কাননকুসুম শেষ পর্ব

0
1214

কাননকুসুম?
আরিফুর রহমান মিনহাজ
অন্তিম পর্ব

একটু পর সেই ধুমসি রমণী বিরক্তিমাখা মুখ নিয়ে হাজির হলো আমার সামনে। ততক্ষণে আমি নিজের কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছি৷ নিজের ভুল অথবা পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় না চাইতেও যে পরিস্থিতি আমি সৃষ্টি করেছি তা থেকে সাফুরাকে মুক্তি দেবার পণ আমার মাথায় ঘুরতে লাগল। কোনপ্রকার ভূমিকা না করে বললাম,
– বাবা অসুস্থ। তিনি সাফুরাকে বাড়িতে যেতে বলেছেন কয়েকদিনের জন্য। আমি ওকে নিয়ে যেতে এসেছি৷
সাফুরা বিস্মিত বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। বড় সতিন অদ্ভুত মুদ্রায় মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
– নিয়ে গেলে আপদটারে একেবারে নিয়ে যান। কে মানা করে? আমরাই বরং একটু শান্তিতে বাঁচি।
আমি নরম-গরম সুরে বললাম,
– ও চাইলে একেবারেও চলে যেতে পারে। কিন্তু অধিকার সমান সমান। আপনারা যেমন এই বাড়ির বউ,সেও তেমন। ঠিক সময়ে ও এসে হাজির হবে তাই না সাফুরা?
সাফুরা বলল,
– আমি বাবাকে দেখেই চলে আসব।
ঘটনা সত্যিই ঘটে যাচ্ছে দেখে সতিন এবার দিকভ্রান্ত হয়ে বলে বসল,
– ঘরের এতগুলো কাজ পড়ে আছে,সেগুলো করবে কে? ঘরে মানুষ থাকতে বাঁদী রাখব নাকি? আমার ছেলেরা কামিয়ে যাচ্ছে, আর তোমরা খাচ্ছ এজন্য গায়ে লাগে না?
সাফুরা কিছু বলতে যাচ্ছিল,ওকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম,
– সাফুরাও এই বাড়ির বাঁদী না। চলো সাফুরা,সময় কম।
বড় সতিন উদ্ভ্রান্তের মতো থপথপ করে পা ফেলে চলে গেল। সাফুরা কপাল কুঁচকে অধীর হয়ে বলল,
– বাবা সত্যি অসুস্থ? এজন্য এসেছেন আপনি? এতক্ষণ বলেননাই কেন?
-হ্যাঁ অসুস্থ। রেডি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি।
মিথ্যেটা আমাকে বলতেই হলো। এছাড়া সাফুরাকে এই বাড়ি থেকে বের করার কোনো সুপথ আমার জানা ছিল না৷ এই বাড়িতে আমার উদ্দেশ্যহীন আগমন, সাফুরা ও তার মেয়ের নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, নাজেহাল জীবনযাপনের দায় আপেক্ষিকভাবে আমার স্কন্ধেই যেন পতিত হচ্ছিল। কাজেই, আমাকে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। মনে মনে একটা খসড়া আমি এঁকে নিয়েছি। প্রথমে সাফুরাকে ভালোভাবে বুঝাতে হবে। এরপর বাবার সম্মতি থাকলে ওকে বাড়িতেই রাখব। না থাকলে, মফস্বলের কোথাও ছোটখাটো একটা চাকরি ধরিয়ে দিয়ে কোনোমতে দিনাতিপাত করার সুযোগ করে দেব। আমার জান্নাতবাসিনী মা এবার নিশ্চয়ই প্রসন্ন হবেন আমার ওপর।
সাফুরা প্রস্তুত হতে চলে গেল। নিজে বোরকা পরে মেয়েকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে ফিরেও এলো খুব তাড়াতাড়ি। বাড়ির পুঁচকে ছেলেমেয়েরা উঠোনে ভিড় জমিয়েছে। তাদের ছোট মা বাড়ির বাইরে যাচ্ছে এটা যেন পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য,তাই দেখার জন্য ঠেলাঠেলি করছে তারা। মেঝো সতিন দর্শন দিল শেষ মুহূর্তে। আমার দিকে একপলক আড়ে তাকিয়ে সাফুরাকে বলল,
– আসবি কবে?
– দেখি আগে…
– এত দেখাদেখি নাই। তাড়াতাড়ি চলে আসবি। বড়টা রেগে ঢোল হয়ে আছে। আমাকে উল্টাপাল্টা কিছু করতে বললে তো খুনাখুনি হয়ে যাবে ঘরে।
আমার বিরক্ত লাগছিল৷ সাফুরার মেয়ে সায়মা ছিল আমার কোলে। আমি এগিয়ে গেলাম ওকে নিয়ে। সাফুরা মেঝো সতিনকে কী যেন উত্তর দিয়ে এলো পিছু পিছু। বাড়ির সীমানার শেষপ্রান্তেই একটা ঝুপড়িগোছের মুদির দোকান। দোকানের সামনে গিয়ে সায়মাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম,
– কী খাবে নাও।
সায়মার হাসি হাসি মুখে ভ্যালভ্যালে দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। সাফুরা বলল,
– আসার সময় তো আনছেন অনেককিছু। আবার কেন?
– মনে হয় না ওগুলো আস্ত থাকবে,আর ওখান থেকে সায়মা কিছু পাবে। নাও সায়মা। যা খুশি নাও।
সায়মা খুশিতে গদগদ হয়ে চিপস চকলেট প্রভৃতি নিতে শুরু করল। সাফুরা আনমনা হয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল,
– বাবা কি বেশি অসুস্থ?
আমি ওর দিকে না তাকিয়ে বললাম,
– গেলেই দেখতে পাবে।

বাড়িতে এসে সাফুরা যখন দেখল বাবা দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে তখন তার মনের অবস্থা কী ছিল আমার জানা নেই। কিন্তু বাবার অবস্থা যে মোটেও সন্তোষজনক ছিল না সে আমার খুব সহজ অনুমেয়। উভয়জনের প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিজ ঘরে অবস্থান করলাম। সেদিন পরিস্থিতি মোটামুটি শীতল থাকলেও পরদিন কিন্তু তা রইল না৷ সকালে বাবা এলেন। এসেই গর্জে উঠলেন,
– কী শুরু করেছ তুমি? তুমি জান এটার শেষ কী হতে পারে?
আমি যেন কিছুই বুঝতে পারিনি এমন ভান করে বললাম,
– কী হয়েছে?
– সাফুরাকে কেন এনেছ? এটা নিয়ে কত কথা হবে ভেবে দেখছ?
– তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ওই বাড়িতে থেকে সাফুরার আর কোনো কাজ নেই।
– এই বাড়িতে থেকেও ওর কোনো কাজ নেই। তুমি ওকে এনেছ। তুমিই ওর গতি করো।
বাবা চলে গেলেন। সাফুরা ঢুকল একটু পর। ওর চোখেমুখে নির্মোহ স্থিরতা।
– হাবিব ভাই, এতদিন পর এসে এসব কী?… কী চান আপনি?
আমার কথা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। ধীরে ধীরে সেগুলো উগরানো শুরু করলাম,
– আমি চাই,তুমি ওই উদ্দেশ্যহীন জুলুমের সংসার ছেড়ে নতুন করে জীবন শুরু করো। এখনো অনেক সময় আছে, তোমার আলাদা একটা সুন্দর লাইফ হতে পারে। তুমি কেন ওই সংসারে অর্থহীন ঘানি টানবে? ভেবে দেখেছ দিনশেষে ওই বাড়ির মানুষগুলো তোমাকে কী দিচ্ছে? অবহেলা, লাঞ্ছনা, শারীরিক-মানসিক অবসাদ… আর কী?
সাফুরা ঘোরলাগা দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই যেন বাস্তবতায় ফিরে এসে ওর ঘোর কেটে গেল৷
– সম্ভব না। আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে হলেও এটা সম্ভব না।
– ওই বাড়িতে থাকলেই বরং তোমার পরিচয়ের কারণে তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। ভেবে দেখো তো, ওই পরিবারে কোন মানুষটা সায়মার পেছনে এক পয়সা খরচ করতে চাইবে? কেনই বা করবে? তোমার প্রয়োজন যখন ফুরিয়ে যাবে,তোমাকে আর তোমার মেয়েকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ওই বাড়ি থেকে বের করে দিলে তুমি কাকে অভিযোগ দেবে? সেই সাহসও তো তোমার নাই।
সাফুরা ভরসাহীন রক্তশূন্য মুখে বিড়বিড় করে বলল,
– আমি কিছু জানি না। আমি ওখানেই থাকব।
– সাফুরা, তোমার জীবনটা এমন হওয়ার পেছনে আমি নিজেও কিছুটা দায়ী। তোমার প্রতি আমার কখনোই সুদৃষ্টি ছিল না৷ হয়তো-বা মায়ের কথা শুনলে আজকে এই দিন দেখতে হতো না। কিন্তু যার জন্য মায়ের কথা আমি শুনিনি পরবর্তীতে সে হয়ে উঠল চরিত্রহীন,দ্বিচারিণী।
– এসব আমাকে শুনাচ্ছেন কেন?
– শুনাচ্ছি কারণ, আমি চাই তুমি আমার অনুশোচনার আগুনকে প্রশমিত করো। আমার সঙ্গে ঢাকায় যাবে তুমি। তোমার জন্য একটা জব খুঁজে দেব আমি। সায়ামকে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করাবে। আপদে-বিপদে তো আমি আছিই।
– আমি আপনাকে কীভাবে বিশ্বাস করব। ছোট থেকে আপনি আমাকে কখনোই দেখতে পারেননি৷ কখনো আমার চোখাচোখি হননি। মুখে না বললেও আমি বুঝতাম,আমি আশেপাশে থাকলে আপনি বিরক্ত হতেন। তবুও মায়ের মৃত্যুর পর লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে আপনার কাছে সাহায্য চাইলাম। কিন্তু আপনি…। এখন কীভাবে আপনাকে বিশ্বাস করে আপনার সঙ্গে ঢাকায় যাব? কীভাবে আমি বুঝব যে,দুইদিন পর আপনি আমাকে ফেলে চলে যাবেন না?
সাফুরার কথা আমার ভেতরটা অভূতপূর্বভাবে নাড়িয়ে দিল। কাঁথার জমিনে যেভাবে হস্তশিল্পীর সূঁচ চলে ঠিক তেমনিভাবে আমার বুকের জমিনের সাফুরার অবিশ্বাসের প্রতিটি কথা সূঁচের মতো বিদ্ধ হতে হতে বড় একটা ঘা তৈরি করল৷ কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে চোখজোড়া ছলছল করে উঠল আমার। এ কী কাণ্ড! কী এমন কঠিন কথা বলেছে ও? সত্যিই তো বলেছে৷ আমার মদদে সম্পূর্ণ নতুন জীবন গড়ার যে বিশ্বাসের ভিত্তি সেটিই যে পাকাপোক্ত হয়নি এখনো! বললাম,
– আমি তোমাকে সাহায্য করিনি ঠিক৷ দেখতে পারিনি এটাও ঠিক৷ কিন্তু সাহায্য করার নামে নিয়ে গিয়ে অবহেলা করব,এতোটা খারাপ মানুষ আমি নই৷ এতটুকু তো বিশ্বাস করতে পার!
– ঠিক আছে। ভেবে দেখব আমি।
– হু দেখ।

দিন দুই পর সাফুরা আমাকে সকালের নাশতা দিতে এসে বলল,
– আমার আর সায়মার কিছু জিনিসপত্র আছে ওই বাড়িতে। ওগুলো কখন আনব?
আমি চোখ তুলে চাইলাম ওর দিকে। ও আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল কৌতুহলী দৃষ্টিতে। চোখাচোখি হতেই নীরব হাসির লহর জেগে উঠল দু’জনের ঠোঁটের প্রান্ত থেকে। বললাম,
– লাগবে না। নতুন কিনে নেব।
সাফুরা চলে যাচ্ছিল, আমি পেছনে থেকে গলা উঁচিয়ে বললাম,
– তাহলে রাতের ট্রেনের টিকিট কাটছি? ঘুমাতে ঘুমাতে যাওয়া যাবে।
সাফুরা সম্মতিসূচক হাসি দিয়ে চলে গেল। দিনদুনিয়া বদলে গেছে দেখি! মানুষে কপাল খুললে নাকি সাপের পা দেখে,আমি দেখলাম সাফুরার হাসি। সাপের পা,সাফুরার মুখে হাসি দুটোই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ দুর্লভ বস্তু।

গভীর নিশীথ। ঢাকামুখী ট্রেন ছুটে চলেছে উল্কাবেগে। আমার পাশের সিটে সাফুরা কী এক অধরা নির্ভারতায় বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে। ওর কোলে চার বছর বয়সী সায়মাও গভীর ঘুমে অচেতন। শার্শি উঠানো জানালা গলে হুহু করে ঢুকছে দিকচক্রবাল হতে ছুটে আসা উন্মাদ বাতাসের দল। আকাশে বিশ্রামহীন চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা চলছে। সেই সাথে আলো আর ছায়ার মাঝে অবগাহন করে চলেছে সমস্ত চরাচর। মনটা ওই অনন্ত অন্তরীক্ষে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো পলকা মেঘের মতোই হালকা হয়ে আছে। ভাসাভাসা চিন্তায় বুঁদ হয়ে থেকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙতেই দেখি সাফুরা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আচমকা আমার ঘুম ভাঙাতে ধরা পড়া ভঙ্গিতে সামান্য বিব্রত হয়ে বলল,
– আ…,এসে গেছি মনে হয়!
আমি বাইরে চনমনে রোদ্দুর-ভরা নতুন দিনের সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– প্রায়… আর দশ পনের মিনিট!
ঘুম-ভাঙতেই দেখা অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য সহজেই মন থেকে সরানো যায় না৷ আমিও সরাতে পারছি না৷ সাফুরা অমনভাবে তাকিয়ে ছিল কেন আমার দিকে? কী চলছিল ওর মন-কাননে? কী ভাবছিল ও?
ট্রেনের গতি ধীর হয়ে আসতে আসতে কমলাপুর রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে এসে একসময় ট্রেনটা থেমে গেল। প্রচণ্ড গরম বাইরে। মানুষের ব্যস্ততাময় কোলাহল আর উচ্চতাপমাত্রার প্রচণ্ড দাবদাহে নিশ্বাস ফেলা দায়। আমরা স্টেশনের বাইরে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে কিছু নাশতা করে নিয়ে রওয়ানা দিলাম আমার বাসার দিকে৷ সাফুরাকে বললাম কথাটা। সে গাঁইগুঁই করে বলল,
– আপনি না বললেন বাসা ঠিক করা আছে?
– না বললে কি আর তুমি আসতে? ঢাকা শহরে বাসা খোঁজা আর চাকরি খোঁজা দুইটাই কঠিন কাজ। একটু সবর করো। কয়টাদিন আমার বাসায় থাকো। আমি এমনিতেও বাসায় খুব কম থাকি। আমার কাজটা তো জানো। কোনো নিয়ম-রুটিন নেই।
দেখলাম তা-ও সাফুরার মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ। বাধ্য হয়ে বললাম,
– তুমি কি বিশ্বাস কর না আমাকে?
– করি।
– তাহলে?
সাফুরা মুখ ফিরিয়ে চুপ করে রইল৷ তবে, আমার বাসায় গিয়ে ওর মুখের মলিন ভাবটা আর অবশিষ্ট থাকল না। চোখ দেখেই বুঝলাম বাসাটা বেশ পছন্দ হয়েছে ওর। অনেকদিন না থাকার কারণে একটু অপরিচ্ছন্ন হয়ে আছে,এই যা। কিন্তু হাতের ব্যাগটা রাখতে দেরি, সাফুরা মিশকালো চুলগুলোকে চুড়োখোঁপা করে,শাড়ির অঞ্চল ঘুরিয়ে কোমরে গেঁথে নিয়ে ঝাড়পোঁছে নেমে গেল। দুপুর হবার আগেই পুরো ঘরটা তকতকে হয়ে গেল, রান্নাবান্না সম্পন্ন হলো;এমনকি দক্ষিণের ঝুল বারান্দায় আমার লাগানো ফুলগাছগুলো দীর্ঘদিন পর পানি পেয়ে জলজিয়ন্ত হয়ে উঠল। আমি শুধু অবাক-বিস্ময়ে বসে বসে দেখলাম ওর কর্মচঞ্চলতা আর ভাবলাম,এই মেয়ের কি ক্লান্তি বলতে কিছু নেই! যাহোক,খাবার টেবিলে ও বসতে চাইল না আমার সাথে। আমি দৃঢ়ভাবে বলাতে অগত্যা বসল। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম,ও কীধরণের কাজ করতে পারবে? বা কেমন কাজ করতে সে আগ্রহী। সে জবাব দিল, চলার মতো যেকোনো একটা কাজ দিলেই সে করতে পারবে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। সম্মানজনক পেশা বলতে কিছু নেই দুনিয়াতে,প্রত্যেক পেশারই আলাদা আলাদা প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সমাজে-রাষ্ট্রে। কিন্তু আমি অন্তত স্বস্তি পাই এমন একটা কাজ তো সাফুরাকে দিতেই হয়, নতুবা ওকে এখানে নিয়ে এসে অকূলপাথারে ফেলার জন্য আমার অনুশোচনা হবে অনন্ত।

দিন সাতেক ঘুরাঘুরির পর সাফুরার জন্য চাকরি এবং বাসা দু’টোই খুব সহজেই পাওয়া গেল। স্বস্তির কথা হচ্ছে, দুটোই আমার বাসার কাছাকাছি। বড় একটা শপিং কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে ‘বিসমিল্লাহ বোরকা হাউস’ নামে একটা বৃহৎ বোরকার দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করবে সাফুরা। বেতন যৎসামান্য। অভিজ্ঞ হয়ে গেলে ধীরে ধীরে বাড়বে। প্রথম কয়েকদিন আমি ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম সেখানে। এরপর থেকে সে একাই যাতায়াত করছে। সায়মাকে নিয়েই সে দোকানে যায়। সায়মা নিতান্ত সহজসরল ওর শান্তশিষ্ট মেয়ে। কর্মক্ষেত্রে কোনোপ্রকার ঝুটঝামেলা হয় না ওকে নিয়ে।
তবে নতুন বাসা নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। আশেপাশে অনেক ভাড়াটিয়া থাকলেও একা একা এই দূর দেশের নিভৃত একটি কুঠুরিতে মেয়ে নিয়ে থাকাটা ওর জন্য মোটেও সহজসাধ্য হচ্ছে না। তথাপি সন্দেহ নেই,শীঘ্রই সে নতুন পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে নিতে পারবে।

মাসপাঁচেক গত হলো। শহুরে হাওয়ায় এরিমধ্যে সাফুরা অনেকটা চালাক আর প্রাণবন্ত হয়েছে। আমার সঙ্গে আজন্ম গুমোট ভাবটা দাবদগ্ধ গ্রীষ্মকে ফাঁকে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সশব্দ-শীতল উদ্দামতা নিয়ে অন্তর্হিত হয়ে গেছে। কর্মক্ষেত্রের বন্ধুদের সঙ্গে তার হৃদ্যতা প্রকট হয়েছে। প্রথমদিকের মতো এখন আর সে প্রতিটা বিষয়ে আমার পরামর্শ বা সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করে না। সবকিছু নিয়ে মিছেমিছি আতঙ্কিত হয় না। সবমিলিয়ে স্বীয় প্রচেষ্টায় ওর সার্বিক আত্মোন্নতি প্রশংসার দাবি রাখে। মাঝেমধ্যেই সে নিজের বাসায় ডাকে আমাকে।
– ইয়ে, বাসায় আছেন আপনি?—ও আচ্ছা,খেয়েছেন? ওমা, খাননি? বুয়া আসেনি? জানতাম আজকে আসবে না। চলে আসুন না আমার বাসায়। সায়মা আপনার সঙ্গে খাবে বলে জেদ ধরে বসে আছে।
ওর বাসা থেকে আমার বাসার দূরত্ব পাঁচ মিনিটের হাঁটার পথ। ওর বাসায় গিয়ে দেখি সত্যি সত্যিই ওরা ভুনাখিচুড়ি আর মাংস নিয়ে বর্তন সাজিয়ে আমার জন্য বসে আছে। মা-মেয়ের মুখে হাসি। আমি বেসিন থেকে হাতটা ধুয়ে নিয়ে টুপ করে বসে পড়ি দস্তরে। খেতে খেতেই কথা বলি,
– মাস শেষ হয়ে আসছে৷ এখন এসব করার কী দরকার? আর তুমি কীভাবে জানলে আজকে আমি বাসায় থাকব,আর আজকেই বুয়া আসবে না?
সাফুরা বরাবরের মতোই কথা কম বলে। আমার প্রশ্নের জবাবে সে শুধু ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসে। একটু পর বলে,
– এভাবে বুয়ার ওপর আর কতকাল?বিয়েটা এবার করেই ফেলুন।
আমি বিষম খেতে গিয়েও থেমে যাই। এধরণের কথাবার্তা ওর মুখে নতুন ফুটতে শুরু করেছে। স্পষ্টতই, আমার ওপর যে ভীতি কাজ করত এখন আর সেই ভীতির ছিটেফোঁটাও নেই। বলাবাহুল্য,সানজানার বিষয়টা সে জানে।ওর কৌতুহল মেটাতে সংক্ষেপে বলেছিলাম পুরো ঘটনা। আমার নীরবতার বিপরীতে এতটুকুতেও সে থেমে থাকে না। বলে,
– আমাদের দোকানে একটা মেয়ে আছে। খুউব সুন্দর। ফেমিলি প্রবলেমের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে।…না,আপনার তো আবার উচ্চশিক্ষিত বউ না হলে হবে না।
বলেই সে স্বীকৃতির অপেক্ষায় আড়নয়নে তাকায়। আমি চুপচাপ খেয়ে যাই। একসময় নিরাশ হয়ে সাফুরাও নীরবে খেতে শুরু করে।

মাসান্তে ওর টাকাপয়সায় ভীষণ রকমের টানাটানি পড়ে যায়৷ ছলেবলে ও আমাকে নিজের শূন্যতার কথা বুঝতে না দিলেও আমি ঠিকই বুঝে যাই। ওর বাসা আর আমার বাসার পথেই একটা জমজমাট কাঁচাবাজার পড়ে। রাতের কর্মফেরত মানুষজন এই বাজার থেকে সদাই করে বাসায় ফেরে। বাজারে ঢুকে পছন্দসই বাজার করে হাজির হই ওর বাসায়। বেল বাজতেই সে ছুটে আসে। দরোজাটা খুলেই আমার দু-হাত ভর্তি সদাই দেখে ওর মুখের প্রসন্নতা ম্লান হয়ে যায়। ও ভাবে ওর অল্প আয়ের সংসারের কারণে আমি ওকে দয়া করে এসব দিই। অবশ্য আমি নিজেও জানি না, কেন দিই। সদাইগুলো সে নেয় না। ঠান্ডাভাবে বলে, আমি কিছু রাঁধতে পারব না এখন। অনেক টায়ার্ড আমি।
সায়মা ততক্ষণে আমার কাছে চলে আসে। ওর গাল টেনে দিয়ে আমি বলি,
– আচ্ছা থাক। চলো সায়মা,আজকে আমরা রান্না করব।
বলেই আমরা দুজন কিচেনের চলে যাই।
এটা-ওটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করার পর সাফুরা এসে দাঁড়ায় চৌকাঠের কোণে। ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ৷ না তাকিয়েও আমি বুঝতে পারি আমার পিঠের ওপর একজোড়া শীতল দৃষ্টি দুর্বোধ্যভাবে তাকিয়ে আছে।
– আমার কিন্তু ভালো লাগে না। পুরো ঘরের জিনিসপত্র কিনলেন, কয়দিন পরপর বাজার করেন, আপনার এতো ঋণ আমি ঐ দোকানে চাকরি করে শোধ করতে পারব না।
আমি হেসে পেছনে ঘাড় ফেরাই,
– শোধ করতে কে বলল?
– বলতে হয় নাকি।… দেখি সরুন। কাজ করতে এসে কাজ বাড়াচ্ছেন আরো।
আমি সরে দাঁড়িয়ে ওকে জায়গায় করে দিতে দিতে বলি,
– উফ বাঁচালে,ভেবেছিলাম সত্যিই রান্না করতে হবে।
সাফুরা আড়চোখে চেয়ে একটা অর্থহীন প্রশ্রয়ের হাসি দেয়।
এরপর…এরপর রান্না হয়,খাওয়াদাওয়া হয়। আমি নিজ বাসায় ফিরে এসে মড়ার মতো ঘুম দিই। এরপর বেশ ক’দিন ব্যস্ততার কারণে কেউ কারো খোঁজ নিতে পারি না। হঠাৎ একদিন সাফুরা ফোন করে বলল,
– আপনি কি বাসায় আছেন?
আমি তখন সবে ফিরেছিলাম বাসায়। বললাম,
– হ্যাঁ,
– থাকুন,আমি আসছি।
বলেই ফোনটা কেটে দিল সাফুরা। একটু পর কলিংবেলটা বেজে উঠলে আমি দরজা খুলে দিলাম৷ ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সাফুরা ঢুকল ঘরে। ঢুকেই বড় একটা নিশ্বাস ফেলে সোফার ওপর বসে পড়ল সে। সায়মাকে পাঠিয়ে দিল অন্য রুমে। আমি অবাক মেনে বললাম,
– কী হয়েছে? অসুস্থ নাকি?
– নাহ্,ফ্যাসফ্যাসে গলায় জবাব দিল সাফুরা,আমি আপনাকে একটা বিষয় বলিনি।
– কী?
– আমাদের বোরকা হাউসের যে মালিক,তার ছেলে অনেকদিন ধরে ঘুরছে আমার পেছনে। অনেকদিন ধরে বলতে,একেবারে শুরু থেকেই। ছেলেটা ডিভোর্সি। কোনো একটা কারণে বউ পালিয়েছে। ওই ঘরে একটা ছেলেও আছে। এখন আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি না করেছি। কিন্তু শুনে না। পাগলামি করে। ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করে। আজকে মালিক এসে আমার কাছে প্রস্তাব দিয়ে গেল। বলে যে, একমাত্র ছেলে।ওরা সবকিছুতে রাজি। বিয়ে করলে আর কাজ করতে হবে না। সায়মার সব দায়িত্ব নিতেও রাজি। কিন্তু যদি বিয়ে না করি তাহলে আমি যেন ওই দোকানে আর না যাই।
সব শুনে এক অকারণ জলোচ্ছ্বাসে আমার চিরতৃষিত হৃদয়বালুকাবেলায় যেন একের পর এক উর্মিমালা আছড়ে পড়তে লাগল। নিজেকে সংযত করে আমি নিশ্বাস ফেলে বললাম,
– এই ব্যাপার! তা,ছেলে দেখতে কেমন? স্বভাব-চরিত্র ঠিক?
– হুম সব ঠিক। কিন্তু আমি বিয়ে করব না। ওরা যে আমার মেয়েকে অবহেলা করবে না তার কোনো গ্যারেন্টি নাই।
আমি দশ আঙুল এক করে সুমুখে ঝুঁকে বললাম,
– তাহলে তোমার জীবনটা এভাবেই নষ্ট হবে?
সাফুরা অবলীলায় বলল,
– আমার জীবন এমনিতেই নষ্ট। নষ্ট হবার আর কী বাকি আছে?
– শুনো,আমার পরামর্শ হলো। আরেকটু যাচাই-বাছাই করে বিয়েটা তুমি কর। আজ না-হয় কাল,তোমার জীবনটা নতুন করে শুরু করা উচিত। তাছাড়া, ওরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটা অাইনগতভাবে করে নিলে,মানতে বাধ্য।
– ওরা আমার জন্মপরিচয় জানে না। জানলে,আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না।
– সেটা লুকিয়ে রাখো।
-অসম্ভব। পরে ঝামেলা হবে।
আমি হেলান দিয়ে ক্লান্ত গলায় জানতে চাইলাম,
– তাহলে তুমি কী চাও?
সাফুরা দ্বিধান্বিত গলায় বলল,
– জানি না।
আমি মুহূর্ত কয়েক চুপ করে রইলাম। বহুমুখী চিন্তাস্রোতে মাথার ভেতরটা ভোঁতা হয়ে আছে। কী করব,কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না আর। বিরক্তিসূচক শব্দ করে সটান বসে বললাম,
– বাদ দাও তো, বাদ দাও। আমাকে বিয়ে করবে? আমি সায়মার খুব ভালো বাবা হবো।
আমার কথা শুনে সাফুরা চকিতে চমকে তুড়িলাফ দিয়ে উঠল। নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠল ওর। কপালে ভাঁজ পড়ল। চোখের দৃষ্টিতে স্থিত উদ্ভ্রান্তি। পলে পলে ছলছল করে উঠল ওর দুচোখ। প্রস্থান করি করি করেও সোফার হাতল ধরে আবার বসে পড়ল সে। মুহূর্তেক অসহ্য নিশ্ছিদ্র অবিচলতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়ে রইলাম। আচানক সে দু’হাতে চোখ মুছে শক্ত গলায় বলল,
– মজা করছেন?
– না।
– অবশ্যই মজা করছেন। আমিই কেন? এই শহরে তো আপনার সুন্দরী, গুণি,শিক্ষিত বান্ধবীর অভাব নাই। ওদের কেউ নয় কেন?
– তোমার যদি ওদের হিংসে হয় তাহলো ওদের চ্যাপ্টার ক্লোজড। শুধু তুমি।
– আমি হিংসুটে না।
– মেয়েরা হিংসুটেই হয়।
– কবে থেকে আপনি আমাকে নিয়ে…
– যবে থেকে আমি জানতে পারলাম,তুমি আমাকে ছোট থেকেই পছন্দ করতে। কিশোরবেলা থেকেই ভালোবাসতে। যৌবনবেলায় আমার অসাক্ষাতে কষ্ট পেতে।
– চুপ করুন। এসব মিথ্যে।
– প্রমাণ আছে কিন্তু আমার কাছে। তোমার ডায়েরিটা…
– আপনি একটা চোর। কোথায় ওটা? দ্যান…
– লাভ নাই। সব পড়া শেষ।
সাফুরার লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবার মতো অবস্থা হলো। বারকয়েক উঠে যাবার চেষ্টা করেও সে সফল হলো না। ওর পা যেন মেঝের সঙ্গে ওয়েল্ডিং করে দেওয়া হয়েছে। মাথাটা নিচু করে নীরবে কাঁদছে ও। কীসের কান্না কে বলবে? আমি শুধালাম,
– কাঁদছ কেন?
সাফুরা বলল,
– আমি কোনোভাবেই আপনার যোগ্য না।
আমি নিজ অবস্থান থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বিঘৎখানেক দূরত্ব রেখে বসলাম ওর পাশে। বললাম,
– তোমার কাছে যোগ্যতার মাপকাঠি কী আমার জানা নাই,কিন্তু আমার মাপকাঠিতে তুমি সবার উর্ধ্বে, তোমাকে নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমি আমার ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। মায়ের শেষ ইচ্ছেটা দেরিতে হলেও পূরণ হবে। তুমি কি রাজি?
সাফুরা জলভরা চোখে মাথা তুলে চাইল। সম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে পুনরায় মস্তক অবনত করল।আমি চাপা খুশিতে আসন ত্যাগ করে দাঁড়ালাম। বারকয়েক দ্বিধান্বিত হয়ে ওর পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়লাম। ওর ডান করতল নিজের মুঠোয় টেনে নিয়ে অন্যহাতের উলটোপিঠে আলতো করে অশ্রু মুছে দিয়ে বললাম,
– তাহলে,এই তোমার আনন্দিত চোখের পানির শপথ, আমি তোমার মন থেকে অন্ধকার অতীতকে সরিয়ে দেবার জন্য সবকিছু করব৷ সায়মা আমার ঔরসজাত সন্তান না এটা তোমাকে মনে করতে দিব না কখনো। কথা দিলাম।

পরেরদিন মধ্যাহ্নে অল্প কয়জন বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে খুবই সামান্য আয়োজনে আমার বিয়ে হয়ে গেল৷ মা কেন নতুন বৌ সেজে বসে আছে এ নিয়ে সায়মার কৌতুহলের অন্ত নেই। সাফুরা মেয়েকে বুঝাবে কি, লজ্জায় সে যেন কানেই শুনতে পাচ্ছে না এমন ভান করে রইল। আমার পরনে শুধু একটা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি পরনে সায়মা আমাকে বহুবার দেখেছে, কাজেই আমাকে নিয়ে তা বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। শেষমেশ, আমাকে কাছে পেয়ে সাফুরা বলল,
– বসে বসে মজা নিচ্ছেন। এতগুলো লোকের সামনে দেখুন কী বলছে মেয়েটা৷ বুঝিয়ে দিলেই তো পারেন।
– আহারে লজ্জাবতী, নিজে বুঝালে কী হয়?
– আমি পারব না৷
সায়মাকে আমি কাছে ডেকে নিলাম। বললাম,
– শুনো সায়মা,আজ থেকে তুমি আর তোমার মা আমার সঙ্গে,আমার বাসায় থাকবে। সকাল,দুপুর রাতে আমরা সবাই একসঙ্গে খাব৷ উম…ঘুমাবও একসঙ্গে।
সাফুরা পাশেই ছিল। শেষ কথাটা শুনে সে নতুন বউয়ের মতোই লাজরাঙা দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। সায়মা যাচাল,
– কেন?
– কেন? কারণ আজ থেকে আমি তোমার বাবা। তুমি আমার মেয়ে৷ বাবা-মেয়েকে কি আলাদা থাকে কখনো? দেখেছ কোথাও?
সায়মার মাথা নেড়ে বলল,
– তাহলে আমি তোমাকে বাবা ডাকব? এজন্য মা বৌ সেজেছে?
আমি হেসে উঠে বললাম,
– হ্যাঁ,এজন্যই।
সায়মার কৌতুহল মিটল কি-না কে জানে। তবুও সে আর কোনো প্রশ্ন করল না৷
ও হ্যাঁ,বাবাকে জানিয়েছিলাম,আমি সাফুরাকে বিয়ে করছি। বাবা বললেন,
– জানতাম, আগে-পরে তুমি এই কাজটাই করবে। করলে করোগে। তবে মনে রেখো,আমার বাড়িঘরের ত্রিসীমানাতেও যেন তোমায় না দেখি।
আমি রেগে গিয়ে বললাম,
– তোমার ত্রিসীমানায় তুমি হালচাষ করোগে। আমার ওসবে লোভ নাই৷
বাবা ততোধিক রাগ দেখিয়ে বললেন,
– ঠিক আছে,আমি তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করলাম।
– আমিও তোমাকে ত্যাজ্যবাপ ঘোষণা করলাম।
বাবার সঙ্গে আমার ঘটনা এখানেই ডিসমিস। তবে মাঝেমধ্যে খবর পাই,বাবা অনুতপ্ত। কিন্তু লজ্জায় আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন না।

বিয়ের দুইবছর পরের কথা।
সাফুরা শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে। চোখেমুখে রাজ্যির ক্লান্তি আর ঠোঁটের কোণে একচিলতে মেঘভাঙা রোদ্দুরের ন্যায় ঝলমলে হাসি। আমার কোলে একটা ফুটফুটে শিশুসন্তান। ছেলে। আমার ছেলে। আমাদের ছেলে। আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে সাফুরা ওর নাম রেখেছে আসাদউল্লাহ। সায়মা তার সদ্যভূমিষ্ট ভাইকে কোলে নেওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করছে।
– আমি কোলে নিব,আমার কোলে দাও।
সাফুরা দিতে চাইছে না, রিনরিন করে বলছে,
– তুমি নিজেই ছোট, ফেলে দেবে তো।
শেষমেশ সে কারোর কথাই শুনল না, ফুলতোলা কাঁথা মুড়িয়ে কোলে নিয়েই ছাড়ল। ভাইকে কোলে নিয়ে সে মহাখুশি। ছোট ছোট হাত-পাগুলো টেনে টেনে,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। সাফুরা সতৃষ্ণনয়নে তৃপ্তিভরে সেই দৃশ্যটির অমেয় স্বাদ আস্বাদন করছিল। ঠিক এমনসময় কক্ষটির টিভিতে নিম্ন আওয়াজে চলছিল দুপুরের সংবাদ। আন্তর্জাতিক সংবাদের পর এখন শোবিজের খবর পড়া হচ্ছে। আজকের চমকপ্রদ খবর হলো, অভিনেত্রী সানজানার বিবাহ-বিচ্ছেদ। এ নিয়ে গোটা সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় কাণ্ড চলছে। ঠিক একবছর আগেই ঘটা করে এক প্রভাবশালী শিল্পপতির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ওর। বছর না ঘুরতেই কেল্লাফতে। টিভিতে একটু করে খবরটা দেখে আমি নীরস গলায় বললাম,
– এটাই হবার ছিল।
-, বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন।
বলেই সাফুরা ফিক করে হেসে উঠতে গিয়ে মধুময় বেদনায় চোখ বন্ধ করে নিল। পরক্ষণেই আবার ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটল ওর মুখে। বিভেদ বা তাচ্ছিল্যের হাসি নয়,পূর্ণতার হাসি। আমার মনে পড়ে গেল মৃত্যুর দিনে মায়ের বলা অমূল্য কথাটি,
‘হাবিবউল্লাহ! তুমি যদি আমার চোখের মণি হও সাফুরা আমার সেই চোখের আলো। তোমাদের দু’জনে আমি এক দেখতে চাই।’
আমার মন বলল, দেরিতে হলেও আমরা এক হয়েছি,মা। তোমার স্নেহের ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠা কুসুমকাননকে আমি নিজের বাগানে ঠাই দিয়ে পরম যত্নে রেখেছি। তুমিও যদি এই খুশির দিনে আমাদের পাশে থাকতে? অবশ্যই তুমি আছ,অদৃশ্য হয়ে,আমি এই কক্ষের অন্ধ্রেরন্ধ্রে তোমাকে অনুভব করতে পারছি। এবারের স্বপ্নে পূর্ণতা নিয়ে এসো…।

সমাপ্ত

ভুলত্রুটি মার্জনীয়। পরবর্তী গল্প পোস্ট করা মাত্র পেতে পেইজ সি-ফার্স্ট দিয়ে রাখতে পারেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here