‘আল্লাহ, দাদী আপনে ফকিন্নি?
‘আমি ফকিন্নি হমু কেন? খান বংশের মাইয়া আমি।’
‘ফুল তো আপনেরি নাতনী। তাইলে কি দাড়াইলো?’
হাতে থাকা লাঠি উঁচিয়ে রাগী গলায় সুফিয়া বিবি বললেন,
‘ঐ ছেমরির লগে থাকতে থাকতে তোরও মুখের খই ফুটছে দেহি।’
সোহেলী বেগম চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠলো,
‘চুপ কর। নিজের কামে মন দে। যদি আজকে ভাজিতে বালি কিচকিচ করে তাইলে তোরে ভাজি করমু।’
বিকালের তপ্ত আলোয় পুরো গ্রামটাকে অপরূপ লাগে। শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশটা ফুলকে ভীষণ কাছে টানে। প্রতি বিকালে তার বের হওয়া চাই। কখনো ময়নার সাথে বসে পুকুর ঘাটে গল্প জমায় নয়তো কখনো একা একা এদিক সেদিক হেঁটে বেড়ায়। আজও চুল আঁচড়ে বাইরে যাওয়ার পথ ধরলো ফুল।
আজকে তেমন কাজ নেই আনোয়ার সর্দারের। যা আছে শাগরেদরা সামলে নিতে পারবে। সামনের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে বই নিয়ে বসেছেন। অবসর সময়ে বই পড়া তার নেশা। ফুল তখন বেণী নাচিয়ে নাচিয়ে সেদিকে আসছিলো। দেখেই কাছে ডাকলেন।
‘ফুল মা এদিকে আয়।’
‘কিছু লাগবে চাচা?’
‘না, আমার কাছে বয়।’
পাশের টুলটাকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো আনোয়ার সর্দার। ফুল ভদ্র মেয়ের মতো বসে উন্মুখ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কিছু বলবেন?’
‘তোরে দেখলে দিলডা শান্তি লাগে। মনে হয় নিজের ভাইডারে দেখতাছি। তুই একটু পাশে বইয়া থাক। আমি তোরে দুই চোখ ভইরা দেখি।’
‘বই পড়বেন না?’
‘না, ভালো লাগতাছে না।’
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আনোয়ার সর্দার। ফুল নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। ঠিক বসে নেই। চাচার শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছে। চাচার শরীর থেকে বাবার শরীরের মতো ঘ্রাণ আসছে। এটাই বোধহয় আপন রক্তের ঘ্রাণ। নিজের মাথাটা অনেকটা পাতলা লাগছে ফুলের। কতদিন ধরে বাবার স্পর্শ পায় না সে। প্রায় সময় সে ঘুমিয়ে থাকলে আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে যেতো তার বাবা। ঘুমের ঘোরেও সে টের পেতো।
‘বাড়ির লিগা অনেক খারাপ লাগে না?’
‘এতটুকু তো লাগবেই চাচা।’
‘চিন্তা করোস কেন? তোর চাচা আছে না?’
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি চাচা?’
হাত বুলানো থামিয়ে নড়েচড়ে বসে বললো,
‘হুম কর।’
‘আপনি গ্রামের চেয়ারম্যান। লেখাপড়া জানেন। তবুও এভাবে কথা বলেন কেন?’
আনোয়ার সর্দার বইয়ের পাতা উল্টে সযত্নে বন্ধ করে দিলো। মুচকি হেসে ফুলের দিকে তাকালো। ওর চোখে উত্তরটা জানার আকুতি প্রকাশ পাচ্ছে।
‘আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে যেই শান্তি পাওয়া যায় তা শুদ্ধ ভাষায় নাই। আমার ভাল্লাগে নিজের গ্রাম্য ভাষায় কথা বলতে। এমনে কথা কইলে মনে হয় খেতের কৃষক, নদীর জেলে, কামার-কুমোর সব আমরা একি সমান। নিজে গো মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। একই গাঁয়ের সন্তান আমরা। বিভেদ কেন করমু?’
বিকেলে বাইরে যাওয়া হলো না ফুলের। সামনের বারান্দায় বসে চাচার সাথে ঘন্টাখানেক গল্প করলো। মাঝে চা বানিয়ে আনলো ফুল। চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে খেতে খেতে একদফা হাসিঠাট্টা হয়ে গেলো। তখন সোহেলী বেগম ও সুফিয়া বিবি দুজনো ভাতঘুম দিয়েছেন। নয়তো আবার এক পশলা খিটমিট করতো।
হাঁস, মুরগী আটকে কলপাড়ে গিয়ে হাত-মুখ ধুলো ফুল। মাগরীবের আজান দিয়ে দিবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো ধীরে ধীরে আধার নামছে৷ ওজু সেরে নিলো। নিজের কামরার দিকে পথ ধরতেই স্টিলের সদর দরজাটা বারি পরলো। এই ভরসন্ধ্যায় কে এলো তা বুঝলো না ফুল। তার সাহসে কুলাচ্ছে না একা গিয়ে দরজা খুলতে।গতবার এভাবেই ভরসন্ধ্যা বেলা মকবুল মেম্বারের বাড়ি ডাকাতি হয়েছিলো। একা মেম্বারের বউ দরজা খুলে দিতেই বেশ মেরেছিলো। ঝুমুরের মুখে বহুবার শুনেছে সেই গল্প। তারপর থেকে সে ভরসন্ধ্যা বেলা কিংবা রাতের বেলা একা দরজা খুলতে আসে না। গলা ছেড়ে ঝুমুরকে ডাকলো,
‘ঝুমুর আপা, এই ঝুমুর আপা! দেখে যাও তো কে এসেছে?’
ঝুমুরে সাড়াশব্দ নেই। এদিকে দরজায় একের পর এক কষাঘাত পরছে৷ বুকে থুথু দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভীরু পায়ে সামনে এগুলো ফুল। আল্লাহ, আল্লাহ করতে করতে দরজা খুললো। দরজা খুলে হতভম্ব। শুভ এক হাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলকে দেখে ধমকে উঠলো,
‘এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?’
টলতে টলতে ভেতরে ঢুকলো। ফুল ভালো করে শুভর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে তোমার? আজ এতো জলদী ফিরলে যে?তোমার নাক-মুখ লাল কেনো শুভ ভাই? তুমি কি আজও মা’রামা’রি করে এসেছো?
#চলবে