কাননকুসুম?
আরিফুর রহমান মিনহাজ
পর্ব ২
৪
ঢাকায় এসে কর্মস্থলে ছুটলাম আবার। জার্নালিজমই আমার মূল পেশা। দেশের স্বনামধন্য একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি খুব অল্প সময়েই। পাশাপাশি রাজনৈতিক টিভি শো-তে উপস্থাপনা সহ গতানুগতিক প্রথাবিরোধী লেখালেখির কারণে দেশের তথাকথিত শিক্ষিত মহলের কাছে আমি অধিক আলোচিত এবং সমালোচিত। তবে সাধারণ জনগণের বড় একটা অংশ আমাকে ভালোবাসে,আশ্বাস দেয়। বছর দুয়েক আগে এক মন্ত্রীর অবৈধ ব্যবসা ও দুর্নীতির মুখোশ প্রমাণসমেত প্রকাশ্যে উন্মোচন করার পর সেই মন্ত্রী আমার পেছনে ফেউ হয়ে লেগেছিল। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তো,কাজের সুবাদেই সানজানার সঙ্গে আমার পরিচয়। এরপর কীভাবে কীভাবে যে আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক লতিয়ে উঠল তা নিজেরাই বুঝতে পারিনি। মেঘে মেঘে বেলা হলে একদিন আচমকা যেন বুঝতে পারলাম,ওকে ছাড়া আমার দিনগুলো বড্ড ফ্যাকাসে লাগে। জুনিয়র রিপোর্টার হলেও প্রথমদিকে ওর সঙ্গে আমার একটা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব বিরাজমান ছিল। কে কার চেয়ে তথ্যবহুল,চটকদার সংবাদ আনতে পারব এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলতো সবসময়। বলতে গেলে, সাপেনেউলে সম্পর্ক ছিল। এরপর,আমাদের কাছে আসার গল্পটা নেহাতই অলৌকিক ঘটনার মতো। একদিন রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম। সানজানা একদম স্বাভাবিকভাবে আমাকে পেছন থেকে ডেকে দাঁড় করিয়ে এসে বলল,
– হাবিব সাহেব, এত তাড়া কীসের? আসুন কোথাও বসি,কিছু কথা আছে।
আমি অপ্রস্তুত। রূপসী অথচ জাঁদরেল সানজানার এই শীতল রূপ আমার কাছে একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। স্বভাবসিদ্ধ শত্রুভাবাপন্ন সুরে আমি বললাম,
– আমার সঙ্গে আপনার কী কথা থাকবে?
সানজানা তার চঞ্চল চোখজোড়া বাঙময় করে নাচিয়ে বলল,
– আই হ্যাভ আ প্ল্যান! যেটা নিয়ে আমাদের চ্যানেলকে মানুষ আলাদাভাবে চিনতে শুরু করবে। আর আপনাকে ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। প্লিজ না করবেন না,আউডিয়াটা তো আগে শুনুন!
একটা ক্যাফেতে বসে কফির ফেনিল তরলে ঠোঁট ডুবাতো ডুবাতে আমি সানজানার আইডিয়াটা শ্রবণ করলাম। চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত আইডিয়া। এই পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন হলে জার্নালিজমে নতুন একটা মাত্রা যোগ হবে বলে আমার বদ্ধপরিকর ধারণা ছিল। কালের আবর্তে তা হয়েছেও। কিন্তু কালের আবর্তে আরো অনেককিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। হঠাৎ করে জার্নালিজম থেকে সানজানার ঝোঁক কর্পূরের মতো উবে গেল।
তখন আমাদের প্রেম হয়ে গেছে। কাজের সুবাদে, নিজেদের অজান্তেই আমরা পরষ্পরের এতোটা কাছাকাছি চলো গিয়েছিলাম যে তখন সেটাকে আর প্রেম না বলে পারা যায় না। দু’জনের কাছেই যখন নিজেদের মনের অগোচরে ঘটে যাওয়া আশনাইয়ের মিহি তরঙ্গরাশি জলোচ্ছ্বাসরূপে উদ্ভাসিত হলো তখন আমার ভাগ্যতরী যেন সেই উর্মিচ্ছ্বাসে কূলে এসে প্রবলভাবে আছড়ে পড়ল। আম্মা গত হলেন। এই সময় ভালোবাসার মানুষ হিসেবে সানজানার নিজের অবস্থানটা বেশ শক্ত করেই ধরে রেখেছিল। একদিন ও জানাল,ও একটা টিভিসি বিজ্ঞাপনে ডাক পেয়েছিল। কাজটা সে করেছে আমি বাড়ি থাকাকালীনই। ভালো একটা এমাউন্টও পেয়েছে সেখান থেকে। আমি শোকাহত থাকায় বিষয়টা সে জানায়নি তখন। অবাক করা বিষয় হলো,টিভিসিটা প্রকাশপূর্বক নিদারুণ সফলতার পর দেশের নামি-দামি ব্র্যান্ডের পণ্যের বিজ্ঞাপনে নিয়মিত হয়ে গেল সানজানা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের অভিনয়ে দর্শকের মন জয় করে নিতে শুরু করল সে। এরপরের বছরের ভালোবাসা দিবসে একজন প্রতিষ্ঠিত টিভি অভিনেতার সঙ্গে একটা শর্টফিল্মে অভিনয় করে নিজেকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করে নিল সানজানা। অভিনয় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকার সত্বেও যে কর্মদক্ষতা সে দেখিয়েছে তাতে দর্শককূল ধরে নিল এটি সানজানার স্রষ্টাপ্রদত্ত সুপ্তপ্রতিভা। যদিওবা কর্মক্ষেত্র থেকে ওর প্রস্থান আমাকে ভালোই মর্মে বিঁধিয়েছে, তবু এই অনভিপ্রেত সাফল্যে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত এবং গর্বিত আমি৷ কিন্তু সত্যি বলতে গেলে, ওর এই আচমকা ক্রমোন্নতি আমার ভেতরে একটা ভীতির সঞ্চার করেছিল। ওকে হারিয়ে ফেলার ভীতি। সেই ভীতি মনের মধ্যে পুষে না রেখে আমি এক চিত্তচমৎকারী আয়োজন করে ওকে নিজের নাগপাশে বন্দি করার প্রস্তাব রাখলাম। সেই প্রস্তাব শুনে কিন্তু সানজানার চোখেমুখে অবিশ্বাস্য অস্বস্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সন্দিগ্ধ হেসে সে বলল,
– অফকোর্স আই উইল মেরি ইউ। বাট…, নট নাউ!
আমার মুখের মেঘবরন ছায়া দেখে সে তার কোমল দুইহাতে আমার একটি হাত পুরে নিয়ে নরম গলায় বলল,
– দেখো হাবিব,এটা আমার কেরিয়ারের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমি আমার স্কিল নিয়ে কাজ করছি। আমি আরো অনেকদূর যেতে চাই। এখনি বিয়ে করে আমি সবকিছু জটিল করতে চাই না।
আমি তর্ক করতে চাইলাম,
– বিয়ে করলে সব জটিল হবে কে বলল? এখন তুমি একলা এগোচ্ছে। তোমার পরিবার তোমাকে সেভাবে সাপোর্ট করছে না। হয়তো-বা আমি পাশে থেকে তোমাকে সেই সাপোর্টটা দিতে পারব।
– দিচ্ছ তো!
বলে সানজানা মুহূর্তেক নিশ্চুপ থেকে আবার বলল,
– আরো কিছুদিন যাক্। তারপর। বাদ দাও না এখন। তোমাকে তো বলাই হয়নি কী পরিমাণ নাটকের অফার আসছে! কিন্তু আমি না গল্প সিলেক্ট করতে পারছি না। তুমি একটু হেল্প কর না!
বলতে না বলতেই সানজানা একের-পর-এক গল্প ফেঁদে বসল। অতএব বহুল প্রতীক্ষিত প্রসঙ্গটার অকালমৃত্যু এভাবে ঘটল।
দিনকয়েক পরে একদিন মাঝদুপুরে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এল। রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপ্রান্ত থেকে একটা উচ্চকিত নারীকণ্ঠ শোনা গেল,
– ভাইয়া,আমি…।
– কে বলছেন?
– আমি,সাফুরা…।
মুহূর্তেই বিরক্তি জেঁকে বসল আমার মনে। এমনিতেই সুখ-শান্তির দেখা নাই তারওপর এই আপদটা আমার কাছে কী চায়!
– আমার নাম্বার কোথায় পেলে?…আচ্ছা বলো কী বলবে। আমার তাড়া আছে।
– বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।
– খুব ভালো কথা। অবশেষে…
কথাটা বলতে গিয়েও প্রগাঢ় অনৌচিত্য বোধ থেকে হুট করে থেমে ঢোক গিললাম। মেয়েটা হয়তো এই মুহূর্তে খুব খুশি। ওর খুশিটাকে মাটি করব কোন অধিকারে? কিন্তু সাফুরার গলায় ভিন্ন সুর বেজে উঠল,
-লোকটা বুড়ো। আরো তিনটা বউ আছে। কীসের জানি অবৈধ ব্যবসা করে৷ স্কুলে যাওয়ার সময় দোকানে বসে খারাপভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আম্মার কাছে অনেকবার এসেছিল, কিন্তু আম্মা…।
– হুম, এখন আমাকে কী করতে বলছ?
– আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাবেন?
– পাগল নাকি? আমি নিজে থাকি একা ব্যাচেলর বাসায়। তোমাকে এনে আমি ঝামেলায় পড়ব নাকি? তাছাড়া না জানো তুমি হাতের কাজ আর না আছে পড়ালেখা।
– ওখানে তো আপনার অনেক পরিচিতি। আপনি তো চাইলেই…
– আমার পরিচিতি আছে বলেই নারীঘটিত কোনো কেলেঙ্কারিতে আমি যাচ্ছি না।… আমি কিছু টাকা পাঠিয়ে দিব। তুমি চট্টগ্রাম চলে যাও। ওখানে আমার এক মেয়ে বন্ধু থাকে৷ ওর কাছে কয়দিন থাকো। সময় করে আমি চট্টগ্রাম এসে তোমার সবকিছু ঠিকঠাক করে দেব।
– চট্টগ্রাম ভালো হবে বলছেন?
– হ্যাঁ।
এতটুকু আলাপচারিতার পর কোনো গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই লাইনটা কেটে গেল। মিনিট কয়েক আমি গুম হয়ে বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম। ভেবে ভেবে কোনো কূল-কিনারা তাবাশ্ করতে পারলাম না। নিঃসন্দেহে বাবা তার ঘটে চেপে বসা উচ্ছের ঝাড়টাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে চাইছে। আপদ তো আপদই, বাবা বিলক্ষণ জানে সাফুরা যতই মায়াবী সুরতের অধিকারী হোকনা কেন,মায়ের সততার গুণে যে সত্যটা প্রকাশিত হয়ে দিকবিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে সেই সত্যতার ফলশ্রুতিতে ওর জন্য যোগ্য পাত্র খোঁজা একপ্রকার অকর্ম। এদিকে আমি অগত্যা অনুরোধের ঢেঁকি গিলেছি। যে মেয়েটার সঙ্গে দীর্ঘদিন একঘরে থাকার পরও কোনোপ্রকার শুদ্ধ ভাব-বিনিময় হয়নি সেই মেয়েটাকে সাহায্য করতে গিয়ে নিন্দুকের কোপদৃষ্টিতে পড়ার কোনো মানে হয়? তথাপি একপ্রকার গা বাঁচিয়ে একটা কথা যেহেতু দিয়ে ফেলেছি সেটা মেনে চলাটাই সৎকর্ম হবে৷
সেদিন রাতেই বাবার ফোন। বাবা আমাকে সচরাচর ফোন করে না।ছোট থেকেই আমি কখন কী করছি,কী পড়ছি,কী খাচ্ছি সে নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। নিজের কাজ আর নিজের নেশাকে আলাদা করে সাজিয়ে নিজস্ব একটা জগৎ সৃষ্টি করেই তার বাস। বাবা হিসেবে তিনি কেমন দায়িত্বজ্ঞানহীন সেটা আসলে অবর্ণনীয়।
ফোন করেই তিনি বললেন,
– কালকে সাফুরার বিয়ে। আসবে তুমি বাড়িতে?
আমি ক্যাটকেটে গলায় বললাম,
– আমার এসে কাজ কী? পাত্র কোথাকার? কী করে?
– পাশের গ্রামেরই। ব্যবসা করে৷ কোনো পণ ছাড়াই শুধু উঠিয়ে নিয়ে যাবে।
– ও আচ্ছা, ভালো তো। আমি আসব না। একদম সময় নেই।
পরেরদিন ঘুম ভাঙল একটু সকাল সকাল। বিছানায় শুয়ে থেকেই আলস্যভরে স্বভাববিরুদ্ধভাবে একটু ফেসবুকে ঢুঁ মারতেই বিরাট একটা ধাক্কা খেলাম। দেশের স্বনামখ্যাত একজন ডিরেক্টরের সঙ্গে সানাজানার টুকরো ফোনালাপের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ নিয়ে তুলকালাম চলছে ফেসবুকে। ইতোমধ্যেই দেশের মধ্যমসারির কিছু নিউজপোর্টাল এই ফোনালাপ নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে নিউজ বানাতে শুরু করেছে। লোকজন তাতে বাজে মন্তব্য করছে। অধিকাংশ মন্তব্যই এমন,
– ডিরেক্টরের সঙ্গে একটু ঘষাঘষি না করলে কি আর পর্দায় আসা যায়? মিডিয়া জগৎটাই এরকম।
– কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়।
– অডিও তো শুনলাম,এবার ভিডিওর অপেক্ষায়।
এছাড়া আরো হরেক রকমের অরুচিকর,অশ্লীল, মন্তব্য ভাসছে ফোনের স্ক্রিনে। সেসব মন্তব্য দেখে,নিউজপোর্টালের বিশদ বর্ণনা পড়ে ফোনালাপটা আগাগোড়া শোনার স্পৃহা আমার আক্ষরিক অর্থেই রইল না। তবে বিষয়টার বিস্তৃতি দাবানলের মতো ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে গিয়েছে যে টুকরো টুকরো কিছু অংশ না শুনে আমার উপায় রইল না। শুনে আমার আর সন্দেহ বাকি রইল না যে,এটা নিঃসন্দেহে সানজানার কণ্ঠ,কিন্তু ও এতোটা নীচ কীভাবে হতে পারে! ওর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটা মেয়ে এমনতর বারবনিতাসুলভ আচরণ কী করে করতে পারে তা সহসা আমার মাথায় খেলল না। টালমাটাল রুদ্ধশ্বাসে ওর নাম্বারে ফোন দিলাম। রিসিভ হোল না।
ছুটে গেলাম ওর বাসায়। আমাদের প্রণয়ের অনেক আগে থেকেই সহকর্মী হিসেবে ওর বাসায় আমার একটা ভালো পরিচিতি ছিল। সানজানার জনকজননী অত্যন্ত ভালো মানুষ। বিশেষকরে বাবাটা একটু গোবেচারা প্রকৃতির,সাতেপাঁচে থাকেন না। কখনো চোখাচোখি হলে দাড়িগোঁফের ফাঁকে মিষ্টি করে একটা আশকারার হাসি ছুঁড়ে দিতেন। একসঙ্গে একই প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করার সময়ে যখন ওর বাসায় আমার প্রায়ই গতাগতি চলতো তখন ওর জননী আমার এমন নির্ভেজাল আতিথেয়তা দেখাতেন যে, আমি অভিভূত হয়ে পড়তাম। সানজানা যখন মডেলিং, অভিনয় জগতে পা বাড়াচ্ছে সেই সময়টাতে ওকে থামানোর জন্য আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সত্যি বলতে,আমি ওকে থামানোর কোনো চেষ্টাই করিনি। বদলে ওকে নানানভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছি।
বাসায় ঢুকেই হালহকিকত দেখে বুঝতে পারলাম,এখানে একটা খণ্ডপ্রলয় ঘটে গেছে। পুরো ঘরটাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের মতো এলোমেলো দেখাচ্ছে। আর লম্বা সোফার দুই প্রান্তে উপবিষ্ট সানজানার বাবা-মাকে দেখাচ্ছে সেই রণ-ক্লান্ত শান্তিকামীর মতো! ওর মায়ের কপালে হাতের কনুই-কব্জিতে ব্যান্ডেজ,চোখে ক্রন্দনচিহ্ন। আমাকে দেখে তাঁরা একটু হকচকিয়ে গেলেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– এই অবস্থা কী করে হলো!
সানজানার মা ইতস্তত তাকিয়ে নিজের মুখের ভাব লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে ঢোক গিলে ঈষৎ কেঁদে উঠে বললেন,
– সানজানা। সানজানা মেরেছে।
আমার পায়ের তলা থেকে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত আশ্চর্য ক্রোধাগ্নি গনগনিয়ে উঠল। ওঁদের আর না ঘাঁটিয়ে আমি দ্রুতপদে সানজানার ঘরে ঢুকলাম। সানজানা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। পদশব্দে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে অদ্ভুত দ্যোতনায় বলল,
– এসে গেছ?
ওর দুই শব্দের কথাটি সূচাগ্র তীরের মতো আমার আঁতে গিয়ে বিঁধল। নিজেকে সংযত করে আমি যাচালাম,
– এসব কি সত্যি!
সানজানার অতিশয় সুন্দর মুখখানা কাগজের মতো ফ্যাকাসে অথচ নির্ভার দেখাল।
– তোমাকে মিথ্যা বলার প্রয়োজন নাই। হুম সত্যি।
– কেন করেছ এসব? কী দরকার ছিল?
– আসলেই দরকার ছিল না। কিন্তু একবার যখন হয়ে গেছে আমিও আর পিছু হটব না।
সানজানার কণ্ঠে অদেখা দৃঢ়তায় আমার গলা চড়ল,
– এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে তুমি কিছুই পাবে না জেনে রেখো। শুধুই হারাবে। তুমি যে এতটা নিচে নামতে পার আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। আর ক’জনের সঙ্গে এমন করেছ তুমি?
– যতজনের সান্নিধ্যে আমি সফলতা পাব বলে ভেবেছি ততজনের সঙ্গেই করেছি। তুমিও তাদেরই একজন। কিন্তু আফসোস, তুমি সুযোগ পেয়েও আমাকে বিছানায় চাওনি। হয়তোবা একটু বেশিই ভালোমানুষ তুমি,নয়তো নপুংসক!
– আমার ধারণার চাইতেও নীচ তুমি। কী যেন বললে, সফলতা? হাহ্ সফলতার সংজ্ঞাই তোমার জানা নাই। হয়তো-বা তুমি তোমার কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাবে,কিন্তু কখনো সুখী হবে না।
– চ্যালেঞ্জ করছ?
– করছি।
– ওকে।একসেপ্টেড।… এখন বের হও আমার বাড়ি থেকে।
শেষের কথাটা চোখজোড়া বিস্ফারিত করে চিৎকার করে বলল সানজানা। আমি এক মুহূর্ত ওর আগুনঝরা দৃষ্টির বিপরীতে স্থির শান্তভাবে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট বাঁকিয়ে শ্লেষের হাসি হেসে বেরিয়ে এলাম। আপাতদৃষ্টিতে আমাকে স্থির, শান্ত দেখালেও বুকের মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলছিল প্রথম এবং শেষ প্রণয়ের সঙ্গী-নির্বাচনের ভুলের মাশুল। পৃথিবীতে মানুষ চেনাই বুঝি সবচেয়ে কঠিন আর দুর্বোধ্য কাজ! সেই সানজানা আর এই সানজানার মাঝে আসমান-জমিন ফারাক হলো কী করে! লাবণ্যময়ী,মিষ্টভাষী, বন্ধুত্বসুলভ, অনাবিল স্বভাবের মেয়েটা রাতারাতি উচ্চাভিলাষী, হিংস্র দুপেয়ে জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে গেল কেমন করে! প্রত্যেক মানুষের ভালোত্বর মাঝে বোধহয় হাজারটি কলুষিত, কিটকিটে দুপেয়ে জন্তু বাস করে? আমার মাঝেও কি তাই? হয়তোবা…। আবার হয়তোবা নয়। সানজানা কেন আমার কাছে নিজের মুখোশটাকে উন্মোচন করল? কেন সে অকপটে নিজের সকল অপরাধ কবুল করে মাথা উঁচু করে রইল? সে কি আমাকে সে বিশ্বাস করে? নাকি ওকে ধসিয়ে দেওয়ার জন্য যে গুর্দা আমার আছে সেটিকে অগ্রাহ্য করে?
যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছিল ততই ভাবনার সূতিকাগারে অনবরত জন্ম নিচ্ছিল দুর্বোধ্য সব চিন্তার বহর। এমন পরিস্থিতি যে আমার জীবনে আসবে তা ছিল চিন্তারও অতীত। সানজানার হঠকারিতায় ব্যর্থ আক্রোশে ব্যথিত হওয়ার চেয়ে নিজের বোকামির কথা মনে করে দুঃখবোধ হচ্ছিল বেশি। কীভাবে আমি এমন একজন চরিত্রহীনার বাতাবরণে প্রলুব্ধ হয়ে তাকে হিস্সাদার বানিয়ে হৃদয়ের বন্ধ দ্বার খুলে দিয়েছিলাম? এখন অকস্মাৎ সেই হৃদয়ের দ্বার যখন সজোরে সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল ;সেই শব্দ, সেই কম্পন যে হৃদয়বাড়িতে ভয়ঙ্কর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে তা দেখে ক’জনে? দেখাবও বা কাকে? কেউ তো জানে না আমাদের মিথ্যে প্রণয়ের কথা! ভালোই হয়েছে,ভাবলাম আমি,আর জানানোরও প্রয়োজন নেই। ঢাকঢোল পিটিয়ে সানজানার প্রকৃত মুখোশ দেখিয়ে বেড়ানো মানে নিজেকে বোকাচণ্ডী প্রমাণ করা। দেশের এতগুলো মানুষের কাছে নিজেকে হাসির পাত্র বানানোর চেয়ে নীরব থাকাই শ্রেয় বিবেচনা করলাম।
৫
বছর পেরোল। বেশ কটি বছর। সানজানা এখন সময়ের আবেদনময়ী আলোচিত অভিনেত্রী। টিভি নাটক,ওয়েব সিরিজ,ওটিটি প্লাটফর্মে সে নিয়মিত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বড় পর্দায় আসবে-আসবে করছে,পছন্দসই গল্প না পাওয়ায় আসা হচ্ছে না; এমনটাই জানিয়ে আসছে সে। ক্যারিয়ারের শুরুর স্ক্যান্ডেলের কথা ধরতে গেলে সকলে ভুলেই বসেছে। তবুও কালেভদ্রে উড়ো কথা আসে কাগজে-পত্রিকায়,এর সঙ্গে প্রেম করছে সানজানা,ওর সঙ্গে নাইটক্লাবে নিভৃত সময় কাটাচ্ছে…কত কী!
ও হ্যাঁ,সাফুরার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বাবার ঠিক করা সেই বৃদ্ধের সঙ্গে। সাফুরার জননী পাগলী খালাও মারা গেছে বছর তিনেক আগে,তখন আমি সিডনিতে ছিলাম একটা প্রোগ্রামে। কাজেই শেষদেখার সুযোগটি হয়নি৷ সাফুরা দেখতে পেরেছিল কি-না কে জানে! বিয়ের পর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি ওর সাথে৷ বিয়ের দিন ফোন দিয়েছিল সে। হতাশা-নিমজ্জিত কণ্ঠে জানিয়েছিল,
– পালাতে পারিনাই হাবিব ভাই৷ এতটা বছর যার ঘরে থাকলাম সমাজের সামনে তাকে লজ্জিত করতে মন চাইল না৷
সেসময়ে আমার অবস্থা সম্পর্কে পাঠক অবগত। ব্যর্থ আক্রোশে নিজের ওপর আমার কোনো আত্মনিয়ন্ত্রণ ছিল না। খ্যাপা ষাড়ের মতো সাফুরার কথায় ফুঁসে উঠলাম আমি,
– খুউব ভালো করেছ। আমায় উদ্ধার করেছ। এখন কি আমাকে শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াত দেওয়ার জন্য ফোন দিছো নাকি?
সাফুরা স্তব্ধ হয়ে গেল আমার আকস্মিক ও অপ্রাসঙ্গিক উত্তেজনা দেখে। সেকেন্ড কয়েক নিশ্চুপ থেকে ইতস্তত করতে করতে সে বলল,
– আচ্ছা, রাখি। দোয়া করবেন আমার জন্য।
ফোনটা কেটে যাওয়ার পর নিজের ব্যবহারের জন্য আমি যারপরনাই লজ্জিত হলাম। অনুতপ্ত মন বারবার বলছিল, সানজানার ঝাল সাফুরার ওপর ঝাড়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না৷ যাইহোক, সেটিই ছিল সাফুরার সঙ্গে আমার শেষ কথোপকথন। গতিময় জীবনের আবর্তে ও কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছে কিংবা ফুরসত কোনটিই হয়ে উঠেনি। কতবার কথার-কথায় বাবাকে জিজ্ঞেস করব বলে ভেবেছিলাম বিবাহোত্তর ওর হালহকিকত, কিন্তু অহর্নিশ বাবার সঙ্গে নানান ভজকট লেগে থাকায় সে আর হয়ে উঠেনি। মাঝেমধ্যেই বাবা বলতো,
– কী ব্যাপার! বিয়েসাদী করবে না না-কি! চিরকুমার থাকবে!
যেহেতু আমার চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্তটা নির্ঘাত পরাজয়ের নামান্তর ছিল, তাই শত ইচ্ছে থাকার পরেও মনেপ্রাণে এই কঠিন সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারিনি। উপরন্তু,কাউকেই সেভাবে মনে লাগত না। চোখের লাগা আর মনের লাগাতে বিস্তর ফারাক। চোখের লাগা তো কতই লেগেছে,কত নিটোল সুন্দরীকে দেখে চমকে উঠে চোখ ফেরানোর ইচ্ছে হয়নি, সে হিসেব করার বিষয় নয়। কিন্তু ভালোর মুখোশ পরে থাকা সানজানাকে চিনতে ভুল করে যে আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করেছে সেই আতঙ্ক আমার মনোদ্বারে যেন চিরস্থায়ী সিলগালা করে দিয়ে গেছে। এখন চোখে লাগা থেকে মনে লাগার আগেই আমি জলাতঙ্ক রোগীর মতোন আতঙ্কিত হয়ে দড়বড় করে ছুটে পালাই।
এদিকে আত্মীয়-স্বজনেরা বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। বিশেষ করে ওয়াশিংটনে অবস্থিত সদ্য স্বামীপ্রয়াত ফুপু। নিয়ম করে তিনি হুয়াট্সআপে একেকটা পাত্রীর ছবি পাঠিয়ে পাত্রীদের স্তবগান করে যাচ্ছেন। অথচ আমার কোনো রা বিকার নেই। এমন করেই কাটল ক’দিন। কিন্তু এমন করেই আর কদিন যায়? শত ব্যস্ততার মাঝেও দিনশেষে মায়ের কথা মনে পড়ছিল ভীষণ। সাফুরার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মা আমাকে সুখী দেখতে চেয়েছিলেন কিংবা সাফুরাকে নিরাপদ হস্তে তুলে দিলে মা স্বস্তি পেতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে মায়ের অবচেতন মন কি জেনে গিয়েছিলে আমার আজকের শোচনীয় একাকিত্বের কথা? হতে পারে। শুনেছি মৃত্যুর আগে মানুষ অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়,চর্মচক্ষুতে সাধারণ কেউ যা জানে না,যা শোনে না, যা দেখে না তার সবই অন্তরে অন্তরে বিদিত হয় মুমূর্ষু ব্যক্তিরা। মা-ও হয়তো এমনকিছুই অনুভব করেছিলেন,কিন্তু অবশ্যম্ভাবী চিরন্তন সত্যটাতে কোনোক্রমেই বদলাতে পারেননি।
হঠাৎ একদিন মাকে স্বপ্নে দেখলাম। স্বপ্ন নয়,দুঃস্বপ্ন বলাই সই। ভর সন্ধ্যাবেলা, পুব আকাশের কার্নিশে লেপ্টে থাকা সূর্যের শেষ লালিমাটুকু যখন মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে…ঠিক এমনই একটা সময় মা পুকুরের নিস্তরঙ্গ নিতল জলে পা ডুবিয়ে বসে আছেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি মায়ের পেছনে। মায়ের মুখ দেখা যাচ্ছে না। মা’কে বললাম,
– মা,তুমি? অনেকদিন পর… এদিকে ফিরো না!
মা ফিরলেন না। শুনলেনই না যেন আমার কথা৷ এরপর আচমকা তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে শুরু করলেন। আমি মাকে অনেক ডাকলাম,কিন্তু তিনি না আমার সঙ্গে একটা বাক্যবিনিময় করলেন,না একবার চোখেচোখে তাকালেন আর না নিজেকে একমুহূর্তের নিমিত্তে ভালোভাবে উন্মোচিত করলেন।
এই স্বপ্ন দেখার দিন-দুই পর কর্মক্ষেত্রে ছুটি নিয়ে গাঁয়ে এলাম। মায়ের কবর জেয়ারত করলাম। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে মায়ের কবরটা। কবরের নিকটেই একটা প্রাচীন হিজলবৃক্ষ চতুর্দিকে ডালপালা বিস্তৃত করে দাঁড়িয়ে আছে। এখন জৈষ্ঠ্য মাস। দীঘল পুষ্পদণ্ডকে ঘিরে অনিবিড় গোলাপি-রঙা ফুলে ভরে ভরে উঠেছে হিজল গাছটা। মাঝ রাত্তিরে ফোটা, সকালে ঝরে পড়া তাজা ফুলগুলো যেন মাটিতে গোলপি ফরাশ বিছিয়ে দিয়েছে। দলছুট ছেঁড়া বাতাসে একটি একটি করে ফুল ঝরিয়ে দিয়ে সেই ফরাশের বুননকে আরো নিবিড় করে তুলছে যেন। হিজলফুলের মিহি মাদকতায় মনের অলিতে-গলিতে উদাসীনতা জাঁকিয়ে উঠছে বারবার। আরো মিনিট খানিক মাকে সঙ্গ দিয়ে প্রস্থান করলাম। ঘরে এসে একসঙ্গে সকালের খাবার খেতে বসে বাবাকে বললাম,
– সাফুরার কী খবর বাবা? ভালো আছে তো?
বাবা বোধহয় খানিকটা অবাকই হলেন। একটু চুপ থেকে বললেন,
– বিয়ের পরের বছরই তো একটা মেয়ে হয়েছে শুনেছিলাম। আর যোগাযোগ হয়নি তেমন। ভালোই আছে হয়তো।
– হয়তো!
নিজে নিজেই স্বগোতক্তি করলাম আমি।
– আমি ভাবছি ওকে একবার দেখে আসব।
বাবা চোখে এবার স্পষ্ট বিস্ময় ফুটে উঠল। আমি বিব্রত হয়ে কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললে উঠলাম,
-এতবছর এখানে থেকেছে,কী অবস্থা, কেমন আছে একটু দেখা উচিত না? মা বেঁচে থাকলে তো এটার কোনো ত্রুটি হতো না! তাছাড়া, খালাতো বোন হিসেবে…
বাবার স্তব্ধ কণ্ঠটি আচমকা ঘরঘর করে উঠল,
– ওখানে যাওয়া তোমার উচিত হবে না৷ ওর শ্বাশুড়ি মরেছে ওর মেয়ে হওয়ার বছরেই। জেয়াফতে দাওয়াত দিয়েছিল,আমি যাইনি।
– তোমার সমস্যা তোমার কাছে। আমি যাব। ঠিকানাটা দাও।
৬
বাবার কাছ থেকে ঠিকানাটা চেয়ে নিয়ে তৎক্ষনাৎ রওনা হয়ে গেলাম সাফুরার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। আমাদের পাশের ইউনিয়নেই ওর শ্বশুরবাড়ি ,অটোতে করে এলে দশ মিনিটের রাস্তা। গাঁয়ের রাস্তা-ঘাটও আধো আধো চেনা। প্রয়োজন না থাকায় এদিকটা খুব কম আসা হয়েছে যার কারণে লোকজনের সঙ্গেও বিশেষ খাতির নেই। তবে স্কুলে পড়াকালীন ক্রিকেট ম্যাচ খেলার সুবাদে এদিকটা আসা হয়েছে বার-কয়েক। সে-ই আগের গ্রামটিই আছে, বদলানোর মধ্যে বদলেছে শুধু, খালের ওপর সাঁকোর বদলে পাকা ব্রিজটা, পাতলা কাঁকরের সড়ক, ইতস্তত কটি পাকা-আধপাকা দালানকোঠা…। গন্তব্যে পৌঁছে অটো থেকে নেমে একরাশ জড়িমা নিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম। বাড়ির সীমানার চারিধারে বাশের বেঁড়া দিয়ে ঘেরা। প্রবেশদ্বারে পাতলা টিন আর কাঠ সংবলিত নিচু দরজা। দরোজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম আমি। দৃশ্যমান হলো, বড় একটা উঠোন। উঠোনের ওপারে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে বেশ বড়সড় একটি আধাপাকা বাড়ি। বাড়ির সদর-অন্দর দরজাটা হাট করে খোলা, একবার সেদিকে তাকিয়ে চারিধারটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। বর্ষায় হাঁটাচলার জন্য উঠোনের মাঝ-বরারব সারিবদ্ধভাবে ঘরের দোর অবধি বসানো জোড়া ইটগুলো বুকঅবধি মাটিতে ডেবে গেছে। একাধারে একটা গোশালা,গোশালার পাশেই একটি মাঝারি শিরিষগাছের তলায় ছোট্ট খোঁয়াড়ে একজোড়া গাই-বাছুর বাঁধা। গাইটি খসখস করে বাছুরের গা চাটছে আর বাছুরটি সীমাহীন অস্থিরতা নিয়ে স্তনে ঢুস দিতে দিতে চুকচুক শব্দে দুধ পান করছে। শিরিষগাছ ঘেঁষেই পাশেই একটা বিশাল খড়ের গাদা। উঠোনের একপাশে দুটো চাটাইতে পাকা ধান বিলোতে দেওয়া হয়েছে। গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নতপনে সেই ধানগুলোকে স্বর্ণদানা বলে ভ্রম হচ্ছে। একজন মলিন শাড়িপরিহিতা অবগুণ্ঠিতা গৃহবধূ ধানগুলো পা দিয়ে নেড়েচেড়ে দিচ্ছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না মেয়েলোকটির। আমি মৃদু গলা-খাঁকারি দিয়ে এগিয়ে গেলাম৷ আমার গলা-খাঁকারির শব্দে স্ত্রীলোকটি চমকে উঠে আঁচল টেনে তাকাল এদিকে। আমার কপাল কুঁচকে উঠল। প্রথমটা ঠিক চিনতে না পারলেও পরে ঠিকই চিনতে পারলাম স্ত্রীলোকটিই সাফুরা। বেশ শুকিয়ে গেছে সে। গায়ের রঙটা একটু ময়লাটে হয়ে গেছে। কোটরাগত চোখের নিচে ঈষৎ কালি পড়েছে,তাতে উপচে পড়ছে অসীম ক্লান্তি। ঠোঁটজোড়া শুকনো,রক্তহীন। নাকের ডগায় আর ওষ্ঠে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘোমটার ফাঁকে উঁকি দিল একগুচ্ছ রুক্ষ-মলিন কুন্তল। একহারা গড়নের শরীরটা ঘিরে লতিয়ে উঠেছে ছোট ছোট অপরিচিত ফুল অঙ্কিত একটি সস্তা শাড়ি। সবমিলিয়ে মায়ের সযত্নে গড়া আগের সাফুরা আর সংসার-যাঁতাকলের পরাকাষ্ঠায় দলিত আজকের সাফুরাতে বিস্তর তফাত।
আমাকে দেখেই সাফুরার মুখচ্ছবি দিনের আলোর মতো করোজ্জ্বল হয়ে উঠল। শান্ত-ধীর মুখের ভাঁজ ঠেলে তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি৷
– আপনি!
কিন্তু পরক্ষণেই কী মনে করে ওর মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। সংযতভাবে দৃষ্টি চলে গেল হাট করে খোলা অন্দরের দিকে
– আসেন। ভেতরে আসেন। বাবা আসেনাই?
বলতে বলতে আমার হাতের উপঢৌকন সামগ্রী বাড়িয়ে নিল সাফুরা। আমি জবাব দিলাম।
– না।
বসার ঘরে আমাকে বসিয়ে সাফুরা ভেতরে চলে গেল। একটু পর ফিরে এলো লেবুর শরবত, বিস্কুট আর চানাচুর সজ্জিত ট্রে হাতে নিয়ে। গ্রীষ্মের দাবদাহে গলা শুকিয়ে এসেছিল, খালি শরবতটাই গলায় ঢেলে নিলাম তাড়াতাড়ি। সাফুরা একবার শুধু মৃদু করে বলল,
– বিস্কুট নিলেন না!
– না থাক।
একটু সময় নীরবতা। সাফুরা আঁচল টেনে ধরে কথার অভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে এককোণে। আমি এখানে আসার কৈফিয়ত খাড়া করার চেষ্টা করছি মনে মনে। কিন্তু কোনো জুতসই কৈফিয়ত দাঁড় করাতে পারছি না। মন বলল তাই চলে এসেছি,এটা কোনো সুস্থ জবাবদিহিতা হতে পারে না। কারণেই আমি একটু খোশখবর নিয়ে সহজ হবার চেষ্টা করলাম,
– তো,কেমন আছ? বাড়িতে যাওনা যে!
সাফুরা সরল স্বীকারোক্তি,
– বাবাও যোগাযোগ করে না। এরাও যেতে দেয় না কোথাও। এভাবেই যাচ্ছে।
– হুম,ঘরের বাকি সদস্যরা কই? এতবড় বাড়ি এমন সুনশান কেন?
– ছেলেমেয়েরা সব স্কুলে। বড় বউ পুকুরে গোসল করতে নেমে মাছ ধরে। মেঝো বউ এখনো ঘুম। সেঝোটা বাপের বাড়ি।
সাফুরার কথা শেষ হতে না হতেই একটা পরিচ্ছন্ন অথচ টিনটিনে গড়নের ছোট্ট মেয়ে এসে ওর শাড়ি ধরে টানাটানি শুরু করল। সাফুরা মেয়েটির হাত ধরে বলল,
– যাও,উনি মামা।
মেয়েটি এলো না। সহাস্য বদনে বারকয়েক সাফুরার পেছনে লুকোচুরি খেলে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। সাফুরা স্মিতহাস্যে বলল,
– আমার মেয়ে। সায়মা।
– বেশ সুন্দর। দেখতে একদম তোমার মতো হয়েছে।
– কিন্তু আমি আমার মায়ের মতো হইনি।
কথাটা এতটা গভীর এবং এর তাৎপর্য এতটা গরল যে এই প্রথম সাফুরার জীবনদর্শন আমাকে খুব কাছে থেকে করুণভাবে স্পর্শ করে গেল। মনের ভাবটা লুকিয়ে আমি বললাম,
– যাইহোক, উনি কোথায়?
– কে?
– তোমার হাসবেন্ড!
– সে! সে তো মরেছে দুই বছর আগে।
অবাক হলাম না। টাকার গরমে বুড়ো বয়সে ধরে ধরে মেয়ে-সমান যুবতীকে বিয়ে করা বান্দারা খুব বেশিদিন টিকে না এ আমার ঢের জানা ছিল। এতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকলেই বরঞ্চ অবাক হতাম। তবুও আমি অবাক হবার ভান করে বললাম,
– কীভাবে?
– আল্লার দয়া হয়েছে তাই নিয়ে গেছে। সুস্থ মানুষ। একদিন কোত্থেকে জানি এসে বলল,
পানি দাও। দিলাম। পানি খেয়ে বলল,খারাপ লাগছে, অস্থির লাগছে,টেবিল ফ্যান ছেড়ে দাও। দিলাম। এরপর রাতে গলা দিয়ে রক্ত যাচ্ছিল,হসপিটালে নিতে নিতে মরে গেল। আপনি বলেন, এতবছর পর কী মনে করে?
ওর আকস্মিক প্রশ্নের উত্তর আমার মনমুকুরে ধোঁয়াশার মতো বিদ্যমান থাকলেও নিজের আত্মম্ভরিতা কিংবা অনভ্যস্ততার কারণে মন খুলে সেটি প্রকাশ করতে পারলাম না৷ বুঝতে পেরে সে কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল,
– দুপুরে কিন্তু খেয়ে যাবেন। এখন যাই। অনেক কাজ। তাড়াতাড়ি সেরে ফিরব।
ঘন্টাখানেক আমাকে একাকী বসে থাকতে হলো। অবশ্য নিষ্কর্মে নয়,এরমধ্যেই আমি মুঠোফোনে একটা অর্ধসমাপ্ত লেখা প্রায় ইতি টেনে নিলাম। ঘন্টাখানেক পর যখন সাফুরা এলো তখন বাড়ির ছেলেপেলেরা একে একে স্কুল থেকে আসতে শুরু করেছে। মেঝো জন বোধহয় জেগে উঠেছে, অন্দরমহলে ছেলেমেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচির সঙ্গে একটা জাঁদরেল মেয়েলি কণ্ঠ পাওয়া যাচ্ছে। সাফুরা সদ্য গোসল করে এসেছে। ঘোমটা-তোলা মাথা হতে পিঠময় বিস্তৃত সিক্ত কেশদামে বেশ পরিচ্ছন্ন আর ঝকঝকে দেখাচ্ছে ওকে। যেন বৃষ্টিহীন ধূ-ধূ ধূসর মরুর বুকে একপশলা বৃষ্টিস্নাত সজীবতা। পরনের সুতির শাড়িটাও বোধহয় আধা নতুন!। আমার দৃষ্টির মুগ্ধতা এড়াতে সে বলল,
– খাবার কি দিয়ে দেব?
– না,একটু বসো।
সাফুরা বসল সামনের একটা নড়বড়ে চেয়ারে। দু-হাত ভাঁজ করে রাখল কোলের উপর৷ আমি শুধালাম,
– ঘরের সব কাজ কি তুমিই করো?
সাফুরা অবাক হয়ে বলল,
– কীভাবে বুঝলেন?
– তোমার অবস্থা দেখে।
এবার সে দৃষ্টি নত করল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে একবার কারোর উপস্থিতি যাচাই করে নিয়ে নিচু গলায় বলল,
– আমার কিছু করার নাই। মেয়েটার জন্যই তো সব। গোয়ালঘর,রান্নাঘর থেকে শুরু করে একপাল ছেলেমেয়েদের কাপড় ধোয়া৷ সব আমাকেই করতে হয়। বড় বউয়ের দুইটা ছেলে বড় হয়েছে,টাকা কামাচ্ছে। সংসারে টাকা ঢালে ওরা। আমি না করলে কে করবে?
– বাকি দু’জন?
– ঝগড়াটে। কিছু বলতে গেলে আমার পরিচয় নিয়ে গালমন্দ করে,গায়ে হাত তুলে। আমার মেয়েটাকে দেখতে পারে না।…
আচমকা একজন চল্লিশোর্ধ্ব ধুমসি রমণীর অন্দর দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
– কী এতো রসের আলাপ হচ্ছে শুনি? মেহমান এসেছে, তাকে খাবার দাও। খেয়ে ক্ষানিক্ষণ শুয়ে বিদেয় হোক। এদিকে রান্নাঘরের কাজ সব পড়ে আছে। আর গোয়ালঘর ঝাঁট না নিয়ে গোসল করছ কোন্ দুঃখে? মেহমান মনে হয় আমাদের আসে না,না?
সাফুরা ফ্যাকাসে মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে কেবল সেদিকে তাকাল একবার। কিছু বলল না। বড় বউয়ের জবাবে মেঝো বউ ভেতর ঘর থেকে ভনভনিয়ে কিছু একটা বলল যার মর্মোদঘাটন করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। কিন্তু অপমানে সাফুরার মুখ লাল হয়ে উঠল।
– আমি খাবার নিয়ে আসছি।
বলেই তাড়াতাড়ি প্রস্থানের চেষ্টা করল সে। আমি চট করে ওর দক্ষিণহস্ত ধরে ফেলে বললাম,
– লাগবে না। আমি খাব না।
সাফুরা ত্রস্ত হয়ে ওর ধরা হাতটার দিকে তাকাল। আমি লজ্জিত হয়ে ছেড়ে দিলাম হাতটা। মুখে বললাম,
– তোমার বড় সতিনকে ডাকো। কথা আছে।
সাফুরা চোখ বড় বড় করে তাকাল। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে আশ্বাস দিয়ে বললাম, ডাকো।
চলবে…
শেষ পর্ব আগামীকাল।