কাননবালা পর্বঃ১০

0
847

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১০

শারিরীক অসুখের চিকিৎসা যতটা দ্রুত মানুষ করে মানসিক চিকিৎসাকে তার থেকেও বেশি ইগনোর করে। তাজকে দেখলে যতটা স্বাভাবিক মনে হয় আসলে সে ততটা ঠিক নেই।আস্ত শরীরে অবস্থিত ছোট্ট মনটা যে বড়ই ভঙ্গুর! মা বাবার জন্য নিজেকে সে স্বাভাবিক রাখে।একমাত্র ছেলে সে।না চাইতেও দায়িত্বটা এসেই যায়।সকাল সন্ধ্যা অফিস করে রাতটা কাটে বড় বিষন্নতায়! বুকের ভিতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরের মত বুকের বাম পাশটা খাঁ খাঁ করে!সে খবর তাজ ছাড়া আদৌও কেউ কি রাখে?
তাজ আজ অফিস থেকে ফিরেই খেয়াল করে ঘরের পরিবেশ থমথমে!মা আজ কোন কথা বললো না।বাবা তাকে দেখে রুমে চলে গেলো।সেতু গম্ভীর মুখে বসে আছে হাত পা গুটিয়ে খাটের কোণে।এমনিতে তাজ অফিস থেকে ফিরলে সেতু তারপাশে ঘুরঘুর করে।না চাইতেও এটা সেটা এগিয়ে দেয়।চঞ্চলতায় দু একটা ভুল করে,তাজ তা দেখেও দেখে না।কোন কিছুতেই তাজ আগ্রহ দেখায় না।বড় পানসে লাগে সব কিছু। নীতুর না থাকাটা যে তাকে এতটা ভোগাবে জানলে সে মা বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও বিয়ে করতো তবুও তো এতটা কষ্ট হতো না!

তাজ ফ্রেশ হলো,নিজেই খাবার বেড়ে খেলো।কেউ এগিয়ে এল না।টেবিলের সব কিছু গুছিয়ে রেখে বিছানায় এসে শরীর এলিয়ে দিলো।এক হাত বুকের উপর রেখে আর এক হাত চোখের উপর রেখে ঘুমের আয়োজন করলো।সবটা সেতু নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখলো। সেতুর নিরাবতার কারণ তাজ একবারো জানতে চাইলো না। সেতু আহত হলো।চোখে জল জমলো। তবুও হতাশা কন্ঠে বললো,”রোজ রোজ কেন অভিনয় করেন বলুন তো?চোখ বুজে থাকলেই মানুষ ঘুমায় না। ডাইরেক্টলি বললেই তো হয়, আমি আপনার ডিস্টার্বের কারণ।সেই তো আমি ঘুমানোর পর বারান্দায় গিয়ে বসে থাকেন।”

তাজ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে সেতুর দিকে তাকিয়ে রইলো অনেক্ক্ষণ। সেতুর মুখে রাগের ছটা। তাজ দৃষ্টি ঘুরিয়ে সিলিংয়ের দিকে রেখে বলে,”ঘরের ভিতর হেঁটে তোমাকে ডিস্টার্ব করতে চাইনি।আর আমি কখনো বলেছি তুমি আমার ডিস্টার্বের কারণ?”

সেতু তেজের সাথে বলে,”সব কথা মুখ ফুটে বলতে হয় না।আপনার আচরণই আমায় বুঝতে বাধ্য করেছে।”

তাজের বিরক্ত লাগলো।ইদানীং অল্পতেই সবকিছু বিরক্ত লাগে।তাই অল্প কথায় বললো,”সেতু আমার আচরণে তুমি কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত!এর বেশি আমি কিছু করতে পারবো না।আমার থেকে বেশি কিছু এক্সপেক্ট করো না,পরে কষ্ট পাবে!”

সেতুর রাগে হাত পা কিড়মিড় করে উঠলো।বরের কাছ থেকে এক্সপেক্ট করবে না তো কার কাছ থেকে করবে? দুমাস হয়ে গেলো বিয়ের না কোথাও ঘুরতে নিয়ে গেছে, না কোন রোমাঞ্চকর মুহূর্ত কেটেছে।চুমু তো দূরে থাক হাত টা অবধি ধরে নি তাজ। এক ঘরে, এক বিছানায় থেকেও অনুভূতি বিহীন একটা সম্পর্ক বয়ে বেড়াচ্ছে। সেতু তাজের দিকে ঘুরে বসলো।তাজ বুঝতে পারলো সেতু তার দিকে তাকিয়ে আছে তবুও দৃষ্টি সিলিং থেকে সরালো না।ওভাবেই উপরের দিকে তাকিয়ে রইলো।সেতু রাগ কমিয়ে মিহি স্বরে বললো,”আপনি এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। তাই না?”

তাজ সত্যিটাই বললো, “হ্যা!”

সেতুর বুকটা কেঁপে উঠলো।তাজের চোখের দিকে তাকিয়ে বড় ভয়ে ভয়ে বললো,”ভালোবাসতেন কাউকে?”

সেতুর কথায় তাজের চোখে কাঁপন দেখা গেলো।দুই ঠোঁট চেপে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো। গলার কাছে কষ্ট গুলো কান্না হয়ে দলা পাকিয়ে রইলো।হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল একটা মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো।একটা সময়ে দৃষ্টি সেতুর মুখের দিকে নিক্ষেপ করে ভারী স্বরে বললো তাজ,”ভালোবাসার কোন পাস্ট টেন্স হয় না,সবটাই প্রেজেন্ট!একদম সদ্য হওয়া দগদগে ক্ষতের মত সদা নবীন! ”

“তার মানে ভালোবাসেন কাউকে?”

“ভালোবাসি কিনা জানি না।তবে আমার সকল অনুভূতির মৃত্যু হয়েছে তাকে হারানোর পর।নতুন এই রুক্ষ, কঠিন তাজের সৃষ্টি হয়েছে তাকে হারানোর পর!বিশ্বাস করো, ভীষণ ভাবে আমি তাকে চেয়েছি তবুও হারিয়ে ফেললাম!এমন ভাবে হারালাম যে তাকে চাইবার অধিকার আর কখনো হবে না!”…… বড় করুণ শোনালো তাজের কথা।তাজের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে সেতু মুখে ওড়না চেপে কেঁদে ফেললো।

” কেঁদো না সেতু।তোমাকে কষ্ট দিবার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না।তবু দিতে হলো।”…..সান্ত্বনার স্বরে বললো তাজ।
সেতু তবুও কাঁদছে।তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।তার বর অন্য একটা মেয়ে কে ভালোবাসে তার জন্য নাকি এই তাজের কষ্ট দেখে তার কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে পারলো না!

“সেতু তুমি কত সহজে কান্না করে তোমার কষ্ট হচ্ছে সেটা আমাকে বুঝালে অথচ আমার বুকের ভিতর অজস্র কান্নার ঢেউ রোজ বুকের জমিনটা ঝাঝড়া করছে তা কেউ জানে না।এক কৃষ্ণবতীর জন্য আমার আজন্ম হাহাকার থেকে যাবে!তার অপূরণীয় স্থান কেউ পূরণ করতে পারবে না!”

সেতু কান্না ভুলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তাজের মুখ পানে।তারপর বললো,”তবে আমায় বিয়ে কেন করলেন?”

“মা বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ার প্রায়শ্চিত্ত করতে!”….. তাজ হেরে যাওয়া কন্ঠে বললো। এরপর আর কোন কথাই তাজ বললো না।পাশ ফিরে চোখ বুজলো।সেতু সারা রাত বিছানার এপাশ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো।তার কিছুতেই ঘুম হলো না।তাজ সবটা বুঝেও চোখ বুজেই গোটা রাতটা পার করলো।সেতুকে কোন সান্ত্বনা দিলনা।যে নিজেই শূন্য, সে অন্যকে কি করে পূর্ণ করবে?

************

নীতুর হাত পা থরথর করে কাঁপছে।চোখ দুটো টলমল করছে।ঝাপসা দৃষ্টিতে হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছে।নীতুর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।এই অসম্ভব কাজটা কি করে সম্ভব হলো?নীতু বিস্মিত চোখে শরীফুল কাকার দিকে তাকালো।আশ্চর্য! শরীফুল কাকা হাসছে কেন? নীতুর ফ্যালফ্যাল চাহনি দেখে শরীফুল আস্বস্থ দৃষ্টিতে তাকালেন।এবার নীতু দু হাতে মুখ ঢেকে উচ্চস্বরে কেঁদে ফেললো।শরীফুল কাকার চোখও ছলছল করে উঠলো।
গোটা বিশটা দিন পরিশ্রম করে শরীফুল নীতুর জন্য একটা জব ঠিক করেছে।ঢাকার একটা বড় সফটওয়্যার কোম্পানিতে কম্পিউটার অপারেটরের কাজ।এই হক টাওয়ারের যে মালিক তার শ্যালক সে কোম্পানির এমডি।ফোন করে যখন শরীফুল অনুরোধ করলো তখন সে প্রথমে রাজি না হলেও শরীফুল শেষতক ঢাকা চলে গেলো তার বাসায়।নীতুর সকল সার্টিফিকেট সঙ্গে নিয়ে গেলো।হক টাওয়ারে যতগুলো কম্পিউটার সেকশনে কাজ করেছে নীতু তার একটা চার্টও নিয়ে গেলো।এরপর পুরানো লোক হিসাবে অনেকটা পায়ে ধরার মতই অনুরোধ করে চাকরির ব্যবস্থা করলো।অবশ্য তিনি বলেছেন,জব পারফর্মেন্স ভালো না হলে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দিবেন।তাতেও শরীফুল রাজি হয়েছে।তার বিশ্বাস নীতু পারবে।নীতুর মত কর্মোঠ একটা মেয়ে সব পারবে।

নীতু তখনও কেঁদে যাচ্ছে। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।কোন ইন্টারভিউ ছাড়া কি করে তার চাকরি হয়ে গেলো? নীতু আশ্চর্য ভঙ্গিতে বললো,”কখন করলেন এসব কাকা?কেন করলেন?”

শরীফুল নীতুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”এটা আমার কাছে আমার চমৎকৃত মেয়েটির প্রাপ্য!নিজেকে প্রমাণ করে দিও,এই বাপের বয়সী বুড়োকে যেন ছোট হতে না হয়।”

“এত ঋণ আমি কি করে শোধ করবো কাকা?”

শরীফুল বিরক্ত হলেন।খিটমিট করে বললেন,”সবসময় ফালতু কথা কেন বলো?একদম চাকরি নট করে দিবো।”

নীতু হেসে ফেললো।জলে টইটম্বুর চোখে খুশির হাসি। শরীফুল দ্রুত সেখান থেকে সরে পরলেন।”চোখের জল হলো ছোঁয়াচে গোত্রের,অন্যের কান্না সবসময়ই আমাদের স্পর্শকাতর করে তোলে!”

***************
নীতুর ঢাকা যাবার কথা শুনে রিশা ভীষণ খুশি হলো।কিন্তু নীতু খুশি হতে পারলো না।এই হোস্টেল,রিশা,শরীফুল কাকা,হক টাওয়ার সব কিছু নীতু ভীষণ ভাবে মিস করবে।রোজ রাতে হোস্টেলে ফিরে রিশার সাথে গল্প করা।শুক্রবার বিকেলে সবাই ভাগ করে ক্যারাম খেলা,মুড়ি মাখা,বিচ্ছিরি সাদা ফ্যাকাশে বয়লার মুরগীর তরকারি সব কিছু নীতু ভীষণ মিস করবে।নীতুর কান্না এসে গেলো।তা দেখে রিশা কতক্ষণ রাগারাগি করলো।এসব সিলি বিষয় নিয়ে ভাবতে বারণ করলো,আগে নিজের ক্যারিয়ার।এসব কথা বলে কতক্ষণ জ্ঞান দিলো। একসময় নীতু রিশাকে জাপটে ধরলো,রিশার বকবক থেমে গেলো! রিশা পাথরের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো আর নীতু ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে থাকলো।

*********
নীতু আজ নিজের বাসায় এসেছে।সুরভি দরজা খুলে নীতুকে দেখে ভীষণ অবাক হলো।নীতু সোজাসুজি বাবার রুমে চলে গেলো।সাথে জায়েদও এসেছে।জায়েদের মুখে হাসির আলোড়ন। নীতু যত নিজেকে গুছিয়ে নিবে তত ভালো থাকবে এটা জায়েদের ধারনা। বাবা নীতুকে দেখে অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। গড়গড় শব্দ করে কিছু বলতে চাইলেন।নীতুর চাকরির খবর শুনে বাবার চোখ থেকে জলের ধারা নামলো।নীতু নিজের ওড়না দিয়ে বাবার চোখ মুছে দিলো।

মহিমা বেগম সবটা শান্ত দৃষ্টিতে দেখলেন।কোন কথা বললেন না।নীতু চলে যাবার সময় মহিমা বেগম ভেজা স্বরে বলে উঠলেন,”কয় টা ভাত খেয়ে যা মা।খালি মুখে যাস নে।”মায়ের আবদার পূর্ণ কথা নীতু ফেললো না।নীতু চুপচাপ আবার বাবার রুমে চলে গেলো।জায়েদ ফোন করে মিতুকে ইতুকে আসতে বললো।একটু পরই গোটা ব্যাটালিয়ান চলে আসলো।নিখিল অফিস থেকে চলে আসলো।কেমন চাকরি, কোথায় কি সবকিছুর খোঁজ নিলো।নীতু শান্ত স্বরে জবাব দিলো।শান্ত বাড়িটা মুহূর্তেই হইহই করে উঠলো তিন বোনের মিলন মেলায়।সেতু ভিডিও কলে জয়েন করলো।নীতুর ঢাকা আসার কথা শুনে সেতু ভীষণ খুশি।ইচ্ছা হলেই বোনের সাথে দেখা হবে।

রান্নাকরার পুরোটা সময়ে মহিমা বেগম বারবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে থাকলো।তা দেখে সুরভি মুখ বেঙচালো।সবার আদিখ্যেতা সহ্য করতে না পেরে একটা সময় বলেই উঠলো,”এতদিন কেন চাকরি হলো না?সাতাশ বছর তো সবার ঘারে বোঝার মত লটকেই রইলে। আর যেই না আড়াই মাস হলো ঘর থেকে বের হলে ওমনি চাকরি হয়ে গেলো।কোন জাদুতে বলতো?রুপের তো এই ছিড়ি তবে কিসের জোরে পাইলে?”

জায়েদ রাগে গরম হয়ে কিছু বলতে নিলো।ইতু তাতিয়ে উঠলো।নীতু দুজনকেই হাত দিয়ে বাঁধা দিয়ে চুপ থাকতে বললো।তারপর ঠান্ডা স্বরে বললো,”ভাবি আমার জন্য তোমার চিরকালই চিন্তার কোন শেষ ছিল না।এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ!আজ থেকে বরং নিজের জন্য চিন্তা করো।অনেক তো হলো পরের ধানে মই দেওয়া।আমাকে নিয়ে এত ভাবলে তোমার ধলা চামড়ায় বলিরেখা পরতে পারে।তারপর বুড়িদের মত লাগবে তোমায়।তুমিই তো বলো পুরুষ মানুষ সৌন্দর্যের পুজারি,তারপর ভাইয়া যদি আর একটা বিয়ে কে আনে।তখন কি করবে?তো অযথা অন্যের চিন্তা করা বাদ দাও!রেগো না আবার তোমার ভালোর জন্যই বললাম।”

নীতুর কথায় ইতু মুচকি হাসলো।জায়েদ হতভম্ব দৃষ্টিতে দেখলো নীতুর এই পরিবর্তনীয় রুপ!

সরষে ভর্তা,রসুন ভর্তা,পুইশাকের তারকারি,আর মাছ দিয়ে নীতু ভরপেট ভাত খেলো।তারপও মহিমা বেগম বললো,”আর একটু ভাত দেই? কিছুই তো খেলি না নীতু।”

বিকেলে চলে আসার সময় মহিমা বেগম হু হু করে কাঁদলেন।নীতু কাঁদলো না একফোঁটাও!মাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে আসলো।বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নীতুর মনে হলো,তার কেমন হালকা লাগছে বুকের ভিতরটা।নিঃশ্বাসে সতেজতার ছোঁয়া। নীতু ব্যস্ত পায়ে হাঁটা ধরলো।জায়েদ একটা রিকশা এনে থামলো নীতুর সামনে।নীতু একা যেতে চাইলেও জায়েদ সে বারণ শোনেনি, ঠিকিই রিকশা নিয়ে চলে এসেছে। নীতু রিকশায় উঠে বসলো।জায়েদ পাশে বসে রইলো।একটা সময় নীতু বলে উঠলো,”দাদাভাই,আমরা আপনমানুষের গুরুত্ব কেন সবসময় বেলাশেষেই বুঝতে পারি?”

জায়েদ কিছু বললো না।কিন্তু সস্নেহে নীতুর মাথায় হাত রাখলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here