কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ পর্ব ৫

0
1110

#কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ
#পর্বঃ ০৫
#JannatTaslima (writer)

— আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি।

আমার উক্তিতে সবাই চমকিত শুধু একজন ব্যতিত।সেই ব্যাক্তিটি এবার বলে উঠলো,
— আমি প্রথমেই ভেবেছিলাম এখানে কোনো ঘাপলা আছে। নইলে কেউ এতদূর শুধু এভাবে একটা ব্যাগ নিয়ে আসে।আসার সময়তো কিছু খান ও নি।কেমন যেন অস্হির হয়ে ছিলেন পুরো রাস্তা।
— আহ চন্দ্র; তুমি থামো ওকে বলতে দাও।বলো মা তুমি এতো বড় পদক্ষেপ কেনো নিলে? তুমি কী কাউকে ভালোবাসো???( চন্দ্রকে থামিয়ে আন্কেল বললেন)
— না আন্কেল তেমন কিছুই না। আমি ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নেওয়ার জন্য পালিয়ে এসেছি।
— কেনো তোমার পরিবার কী তোমাকে পড়াতে চায় না?
— না আসলে, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হয়ে যায়।আমরা তিন ভাইবোন সহ মায়ের দ্বায়িত্বও চলে যায় চাচাদের উপর।জীবনের সবক্ষেত্রে চলে আসে সংকীর্ণতা। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলাম আমরা সবাই চাচাদের পরিবারে। যৌথ পরিবারে থাকলেও আমার চার জনের কোনো আয় নেই শুধুই ব্যয়।তাই সব ক্ষেত্রে সবকিছু অন্যান্য চাচাতো ভাই-বোনদের মতো পাওয়া হয়ে উঠে নি আমাদের। তবে পড়ালেখায় ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছিলাম আমরা তিন ভাইবোন। সে কারণে চাচারা এ ব্যপারে কোনো সংকীর্ণতা দেখাননি। অথচ ছোট চাচীর এ ব্যপারে ঘোর আপত্তি ছিল। কারণ হলো আমরা তিন ভাইবোনই তার তিন সন্তান থেকে এগিয়ে ছিলাম।যা তাকে ব্যপক পীড়া দিতো।আদনান আরিয়ানের ব্যপারে তেমন গুরুত্ব না দিলেও আমার বিষয়ে তিনি প্রতিবারই বাধা দিতেন।তার দুই মেয়ে আমার বয়সে বড় হলেও একজন আমার সাথে পড়তো,অন্যজন আমার জুনিয়র ছিলো। তার তিন ছেলে মেয়েই বার্ষিক পরিক্ষার কারণে আমাদের থেকে পিছিয়ে ছিলো। যাতে বড় চাচা ও ছোট চাচা খুবই অসন্তুষ্ট থাকতেন।এভাবেই এইচএসসি পাশ করি।আমার অনার্স নিয়ে পড়ার প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু ছোট চাচার সিদ্ধান্ত আমি আমাদের নিকটবর্তী কলেজে ডিগ্রি নিয়ে পড়বো।যদিও তার ইন্ধন জুগিয়েছেন ছোট চাচী। কারণ, মনিরা আপুর এতো কম মার্কসে কোনো ভার্সিটিতে চান্স হবে না।আমার পক্ষে তা মেনে নেয়া সম্ভব ছিলো না। তাই আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি।
— আর ইউ স্টুপিড! এতো ছোটো কারণে কেউ এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে।তুমি সেখানে থেকে ফাইট করতে পারতে,তাদের বুঝাতে পারতে,এরকম পালিয়ে আসা তোমার একদমই ঠিক হয় নি
— হ্যা আঁধার, ভাইয়া ঠিকই বলছে।তোমার এভাবে পালিয়ে আসা ঠিক হয় নি।তোমাকে তো আমার যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মনে হয় তুমি এরকম একটা বোকামি কিভাবে করতে পারলে????
( চাঁদনির প্রশ্নবাচক বাক্যে আমি একটু অপরাধবোধ করলাম না।কারণ ওতো আসল কারণ জানে না আসলে আমি কেনো পালিয়ে এসেছি। হ্যা যেটা বলেছি সেটা মিথ্যে না।আমি প্রতিবারের মতো নিজের ইচ্ছাকে বুকে চেপে ছোট চাচার ইচ্ছার সাথে সমঝোতা করে নিয়ে ছিলাম।তাই এটা আমার পালিয়ে আসার কারণ ছিলো না।
হঠাৎ চন্দ্রের মুখনিঃসৃত এক ভয়ানক বাণী শুনে আমি আতংকগ্রস্ত হয়ে উঠলাম)
–আমি এক্ষুনি বড় মামার কাছে কল দিয়ে ওনার বাড়ির নাম্বার আনছি,ওনাদের এটলিস্ট জানা উচিত আধারিকা এখানে আছেন।
এটা কী বললেন চন্দ্র আমার বাড়িতে জানিয়ে দিবেন।এখন আমার কী হবে!তারা তো জানা মাত্রই আমায় অনতিবিলম্বে এখান থেকে নিয়ে যাবে। আমার বাড়ির লোকের নিকট তাদের মান সম্মান সব চেয়ে উপরের সাড়িতে।যদিও তা এখন আমি বজায় রাখি নি।আগেতো একটাই দোষ ছিলো তাদের অন্যায় সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেই নি।আর এখনতো আমার অপরাধ অনেক বড় হয়ে গেছে। না আমি আর নিতে পারছি না।আমি নিজের ভবিষ্যত পরিস্থিতি স্বচক্ষে বর্তমান দেখছি।আমি মেজেতে বসে পড়লাম। কান্না গলায় দলা পেকে গেছে। তবুও কিছু বলতে হবে,
–আমি দুই হাত জুড় করে বলছি, আমি আপনাদের বাসা থেকে চলে যাবো। কেউ জানতেও পারবে না আমি এখানে ছিলাম। দয়া করে আমার বাড়িতে বলবেন না আমি এখানে আছি। প্লিজ আমার প্রতি এইটুকু দয়া করুন।

আমার আচরণে সবাই হতবাক। চাদঁনি দ্রুত গতিতে আমার পাশে বসলো।কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা স্বরুপ বলল,
–আঁধার তুমি ঠিক আছো তো।তুমি চিন্তা করো না, আমরা কেউ তোমার বাড়িতে খবর দিবে না।কেউ জানবে না তুমি এখানে আছো।
তৎক্ষনাৎ চাদঁনিকে ধমকে চন্দ্র বললেন,
–কীসব উল্টা পাল্টা কথা বলছিস চাঁদনি? তর মাথা ঠিক আছে? একটা মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা মানে বুঝিস,তার বাড়ির লোকেরা গ্রামে মুখ দেখাবে কী করে?ঔ টা শহর না ঔ টা গ্রাম। আর জীবন কোনো সিনেমা না।

শেষোক্ত কথাটা আমার দিকে থাকিয়ে স্থির স্বরে বললেন। আমি বেশ বুঝতে পারছি লোকটা আমার কর্মকান্ডে অসন্তুষ্ট। আসলেই কী আমি ভূল করেছি।পৃথিবীর সব থেকে নিরাপদ স্থান হলো পরিবার। সেই সর্বশ্রেষ্ট নিরাপদ স্থানে যখন আমি অনিরাপদ হয়ে গেলাম। তখন আমার কী-ই বা করার ছিলো। আমার কিছু বলার আগে আন্কেল বললেন,
–আহ! চন্দ্র থামো তো।কেউ নিজের আশ্রয় স্থল থেকে এমনি এমনি পালিয়ে আসে না।নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।চাঁদনি ঠিকই বলছে আমাদের এখন কাউকে কিছু জানানো ওচিত না।
–বাবা তোমারও কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওনিতো বললেনই ওনি কেনো পালিয়ে এসেছেন,তারপরও তুমি এরকম কথা কীভাবে বলছো? আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,
আর এই যে শুনছেন,আমার মনে হয় না আপনি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন।আপনার ফিরে যাওয়া উচিত। আপনাদের জেলা শহরেও তো অনেক ভালো ভালো ভার্সিটি আছে। সেখানে অ্যাডমিশন নিতে পারেন।দরকার পড়লে আমরা আপনার বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলবো।

লোকটার প্রতি কেমন জানো রাগ হচ্ছে যদিও সে অযৌক্তিক কিছু বলে নি।আমি এবার শান্ত গলায় বললাম,
–দেখেন আমি আপনাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।আপনারা আমায় অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তা থেকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। আমায় সারাদিন আপনাদের বাসায় তাকতে দিয়েছেন।কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেই নি। বরংচ আমার মায়ের আদেশেই এসেছি। এখন আমি এতো দূর এগিয়ে পেছন ফিরতে পারবো না। আমার নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নিতে পারবো।আসি, বলে আন্কেল আর চাঁদনির দিকে একবার দৃষ্টি দিলাম।

পড়নেতো বোরখা রয়েছেই।বিকেল হয়ে গেছে বলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেইতো এতে প্রশ্নের সম্মুখীন। হাতে থাকা কলেজ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম।আন্কেল ও চাঁদনির অনেক পিছু ডাক শুনতে পাচ্ছি।মন পিছু ফেরে তাকাতে চাইলেও মস্তিষ্ক সায় দিলো না।আমার আপনজনরা যখন আমায় বুঝলো না তখন তারা আমায় কী বুঝবে। হয়তোবা আমার কর্মে তারা সবাই আশ্চার্যান্বিত।আর আমার কথায় ও।কোন মা-ই বা তার যুবতী মেয়েকে এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়।

——————————-

বারো তলা বিশিষ্ট ভবনের নিচে দাড়িয়ে আছি আমি। ভবনের ফটক পেরুতেই মনে নানান দুশ্চিন্তার আনাগোনা হতে লাগলো। আমার আন্দাজ টাই সঠিক হলো, আজ হয়তো সারাদিন সূয্যি মামা লুকোচুরি খেলেছে। তা বর্তমানে আসন্ন ঝড়ের অবকাশ দেখে বুঝতে পারছি। আকাশের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বির বির করে বললাম,
“আমার যে গতি তোমারও সেই গতি”। প্রকৃতির এমন বেহাল অবস্থায় কোথায় যাবো আমি। এই শহরের রাস্তাঘাট কিছুইতো জানা নেই আমার। এই বাসায়তো আর কখনো ফিরে যাবো না।আস্তে আস্তে হাটা ধরলাম।এটা আমার নাম না জানা একটা আবাসিক এলাকা।রাস্তার দুই পাশ ঘেরা উঁচু প্রাচীর।এতো বড় বড় প্রাচীরে আমার যদি থাকার ছোট্ট একটা জায়গা হতো।আমার সব ভাবনায় ফোটা ফোটা জল পড়তে শুরু করলো। হ্যা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, হালকা হালকা বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে,বাতাস তো আর ফ্রী। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি।বিদ্যুৎ চমকানোর কারণবশত চোখ বন্ধ করে আছি। কী হবে এখন কিছুই জানি না।আল্লাহ সহায় হলেন,আমার সব ভাবনায় এখন আর বিন্দু মাত্র জল পড়ছে না।ঝড় কী থেমে গেলো নাকি!চোখ খুলে দেখি, না ঝড়তো থামে নি বরং সময়ের সাথে তীব্র হচ্ছে। পাশে তাকিয়ে দেখি,ওমা একি আমার সামনে তুফান দাড়িয়ে আছে। তা ও আবার আমার মাথায় ছাতা ধরে।মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
–আমার জন্য যতটুকু করেছেন তাই অনেক। আমায় আর কৃতজ্ঞ করবেন না।আমি নিজের ব্যবস্থা করতে পারবো।
–জ্বি, তাইতো দেখতে পাচ্ছি। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে নিজের খুব ভালোই ব্যবস্হা করছিলেন। বাসায় চলেন,ঝড় থামার পর যেখানে ইচ্ছা যাইয়েন।
–আপনি বললেন আর আমি চলে যাবো।খুব সোজা পেয়েছেন না।আমি ঝড়ের পর যখন যেতে পারবো,এখনোও যেতে পারবো। আপনার তা নিয়ে
কোনো চিন্তা করতে হবে না।
–দেখুন আধারিকা জেদ করবেন না।ঝড় এখনো ভালো করে শুরুও হয় নি। তাই চুপচাপ আমার সাথে বাসায় চলুন।বাবা, চাদঁনি টেনশন করছে। আর আপনি হয়তো খুব ভালো করে জানেন ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট মেয়েদের জন্য নিরাপদ না।

আমার কী করা উচিত বুঝতে পারছি না। এতো কিছুর পর এখন চন্দ্রের সাথে চলে যাওয়া কী আমার ঠিক হবে।তাছাড়া এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকটাও ঠিক না।আর এই দ্বায়িত্বশীল নাগরিকের ও ভরসা নেই কখন না বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেয়। ওনি এবার সাথে থাকা দ্বিতীয় ছাতাটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন,
–চিন্তা করবেন না। আমি আপনার বাড়িতে কিছুই জানাবো না।
হাজারও দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে ছাতাটা হাতে নিলাম। ছাতা মাথায় দিয়ে চন্দ্রের পিছু পিছু হাটছি।অন্ধকার প্রায় হতে চললো। আমার বোরখা ব্যাগ বলতে পারেন ভিজে একাকার।

{আজকে একটু বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করছি।জানি না আপনাদের মন মতো হবে কী না।আপনাদের মনে হতে পারে গল্পটা খুবই ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আধারিকার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার কারণ আমি এখনো কেনো পরিষ্কার করি নি।আমার মনে হয় ঔ রহস্য খোলার আগে এই প্রেক্ষাপটগুলো আনা জরুরি। যেটা আপনাদের যুক্তিসঙ্গত মনে নাও হতে পারে।তবে আমি উপন্যাসটা যেভাবে সাজিয়েছি সেভাবে যদি লিখি,আমার মনে হয় আমি সুন্দরমতো উপন্যাসটা শেষ করতে পারবো।ভুল ত্রুটি সবাই মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন।}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here