কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ পর্ব ১৪

0
800

#কৃষ্ণপক্ষের_চাঁদ
#পর্ব :১৪
#JannatTaslima(writer)




আমার মতো একটা ধর্ষিতা মেয়েকে চন্দ্র কেন বিয়ে করলেন।ওনার মতো চাকুরিজীবি প্রতিষ্ঠিত ছেলেরতো অনেক ভালো, রূপবতী, নিষ্পাপ, কলংক হীন একটা মেয়ে প্রাপ্য।আমি কী তাহলে তার জীবনে এসে স্বার্থপরের মতো কাজ করলাম।চন্দ্র ও তার পরিবারের কোনোদিন শুভ বুদ্ধির উদয় হতেই যদি তাঁরা আমায় বাসা থেকে বের করে দেয়।নিজের অতীত আর ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির চিন্তা মাথায় আসতেই,আঁখিদ্বয় সায় দিতে শুরু করলো।তখনই কারো হাতের স্পর্শ কাঁধে অনুভূত হলো।
–কী ব্যাপার তুমি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?সবাই বাইরে,,,

বারন্দার গ্রিল ছেড়ে পেছন ফিরতে ফিরতে, অশ্রু কণাগুলো অগোচরে রেখে দিতে প্রায় ব্যর্থ আমি।
–তুমি কাঁদছো?

অনেকটা ভেজা গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম,
–আপনি আমায় কেন বিয়ে করেছেন চন্দ্র?

–তোমাকে কী কেউ কিছু বলেছে?(গলায় তার অস্থিরতা)

–আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি?

ওনি সন্তপর্ণে আমার অশ্রু কণা মুছে দিলেন। এবং আমার এক হাত মুঠোয় পুরে নিয়ে বললেন,
–জবাবটা না হয় সকলের সামনেই দিবো

বলে আমায় হাত ধরে বসার ঘরে সবার সামনে নিয়ে আসলেন।দুই ফুপু আর বাবা প্রথম থেকেই সোফার আসন পেতে বসে আছেন।আমি ওনার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলাম।ওনি এগিয়ে গিয়ে খালি থাকা একক সোফায় বসলেন,
–ফুপু তোমরা দুজন একা আর কাউকে সাথে নিয়ে আসো নি।

বড় ফুপু ঘসেটি বেগমের ন্যায় মুখ করে বললেন,
–কাউরে নিয়ে আসার মুখ রাখলেতো আনমু।

–কেন আমি কী করেছি?(ওনার নির্লিপ্ত প্রশ্ন)

ছোট ফুপু মুখ বাকিয়ে বললেন,
–কী করেছিস জানোস না?সবার অমতে গিয়ে এই মেয়েকে বিয়ে করেছিস কেন?তাও আবার সব জেনে বুঝে।

–কী জেনে বুঝে? (যেন ওনি কিছুই বুঝতেছেন না)

–বুঝতে পারছিস না কিসের কথা বলছি?এই মেয়ের নামে এতো বড় কলঙ্ক রটার পরও তুই সবাইকে উপেক্ষা করে,এই মেয়েকে কেন বিয়ে করেছিস। (ছোট ফুপু)

–ফুপু তোমরা হয়তো ভুল জানো।আমি সকলের সম্মতিতে আধারিকা কে বিয়ে করেছি।

–তোর মামাতো এই বিয়ে করতে নিষেধ করছিলো? তারপরও তুই করলি?তোর বাপের মাথায় তো এমনি বুদ্ধি-সুদ্বি কম।ভাবছিলাম তুই লেখাপড়া জাইন্না ওর মতো মূর্খ হবি না।শেষ পর্যন্ত তুইও তোর বাপের মতো মূর্খ হইলি।

বড় ফুপু রাগী গলায় বললেন,ছোট ফুপু আগুনে আরো কিছু ঘি ঢাললেন,
–তোরাতো আর গ্রামে থাকিস না।বছরে একবার যাস।আর আমাদেরতো গ্রামেই থাকতে হয়।তুই কী মনে করিস, এসব কথা লোক মুখে আমাদের স্বামীর বাড়ি পর্যন্ত পৌছায় নি?তোর কারণে আমরা কারো কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।আমি স্কুলে গেলেও সবাই এবিষয় নিয়ে জানতে চায়।

–কী বিষয় নিয়ে জানতে চায়? আমি আধারিকা কে কেমন রাখছি,এই নিয়েতো?এতোদিনতো জানতে না,এখন জেনে যাও।আধারিকা এখানে অনেক সুখে আছে। আর আমি যতোদিন বেঁচে থাকবো,ওকে কোনো কষ্ট পেতে দিবো না।

বলেই এক নজর আমার দিকে তাকালেন। এই লোকটা আমার চিন্তা ভাবনার উর্ধ্বে।ওনি আসলে কী চান আমার বোধগম্য হয় না।বড় ফুপু আমার উপর ঘৃণ্য দৃষ্টি রেখে বললেন,
–তুই দেখি তোর বাপের থাইক্কা আরো বড় পাগল। এতোসব বুঝি না,আমাদের এই সমাজে চলতে হয়।তুই যতো তাড়াতাড়ি পারোস এই মাইয়ারে ছাড়োন দে।

এই সামান্য শব্দটা আমার মনে অসামান্য সুনামির সৃষ্টি করলো।কেন জানি চন্দ্র আর এ পরিবার ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই, ভেতরজুড়ে বজ্রপাত শুরু হয়ে গেলো।চন্দ্রের প্রতিউত্তরও ছিলো ঘুর্ণিঝড়ের আভাস।
–ছেড়ে দিবো,তার আগে বলো বকুল ভাই ভাবীকে কবে ছাড়ছেন।আর ছোট ফুপু, মিনাকে তার স্বামীর বাড়ি থেকে কবে ছাড়িয়ে আনছো।

দুই ফুপুর মুখের মানচিত্র এখন অন্য রঙ আর অন্য আকৃতির হয়ে গেছে।দুইয়ে মিলে যাকে বলে অনন্য।ছোটো ফুপু রাগ নিয়ে বললেন,
–ভাই হয়ে নিজের বোন সম্পর্কে কী সব বলছিস চন্দ্র।মিনাকে কেন ছাড়িয়ে আনতে যাবো।আর বকুল-ই বা কেন তার বউকে ছাড়বে।

ওনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বললেন,
–বলবো না কেন? তোমরাও তো আমাকে আমার বউ ছাড়তে বলছো।

–তোর বউ ছাড়াছাড়ির সাথে ওদের ছাড়াছাড়ির সম্পর্ক কী?(বড় ফুপু কপট রাগ নিয়ে বললেন)

–অবশ্যই আছে। আমার স্ত্রীর সাথে আরেক ছেলের নাম জড়িয়ে থাকায়।আমাকে যখন তাকে ছেড়ে দিতে হবে।তখন বকুল ভাইকেও ভাবীকে ছেড়ে দিতে হবে।কারণ,তার প্রবাসে থাকার সুযোগ নিয়ে সে বিয়ের পর পরকীয়াতে লিপ্ত হয়েছে। তুমি নিজেও তো তাকে আপত্তিকর অবস্থায় পেয়েছো।তারপরও তো শালীশ বৈঠক শেষে তোমরা তাকে এখনো নিজের সংসারে রেখেছো।এখন অবশ্য সে দুই বাচ্চার মা হয়ে গেছে। তাহলে ভাবীকে তো এখন বকুল ভাইর থালাক দেয়া উচিত। আর ছোট ফুপু তুমি একজন স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার পর, আমার তোমাকে বুঝানো লাগবে ভাবিনি।ক্লাস নাইনে থাকতেই যে মিনা তোমার বেখেয়ালে কোনো এক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলো, সে কথা মনে নেই তোমার।একদিন তোমার হাতে ধরা পড়লে,তুমি তাকে প্রচন্ড মারলে।পরেরদিন কী হলো?সে ঐ ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেলো।তিন দিন খোঁজ পাও নাই।তারপর আমিই তো তাকে ঢাকার এক হোটেল থেকে খুঁজে বাড়িতে নিয়ে গেলাম। তুমি সেই লজ্জা ঢাকতে সবাইকে বলে ছিলে সে আমাদের বাসায় ছিলো।এই ঘটনার পর খুব তাড়াতাড়ি করে মিনার আঠারো হওয়ার আগেই, তাকে বিয়ে দিয়ে দিলে।এখনতো তার স্বামীরও উচিত তাকে থালাক দেয়া।কী বলো বড় ফুপু?
দুজনেই মাথা নিচু করে আছেন।আমি অবাক নয়নে চন্দ্রের পানে চেয়ে আছি। এই প্রথম তাকে আমার সব থেকে ভালো আর সব থেকে সুন্দর পুরুষ মনে হচ্ছে। ওনি একটু দম নিয়ে বললেন,
–বকুল ভাইয়ের বউ যদি বিয়ের পর ইচ্ছাকৃত পরকীয়ায় যুক্ত হয়ে সংসার করতে পারে। মিনা যদি বিয়ের আগে পর পুরুষের সঙ্গে তিন দিন বাড়ি থেকে নিখোঁজ থাকার পরও সংসার করতে পারে। তাহলে আধারিকা কেন পারবে না।ওতো আর ইচ্ছে করে কোনো পুরুষের সংস্পর্শে যায় নি।ওর সাথে যা হয়েছে, ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হয়েছে।এখানেতো ওর প্রতি অবিচার করা হয়েছে।তাহলে ও কেন সংসার করতে পারবে না।

সবাই নিশ্চুপ আমি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ছল ছল নয়নে চন্দ্রকে দেখে চলছি।জানি না কেন, আজ ওনাকে খুব জড়িয়ে ধরার আকাশ কুসম সাধ জাগছে মনে।কৃতজ্ঞ সুরে ধন্যবাদ দেওয়ার অভিপ্রায় জন্ম নিচ্ছে।আমার চিন্তা ভাবনায় ভাজ পড়লো,কাঁধে কারো ভরসার হাত পেয়ে।যে আর কেউ নয় আমার বিপদের প্রকৃত বন্ধু চাঁদনি। আমি আমার কৃতজ্ঞ দৃষ্টি তার উপর রাখতেই,ও চোখের ইশারায় “আমরা সব সময় তোমার সাথে আছি”এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো।রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা, নিশ্বাসের শব্দে কান ভারি হয়ে আসছে।উপস্থিত সবাই যেন মৌন ব্রত পালনের নিয়ম রক্ষা করছে।আবারও সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে দিলেন চন্দ্র।
–ফুপু তোমরা এখানে এসেছো,আমি খুব খুশি হয়েছি।তোমরা যতদিন ইচ্ছা এখানে থাকো।আমার কোনো সমস্যা নেই।আর একটা কথা মনে রেখো আধারিকা আমার স্ত্রী।ওকে আমি ছাড়ার জন্য বিয়ে করি নি,ধরে রাখার জন্য বিয়ে করেছি।(উক্ত বাক্যটা যে আমার প্রশ্নের উত্তর তা আমার প্রতি তার চাহনিই জানান দিচ্ছে।ওনি আবারো সামনে মনোযোগী হলেন)তোমাদের মতো আশেপাশে সকলের মনেই আমার আর আধারিকার সম্পর্ক নিয়ে যে সংশয়।তা দূর করার জন্য আগামীকাল বাসায় ছোটো খাটো একটা আয়োজন হচ্ছে।বিল্ডিংয়ের সবাই থাকবে,আমার অনেক বন্ধু বান্ধবও থাকবে।তোমরাও থাকবে আশা রাখি।

চন্দ্র আর এক মুহূর্তও এখানে ব্যয় করলেন না।আমায় অতিক্রম করে রুমে চলে এলেন।মানুষটা অফিস থেকে এসেইতো আর জামাটা পর্যন্ত বদলানোর সুযোগ পায় নি।ফুপুরা উশখুশ শুরু করে দিলেন,যেন আমার উপস্থিতি তাদের পীড়া দিচ্ছে। দিবেই না কেন?চন্দ্র তাদের মুখে না বললেও, আমায় কিছু বলার পথ যে বন্ধ করে দিয়েছে।সে আফসোসই হয়তো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।বাবার মুখে তৃপ্তির ঝলক, যা আমার মনটা ভরিয়ে দিলো।দ্রুত গতিতে চন্দ্রের পাশে চলে আসলাম। চন্দ্র হাতের ঘড়ি খুলছে,আমার পাদচারণ উপলব্ধি হতেই তাকলো,আবার অসভ্যের মতো আমার সামনেই শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করলো।আমি তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে বললাম, ধন্যবাদ!

ওনি কপাল কুচকে বললেন, কেন?

আমি নিম্ন দৃষ্টি রেখেই বললাম,
–আমার হয়ে স্ট্যান্ড নেওয়ার জন্য।আমি আপনার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।

–তার প্রয়োজন নেই।আমি যেটা ঠিক সেটা করেছি।তোমাকে সারাজীবন কৃতজ্ঞ না থেকে এখন আমার একটা কাজ করলেই হবে।

আমি ব্যস্ত হয়ে উপরে তাকিয়ে বললাম,
–আপনি যে কাজ করতে বলবেন, আমি তাই করবো।

আবার চোখ নামিয়ে নিলাম, কারণ তার শার্টের দুইটা বোতাম খোলা।ওনি ক্লান্ত স্বরে সাহায্য চাইলেন,
–তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি টায়ার্ড এখন ফ্রেশ হতে ইচ্ছে করছে না।তুমি আমার শার্টের বাকি বোতাম গুলো খুলে দাও।

এটা আবার কী ধরনের কাজ।কেন যে এই সময়টায় আমার তাকে প্রশ্ন করতে হলো।নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিচ্ছি।এখন শার্টের বোতাম খুলাতে চাইছে পরে যদি ফ্রেশ করিয়ে দিতে বলে।
–চিন্তা করো না,ফ্রেশ আমি নিজে হয়ে নিতে পারবো।তোমার শুধু শার্টের বোতামগুলো খুলে দিলে চলবে।

মনের ভিতরে কথাও চেপে রাখতে পারি না।চন্দ্রের কী অতিরিক্ত শ্রবণেন্দ্রিয় আছে নাকি।কী আর করার,নিজের কথার বেড়া জালে নিজেই ফেসে গেলাম।ধীরে ধীরে ওনার নিকটবর্তী হয়ে বোতাম গুলো খুলতে শুরু করলাম।তাকে চোখ দিয়ে দেখার কথা ভাবতেই মনে লজ্জার ফুলঝুরি খেলছে।তাই আড়ষ্টতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।অকস্মাৎ তিনি আমার কপালে চুমু খেলেন।হঠাৎ এমন কিছুতে আমি ভরকে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম।ওনি স্বাভাবিকভাবে বললেন,
–কী ব্যপার কাজ বন্ধ করে দিয়েছো কেন?চালিয়ে যাও,

আমি বড়সড় চোখ নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
–এটা কী হলো?

–আমার সামনে মাথা নিচু করে রাখলে এমনি হবে।আমি চাই না আমার বউ কারো সামনে মাথা নিচু করে থাকুক।আমার সামনেও না।সব সময় মাথা উঁচু করে রাখবে।মনে থাকবে,

চন্দ্রের নির্লিপ্ত জবাবে আমি বাক শূন্য।নিজের অজান্তেই নিজের সেই আকাশ কুসম সাধ পুরণ করে ফেললাম।ঝাপিয়ে পড়লাম চন্দ্রে উন্মুক্ত বুকে।ওনিও স্মিথ হেঁসে আমায় আগলে নিলেন।আমি আসলেই সৌভাগ্যভতী,যে এমন স্বামী আর এমন শশুর বাড়ি পেয়েছি।যা আমার চাওয়া পাওয়ার বহির্ভূত ছিলো।আপন বোকামি উপলব্ধি হতেই মাথায় বাজ পড়লো।এটা কি করলাম, কিশোর বয়সী আবেগের মতো ধরে রাখতে পারলাম না, নিজের নিষিদ্ধ অভিপ্রায়কে।এখন এই অসভ্য লোকতো আমায় আরো লজ্জা দিতে ত্রুটি করবে না।তাই ওনার কাছ থেকে সরে আসতে চেয়েও পারলাম না।মুখে কোনো খই ফুটছে না, তবুও প্রয়াস করছি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার।কিন্তু ওনার পুরুষালী হস্তদ্বয়ের সাথে আমি ব্যর্থ।
–এখন সারাদিন নাড়া চাড়া করলেও লাভ হবে না।আমি কাজ দিয়েছি তাতে ফাঁকি বাজি করেছো।তাই এখন শাস্তি পেতে হবে।

এক ধন্যবাদ দিতে গিয়ে যে কারাবন্দি হয়ে পড়বো।তা আমার ধারণার সপ্তম আসমানে ছিলো।এখন এই দন্ড প্রাপ্ত আসামীকে মুক্ত করতে আল্লাহই সহায়।

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here