#কৃষ্ণপক্ষের_চাঁদ
#পর্ব :১৩
#JannatTaslima(writer)
:
:
:
–তোমার ভাই আমায় কেন বিয়ে করেছেন চাঁদনি?
ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে রিকশায় বসে প্রশ্ন করলাম চাঁদনিকে।তারও সেই ভাবলেশহীন জবাব,
–সেটা না হয় ভাইয়াকে জিজ্ঞেস কর?
আমি বিরক্ত স্বরে বললাম,
–এই এক কথা আর কতদিন বলবে?বলে দিলে কী হয়?
চাঁদনি মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
–তুমি আর কতোদিন এভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করবে? ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারো।
–তুমি জানো না তোমার ভাইকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে সে সোজা উত্তর না দিয়ে বাকা উত্তর দেয়।আর যেটা আমার একদম পচ্ছন্দ না।
(এই লোকের সাথে কথা কী বলবো।ইদানীং আমাদের প্রতিটি সংলাপে দু’একটা লজ্জাসূচক শব্দ যোগ করা তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তার কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও, আমার কাছে সেগুলো কতটা অস্বাভাবিক সেটা আমিই জানি।)
–আজ এরকম বলছো,কাল বলবে তোমার ভাইয়ের শুধু কথা না তোমার আপাদমস্তক ভাইটাকেই আমার পচ্ছন্দ। (ব্যাঙ্গ করেই কথাটা বললো চাঁদনি)
–আমার পচ্ছন্দের কথা ছাড়ো,তুমি কী ঔ সিনিয়র ছেলেটাকে পচ্ছন্দ করো?
চাঁদনি স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
–সেটা জানি না,তবে ওনি আমাকে পচ্ছন্দ করেন?এই নিয়ে তিনবার প্রপোজ করেছে?
–তুমি কী বললে?তোমার ওনাকে পচ্ছন্দ?
–আমি কিছুই বলি নি।আমার সব ফ্রেন্ডরা বলছে রাজি হয়ে যেতে। কারণ ছেলেটা দেখতে শুনতে কোনোদিক থেকে খারাপ না।
–তারমানে তোমারও তাকে ভালো লাগে?
–ধুর! সেটা না।আচ্ছা আঁধার,দুঃখিত ভাবী।তোমার কী মনে হয়? আমার কী করা উচিত?
–প্রথমে এই ডাকাডাকির বিড়ম্বনা ছাড়ো।আমায় নাম ধরে ডাকলেও আমার কিছু যায় আসে না।
পুরো কথা সম্পন্ন করার পূর্বে চাঁদনি বলে উঠলো,
–তা হয় নাকি।বিয়ে যেভাবেই হোক,তুমি আমার একমাত্র ভাইয়ের বউ বলে কথা। তোমাকে ভাবী ডাকবো না তো কাকে ডাকবো।এবার বলো কী বলতে চাইছিলে?
চাঁদনি উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি এবার নিজের মতামত বর্ণনা দিলাম,
–দেখো চাঁদনি, তুমি রিলেশনশিপে যাবে কি-না এটা তোমার নিজের ইচ্ছা।আমি তোমাকে করতেও বলবো না, আবার না ও করবো না।তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো,বিবাহ বহির্ভূত যেকোনো সম্পর্কই হারাম।আর আমাদের জন্ম, মৃত্যু,বিবাহ সবই তাকদীরের লিখন।এখন আল্লাহ আমাদের কার ভাগ্যে কাকে লিখেছেন তা আমরা জানি না।আমরা একজন মানুষকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতে পারবো।কিন্তু সে যদি আমার তাকদীরে না লেখা থাকে।তাহলে আমরা তাকে কোনোদিন পাবো না।কাউকে ভালোবেসে যদি নিজের করে না পাই।তাহলে সেই ভালোবাসার কোনো স্বার্থকতা নেই। তাই আমি মনে করি,এসব ভালোবাসার মোহে আচ্ছন্ন না হয়ে, সেই মানুষটির অপেক্ষা করা।যার ভাগ্য তোমার সাথে জুড়ে আছে।এখন তুমি দেখো তুমি কী করতে চাও?
চাঁদনি আমার বর্ণনায় চিন্তায় পড়ে গেলো।রিকশা ওয়ালা ছেলেটা আমাদের দিকে ঘুরে তাকলো,
আমি বললাম,
–কী ব্যপার ভাইয়া কোনো সমস্যা?
ছেলেটা বয়সে হয়তো আমার থেকে ছোটো হবে।অভাবের তাড়নায় আজ সে রিকশা চালাচ্ছে, আর আমি তার রিকশায় চড়ে ভার্সিটিতে যাচ্ছি।সে ম্লান হেঁসে বললো,
–না আপা কোনো সমস্যা না।আপনি যে কথাটা কইছেন একদম ঠিক কইছেন।এরহম কইরা কোনোদিন ভাবি নাইতো।
চাঁদনি গর্ববোধ করে বললো,
–দেখতে হবে না ভাবী টা কার।
ইতিমধ্যে আমাদের ঠিকানায় এসে রিকশার চাকা ঘুরা বন্ধ হয়ে গেলো।নেমে দুজনেই রিকশা ওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে ভিতরে যাচ্ছিলাম। তখন এক যুবক আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
–কীরে চাঁদনি ভাইয়ের বিয়েতে দাওয়াতও দিলি না।লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ সেরে ফেললি।
এগুলো নতুন না প্রতিদিনই এসব শুনতে হয়।
তখন আরেক যুবতী নারী(ওনার স্ত্রী সম্ভবত)এর সাথে আরো কিছু যোগ করলেন,
–দাওয়াত দিবে কী করে ও নিজেই দাওয়াত পেয়েছে কী না সন্দেহ।
আমি চুপচাপ চলে আসছি।চাঁদনি ওনাদের বললো,
–চিন্তা করো না ভাইয়া।ভাইয়া-ভাবির রিসিপশনে তোমাদের দাওয়াত দিতে ভুলবো না।
রিসিপশন কীসের রিসিপশন এই মেয়ে কী বলে এসব।সত্যিই প্রেমে টেমে পড়ে মাথা টাথা নষ্ট হয়ে যাই নি তো।
—————————————————–
গোলাকৃতির টেবিলে বসে নৈশভোজ সারছি আমরা চারজন।আমি চাঁদনির পাশের চেয়ারে আর চন্দ্র আমার সম্মুখ বরাবর বসছেন।আন্কেল মানে আমার শশুর বাবা ও চন্দ্র ঠুকঠাক আলাপ করছেন।হঠাৎ সম্পর্কে বাঁধা পরায় সব কিছু আমার নিকট ঘোলাটে মনে হচ্ছে।কিন্তু চন্দ্রর হাব ভাব আমার ধারণার উর্ধ্বে।যেন সব কিছুই স্বাভাবিক।ওনি যে আমায় শুধু শহরে নিয়ে আসার জন্য বিয়ে করেছেন তাকে দেখলে মনেই হয় না।চাঁদনি তার মৌনতা ভেঙে বললো,
–ভাইয়া জানো,
–না বললে জানবো কী করে?(ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে)
চাঁদনি মুখটা কালো করে পুনরায় হাঁসি মুখে বললো,
–আমাদের ভার্সিটি এই প্রথমবার আন্তঃবিতর্কে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে।
–ভালোতো তুই নাম দিছিস।
–ধুর ভাইয়া,কী যে বলো আমার দ্বারা ঐসব হবে নাকি।
–তা তোমার দ্বারা হয়টা কী? উচ্চ মাধ্যমিকেও ভালো রেসাল্ট করতে পারলি না।পারলে তো একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিতে পারতাম। (তাচ্ছিল্যের সাথে চন্দ্র বলেই যাচ্ছেন, ঐদিকে চাঁদনির মুখের হাঁসি গায়েব।)
–ভাইয়া এটা তুমি কী বললে?আমার ভালো রেসাল্টের সাথে আমার বিয়ের কী সম্পর্ক।বাবা তুমি কিছু বলছো না কেন?
–বাবা কী বলবে?এমনিই কোনোরকম পাশ করেছিস,তা-ও আবার ঐ মার্কস নিয়ে বাবার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিস।এখন হয়ে গেছিসতো আর কী করার।আমার সাথে অযথা তর্ক না করে প্রতিযোগিতায় গিয়ে কর।বাবার মুখ একটু হলেও উজ্জ্বল হবে।
–ভাইয়া তুমার কথায় মনে হচ্ছে আমি সব বিষয়ে কোনোরকম ৩৩ পেয়ে পাশ করেছি।আমি ভালো রেসাল্ট না করতে পারলেও অতটা খারাপ রেসাল্টও করি নি।যতটা তুমি বলছো।আর বাবা তুমি চুপ করে আছো যে?তোমার ছেলেকে কিছু বলছো না কেন?(কাঁদো কাঁদো গলায় চাঁদনি)
এবার বাবার মুখের এক কথায় চন্দ্রের কাশি শুরু।
–নিজে মনে হয় দশটা গোল খেয়ে আমার মুখ বড় উজ্জ্বল করেছো।
আমি চন্দ্রের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে মুচকি হাসলাম।যা তার নজর এড়ালো না।চাঁদনির মুখে নোবেল জয়ী হাঁসি।
–ভাইয়া ভাবীকে তোমার দশ গোল খাওয়ার বিষয়টা পরিষ্কার করবো।যেটা তুমি বাবার ফুটবল টিমে মাতব্বরি করে খেয়েছো।বাবা তোমাকে কতবার নিষেধ করেছিলো না খেলতে।কিন্তু তুমি, বুক চওড়া করে গোল কিপার হলে।আর দশটা গোল খেলে।
চাঁদনি দাত কপাটি বের করে হাঁসছে।আর আমার মুখ ফসকে বের হয়ে এলো,
–এতো গোল খাওয়ার পর আর ভাত খাওয়ার কী দরকার!!!
চাঁদনির হাঁসি আরো প্রসারতা পেলো।বাবা মিটি মিটি হাসছেন।চন্দ্র হয়তো এখন আমার মুখ থেকে এমন কথা আশা করেন নি।তবুও ভাব নিয়ে বললেন,
–তো কী হয়েছে? প্রথম প্রথম এরকম একটু আধটু হয়।তাছাড়া প্রবাদ আছে, “Failure is the pillar of success “।
আমি ঠোটে হাঁসি ঝুলিয়ে, দৃষ্টি চাঁদনির উপর রেখে, চন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
–চাঁদনি মনে হচ্ছে আমাদের সামনে এখন লিওনেল মেসি, রোনালদো আর নেইমার একসঙ্গে বসে আছে।
আমার এরুপ কথায় চাঁদনির সেকি গগন কাঁপানো হাঁসি।আমিও তাতে কিছুটা তাল না মিলিয়ে পারলাম না।বাবা হেসে হেসে আহার্য সম্পন্ন করে চলে গেলেন।আর চন্দ্র সাহেব তো পুরাই অপ্রস্তুত এমন ঠান্ডা মাথার অপমানে।তবুও নিজের ভাব ছাড়তে রাজি না,
–এমন ভাবে বলছো, যেন নিজে অস্কার পেয়ে বসে আছো।জীবনে তো দৌড় প্রতিযোগিতায়ও নাম লেখাও নি।সানজুর কাছ থেকেতো তোমার সব খবরই আমার পাওয়া। বলতে গেলে তুমি আর চাঁদনি দুজনই এক গোয়ালের গরু।
–কী বললে ভাইয়া?তুমি আমাদের এতো দুর্বল মনে করো।প্রতিদিন যে অফিসে শার্ট পরে যাও তাতো নিজে কোনোদিন আয়রন করতে পারো না।আমাকেই করে দিতে হয়। আর এতক্ষণ ধরে যে বসে বসে গিলছো।এগুলো কার রান্না করা, ভাবীর।নইলেতো আজ মান্না খালা আসে নি।না খেয়েই ঘুমাতে হতো।
তেজ গলায় চাঁদনি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। আর আমি নিরব দর্শক।ওনার যেনো এসব কথা শুনে হাঁসি পাচ্ছে।
–কী আমার আয়রন করে দাওরে,আমার কত ইদের শার্ট আর ফেভারিট শার্ট পুড়িয়েছো সেই হিসাব আছে।হু, আমার কোনোদিনও না খেয়ে থাকার চান্স নেই। কারণ আমি রান্না করতে জানি। তুইতো তা-ও জানিস না।আর রইলো তরকারির কথা, এটা তার রাঁধুনির মতোন লবণ কম।
বর্তমানে আমার আর নিরব থাকা হয়ে উঠলো না।খেতে বসেই তরকারির সুগন্ধি থেকে শুরু করে তেজপাতা নিয়ে মান্না খালার প্রশংসা করছিলো।এখন আসল রাঁধুনি সম্পর্কে অবগত হতেই লবণ কম হয়ে গেছে। রাগ একপাশে রেখে পৈশাচিক হাঁসি দিয়ে বললাম,
–চাঁদনি আমার মনে হচ্ছে, তোমার ভাইয়া তরকারিতে লবণ কম হওয়ার জন্য খেতে পারছে না।তাকে একটু লবণ দেওয়া দরকার।
বলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার খাওয়া প্রায় শেষ। উঠে তার থালায় পুরো লবণের কৌটা উপুড় করে দিলাম।
–দেখুন এবার লবণ ঠিক আছে কী না।
আর দাঁড়িয়ে থাকলাম না।আমার থালা নিয়ে রান্না ঘরে চলে আসলাম। চাঁদনি আমায় বাহবা দিতে ব্যস্ত।ওনার নিঃশ্বাসের শব্দও পাচ্ছি না।
|
|
|
আজকের দিনটা আমার জন্য বড়ই দুর্ভাগা।সকালে আমার একমাত্র আয়ের উৎস কিন্ডারগার্টেনের চাকরি থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইস্তফা দিতে হলো।কী করবো এভাবে প্রতিষ্ঠানের মান মর্যাদা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে কয়দিন আর থাকবো।অন্য টিচাররা প্রতিদিন ইনিয়ে বিনিয়ে বললেও,আজ হেড সাহেবও আকার ইঙ্গিতে বুঝালেন,আমার এখানে থাকা ঠিক হচ্ছে না।তাই আর কী করার। এখন থাকা খাওয়ার চিন্তা না থাকলেও।পরিকল্পনা ছিলো এ মাসের বেতন পেয়ে বইপত্র কিনবো।সেটাও আর হবে না।ভার্সিটিতে এসে জানতে পারলাম আমি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি। বাবা নাম দিয়েছেন। এখন পরিষ্কার হলো কাল ঘুমানোর পূর্বে চন্দ্র কেন বাবার রুমে গিয়েছিলেন।ঠান্ডা মাথায় প্রতিশোধ ওনিও নিলেন।আবার বাসায় এসে নিজের দুই ফুপু শাশুড়ীর সাথে পরিচয় হলো।যারা এই বিয়েতে অসন্তুষ্ট। আমি তাদের সহ্যের অপারে।বড় ফুপু শাশুড়ীতো শুরুতে আমার সাথে কোনো কথাই বলেন নি।ছোটো ফুপু আমার সালামের জবাবে বললেন, “এখনো থ্রিপিস পরো, শাড়ি পরতে জানো না। নাকি মা কিছু শেখায় নি। ”
কি আজব ব্যাপার মেয়ের কোনো দোষ গিয়ে মায়ের কাছে ঠেকে কেন?চাঁদনির নানাবিধ বাধায় কোনো কাজ হয়নি।কথার বেড়া জালে তাঁরা আমায় হেনস্তা করে চললো।সন্ধ্যায় মায়ের ফোনালাপের ভিত্তিতে জানতে পারলাম, আমার আর চন্দ্রের বিয়ে নিয়ে গ্রামে বিশেষ এক গোষ্ঠী সমালোচনার ঝড় তুলেছেন।যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আলম ভাইয়ের বড় ভাইয়েরা।মা স্বভাবজাত চেপে গেলেও বুঝতে পারলাম,তারা ভালো নেই।আমার খুব ইচ্ছে করে তাদের ঐ রাক্ষসপুরী থেকে আমার কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু আমি নিজেইতো এখন ঝুলে আছি।শেষ ভরসা চাকরিটাও নেই।চন্দ্র ও তার পরিবারের কোনোদিন শুভ বুদ্ধির উদয় হতেই যদি তাঁরা আমায় বাসা থেকে বের করে দেয়।নিজের অতীত আর ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির চিন্তা মাথায় আসতেই,আঁখিদ্বয় সায় দিতে শুরু করলো।তখনই কারো হাতের স্পর্শ কাঁধে অনুভূত হলো,,,,,,,
#চলবে,,,