কাননবালা পর্বঃ১৪

0
914

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ ১৪

অভীকের ওষ্ঠদ্বয় অতি আশ্চর্যে এখনো আলাদা হয়ে আছে।না চাইতেও অভীক নিজের বিস্ময় লুকাতে পারছে না।
অনেকক্ষণ পর অভীক নিজেকে সামলে কেবিনে প্রবেশ করে।নিজের ভিতরের অস্থিরতা কিছুতেই অভীক লুকাতে পারছে না।সবসময় স্ট্রেইট কথা বলা অভীক আজ বড় নার্ভাসনেসে ভুগছে।ঘামে ভিজে গেছে শার্ট! অভীককে দেখে সাথি এগিয়ে এসে বলতে শুরু করে কি করে রুশিয়া বেগমকে হসপিটালে নিয়ে আসলো।অভীক যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না।ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি আর অপরাধ বোধে ভুগছিল! নীতু খুবই স্বাভাবিক ভাবে অভীকের দিকে ফিরে তাকালো।কৃষ্ণবর্ণ মুখটিতে মৃদু হাসির রেখা টেনে বললো,”মি.অভীক আন্টি এখন ঠিক আছে। ডক্টর দেখে গেছে।মাথায় দুটো স্টিচ আর কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে।কিছুদিন রেষ্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ”
অভীক চোখের পলক ফেলে মাথা নাড়লো।মায়ের সুস্থতায় আলহামদুলিল্লাহ বললো মনে মনে। সাথি ফের বলে উঠলো,”ভাইয়া আজ যে ভয় পেয়েছিলাম।আন্টির মাথায় রক্ত দেখে তো আমিই বেহুশ হতে গিয়েও হয়নি।নীতু আপু ছিল বলে রক্ষে।সে দারোয়ানকে ডেকে গাড়ি ঠিক করেছে।তারপর দুজনে মিলে আন্টিকে চারতলা থেকে নামিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। হসপিটালিটির যেখানে যা সবকিছু আপুই করেছে। আমি কেবল বোকা বোকা চোখে সবকিছু দেখে গেছি।এতটা নার্ভাস হয়ে পরেছিলাম!”
অভীক কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে নীতুর দিকে তাকালো।নীতু কিছুই বললো না।রুশিয়া বেগমের পাশে ঠায় বসে রইলো।অভীক কেবিন থেকে বেড়িয়ে আবার ডাক্তারের সাথে কথা বললো। পুরো দু’ঘন্টা নীতু বসে রইলো, রুশিয়া বেগমের জ্ঞান ফিরার অপেক্ষায়।
অভীক পুরোটা সময়ই ভীষণ আরষ্ট হয়ে রইলো।নিজেকে কেমন খুনী দাগি আসামী মনে হতে লাগলো। রুশিয়া বেগম জ্ঞান ফিরে নীতুকে দেখে হু হু করে কেঁদে দিলো।নীতু নিজ হাতে চোখ মুছে দিল তার।অভীক এসে মায়ের পাশে বসলে তিনি ছেলেকে জরিয়ে ধরে কেঁদে দিলেন ফের।অভীক মাকে তার বুকের সাথে জরিয়ে রাখলো।সাথি খাবার কিনে আনলে নিজ হাতে নীতু খাবার খায়িয়ে ঔষধ খাওয়ালো।অভীক সবটা চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখলো।নীতুকে এত স্বাভাবিক ভাবে সবটা করতে দেখে অভীক গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।অভীক আবারো বিশ্বাস করলো, আল্লাহর সৃষ্টির সেরা রহস্যময় সৃষ্টি হলো নারী!

*********
মহিমা বেগমের শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে।বুকের উপর চাপ অনুভব করছেন।বুকের কাছে আঁচল সরিয়ে অনবরত সরিষার তৈল মেজে যাচ্ছেন। একটু পর শ্বাস কষ্ট কমলেও চোখে জল এসে গেল।নীতু… আমার নীতু বলে কেঁদে উঠলেন।নীতু কখনোই মহিমা বেগমকে বেশি কাজ করতে দিত না।সব কাপড় চোপড়, থালা বাসন নিজে ধুয়ে দিতো।পাছে মায়ের ঠান্ডা না লাগে।বাসার সব কাজ ধরতে গেলে এখন মহিমা বেগমই করেন।সুরভি আগের মতই ছাড়া হাত পা নিয়ে কাজ করে। নিখিল অফিস থেকে ফিরেই দেখে মা বিছানায় বসে কাঁদছে। নিখিলকে দেখে মহিমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।এই সেই ছেলে যার জন্য নিজে কত কষ্টই না করেছেন।ছেলেটা হওয়ার সময় কিছুই খেতে পারতেন না তিনি।খুবই রুগ্ন ছিলেন।এরপর তো একটু বড় হওয়ার পর সেরা জামাটা ছেলেকে পড়িয়েছেন।ভালো স্কুল, কলেজ ছেলের জন্য। মেয়েদের ভাগের আদরটুকুও ছেলের জন্য বরাদ্দ ছিল।নীতু কোলের মাছ পছন্দ করতো আর নিখিলও।তিনি নিখিলকেই সবসময় বেশিই দিতেন।মেয়েরা অভিযোগ করলে মহিমা বেগম বুক ফুলিয়ে বলতেন,”শেষ বয়সে দেখলে আমার ছেলেই দেখবো তোরা তো সব পরের ঘর করবি।আমার আব্বার সাথে তোদের তুলনা করিস না!”
আজ মনে হলো তিনি ভুল ছিলেন।মেয়েরা তার যতটা খোঁজ নেন ছেলে তার এক আনাও নেন না।
নিখিল মাকে শান্ত কন্ঠে বলে,”মা ঔষধটা তো নিয়মিত খেতে পারো।তাহলে আর শরীর খারাপ হয় না।কতগুলো টাকার ঔষধ অথচ তুমি নষ্ট করো।!”
ছেলের চোখে বিরক্তি দেখে মহিমা বেগমের বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে। অনেক সময়ই মনে থাকে না ঔষধ খাওয়ার কথা।অসুস্থ স্বামী আর সংসার সামলে নিজের কথা ভুলে যান তিনি। পাশে বসে কেউ মনে করিয়ে দেয় না। নীতু থাকলে ঠিকই হাতে ধরিয়ে দিত। নিখিল কথা বলে চলে গেলো।মহিমা বেগম ফের কাঁদতে শুরু করলেন।ছেলেকে কি করে বুঝাবেন?বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার ঔষধের থেকেও সন্তানের সঙ্গের বেশি প্রয়োজন হয়!

**********–
ইতুর সকাল থেকেই মেজাজ গরম।আজো তার শাশুড়ী উল্টা পাল্টা কথা বলেছে তার নামে পাশের ফ্লাটের আন্টির সাথে। ইতু মাথা গরম নিয়েই সন্ধ্যার পর থেকে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটা কাজ করছে শব্দ করে।মিলন চুপিসারে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ইতু যতই বদমেজাজী হোক কখনো মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনা এটা মিলনের ভালো লাগে।অবশ্য তার ঝাল ঠিকই মিলন ভোগ করে।মিলন তাতে অসন্তোষ হয় না।ইতু কাপড় ভাজ করছিল।মিলন পাশে বসে নিজেও কাপড় ভাজ করতে শুরু করে।ইতু বিরক্ত চোখে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তুতুন মেঝেতে বসে খেলছে আর বারবার মায়ের দিকে অসহায় চোখে তাকাচ্ছে।তুতুনও মায়ের মেজাজের আঁচ বুঝে গেছে। মিলন ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে,”ইতু এরকম আচরণ কেন করছো?তুতুন ভয় পাচ্ছে তো।”
ইতু চোখ রাঙিয়ে মিলনের দিকে তাকায়। মিলন চুপিসারে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
তুতুনকে ঘুম পাড়িয়ে ইতু ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে দেখে বিছানার এক কোণে একটা প্যাকেট রাখা।সাথে ছোট্ট চিরকুট। “আমি তোমাকে ভালোবাসি ইতু।কে কি বললো তাতে কিছু যায় আসে না আমার।আমার বদমেজাজী ইতুকেই আমি প্রচন্ড ভালোবাসি!ম্যাডামের রাগ কমানোর ঘুষ হিসেবে এই অধম চটপটি নিয়ে এসেছে।রাগ কমিয়ে এবার আমায় উদ্ধার করুন।”

ইতুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।চটপটি দুটো বাটিতে ঢেলে বারান্দায় বসা মিলনের কাছে নিয়ে যায়।মিলন ইতুকে দেখে একগাল হেসে দেয়। ইতু কপট রাগ নিয়ে বলে,”আমি বদমেজাজী? ”
মিলন একচামচ চটপটি মুখে পুরেই বলে,”একটু! ”

*************–
রুশিয়া বেগমকে একদিন হসপিটালে রাখার নির্দেশ দিয়েছে ডাক্তার। সাথির খারাপ লাগছিল বলে নীতু তাকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে।রাত বাজে নটা।সারাদিন হসপিটালে থাকার কারণে নীতুর চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।চোখের কাজল লেপ্টে রয়েছে।আজ সকালে নীতু মায়ের দেয়া একটা সুতি শাড়ি পড়েছিল।এত দৌড় ঝাপের কারণে পরনের পোশাক কুঁচকে এলোমেলো হয়ে আছে।চুলের খোপাটাও এলিয়ে পড়েছে!তারপরও নীতুর মধ্যে কোন আরষ্টতা দেখা গেলো না। সবটাই অভীক পর্যবেক্ষণ করে! নীতুর এরকম ব্যক্তিত্বে অভীক অনেকটাই অবাক হয়েছে। রুশিয়া বেগম ঘুমিয়ে পরতেই নীতু অভীককে বললো,”মি.অভীক আমি এখন আসি।”
অভীক খেয়াল করলো এই সামন্য বাক্যটা বলার সময়ও নীতুর ঠোঁটে মৃদু হাসি ছিল। অভীক ঠিক সেই সময় আরো একটি বিষয় অনুধাবন করলো। প্রথম থেকেই নীতু তাকে নাম ধরে ডাকছে।তারমানে নীতুর মনে আছে ওই বিদঘুটে সময়টা। অভীকের আবার হাসফাস লাগে! অভীক কখনোই কারো সামনে এতটা উইক ফিল করে নি।তবে আজ কেন?
অভীক নীতুকে এগিয়ে দিতে কেবিন থেকে বের হয় একসাথেই। করিডোর প্যাসেজে দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে।পকেটে হাত ঢুকিয়ে অভীক হাঁটছে।চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ পাশে হাঁটতে থাকা কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটির দিকে।কৃষ্ণবর্ণ মুখটিতে ফুটে উঠেছে অন্যরকম এক আত্মবিশ্বাস! নিরবতা ভেঙে অভীক বললো,”মিস নাকি মিসেস বলবো?”
নীতু কপালে ছড়িয়ে পড়া ছোট ছোট চুলগুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে বলে,”মিস..!”
অভীক এবার দাঁড়িয়ে পড়ে নীতুর দিকে ফিরে।নীতুও থেমে যায় মুখোমুখি হয়ে।অভীক পুরুষালী গমগম স্বরে বলে,”মিস নীতু আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আজ যদি আপনি সময়মত মাকে নিয়ে হসপিটালে না আসতেন তবে সত্যিই অনেকবড় ক্ষতি হয়ে যেতো আমার।”

নীতু সরাসরি অভীকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,” মি.অভীক, কারো জন্যই কোন কিছু আটকে বা থমকে থাকে না।।সৃষ্টিকর্তা কারো না কারোর মাধ্যমে শূন্যস্থান পূরণ করে দেন। তাই এসব ফর্মালিটির কোনই প্রয়োজন আমি দেখছি না।
অভীক নীতুর বাচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হলো।চোখে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বললো,”ধন্যবাদ না নিলেও সরি টুকু গ্রহণ করলে আমি কৃতজ্ঞ হবো।”

নীতু বুঝতে পারলো কেন অভীক তাকে সরি বলতে চাইছে।কেননা অভীকের চোখে মুখে অনুতপ্ততার রেশ!তাই চোখে মুখে ধারালো অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বললো,”মি.অভীক আমরা বড় স্বার্থপর গোছের মানুষ। আমরা যতটা সহজে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি ততটা সহজে অনুতপ্ত হই না।অনুতপ্ত আমরা তখনই হই যখন কৃতজ্ঞতার ভার অধিক হয়ে যায়! আসি ভালো থাকবেন।”

নীতু ব্যস্ত পায়ে হাঁটা শুরু করলো।অভীক ব্যথিত, বিহ্বল ও নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো নীতুর চলে যাওয়ার দিকে।কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটির চলার মাঝেও কেমন রুক্ষতা! অভীক আবার অপরাধবোধে বিদ্ধ হলো।হ্যা আজকে নীতুকে দেখার পর থেকে অভীক নিজ কাজে অনুতপ্ত। আজকের আগ পর্যন্ত না নীতুকে মনে ছিল তার, না ছিল কোন অনুতপ্ততা!কৃতজ্ঞতাই যেন অভীককে অনুতপ্ত হতে বাধ্য করলো!অভীকের মনে হলো নীতুর সাথে তার দেখা না হওয়াই ভালো ছিল।

চলবে,
আশাকরি সবাই রেসপন্স করবেন।ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে গল্প লিখলাম।
আর আমাদের পরিাবারে টুইন বেবি এসেছে।আলহামদুলিল্লাহ ফুপি হলাম প্রথম বারের মত। ফুটফুটে দুটি ছেলে বাবুর ফুপি হয়েছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here