কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ৩

0
423

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_৩
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“কুয়াশা তুমি কোথায়? রাত বাজে এগারোটা। আর তুমি বাসায় নেই। তোমাকে কম করে হলেও ত্রিশ বার কল দিয়েছি। কল পর্যন্ত রিসিভ করলে না। আমাকে না বলে কোথায় গিয়েছ তুমি?”

“অভিনয়ের আর কোনো প্রয়োজন নেই মিস্টার তুরাব তৌহিদ। আমি সবকিছু জেনে গিয়েছি।”

“মানে? কীসের অভিনয়? আর কী জেনে গিয়েছ তুমি?”

“আহা এত অভিনয় করে ক্লান্ত হয়ে যান না আপনি? আর কত অভিনয় করবেন? আমি কী খেলনা বস্তু? অনেক তো খেললেন আমার জীবন নিয়ে। এইবার এসব বন্ধ করুন।”

“কী বলছ তুমি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

প্রায় ঘন্টা খানেক বিছানায় গড়াগড়ি করার পর চোখটা একটু লেগে এসেছিল কুয়াশার। এমন সময় বিছানা কেঁপে উঠলে সে খেয়াল করে তার ফোনে কল এসেছে। ফোন হাতে নিতেই মেজাজ বিগড়ে যায় কুয়াশার। একে তো মেজাজ আগে থেকেই বিগড়ে আছে। তার উপর তুরাবের এখনো কিছু না বোঝার ভান করা ক্ষেপিয়ে তুলছে কুয়াশাকে।

“এই কী সমস্যা আপনার? আমার সামনে নাটক কম করবেন বুঝতে পেরেছেন? আপনি যে তিন্নি আপুর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকে ব্যবহার করেছেন সেটা আমি জেনে গিয়েছি।”

“তোমাকে এসব তিন্নি বলেছে? আরে ওই মেয়ে আমাদের ভালো চায় না। তাই এসব বলেছে তোমাকে। সব মিথ্যা কথা। আমাকে একটু বিশ্বাস কর কুয়াশা।”

“বিশ্বাস? সেটাও আপনাকে? আমি বিকেলে ছাদে উঠে নিজের কানে আপনার সব কথা শুনেছি। তাই এখন অবুঝ শিশু হওয়ার ভান করবেন না। আপনার ওই কুবুদ্ধি দিয়ে ভরা মস্তিস্ক এখন যত ইচ্ছা বানোয়াট গল্প তৈরি করুক। কিন্তু আমাকে সেইসব গল্প বিশ্বাস করাতে পারবেন না আপনি।”

“কুয়াশা আমার কথা তো শুনবে তুমি!”

“কী শুনব হ্যা? কী শুনব?”

“আরে ওসব তিন্নিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলেছি আমি। মন থেকে একটাও কথা বলিনি।”

“ভাই রে ভাই! আপনি কী দিয়ে তৈরি বলুন তো। লজ্জা বলতে কিছু নেই আপনার মধ্যে? মিথ্যা বলতে বলতে মিথ্যার পাহাড় বানিয়ে ফেলেছেন। এবার থামুন দয়া করে। নয়তো এর জন্য উপরওয়ালাও কখনো আপনাকে মাফ করবে না।”

“তুমি আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে যাচ্ছ। এমন কর না কুয়াশা।”

“আহারে বেচারা! কষ্ট হচ্ছে খুব? নিজের পরিকল্পনা সফলের জন্য এত দূর পর্যন্ত এসে শেষমেশ হেরে গেলেন। আমি আপনার ব্যাথাটা বুঝতে পারছি। আপনার জন্য সমবেদনা জানিয়ে কল রাখছি। ভবিষ্যতে আমাকে কল দিয়ে এমন নাটক আর করবেন না আশা করি।”

কথাগুলো বলে ফোন রেখে দেয় কুয়াশা। অতঃপর বিরক্ত হয়ে নিজেকে নিজেই বলে,

“এমন অসভ্য মানুষ আমি জীবনে দ্বিতীয় আর কাউকে দেখিনি। তুই আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করলি। রীতিমতো ঠকিয়ে বিয়ে করলি আমাকে। ভুলভাল বুঝিয়ে আট মাস তোর সংসার করালি। আজকে আবার তোর সব সত্যি জেনে গেলাম। এরপরেও তোকে কোনোকিছু বলিনি। এজন্য তোর আমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। সেটা না করে তুই এখনো অনায়াসে মিথ্যা বলেই যাচ্ছিস। নির্লজ্জ ছেলে কোথাকার!”

“কিরে কী বিরবির করছিস তুই?”

মলি খাবারের থালা হাতে কুয়াশার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল কথাটা। কুয়াশা প্রশ্নের জবাবে ছোট করে উত্তর দিল,

“ওই বিশ্বাসঘাতক আমাকে কল দিয়ে এখনো মিথ্যা বলেই গেল। মানে তুই শুধু একবার ভাব, একটা ছেলে ঠিক কি রকম নির্লজ্জ হলে এমন করতে পারে!”

“আচ্ছা হয়েছে এখন আর এত রাগ করতে হবে না। আগে খেয়ে নে তুই। আমি আজ তোর সাথেই থাকব। সারারাত ধরে তোর কথা শুনব ঠিক আছে? আপাতত লক্ষ্যি মেয়ের মতো খেয়ে নে।”

“আরে এত অনুরোধ করছিস কেন? তোর কি মনে হয় যে আমি শোকে পাথর হয়ে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিব? ছোট থেকে দেখছিস আমাকে। কখনো অন্যের উপর রাগ করে নিজেকে কষ্ট দিয়েছি আমি?”

“একবার দিয়েছিলি।”

“ওটা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি তাই আর কি!”

“আচ্ছা বাদ দে। আজকে আন্টি আমাদের জন্য খিচুরি আর কালা ভুনা রান্না করেছে। তোর পছন্দের খাবার। একসাথে খাই চল।”

“তুই বস এখানে। আমি হাত ধুয়ে আসি।”

কুয়াশা হাত ধুয়ে এসে মলির পাশে বসে খাওয়া শুরু করল। দু’জন সম্পূর্ণ খাবার শেষ করে এঁটো থালা রান্নাঘরে রেখে হাত ধুয়ে পানি খেয়ে ঘরে চলে এলো। কুয়াশা বিরক্ত হয়ে মলিকে বলল,

“আমার না খুব বিরক্ত লাগছে। আজ বিকেলের ঘটনাগুলো মনে পড়লেই শরীর জ্বলে যাচ্ছে একদম। মানুষ এত নিখুঁত অভিনয় কী করে করে?”

“মানুষের চেয়ে নিখুঁত অভিনয় বিশ্বে আর কোনো প্রাণী করতে পারে নাকি? একজন মানুষকে বিশ্বাস করতে এখন দশবার ভাবতে হবে বুঝলি।”

“কমই বললি তুই। অন্তত পঞ্চাশ বার ভাবা উচিত। আমি অবাক হচ্ছি এটা ভেবে যে তুরাব যখন আমার কাছে এসে আমাকে স্পর্শ করত তখন এত সুন্দর করে অভিনয় করত যেন মনে হতো ওও সত্যি সত্যি ভালোবেসে আমার কাছে এসেছে। এমন অনুভূতিগুলো কিভাবে মিথ্যা হয়!”

“এই তুই কী ওকে মন থেকে ভালোবেসে ফেলেছিস?”

“মিথ্যা বলে লাভ নেই। আট মাস একসাথে থাকার পর একটু হলেও ভালোবেসে ফেলেছি। ব্যাপার না এটা। আমি বিশ্বাসঘাতককে মনে জায়গা দিই না। এর প্রমাণ অনেক আগেই পেয়েছিস তুই। কয়েকদিন কষ্ট হবে ঠিকই। কারণ আমিও তো মানুষ। সব রকম অনুভূতি আমার মধ্যেও বিদ্যমান। কিন্তু হ্যা, আমি অতি আবেগি নই। পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলতে পারি। সুতরাং, মিস্টার তুরাব তৌহিদের কপালে শনি নাচছে এটুকু গ্যারান্টি দিতেই পারি।”

কুয়াশার এমন কথা শুনে মলি কিছুটা অবাক হয়। এই মেয়েটা সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে এটা সত্যি। কিন্তু এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও স্বাভাবিক থাকা অস্বাভাবিকই বটে!

“আচ্ছা কলি তুই কী করতে চাচ্ছিস তুরাব ভাইয়ার সাথে?”

“এক বছর আগের কথা মনে কর। তখন যা করেছিলাম এখনো সেটাই করব৷ আমি বদলাইনি মলি। ঠিক আগের মতোই আছি। আগেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম। এই মুহূর্তেও সেটাই করব।”

“যা করবি একটু ভেবে করিস। পরে যেন নিজেকেই কাঁদতে না হয়।”

“আচ্ছা তুই একটু মা’কে ডেকে নিয়ে আয় তো।”

“কেন?”

“মা আসুক। তারপরেই বলছি।”

“আচ্ছা।”

মলি মিসেস নাহারকে ডেকে আনার পর কুয়াশা বিছানায় বসে বলল,

“আমি ভাবছি কাজ করা শুরু করব।”

“মানে?”

“মানে আমি তো ‘ল’ নিয়ে আমার পড়াশোনা শেষ করেছি। কিন্তু এরপরই আমার বিয়ে হয়ে যায় গতবছর। এরপর আর এগোনো হয়নি। এখন আমি নতুন করে সব শুরু করতে চাই।”

“তুই এসব করে ভালো থাকলে অবশ্যই করবি।”

মলির কথার প্রতিত্তোরে কুয়াশা বলে,

“কিন্তু আমি এই শহরে থেকে কিছু করতে চাই না। আমি অন্য কোথাও যেতে চাই।”

“কোথায় যাবে?”

“মা এখনো এসব নিয়ে ভাবিনি। আগে তোমার অনুমতি চাই আমি।”

“অনুমতি দিব আমি। তুমি যেটাতে ভালো থাকবে তাতেই খুশি আমি। কিন্তু তুরাবের কী হবে? তুমি তো ওর সাথে আর সংসার করবে না। তাহলে কী ডিভোর্স দিবে?”

“আমি ওকে ডিভোর্স দিব না। ওর জীবনে থেকেই ওকে শাস্তি দিতে চাই আমি।”

“তোমার জীবন কেবল শুরু। এসব করে নিজের জীবন নষ্ট কর না। মা হয়ে এটুকু তো আমি চাইতেই পারি।”

“আমার জীবন এত সস্তা নাকি যে কিছু মুখোশধারীর জন্য নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে নিয়ে চিন্তা কর না তোমরা। আমি ঠিকই ভালো থাকব। আর যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের ভালো থাকা নষ্ট করার জন্য আমি প্রস্তুত।”

“যা করবে আমাকে জানিয়ে করো কেমন? আমার একমাত্র মেয়ে তুমি। রাগের বশে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ো না।”

“মা তুমি আমার উপর ভরসা রাখতে পারো।”

“বাকি কথা কাল সকালে হবে। এখন তোমরা দু’জন ঘুমাও। আমি আসি।”

“শুভ রাত্রি মা।”

“শুভ রাত্রি।”

মেয়ের মা থা য় হাত বুলিয়ে দিয়ে মিসেস নাহার চলে যান নিজের ঘরে। কুয়াশা ঘরের দরজা বন্ধ করে এসে মলিকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুম আসছে না তার। সে আপনমনে কিছু ভেবে যাচ্ছে।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here