কোন সুতোয় বাঁধবো ঘর পর্ব ১০

0
190

#কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১০

মেঘাচ্ছন্ন আকাশে কালো মেঘের ভেলা৷ ফজরের আগে থেকে থেমে, থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এখন যদিও বৃষ্টি নেই তবে,আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। ইরহা সেই কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে, সব কাজ গুঁছিয়ে নিচ্ছে। আজ সে জবের জন্য তিন’ অফিসে ইন্টারভিউ দেবে৷
সকাল টাইমে নওশবা বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে। সেই সুযোগে সব কাজ করে নিচ্ছে। রান্না শেষ করে; লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। পরোনে রয়েল ব্লু আর গোল্ডেন কালারের মিশ্রণে একটা হালকা কাজের কটন থ্রিপিস। ও বাড়ি থেকে আসার সময়, রবিনের দেয়া কিছু নিয়ে আসেনি। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে। ঠিক তখন মনে হলে, জীবনটা এমন না হলেও পারতো! একটা ছোট জীবন;তারমধ্যে এতো ট্রাজেডি। চোখের কার্নিশে জমে থাকা জলগুলো গড়িয়ে পরার আগেই মুছে নিলো।নিজেই; নিজেকে বলছে,আমি কাঁদবো না!আমি তো নিজেকে, মুক্ত করেছি একটা অসুস্থ সম্পর্ক থেকে!আমার মেয়ে আর আমি’আমাদের একটা পৃথিবী গড়বো।দ্রুত রেডি হয়ে নাস্তা করে, মেয়েকে খাইয়ে নিজের মায়ের কাছে রেখে যাচ্ছে।ভেতরে থেকে দলা পাকিয়ে আসা কান্নাগুলো বারবার সংযাত করছে। জন্মের পর থেকে মেয়েটাকে এক সেকেন্ডের জন্য চোখের আড়াল হতে দেয়নি। এখন থেকে হয়তো রোজ মেয়েটাকে রেখে যেতে হবে। নওশাবার কপালে চুমু দিয়ে বের হয়ে গেলো। একটা রিকশা ডেকে, তাতে উঠে বসলো,পার্স থেকে টিস্যু বের করে, চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু মুছে নিলো। রিকশা চলছে আপন গতিতে। এই জবটা হলে ইরহার জন্য ভালো হয়। কারণ এই অফিসটা মোটামুটি কাছাকাছি। সকাল দশটায় ইন্টারভিউ। এখন বাজে ন’টা পঞ্চাশ। আরো অনেকই এসেছে, তাদের সাথে ইরহাও বসে আছে। জীবন কখন কোন পথে এনে দাঁড় করায় কেউ বলতে পারে না!ইরহা কি কখনো ভেবেছিলো,তার স্বপ্নের সংসার ছেড়ে এভাবে সিরিয়ালে দাঁড়াতে হবে জবের জন্য! জীবন এক প্রহেলিকার নাম। তার প্রতিটি অধ্যায় কি আছে কেউ জানেনা। আমরা হঠাৎ হঠাৎ নতুন নতুন প্রহেলিকায় জড়িয়ে পরি।
অনেক অপেক্ষার পর ইন্টারভিউ হলো। কিন্তু এখানে বিবাহিত নেবে না। ইরহা এই লজিকের আঁগা মাথা বুঝলো না। আচ্ছা এটা কেমন রুলস? ভঙ্গ হৃদয়ে বেরিয়ে পরলো আরেকটা ইন্টারভিউ দিতে সেটার টাইম দুপুর বারোটা। এরপরের টা বিকেল তিনটে।
গন্তব্যে পৌঁছে অপেক্ষা করছে। কিন্তু এখানেও হলো না। একে একে সব ইন্টারভিউ দিয়ে ক্লান্ত পথিকের মত বাসার পথ ধরলো। লোকাল বাসে মানুষের ভিড় আর অসহনীয় গরম, পেটের খুদা, মনের যন্ত্রণা। অথচ এতো মানুষের মধ্যে কেউ তা জানেনা। মানুষের খোলস এতো শক্ত!উপর থেকে দেখে ভেতরটা বোঝাই যায় না! বাস থেকে নেমে কিছু পথ হেঁটে রিকশা নেয়ার চিন্তা করলো ইরহা। মনের মত শত চিন্তা নিয়ে হাঁটছে, হঠাৎ চোখ পরলো রাস্তায় পাশে বেঞ্চে এক মহিলা বসে কাঁদছে। ব্যাস্ত রাস্তা মানুষ আসছে, যাচ্ছে অথচ কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। ঢাকা শহরের মানুষদের মন কি?সত্যি ইট,পাথরের মত শক্ত থাকে?সবাই কেমন নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত কেউ ম’রে গেলেও ফিরে তাকায় না। ইরহা মহিলাটার পাশে যেয়ে বসলো,দিন গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা নামছে। ইরহা নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো, বোন আপনার কি হয়েছে?
“কি হবে বলুন! কি হওয়ার আছে? বিয়ে হয়েছে তিন বছর, পান থেকে চুন খসলেই গায়ে হাত। মনে হয় আমি মানুষ না!মধ্যবিত্ত পরিবাবের মেয়ে আমি’ এক ভাইয়ের আয়ে সংসার চলে,তাই মুখ বুঝে সব সহ্য করি।যখন আমার স্বামী আমাকে প্রচন্ড আঘাত করে, তারপর বাবাকে নয়তো মা’কে কল করে কথা বলি।কান্না গিলে তাদের কন্ঠ শুনে নিজেকে স্বান্তনা দেই। ভাবি এদের জন্য হলেও মানিয়ে নিতে হবে।জানেন আপু মাঝে মাঝে মনে হয়, “আমি কালো হয়েছি সেটাই ভালো!আচ্ছা যদি ফর্সা হতাম, তাহলে শরীরের এই আঘাতের চিহ্ন কি করে লুকাতাম?নিজের হাতে রান্না করে খাইয়ে তার শক্তি যোগাই। আর সেই শক্তি দিয়ে সে আমাকেই আঘাত করে।আচ্ছা আঘাত করার সময় কি আমার অসহায় মুখটা দেখে তার মায়া হয় না? বউ নাকি ভালোবাসার জিনিস!তাহলে তার শরীরে আঘাত করে কি করে? রাগ করে সেই দুপুরে বাসা থেকে বের হইছি, ভাবছি স্বামী নামক মানুষটা আসবে,কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামছে ‘সে আসলো না। বাবার বাড়িতে যে,যাবো সে উপায়ও নেই।
ইরহা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,এখন রাত নামছে,একটা মেয়ের জন্য রাত হলো জঙ্গল আর মানুষগুলো পশু। সুযোগ পেলেই খাবলে খাবে।তাই বাসায় চলে যান। আর হ্যা প্রতিবাদ করুন। তারপরেও যদি না শুধরে নেয়। তাহলে তাকে ছেড়ে দিন। জীবন একটাই কারো পায়ের তলে পিশে মরার চেয়ে মাথা উঁচু করে একদিন বাঁচলেও শান্তি।
‘ধন্যবাদ তোমাকে বোন। এটাই শেষ ভরসা। তবে আসল কথা হলো,রুপ আর টাকা ছাড়া মেয়ে হয়ে জন্মানোই হয়তো,সবচেয়ে বড় অন্যায়।
‘না গো বোন, ভুল বললে, রুপ,বাবার নাম, ভাইয়ের টাকা,কোন কিছুই মূলত কারণ না। কারণ হলো কিছু মানুষ আর তাদের হায়েনা মনোভাব। আচ্ছা বোন উঠে পরো রাত হওয়ায় আগেই ফিরে যাও। আমাকেও যেতে হবে,আমার ছয় মাসের বাচ্চাটাকে রেখে এসেছি বাসায়।
” দু’জনেই উঠে হাঁটা শুরু করলো,রাস্তাটা ভিন্ন কিন্তু উদ্দেশ্য এক।”নতুন করে বাঁচা।


বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা ছাড়িয়েছে,সারাদিনের না খাওয়া ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে কোনমতে, ঘরে ঢুকতেই চোখে পরলো নওশাবাকে কোলে নিয়ে বসে আছে রবিন৷ তার পাশেই শেফালী বেগম।
ইরহা ঘরে ঢুকেই এক প্রকার ছিনিয়ে নিলো,রবিনের কোল থেকে নওশাবাকে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,মা’এনারা কারা?আর এখানে কেন এসেছে? কান খুলে শুনে রাখো, এদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। বলেই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। শেফালী বেগম, সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে বলে,মা’আমরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছি। প্লিজ ফিরে চলো। তোমাকে রাজরানি করে রাখবো। আমার নাতনী কে আর তোমাকে ছাড়া,আমার বাসাটা কেমন মরুভূমি।
“আপনি হয়তো ইসলামি বিধান সম্পর্কে অবগত না। তাই এসব বলছেন। যেদিন আপনার ছেলে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে, সেদিন থেকে আমার জন্য আপনার ছেলে বাহিরের পুরুষ। আর যেখানে আপনার ছেলের সাথে কোন সম্পর্ক নেই, সেখানে আপনিও অপরিচিত।এসেছেন চা,নাস্তা করুন চলে যান।
” ইরহা এভাবে ফিরিয়ে দেবে আমাকে! রবিনের রসালো কথা শুনে ইরহার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। লাবিবার কোলে নওশাবাকে দিয়ে পাঠি দিলো। তারপর হাত তালি দিয়ে বলে,বাহহহহ মিস্টার রবিন’আপনি তো দারুণ অভিনয় করতে পারেন! তবে এসব অভিনয়ে আপনার এক্স ওয়াইফ ইরহা গলে যেতো। কিন্তু আপনার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে নওশাবার মা’ আর সে কোন সস্তা অভিনয়ে গলে না।ভদ্র ভাবে এখান থেকে চলে না গেলে!অপমান করে বেড় করে দেবো।এবার আপনারা ঠিক করুন, কোনটা চান?
‘এতো দেমাগ ভালো না।মানলাম রবিন ভুল করেছে, তাতে কি ওতো নিজের ভুল স্বীকার করে নত হয়ে,তোমাকে নিতেও এসেছে। নিশাত বললো কথাগুলো।
‘ভাবি তোমার হ্যাসবেন্ড আরেকটা বিয়ে করে, তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার কিছুদিন পর আবার তোমাকে আনতে গেলে তুমি কি করতে?
‘একদম বাজে বকবে না ইরহা!তোমার ভাই কখনো এরকম করবে না। এসব অলুক্ষণে কথা মুখেও আনবা না।
‘তাহলে মেয়ে হয়ে কিভাবে তুমি আমাকে এমন কথা বলো? যেই জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারছো না! সেই জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি! এখন ভুল বুঝতে পেরে কি হবে? ধরো তুমি আমাকে হত্য করলে, এপর মনে হলো তুমি ভুল করেছ। তখন কি আমাকে আবার জীবিত করতে পারবে? তালাক মানে বিয়ে কে হত্যা করা। আর মৃত মানেই শেষ। তা আর শুরু করার কোন রাস্তা নেই।

#চলবে
আসসালামু আলাইকুম।প্রিয় পাঠক/পাঠিকা,গল্পটা আমি ধীরে ধীরে আগাবো। তার কারণ হলো ইরহার লড়াইটা ফুটিয়ে তোলা।একজন ডিভোর্সী মেয়ের পথ চলা সমাজে সহজ না। হুট করেই কোন কিছু হবে না। তাই ধৈর্য নিয়ে সাথে থাকুন।
হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here