কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ১২

0
519

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী

শহিদ আহমেদ রাতে বাসায় আসলে রাজিয়া খানম তাকে ডেকে পাঠায়।

” বলো আম্মা, কেন ডেকেছ? ”

” ডেকেছি তোমার বড় ছেলের বিষয়ে কথা বলতে। তার কোন অন্যায়ই তো তোমার চোখে পড়েনা। তাকে তুমি আদর দিয়ে মাথায় তুলে রেখেছ। আর সে বাড়ির সবাইকে অপমান করে বেড়াচ্ছে। ”

” আরমান! ও আবার কি করেছে? ”

” সে আজ আকলিমাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছে। ” রাজিয়া খানম একে একে সত্যমিথ্যা মিলিয়ে ছেলের কাছে বলতে থাকে। শহিদ আহমেদও মায়ের কথা সত্যি বলে ধরে নেয়।
সেই সাথে আরমানের উপর রে’গে যান।
এরপর মায়ের কথার প্রত্যুত্তর না করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

আরমান রুমে এসে নিজের মত চলছে। যেন কিছুই হয়নি, এমন ভাব করছে। কান্তা ভেবে পায়না একটা মানুষ এভাবে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে কিভাবে চলতে পারে!

” এভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দি দেখছ? বইয়ের সব পড়া কি আমার মুখে ট্রান্সফার হয়েছে? না-কি আমার নতুন রূপ বেরিয়েছে? এভাবে আমার মুখের দিকে স’ঙ’য়ে’র মত তাকিয়ে না থেকে বইয়ের দিকে নজর দাও। ”

” আপনি মুখ খুললেই করলার রস অমৃতের মত ঝরে। মানুষতো নয় যেন করলার রসের গোডাউন। বলছি কি করলা কি আপনার প্রিয় সবজি? তবে শুনে রাখুন কাল থেকে করলা রান্না না করে শুধু জুস করে খাওয়ানো হবে আপনাকে। এতে যদি একটু বদলান। ”

” এই মেয়ে, বেশি কথা না বলে চুপচাপ পড়তে থাক। বেশি কথা বললে কানের নিচে ঠাঁ’টি’য়ে দিব। তখন কানে ভোঁ ভোঁ আওয়াজ ছাড়া আর কোন কথা শুনতে হবেনা। ফাজিল একটা। ”

” ভালো কথার দাম নেই। যেই একটা ভালো কথা বললাম, তাতেই আমি ফাজিল! কান্তারে, তুই এখন থেকে মুখ বন্ধ করে থাকবি। কথা বলে নিজের বিপ”দ নিজে ডেকে আনিস না। ”

” কোচিং এর পড়াগুলো ঠিকঠাক করবে। ক্লাসে যদি দেখেছি পড়া দিতে পারছনা, তবে সবার সামনেই কানের নিচে দিব। আর অন্য টিচারদেরও বলে দিব, পড়া না পারলেই যাতে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে। ”

” একে রামে রক্ষা নেই, আবার সুগ্রীব দোসর। নিজেও অবিচার করবে, আবার অন্যদেরও উস্কে দিবে! অ’ত্যা’চা’রী, জা’লি’ম মাষ্টার। ”

” কি বললে? অ’ত্যা’চা’রী, জা’লি’ম আবার মাষ্টার? ”

” তো আবার কি। আপনি যা শুরু করেছেন সেটা অ’ত্যা’চা’রী’র’ই কাজ। আর গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকদের মাষ্টারই বলা হয়। সে যতই কলেজ অথবা ভার্সিটির শিক্ষকই হোক। সে হিসেবে আপনিও মাষ্টার। নিতাই মাষ্টার। ” কান্তা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।

” বে’য়া’দ’ব মেয়ে। বড়দের সম্মান দিতে জানেনা। তোমার থেকে ভবিষ্যতে সুশীল সমাজ আশা করা যায়না। যেগুলো জন্মাবে সবই তোমার মত বে’য়া’দ’ব হবে এটা বেশ বুঝতে পারছি। ”

” ভবিষ্যতে কারও জন্মানোর সম্ভাবনা আছে নাকি! ইশ! কি লজ্জা, কি লজ্জা। ” কান্তা আরমানকে রা’গা’নো’র চেষ্টা করলেও ওর ভিষণ লজ্জা লাগছে। আবার একটু ভয়ও পাচ্ছে। না জানি একটু এদিক সেদিক হলেই আরমান কানের নিচে সত্যিই দেয়!

কান্তার এমন লাগামছাড়া কথা শুনে আরমান একটু থতমত খায়।

” এ..এ…এই মেয়ে, কিসব ভুলভাল বলছ? এক্ষুণি যদি মুখ বন্ধ না করেছ তবে সত্যিই কানের নিচে দিব। তখন সারাজীবন আর কারও কথা শুনতে পাওয়া লাগবেনা। ”

কান্তা বুঝতে পারে অবস্থা বেগতিক। কথা বাড়ালে এবার নির্ঘাত দুই-চারটা খেতে হবে। তাই সে ভদ্র মেয়ের মত বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে।

পরদিন সকালে কান্তা রান্না সেরে আরমানের অপেক্ষা করছে। শহিদ আহমেদও এসে গেছেন। একটু পর আরমান সেখানে আসলে, কান্তা তাদের দুজনেই খাবার দেয়।

” গতরাতে তোমার মায়ের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছিল, আরমান? গুরুজনদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, তা তুমি বারবার কেন ভুলে যাও? তোমার আচরণে তোমার মা কষ্ট পায়, তা কেন বোঝনা? তবে কি আমরা তোমাকে সহবৎ শিক্ষা দিতে পারিনি! তোমাকে মানুষ করতে পারিনি! ” খেতে খেতে ধীরভাবে শহিদ আহমেদ তার ছেলেকে কথাগুলো বললেন।

” আমি কারও সাথে যেচে খারাপ আচরণ করতে যাইনি। আমি শুধুমাত্র তার কথার জবাব দিয়েছি। আমি কান্তাকে পড়াব কি না সেটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত বিষয়। স্বামী হিসেবে আমার পূর্ণ অধিকার আছে স্ত্রীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার। কারও কাছ থেকে হুকুম নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। কিন্তু এসব নিয়ে যদি কেউ আমাকে এই বাড়িতে থাকার খোঁ’টা দেয় বা অপমানজনক কথা বলে, আমি সেটা মেনে নিবনা। শুধু একপাক্ষিক কথা শুনে কারও বিচার করতে আসবেননা। যদি মনে করেন, সারাজীবন অন্ধকারে ছিলেন বলে বাকিটা জীবন অন্ধকারেই কাটাবেন, তবে এ আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে পরিগনিত হবে। এবং একটা সময় আপনি আফসোস করবেন। ” আনমানও ঠান্ডাভাবে উত্তর দেয়।

” বউমা, শুধু নিজের শ্বশুরকে খেতে দিলে হবে? তোমার আরেকটা শ্বশুর যে বাসায় এসেছে সেই খোঁজ একবারও নিয়েছ? তাকে কে খেতে দিবে শুনি? ” শহিদ আহমেদের মামাত ভাই রশিদ বেগ এসে বাবা-ছেলের কথার মাঝে কথা বলে৷

কান্তা তাকে চিনেনা তাই চুপ করে থাকে।

” বউমা, ও আমার মামাত ভাই। ও আমাদের বাসায়ই থাকে। তবে তোমার বিয়ের আগে ব্যবসার কাজে ওকে শহরের বাইরে পাঠিয়েছিলাম। ও গতরাতেই এসেছে। ”

কান্তা তার পরিচয় জেনে সালাম দিয়ে বসতে বলে। এরপর একটা প্লেটে পরোটা, ডিম ভাজা, সবজি তুলে দেয়। রশিদ বেগও মনের আনন্দে সেগুলো গলাধঃকরণ করতে থাকে।

” বাহ্ বউমা, তোমার হাতের রান্নার সুনাম শুনেছি ভাইজানের কাছে। সত্যি ভাইজান ভুল কিছু বলেনি। আরমান, বউমা দেখছি খুব গুণবতী। ”

আরমান কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খেতে থাকে।
খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যেতেই কান্তা ওর হাতে টিফিনবাক্স ধরিয়ে দেয়।

” চারটার মধ্যেই কোচিং-এ পৌঁছাতে চেষ্টা করবে। বাইরে যেয়ে রিকশা কিংবা সিএনজি দাঁড় করিয়ে আমার কাছে ফোন দিবে৷ আমি তাদের জানিয়ে দিব কোথায় যেতে হবে। একমিনিটও এদিকসেদিক যাতে না হয়। আমার ফোন নম্বর তোমার কাছে আছে তো? ”

” আপনি কি আমাকে আপনার নম্বর দিয়েছেন! খালি পারেন হু’ম’কি’ধা’ম’কি দিতে৷ ফোন নম্বর যে আমাকে দিতে হবে , সেটা কি কখনও মাথায় এসেছে? ”

” এরকমই বউ তুমি। তোমার নম্বর কি আমাকে দিয়েছ? কিন্তু তোমার নম্বর আমার কাছে ঠিকই আছে। যতসব বুদ্ধিহীনের মত কথাবার্তা। ”

কান্তার মুখে আর কোন কথা জোগায়না। ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, এই ত্যা’ড়া মানুষটার সাথে যেচে কোন কথা বলতে যাবেনা।

সকালের নাস্তা করে কান্তা রুমে আসতেই ওর ফোন বেজে ওঠে। আননোন নম্বর দেখে রিসিভ করার সাহস হয়না। এদিকে ফোনটা বেজেই চলেছে। তবুও রিসিভ করেনা কান্তা।
একসময় বন্ধ হয়ে যায় আওয়াজ।
একটু পর টুং করে শব্দ করে ম্যাসেজ আসে। কান্তা কি মনে করে ম্যাসেজ চেইক করে। সেখানে ছোট্ট করে লিখা।

” এই যে বুদ্ধিহীনা, ভদ্রমহিলা আমার ফোন রিসিভ করলে কি তোমার শরীরের এ্যানার্জি লস হয়ে যাবে? ”

ব্যাস কান্তার বুঝতে বাকি নেই এতক্ষণ ফোন দিতে থাকা ব্যাক্তিটা কে। কারন এভাবে খোঁ’চা মারতে শুধু একজনই পারে৷
কান্তা মনে মনে কয়েকটা গালি দিয়ে নম্বরটা সেইভ করে রাখে।

বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে কিছু সময় ব্যায় করে রিক্সার খোঁজে। খানিক পর একটা রিক্সা পেয়ে আরমানকে ফোন করে কান্তা। আরমান ওর ফোন কেটে, পুনরায় ফোন করে। কান্তা রিক্সাওয়ালাকে ফোন ধরিয়ে দিলে আরমান তাকে কোথায় যেতে হবে বলে দেয়।

দুইঘন্টা ক্লাস শেষে কোচিং থেকে বেরিয়ে আসতেই আরমান কান্তার পাশে এসে দাঁড়ায়।

” দুপুরে খেয়েছিলে? এখন কিছু খাবে? ফুচকা, আইসক্রিম, নাকি চটপটি? ”

কান্তা আরমানের কথার জবাব না দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মানুষটা। যে নিজে ভার্সিটিতে ক্লাস নিয়ে, কোচিং করাচ্ছে, সে নিজের কথা না ভেবে কান্তাকে জিজ্ঞেস করছে খেয়েছে কি না!
কান্তা লক্ষ্য করল মানুষটার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, সেই সাথে ঘামে ভেজা শার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে।
টিকোলো নাক বেয়ে ঘাম পরছে। ভ্রুর ওপরেও কয়েক ফোঁটা ঘাম তাদের রাজত্ব করছে। কালচে খয়েরী ঠোঁটের একপাশ দাঁত দিয়ে কা’ম’ড়ে রেখেছে।

” আপনি কি সিগারেট খান? ” কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করে কান্তা।

” কিহ! আমার প্রশ্নের উত্তর এটা? ফা’জি’ল মেয়ের মনে খালি আজেবাজে প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। ”

” আমি বাসা থেকে খেয়েই এসেছি। আপনি খেয়েছেন? নাকি ভার্সিটি থেকে এসেই ক্লাস নেয়া শুরু করেছেন? ”

” আমিও খেয়েছি। ”

” কি সিগারেট? ”

” কিহ্? ”

” ভাত খেয়েছেন না সিগারেট খেয়েছেন? কোনটা? ”

” ভাত খেয়েছি। ” দাঁতে দাঁত পি’ষে জবাব দেয় আরমান।

” আর সিগারেট? ”

” আমি সিগারেট খাইনা। আর একটাও কথা যদি বলেছ তবে তোমার মুখ আমি সেলাই করে দিব। ”

” বাসায় যাব। ” পা’গ’ল’কে ঘাঁটানোর আর সাহস হয়ে উঠেনা।

” কি খাবে বললেনা তো। ”

” কিছুই খাবনা। আমাকে রিক্সা ঠিক করে দিন। বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাবে। ”

” এত তাড়াহুড়ো কিসের! তুমি আমার সাথে আছ। তোমার বাসায় যাওয়ার চিন্তা করব আমি। কিন্তু তুমি চিন্তায় অস্থির হচ্ছ কেন? ব্যাপারটা কি? ”

কান্তা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আরমানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ত্যা’ড়া মানুষ কার ভেতর কি বলে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here