কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ পর্ব ২

0
1816

সদরে এসে পৌঁছেছি কিছুক্ষণ হলো।
অবসাদগ্রস্ত দেহ নিয়ে বাসে জানালার পাশের সিটে বসে আছি। চোখ বন্ধ করতেই আঁতকে উঠলাম পিছু পিছু কেউ এসে পরে নি তো।তৎক্ষনাৎ পিছু ফিরে নিজের অযথা দুশ্চিন্তা নিশ্চিত হওয়ার পর ও স্বস্তি পেলাম না।আবার সবকিছু মনে পড়ে গেল।ক্রমশ শ্বাস ঘন হতে শুরু করলো ইচ্ছে করছে আত্মাহুতি দিয়ে দেই কিন্তু না এমন চাইলে তো আজ বাসের নিচে এসে পড়তাম ভিতরে উঠে বসতাম না।আচ্ছা আমি মরলে কী সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে! বড় চাচীতো তাই বলে।সকালের কথা মনে হতেই ভয় যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো,অল্পের জন্য বেঁচে গেছি আমাদের বাড়ির কাজের লোক মনাই কাকা প্রায় আমায় দেখে ফেলেছিলেন, গরুর জন্য ঘাস কাটছিলেন বাড়ির পিছনের মাঠে । স্বভাবত তিনি শিল্পী, কাজের ফাঁকে গান না গাইলে তার কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। মনের সুখে দুই লাইন গাইতে শুরু করছিলেন বলে প্রতিবারের মতো তার উপস্থিতি ঠের পেয়েছি।
চোখ বন্ধ করে বসে আছি।হঠাৎ মুখে ভেজা কিছু অনুভব করলাম। চোখ খুলতে দেখি এক জোড়া চোখ বোতল হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কথাটা হাস্যরসাত্মক হলেও আমার কাছে শঙ্কা জনক চাচারা চলে আসে নি তো।সন্দেহ দূর করতে পিছনে ফিরে দেখলাম তেমন কিছুই না।চোখ জোড়া বিরক্তি নিয়ে বললো, এক্সকিউজ মি আপনার সমস্যা কী? আমার সিটেতো আপনিই বসে আছেন পানিতো আপনার উপরই ফেলবো।পিছনে তাকিয়ে দেখার কী আছে।

এখন বুঝতে পারলাম ভদ্রলোকের বিরক্তির কারণ।আমি ভুল করে ওনার সিটে বসে আছি। তাই বলে ডেকে বললেই তো পারেন এভাবে পানি ফেলার কী দরকার। অন্য সময় হলে এ বিষয় নিয়ে তর্ক করতাম কিন্তু এখন এই বিষয় নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছা বা অবস্থা আমার নেই। এমনি অনেক জামেলা করে লাইন ভেঙ্গে বাসের টিকেট টা নিয়েছি কাউন্টারের লোকেরা তো আমায় টিকেট দিতেই চাই নি এক প্রকার জোর করেই এনেছি।এখন জামেলা বাধালে হয়তো আর ঢাকায় যাওয়া হবে না।তাই ছোট্ট করে, ওহ আচ্ছা। আমার ভূল হয়ে গেছে বলে ওঠতে চাইলে লোকটা বাধা দিলো,
— থাক আর ওঠতে হবে না।ওখানেই বসেন আমি কারো ব্যবহৃত কোনো কিছু ব্যবহার করি না।যেভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলেন চোর ডাকাত সব ছিনতাই করে নিয়ে গেলেও বলতে পারবেন না।তাই ডেকে তুললাম।
— আমায় ডেকে ছিলেন।
— একচুয়্যালি আমি আপনার নাম ও জানি না, চিনিও না তাই কীভাবে ডাকবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।দুই তিন বার হ্যালো হ্যালো বলার পর যখন কাজ হলো না তখন এই ব্যবস্থা করলাম।

আমি আর কিছুই বললাম না।লোকটা যথেষ্ট এটিটিউড দেখাচ্ছে তাতে আমার কী।আমার কোনোরকম পালাতে পারলেই হলো।কিন্তু লোকটার তখনকার কথাটা এখনও আমার কানে বাজছে,”আমি কারো ব্যবহৃত কোনো কিছু ব্যবহার করি না”আচ্ছা সত্যিই কী ব্যবহৃত জিনিস মূল্যহীন।তার মানে কী আমি ও মূল্যহীন।

বাস ছেড়েছে বেশ কিছুক্ষন হলো।বরাবরই প্রকৃতি বিলাসী আমি।বাইরের পৃথিবী তেমন দেখা হয় নি আমার।তাই অল্প প্রকৃতি অবলোকন করতে পারলে খুশি যেন আর ধরতো না।আর এরকম চলন্ত গাড়িতে দুরন্ত প্রকৃতিতো আমার কাছে সবসময়ই দুর্দান্ত।কিন্তু আজ সবই বিষাদগ্রস্ত। পুরনো স্মৃতিগুলো মনে কড়া নাড়ছে। স্কুলে থেকে একবার পিকনিকে গিয়েছিলাম মনিরা আর মুন্নী আপুও ছিলো সাথে।পিকনিকে যাওয়ার কথা শুনে মনিরা আর মুন্নী আপুর মতো লাফিয়ে উঠেছিলাম আমি।কিন্তু আমার যে বাবা নেই আমার কাছে তো শপিং করা,পিকনিকে যাওয়া এগুলো উচ্চাভিলাস বৈ আর কিছুই নয়।তাই ইচ্ছাগুলোকে মাটি চাপা দিতে চাইলাম। সৌভাগ্যক্রমে শেষ পর্যায়ে মায়ের জমানো কিছু টাকাই হলো সহায়। যদিও টাকাগুলো দিয়ে যাওয়া আসার খরচটুকুই হলো।মনিরা আর মুন্নী আপু পিকনিকে গিয়ে অনেক কিছু কিনেছিলো।তাদের মন্তব্য ছিলো, এগুলো নাকি পিকনিকের স্মৃতি। যা এই সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে করিয়ে দিতে ভূমিকা রাখবে।কথায় আছে, নিজের হলে খাওয়া আর পরের হলে চাওয়া। তাই চুপচাপ দেখেই গেলাম।আর হ্যা আমিও অনেক কিছু নিয়ে এসেছিলাম।প্রকৃতির অমায়িক দৃশ্যকে অক্ষি ক্যামেরায় বন্দী বানিয়ে হৃদঅ্যালবাম পূর্ণ করে এনেছিলাম। আর জমিয়েছিলাম বিস্তর অভিজ্ঞতা যা আজ সদর পর্যন্ত আমায় চিনিয়ে দিয়েছে। তবে এগুলোর কড়া মূল্য দিতে হয়েছে আমাকে।সেবার আরিয়ানের প্রচন্ড জ্বর আসে।বড় চাচীর এ বিষয় নিয়ে বিবৃতি ছিলো, “পুলাপানের এমন হালকা পাতলা জ্বর হয় দু একদিনে গেলে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।” ছোট চাচীতো মুখ বাকিয়ে বলেই ফেললেন,” পরের ঘাড়ে বসে খেলে টাকা পয়সার মায়া আসবে কোত্থেকে, তাইতো সারাদিন পুকুরে সাঁতার কেটে ইচ্ছে করে জ্বর বাধাবে।” হুম সেই ইচ্ছাকৃত জ্বর বিনে ঔষধে সেরে গিয়েছিলো।বেশি কিছু হয় নি আমার ভাইটার,দশ পনেরো দিন বিছানায় পড়েছিল আর মাস খানেক দুর্বল দেহ নিয়ে ঘরে বসেছিল। টাকা পয়সার প্রতি হয়তো মায়া জন্মেগেছিলো তার, মাস তিন এক পানি ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই খায় নি সে। সেই থেকে মায়ের জমানো টাকায় আর হাত দেই নি।লেখাপড়ার খরচ যেহেতু চাচারা দিতো, তাই বৃত্তির টাকা দিয়ে নিজের ছোটো খাটো প্রয়োজনগুলো সারতাম।
রাত হয়ে গেছে অনেক্ক্ষণ আগে।চারদিকে কৃত্রিম আলো জ্বল জ্বল করছে।চন্দ্র তাঁরা সবই অনুপস্থিত আজ হয়তো কৃষ্ণপক্ষ।মেঘেরা এক হচ্ছে সূর্যের বিপক্ষে, কাল হয়তো সূর্যের দেখা মিলবে না।আমার জীবনও তো কৃষ্ণপক্ষের আঁধারে আচ্ছন্ন।কৃষ্ণপক্ষের অবসান ঘটলেই তো শুক্লপক্ষ।আমার জীবনেও কী শুক্লপক্ষ আসবে, এই আঁধার বিদুরিত হবে চন্দ্রের আগমনে।আচমকাই জোরে ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। কিছু বোঝার আগে দুটি বলিষ্ঠ হাত আমার বাহু চেপে ধরলো। আমি বিস্ফুরিত চোখে চেয়ে আছি ।হাত দুটি এবার মুখ ফোটে বলতে শুরু করলো,
— এতো দুর্বল হলে চলে।এক্ষুনি তো বাড়ি খেয়ে নাক মুখ সব ফেটে যেতো।অযথাই মানুষের দ্বায়িত্ব বাড়াচ্ছেন।
পাশের সিটের লোকটাকে নিতান্ত অসহ্য আর অভদ্রই মনে হলো আমার।লোকটা উপকার করে খোটা দিতে বেশ অভিজ্ঞ। আমি বেশ বিরক্ত লোকটার উপর।কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছা করলেও স্বভাবগুনে চুপই রইলাম কিছুই বললাম না।লোকটা এবার এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে বলল, — খেয়ে নিন ভালো লাগবে।
এখন আমার রাগ হচ্ছে লোকটার উপর।জুতা মেরে গরুদান ভালোই করতে পারে সে। অতিমাত্রায় রাগ আর বিরক্তি আমার মুখের কথা কেড়ে নিলেও চোখে তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। আমার চোখের ভাষা যেন তার নিমিষেই বোধগম্য হলো। — ওকে না খেতে চাইলে না ই সই।
আমি এবার তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে মনোনিবেশ করলাম।আর কোনো কথা হতো হলো না আমাদের মধ্যে। সকাল ছয় টায় বাস তার গতি থামলো।নেমে পড়লাম আমি নাম না জানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।কোথায় যাবো কী করবো কিছুই জানি না।অথচ আমি ভয় পাচ্ছি না।ভয় পাবোই বা কেন।হারিয়ে যাওয়ার চিন্তা থেকেই তো ভয়ের জন্ম। আর আমি তো সব হারিয়েই ফেলেছি নতুন করে কী হারাবে আমার।এসব ভাবছিলাম আর পা ফেলছিলাম।হঠাৎ কোলাহলহীন পাকা সড়ক টায় সমস্ত দেহের ভারই ছেড়ে দিলাম,,,,,
#কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ
#পর্বঃ২
#জান্নাত তাছলিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here