কানামাছি,পর্ব:১১

0
1877

#কানামাছি
#পার্টঃ১১
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
—” অনিক ছাড়ো আমাকে। বাঁচাও কেউ আমাকে। অনিক ছাড়ো। কেউ আছে আশেপাশে?”

সাঁঝের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিক।সাঁঝের গলা চেপে দাঁড়িয়ে আছে অনিক। সাঁঝের মুখ শুকিয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে তীব্র শ্বাসকষ্টে এখনই মারা যাবে। অনিক হিংস্রভাবে বলল,

—” আমারও ঠিক এমনই লাগছিলো সেদিন যেদিন তুমি আমার সাথে সম্পর্কটা ভেঙে দিয়েছিলো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো তোমাকে ছাড়া। কিন্তু তুমি তো বিয়ে করে নিলে এই ইহানকে”

সাঁঝ চেষ্টা করেও অনিকের লোহার মতো হাতকে ছাড়াতে পারছে না। মনে সাড়াঁশির মতো চেপে ধরেছে। অনিক আবার বলল,

—” কি ছিলো এই ইহানের মধ্যে যা আমার মধ্যে নেই”

সাঁঝ কোন উত্তর দিতে পারছেনা। অনেকক্ষণ হাসফাস করার পরে অনিকের হাত একটু হালকা হলে জোরে একটা লাত্থি মারলো অনিককে।
হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার শুনে সাঁঝ জেগে বসলো। অন্ধকারে কোন একটা জায়গায় আছে। এখনো মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সাঁঝ নিজের মাথা চেপে ধরে বসলো। চিন্তা ভাবনা ধোয়াশার মধ্যে আছে। আ… একটা মৃদু চিৎকারে মাথা একটু পরিষ্কার হলো সাঁঝের। মনে পড়লো কাল তার বিয়ে ছিলো আর সে এখন বাসর রাতে আছে। পাশে তাকিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই দেখলো ইহান নেই। সাঁঝ ডাকলো,

—” ইহান?”

—” আ… আ.. আমি এখানে”

বিছানার ওপাশ থেকে ইহানের আওয়াজ শুনে সাঁঝ টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঝুকে দেখলো ইহান চোখ মুখ কুচকে নিজের কোমড় চেপে নিচে শুয়ে আছে।
সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো

—”আপনি এখানে কিভাবে?”

ইহান বলল,

—” আমি কি দোষ করেছিলাম সাঁঝ? এতো জোরে কিক মেরে ফেলে দিলে কেন নিচে?”

সাঁঝ একটু বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—”ওটা আপনার লেগেছে?”

—” হ্যা তোমার পাশে আমি বাদে আর কেউ ছিলো না তো!”

সাঁঝ মনে মনে বলল,”স্বপ্নে অনিককে মেরে বাস্তবে আপনার লাগলো”
তারপর বলল,

—” আচ্ছা আসুন। খুব বেশি লেগেছে?”

সাঁঝ ইহানকে তুলে বিছানায় বসালো। ইহান বলল,

—” তাও লেগেছে একটু”

—” মুভ বা এই টাইপের কিছু নেই?”

—” হ্যা ওই বেডসাইড টেবিলের নিচের ড্রয়ারে আছে”

সাঁঝ ইহানের কোমড়ে স্প্রে করতে করতে বলল,

—” এজন্য রাতে বলেছিলাম একটা ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার দিই। আপনিই আমাকে বর্ডার দিতে না দিয়ে শুধু একটা বালিশ দিলেন”

ইহান মিনমিনে স্বরে বলল,

—” আমি কি জানতাম নাকি তুমি মাঝরাতে এরকম কিক মারো! জানলে অবশ্যই দিতাম”

সাঁঝ অনুতপ্ত হয়ে বলল,

—” সরি। আমি বুঝতে পারিনি”

—” ঠিক আছে ”

স্প্রে করা হলে সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,

—” ব্যথা কি কমেছে?”

—” বেটার। তুমি চিন্তা করো না। সকালে একটা মেডিসিন নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ঘুমাও। অনেক রাত এখন”

—” I am sorry.”

ইহান একটু রেগে বলল,

—” হয়েছে আর এতো সরি বলো না। মন খারাপও করো না। শুধু বর্ডারটা ঠিক মতো দাও”

সাঁঝ বালিশ দিয়ে তাদের বিছানায় একটা ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার দিলো। যাতে অনিককে মারতে গিয়ে আবার ইহানকে মেরে না দেয়।
,
,
,
?
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতের কথা মনে হতেই সাঁঝ লজ্জা পেলো। বাসর রাতে ঘুমের মধ্যে বরকে কিক মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছে। ছি ছি।

সাঁঝ বর্ডারের উপর ভর করে ইহানের দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে আছে। ভালো করে ইহানকে পর্যবেক্ষণ শুরু করলো। গায়ের ফর্সা। সরু নাক। গালে চাপদাড়ি। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। নাকটা কোন কারণে লাল হয়ে আছে। সাঁঝের মনে হলো নাকে হাত দিলে হাতে লাল রঙ লেগে যাবে। ইহানের নাকে হাত দেয়ার ইচ্ছাটাকে দমন করে উঠ পড়লো। একটু পরেই হয়তো ডাকতে আসবে। তাই সে শাওয়ার নিয়ে রেডি আয়নার সামনে দাঁড়ালো।

নিজেকে আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সাঁঝ। কেন জানি আজ নিজেকে অন্যরকম লাগছে তার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে। সাঁঝ যদি একবার পিছন দিকে তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো কেউ আলতোভাবে চোখ খুলে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ ইহানের কাছে এসে দেখলো ইহান এখনো ঘুমাচ্ছে। সাঁঝের ইচ্ছা হলো না ডাকার। কোন কাজ না পেয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে আসলো।

বেশ বড় একতালা বাসা ইহানদের। সাঁঝ হাঁটতে হাঁটতে ড্রইংরুমে চলে আসলো। এসে তার মনে হলো আসা ঠিক হয়নি। অনেক মহিলা বসে আছে। তাকে কেমন ঘুরে ঘুরে দেখছে! মনে হচ্ছে আগে কখনো মানুষ দেখেনি। সাঁঝের মনে হলো আজকে হয়তো শাড়ি পরা উচিত ছিলো। কিন্তু তার ইচ্ছা হয়নি বলে পরেনি। মালিহা বেগম সাঁঝকে দেখে খুশি হয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে সবার মাঝে বসিয়ে দিলো। তারপর একে একে পরিচয় করিয়ে দিলো। ইহানের দাদী, মামী, ফুফুসহ অনেক মেয়ে আত্মীয় আছে। একজন মহিলা বলে উঠলো,

—” বাহ আজ প্রথম দিনে বউ শাড়ি কেন পরেনি?”

সাঁঝের ইচ্ছা হলো বলতে, “প্রথম দিনে শাড়ি পরতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আছে নাকি?” কিন্তু বলল না। তার শাশুড়ী বলল,

—” না পরলেও তো কোন সমস্যা নেই আপা? থ্রি পিসে ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে তাই এটাই ঠিক আছে”

আর কেউ এই বিষয় নিয়ে কোন কথা না বললেও সাঁঝ বুঝলো সবাই তার শাশুড়ীর কথায় ক্ষুব্ধ। কথা বলতে বলতে ইহানও চলে আসলো। সেও রেডি হয়ে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে ইহানকে স্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু সাঁঝ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকার পরে বুঝলো কোমড়ে ব্যথা আছে।

ইহান এসে সাঁঝের পাশে বসলে সাঁঝ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,

—” আপনার ব্যথা কমেছে?”

ইহান তার দিকে না তাকিয়েই বলল,

—” হুম”

—” এখনো কি আছে?”

—” আছে একটু। ব্রেকফাস্ট এর পরে মেডিসিন খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

—” আচ্ছা”

ইহান তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

—” তোমার ঘুম হয়েছে? কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?”

—” না সব ঠিক আছে”

তাদেরকে এভাবে কথা বলতে দেখে একজন বৃদ্ধ মহিলা রসিকতার সুরে বলল,

—” কি এতো কথা বলিস বলতো? আমরাও একটু শুনি”

সাঁঝের কিছুটা অস্বস্তি হলো। না জানি কি না কি ভাবছে সবাই! ইহান হেসে বলল,

—” ছোট দাদী তোমার নাতবৌকে জিজ্ঞেস করছিলাম এখানে কেউ জ্বালাচ্ছে না তো!”

কেউ হেসে উঠলো আর কেউ মুখ গোমড়া করে রাখলো। এরপর সবাই নাস্তা করে নিলো। সাঁঝ রেডি হয়ে নিলো বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্য। অনুষ্ঠানে সাঁঝের বাসা থেকে অনেকেই এসেছিলো। ফুফু-ফুফা সহ মায়ের পরিবারের সবাই। তার আর ইহানের আজকেই যাওয়ার কথা ছিলো ওই বাড়িতে কিন্তু বৌভাতের অনুষ্ঠানে শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেলো। সাঁঝের বাড়ির লোক চলে গেলেও তারা দুজন গেলো না। কাল আবার সাঁঝের বাসা থেকে কেউ আসবে তাদেরকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

রাতে সাঁঝ ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে যাওয়ার সময় ইহান তাকে জিজ্ঞেস করলো,

—” এখন কোথায় যাচ্ছো?”

—” ড্রয়িংরুমে। আন্টি আর ইশিতার সাথে গল্প করতে”

—” ও আচ্ছা”

—” আপনি কি এখন ঘুমাবেন? ১০.৩০ বাজে মাত্র”

—” না এখন ঘুমাবো না। তুমি যাও”

—” হুম”

ড্রয়িংরুম থেকে সাঁঝের গলার আওয়াজ পাওয়ার পর ইহান ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো।
,
,
,
?
বিগ ব্রো,
জানো আজ একটা মেয়েকে দেখলাম। শান্তশিষ্ট মনে হলো অনেক দেখে। মেয়েটাকে দেখে আমার একটা বহমান নদীর মতো মনে হয়েছে।
যে বয়ে চলেছে সময়ের সাথে। দেখতে শান্ত কিন্তু ভিতরে হয়তো অনুভূতির
জোয়ার আছে। জানিনা কেন জানি বারবার ওর কথায় মনে হচ্ছে। তোমার কাছে হয়তো কোন একদিন চিঠিগুলো পৌঁছে যাবে তাই নিজের অনুভুতিগুলো লিখলাম।
লিটিল।
,
,
বিগ ব্রো
জানো আমি তোমাকে যেই মেয়ের কথা বলেছিলাম না? সেই মেয়েটার নাম
আর ও কোথায় পড়ে জানতে পেরেছি। নিজের কাজের সুবাদে কিছু সুবিধা
পাই। সেগুলো ব্যবহার করে জেনেছি। মেয়েটার নাম কি হতে পারে বলো
তো? তোমাকে বলে দিবো? না বলবো না। কোনদিন সামনে আসলে সেদিন
বলবো। শুধু এটুকু বলতে পারি আজও মেয়েটাকে দেখে আমার একই কথা
মনে হয়েছে। মেয়েটার শান্ত, চুপচাপ,আর কিছুটা বিষন্নতার মুখোশের আড়ালে রয়েছে হাজারো না বলা অনুভূতি, শত শত অপ্রকাশিত ইচ্ছে আর স্বপ্ন। আচ্ছা মেয়েটাকে দেখলেই কেন আমার এমন মনে হয়? আমি কি প্রেমে পড়েছি ওর? আর আমার এখন ইচ্ছা হয় সেই অনুভুতিগুলোর গন্তব্য আমি হবো। কেন এই ইচ্ছা হয়? যদি চিঠিটা পৌঁছাতে পারি সেদিন তোমার উত্তর শুনবো।
লিটিল।
,
,
ইহান দ্বিতীয় চিঠিটা পড়ার পরে চিঠির বক্সে রেখে দিলো। বক্সের ভিতরে অনেকগুলো ডাকটিকিটবিহীন খামে চিঠি আছে। পড়া শেষ সবগুলো। তার উদ্দেশ্যেই লেখা। কিন্তু যখন সে চিঠিগুলো হাতে পেয়েছে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আজ আবার এই দুইটা চিঠি বের করে পড়লো কারণ চিঠির প্রেরকের মতো সেও একই রকম অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে। ক্রমেই দূর্বলতা তৈরী হচ্ছে। যেটা কাটিয়ে উঠতে হবে। (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here