#কালো_হরিণ_চোখ (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা
পড়ন্ত বিকেল প্রকৃতি ছাদে উঠে আসে। হাতে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। এটা ওর প্রতিদিনের রুটিন। ফুলগুলো বাতাসে দুলছে, সেদিকে তাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেবার ফাঁকে ফাঁকে সে গুনগুনিয়ে উঠছে, ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো…’
এই সময়টা ওর বড্ড প্রিয়। কেমন বিষাদ ছোঁয়া মন ভালো করা ক্ষণ। দুটো বিপরীত অনুভূতি কেমন সমান্তরালে বয়ে যায় হৃদয়ে। সূর্য ডুবি ডুবি করছে। সে এসে দাঁড়ালো রেলিংয়ের ধারে৷ তখনই চোখে পড়ল প্রিয়মকে। রিকশা থেকে নামছে। কাঁধে ক্যামেরা। চির পরিচিত ভঙ্গিতে গেটের ভেতরে ঢুকল। এরপর মিলিয়ে গেল।
পুরো সময়টায় প্রকৃতি সেদিকে তাকিয়ে ছিল। সূর্য ডুবে গেছে। মাগরিবের আযান হচ্ছে। দূরে এক ঝাক পাখি উড়ে যাচ্ছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। সময়টা বোধহয় ঘরে ফেরার। মানুষের, পাখিদেরও। সে-ও দুদ্দাড় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিজের ঘরে।
ভেতরে এসে মায়ের ডাক শুনল, তার গলায় উচ্ছ্বাস। তিনি অল্পেই আনন্দিত হন। আনন্দিত হবার এক অসম্ভব ক্ষমতা তার মধ্যে বিদ্যমান।
সে এগিয়ে গেল মায়ের ঘরে, “তোর মেজ খালা, রানু বুবু আসছে। কতদিন পরে ওর সাথে দেখা হবে।”
কিছুটা থেমে তিনি বললেন, “তোকে বলেছি না ঘর এলোমেলো করে রাখবি না। নিজের ঘরের জিনিস তো অন্তত গুছিয়ে রাখতে পারিস।”
“গুছিয়ে রাখলে কিছু খুঁজে পাই না মা। আমার এভাবেই ভালো লাগে।”
“তা লাগবে কেন? বন্য বাপের জংলী বেটি।”
“বাবা কই মা?” কথা গায়ে না লাগিয়ে প্রশ্ন করল প্রকৃতি।
“বাইরে গেছে। ঘরে থাকতে পারে নাকি? মানুষটা একেবারে বন্য। তাও মাঝে মধ্যে ভুল করে ফিরে আসে।”
কপট রাগ করে বললেও তার মুখের হাসি অমলিন। একজন বন্য মানুষকে তিনি সংসারে বাঁধতে পেরেছেন, এই খুশি তার চোখেমুখে। মা তার আনন্দিত হবার ক্ষমতা সবসময় লুকিয়ে রাখতে চান বলেই অনেকসময় চিৎকার চেঁচামেচি করেন। এমন ভাণ করেন যেন বাবার উপরে তিনি অসম্ভব বিরক্ত।
ক্ষেত্রবিশেষে তা সত্য হলেও বেশিরভাগ সময় কেবলই কপট অভিমান মেশানো থাকে। বাবা এই অভিমান বুঝতে পারেন, এবং তিনি চমৎকার করে সেটা ভাঙাতেও পারেন। এই দুজনের এত বছর পাশাপাশি থাকার পরেও যে অভূতপূর্ব রসায়ন সেটা মনোমুগ্ধকর। কী দারুণ বোঝাপড়া। কেমন নবপরিণীত দম্পতির মতো মনে হয় দুজনকে। যেন সদ্যই দু’জন পরস্পরকে পেলেন। ঝগড়া চলে তুমুল৷ ক্ষণেক পরেই গলায় গলায় ভাব।
কী যে ভালো লাগে প্রকৃতির! মনে হয় এমন বাবা মায়ের সন্তান হতে পারাটা অসম্ভব সৌভাগ্যের। সে পৃথিবীর সবচাইতে ভাগ্যবানদের একজন। ওর চোখ চকচক করে উঠে আনন্দাশ্রুতে।
***
“মা, মা…”
প্রিয়মের ঘর থেকে অনবরত ডাকাডাকিতে রুবিনা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “চেঁচাচ্ছিস কেন?”
“মা আমার সাদা শার্টটা খুঁজে পাচ্ছি না।”
“ক্যামেরার লেন্স দিয়ে দেখ। ওটা ছাড়া তো তোর চোখে আর কিছুই পড়ে না।”
প্রিয়ম হেসে ফেলল, “মা, আমার এই নিতান্ত নিরীহ জিনিসটার প্রতি তোমার এত রাগ কেন?”
“কারণ ঘরে যে তোর মা থাকে সেটা তো মনেই থাকে না। সারাদিন ওটা নিয়েই টো টো করিস।”
প্রিয়ম এগিয়ে এসে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে আবারও হেসে বলল,
“আচ্ছা এখন থেকে আরও বেশি করে সময় দেব। হলো? খুশি?”
“মুখের কথায় চিড়ে ভিজবে না খোকা।”
“আচ্ছা, যা করলে চিড়ে ভিজবে তাই করব। শার্টটা কোথায় প্লিজ বলো মা?”
“ছাদে। শুকাতে পাঠিয়েছিলাম।”
প্রিয়ম সাথে সাথে গেল না, সে সেভাবেই কিছুক্ষণ মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। এরপর বলল,
“মা, তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? ছোটবেলায় শুনতে চাইতে জিজ্ঞেস করে। তখন হাত মেলে পরিমাপ করে দেখাতাম। এখন বুঝি, এর পরিমাপ হয় না।”
প্রিয়ম এরপর ছাদের জন্য পা বাড়ালো। রুবিনার চোখের কোণে পানি জমেছে। কী এক অপার্থিব সুখ ছুঁয়ে গেল তাকে। তিনি জানেন ছেলে মা অন্তপ্রাণ, তবুও এই যে মুখ ফুটে বলা, সেটা শুনতেও তাও কী ভীষণ ভালো লাগছে! ছেলের জন্য সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে দোয়া করলেন তিনি।
***
প্রিয়ম যখন ছাদে এলো তখন অন্ধকার নেমেছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। চাঁদের আলোতে চারপাশ আলোকিত। সে শার্টটা নিয়ে এগুচ্ছিল, ছাদ ওর ভীষণ পরিচিত। কোথায় কী, তাও মুখস্ত। তাই সেই আন্দাজ মতোই এগুচ্ছিল, অতটা খেয়াল না করে। তাতেই কাল হলো। কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে সামলে নিল। তখনই ইলেক্ট্রিসিটি চলে এলো। এবং নিচে তাকিয়ে দেখল, প্রকৃতির নতুন গাছের টব, এটা আগে এখানে ছিল না।
সে ওটা উঠাতেই যাচ্ছিল, তখনই মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে উপস্থিত হলো প্রকৃতি। ক্ষ্যাপাটে ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা৷
প্রিয়ম মনে মনে বলল, “সর্বনাশ।”
………
(ক্রমশ)
কালকের পর্বে দুজনের মধ্যে একটা ফাটাফাটি হবার সম্ভাবণা দেখছেন কী? ওটুকু এক পর্বে দিতে হবে বলে আজ এটুকুই দিলাম।