কাননকুসুম?
আরিফুর রহমান মিনহাজ
পর্ব ১
১
– তোমার মা বোধহয় আর বাঁচবে না,ওর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করো।
কথাটা বাবা বললেন একটু নির্দয়ভাবে। বলেই মাথাটা ঈষৎ উঁচু করে নাকের ডগার চশমার কাচ ভেদ করে পত্রিকায় চোখ রাখলেন। যেন এই যুগান্তকারী আলাপের চেয়ে পত্রিকা পড়াটাই তাঁর কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমি আজন্ম স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম,বাবা কবে থেকে মায়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে? কই,আমি তো কখনো দেখিনি কিংবা অনুভব করিনি! উলটো মায়ের তাবত চাওয়া-পাওয়াকে চিরকাল অবজ্ঞা আর উদাসীনতায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াটা চিরাচরিত নিয়ম ছিল। অদ্ভুতভাবে আমার শিক্ষিত মা বঙ্গদেশীয় আট-দশটা রমণীর মতোই রকমফের উপেক্ষা সহ্য করে সংসার করেছিলেন৷ অতীতের অজস্র সাংসারিক কলহের চিত্র ভেসে উঠতে থাকে আমার মানসপটে। বাবার প্রতি ঘৃণায়-ক্রোধে আমার ভেতরটা বিদ্রোহী হয়ে উঠল। শক্ত কোনো বাক্য প্রয়োগ করতে যাব এমনসময় বাবাই পত্রিকাটা নামিয়ে বললেন,
– কী ছাইপাঁশ লেখ পত্রিকায়? নিজের যা প্রফেশন তা নিয়ে থাকো! যত বড় মাথা না তত বড় কথা বলার চেষ্টা করো কেন?— সাম্প্রতিক ইস্যু নিয়ে তোমার চিন্তাধারা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই যে তুমি আসলেই আমার ছেলে কি-না।
আমার মেজাজ খিঁচড়ে গেল। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় কলামে প্রতি সোমাবারই আমার লেখা যায়। আমার নিরপেক্ষ বক্তব্যের সমালোচনা অনেক একপাক্ষিক কলামিস্টরা করলেও বাবার মতো করে কেউ বলেনি। তথাপি বাবার সঙ্গে তর্কে জড়ানোর ইচ্ছে আমার আপাতত নেই। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা করে মূল প্রসঙ্গে এলাম,
– মায়ের শেষ ইচ্ছেটা কী?
তর্কে আমার উদ্যমহীনতা দেখে বাবা একটু নিভে গিয়ে বললেন,
– শেষ ইচ্ছে হলো, সাফুরাকে তুমি বিয়ে করবে। তাছাড়া তোমার খালার ওই জারজ মেয়েটাকে বিয়ে করবে কে? পাত্র আসে,দেখে যায়, আর রিজেক্ট করে। হোক না চেহারা সুন্দর। জন্মের তো ঠিক নাই।
আমি চট করে উঠে দাঁড়ালাম। বাবার মুখটা ইদানীং ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ হয়ে গেছে। ঘরঘরে কণ্ঠটাই আজকাল বিরক্তিকর ঠেকে কানে। সাফুরার ব্যাপারটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারলাম না৷ মা এমনটা কী বিবেচনায় ভেবেছেন আমার জানা নাই। অন্য সময় হলে মায়ের সঙ্গে আমার বিষম বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, তিনি বেজায় অসুস্থ,—মরণদশা। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে মা নিজেও ছিলেন একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার। নিজের শারিরীক অবস্থাটা বুঝতে পেরেই বোধকরি তিনি আর হসপিটালে থাকতে চাননি। কে না চায় শেষ নিঃশ্বাসটা বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের গোলকের মধ্যে ত্যাগ করতে? সবাই-ই চায়।
মায়ের শয়নকক্ষে যেতেই ক্ষুব্ধ মনটা আদ্র হয়ে উঠল। চক্ষুজোড়া মুদে সটান শুয়ে আছেন মা। চোখে-মুখে স্পষ্ট বেদনাবহ চিহ্ন আঁকা। মায়াময় গৌর মুখখানি ঘিরে মুখের বলিরেখাগুলো যেন আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। পশ্চিমের জানালা গলে শেষবিকেলের একঝাঁক নরম আলো মায়ের খাটের কার্নিশ আর মেঝেতে এসে শুয়েছে। হুহু করে ঢুকছে বাসন্তী হাওয়া। সেই হাওয়ায় নাম-না-জানা এক বাসন্তী ফুলের সৌরভ নাকে শীতল,মেদুর স্পর্শ বুলিয়ে যাচ্ছে।
মায়ের শয়নকক্ষে চেনা-অচেনা আত্মীয়স্বজনের ভিড়। একপাশে আমার পাগলী খালা হাত-পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছে আর বলছে,
– বু বু বু…
মা’কে খালা বু বলেই ডাকেন। ওই একটা শব্দই খালার মুখে শুনে এসেছি ছোটকাল থেকে। খালার মেয়ে সাফুরা মায়ের পাশে আঠার মতোন লেগে রয়েছে,দিনরাত সেবাশুশ্রূষা করছে। আমাকে দেখে আত্মীয়স্বজনের দলে একটা মৃদু কল্লোল খেলে গেল। কয়েকজন উঠে গেল,আবার কেউ উঠি-উঠি করেও আগ্রহভরে বসে রইল। মা অতিকষ্টে মৃদুশব্দে ঠোঁট নেড়ে সবাইকে একটু বাইরে যেতে বললেন। সকলেই বাইরে চলে গেল। পড়ে রইলেন শুধু পাগলী খালা,তাঁর চোখে পানি আর মুখে ওই এক বুলি,‘বু…বু…বু…’। সাফুরাও যেতে উদ্যত হতেই মা বললেন,
– সাফুরা,তুই থাক।
সাফুরা সন্ত্রস্ত পদে খাটের অপরপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল।আমি সমস্ত ইন্দ্রিয় সচল হয়ে জানান দিল, মা কী করতে চলেছেন৷ তথাপি সেদিকে আমার ধ্যান-খেয়াল নেই। আমি মায়ের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। শেষবার যখন বাড়িতে এসে মায়ের হাতে রান্না করা আণ্ডাঅলা কইমাছ খেয়ে হাসিমুখে কথা বলেছি,তখনো একবারের জন্যও মনে হয়নি মায়ের ভেতরে কঠিন অসুখ বাসা বেঁধেছে। একমাসের মধ্যেই কেমন ঝটকে রুগ্ন হয়ে গেলেন মানুষটা। অনেক কসরত করে মা ডাকলেন,
– হাবিব,হাবিবউল্লাহ!
– জি আম্মা!
– আমি চাই তুমি সাফুরাকে বিয়ে করো। তুমি যদি আমার চোখের মনি হও,সাফুরা আমার সেই চোখের আলো। তোমাদের দু’জনকে আমি সমান ভালোবাসি। মরার আগে আমি তোমাদের এক দেখতে চাই। চাওয়াটা বড় আটপৌরে হয়ে গেল, না? কিন্তু কী করব বলো? আমি যে নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে চাই।
আমার মুখে বাক্যি জোগাল না। আড়ে চেয়ে দেখি সাফুরা নতমুখে দাঁড়িয়ে ভীষণ অস্বস্তি আর লজ্জায় দুই হাত কচলাচ্ছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
– আম্মা,এখন এই অবস্থায়…।
মা’র শ্রান্ত দৃষ্টি আমার আর সাফুরার মধ্যে একবার পাক খেয়ে অলক্ষ্যে নেমে এলো। কম্পিত গলায় তিনি বললেন,
– আমি শুধু আমার ইচ্ছেটা বললাম। বাকিটা তো তোমাদের খুশি৷
আমি জীবনে এই প্রথম পূর্ণদৃষ্টিতে তথা বিপর্যস্তভাবে সাফুরার দিকে তাকালাম। ইশারা বুঝতে পেরে ও ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। মায়ের কপালে হাত বুলিয়ে আমি মৃদু কপটহাস্যে আশ্বাস দিলাম,
– চিন্তা করো না আম্মা,তোমার ইচ্ছেই পূরণ হবে।
বলে আমি সাফুরার পিছুপিছু বেরিয়ে এলাম। ভাবনাবিধুর ও তখন অল্পই এগিয়েছে। আমি দীর্ঘপদে হেঁটে ও কাছাকাছি এসে হাওয়াকেই যেন বললাম,
– বাড়িভর্তি মানুষ। এদিক একটু সামলে পুকুর ঘাটে এসো।
২
সাফুরার ইতিবৃত্তটা এখানে একটু পরিষ্কার করা আবশ্যক। সম্পর্কের দিক দিয়ে সাফুরা আমার আপন খালাতো বোন। অর্থাৎ সাফুরার পাগলী মা আমার মুমূর্ষু জননীর মায়ের পেটের ছোটবোন৷ আমার মা-রা ছিল তিনভাই দুই বোন। মা ছিল ভাইবোনদের মাঝে সবার বড় আর পাগলী খালা দ্বিতীয়। নির্দিষ্ট একটা বয়স পার হবার পর খালার মতিগতি,চালচলন, কথাবার্তার অসংলগ্নতা দেখে বাড়ির সকলে বুঝেছিল,তিনি স্বাভাবিক নন। একটা অতি ক্ষীণ জনশ্রুতি আছে যে, আমার নানী যখন পাগলী খালাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন তখন কোনো একটা আধিদৈবিক শক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি,ভয় পেয়েছিলেন মারাত্মকভাবে। যার কারণে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়েছে। সে যাইহোক, আমার বয়স যখন ছয়,তখন একদিন আচমকা শুনলাম ;আমার পাগলী খালার একটা মেয়ে হয়েছে। তখন কিছু বুঝিনি, কিন্তু বড় হবার পর সাধারণভাবেই জানতে পারলাম, কে বা কারা তাদের উদ্দাম কামক্ষুধাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে নিষ্কলুষ খালার গর্ভে বপন করেছিল নিষিদ্ধ এবং সমাজ-অস্বীকৃত এক কাল-বীজ। সে কাল-বীজের সন্তানই আজকের সাফুরা৷ খালার তলপেট যখন সাতমাসের অনাগত সন্তানের ভারে স্ফীত হয়ে উঠেছিল তখন আমার নানা একদিন লোকলজ্জায় খালাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন আম্মার কাছে। বিশেষত পাগল হওয়ায় খালাকে ভীষণ ভালোবাসতেন মা। হাসপাতালের চাকরি থেকে মাসকয়েকের ছুটি নিয়ে তিনি খালাকে নিয়ে চলে এলেন গাঁয়ে,অর্থাৎ আজ তিনি যে বাড়িতে শুয়ে মৃত্যুর ক্ষণ গুনছেন,সেই বাড়িতে। আগেই বলেছি, মা ছিলেন ডাক্তার; যথেষ্ট স্বাবলম্বী, কাজেই বাবার বাধা-আপত্তি, হইচইতে বড় একটা গা না করে তিনি খালার সেবাশুশ্রূষা করে সহিসালামতে সাফুরাকে মাতৃগর্ভের বেষ্টনী থেকে পৃথিবীর আলো দেখালেন৷ শুধুমাত্র সাফুরার জন্যই মা শহরের মোটা অঙ্কের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে মফস্বলের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি নিলেন। বাবা এতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেও কিছুটা নিজ স্বার্থে মায়ের জেদের কাছে হার মানার ভান করে তিনিও মফস্বলে বাস করতে শুরু করেছিলেন।
দিন পেরোল। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সাফুরা বড় হয়ে উঠল। চট করে চোখে পড়ার মতো হয়ে উঠল ওর সমস্ত অস্তিত্বটা! দোহারা গড়ন, মাজা-মাজা গায়ের রং, ঈষৎ-বঙ্কিম ভুরু জোড়ার নিচে উজ্জ্বল নিকষকালো মায়াময় দু’টি চোখ। চোখজোড়া ছাড়া চেহারায় আর তেমন বিশেষত্ব নেই। তবে সর্বসাকুল্যে একটু সময় নিয়ে তাকে রূপবতী বলতে কারোরই বিশেষ আপত্তি থাকবে না। তবু এক ছাদের নিচে বাস করেও সাফুরার সঙ্গে আমার কোনোকালেই বনিবনা হয়নি। হয়নি বলতে, বাল্যকাল থেকেই আমার দু’জনেই পরস্পরকে অজানা কারণে এড়িয়ে চলেছি। রাখঢাক রেখে না বললে, ওকে আমার ভালো লাগতো না। বারাবরই স্বাভাবিক বালখিল্যতায় আমার মনে হতো, ছপ্পর ফুঁড়ে ও আসার পরই আমার প্রতি মায়ের ভালোবাসা কমে গেছে। বড় হয়ে আসল সত্যটা বুঝতে পারার পরও তার প্রতি আমার বিতৃষ্ণ অগ্রহণযোগ্যতায় কিঞ্চিৎমাত্র ভাটা পড়েনি। এনিয়ে আমার কখনো আফসোসও হয়নি। ওকে বন্ধু বানানো কিংবা ওর সঙ্গে দু’চার বাক্য আলাপ করে আত্মীয়সুলভ আচরণ করার মতো যথোপযুক্ত কারণ,সুযোগ কোনটিই ঘটেনি। বলাবাহুল্য, ব্যাক্তিগতভাবে সে নিজেও ছিল বাস্তুত্যাগী বোহেমিয়ানের মতোন নির্মোহ,নির্লোভ,নিরাকাঙ্ক্ষী। ঢাকায় পড়াকালীন যখন দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরতাম তখন সাফুরা কেবল নতমস্তকে একটা সালাম দিয়ে আমার হাতের গাঁটরি-বোঁচকা বাড়িয়ে নিয়ে অন্দরের পথে যাত্রা করত। এভাবেই অভ্যস্ত আমরা। বয়স যখন আঠারো ছুঁল, সাফুরা এইচএসসি দিল। রোজাল্ট মোটামুটি। কিন্তু এরপর সে আর পড়তে রাজি না। কেজানে, নিজেকে নিয়ে হয়তো-বা তার পর্বতপ্রমাণ হীনম্মন্যতা ছিল, পরের গলগ্রহ হয়ে থাকার ইচ্ছে তার ছিল না;বস্তুত ওকে কখনোই বুঝে উঠার চেষ্টাও করিনি আমি। যাইহোক, আম্মা তখন ওকে বিয়ে দেবার জন্য আদাজল খেয়ে নামল। পাত্রপক্ষকে মিথ্যে বলে ঠকানোর কোনো অভিপ্রায় মায়ের ছিল না। কাজেই অনেকগুলো বিয়ে হয়ি-হয়ি করেও শেষমেশ ওর পিতৃপরিচয়হীনতার কারণে হয়ে উঠেনি। বাবা নাক সিঁটকে বলেছিলেন,
– এমন ভালোমানুষি করলে ওকে জীবনেও বিয়ে দিতে পারবে না। কোন্ ছেলে জেনেশুনে একটা জারজ মেয়েকে বিয়ে করবে? জেনেশুনে সমাজে কে লাঞ্ছিত হতে চাইবে?
কথা সত্য। এই কঠিন সত্যটা আমিও উপলব্ধি করেছিলাম,হয়তোবা মা-ও করেছিল। কিন্তু মিথ্যার আশ্রয় নিতে মন সায় দেয়নি তার।
৩
শানবাঁধানো পুকুরঘাটের প্রবেশপথের দু’ধারে মুখোমুখি দু’টি বৈঠকখানা। হেলান দেওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। আমি ভোঁতা দুশ্চিন্তায় জর্জর মনটার লাগাম ছেড়ে হেলান দিয়ে বসে আছি। বৈশাখের শেষাশেষি সময়,তথাপি প্রকৃতিতে লেগে রয়েছে বোশেখি উন্মাদনা। এই চড়া রোদ,এই মেঘ,এই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। একটু আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। মেঘ-ভাঙা-রোদ্দুরে পুকুরের চারিধারের সুউচ্চ বৃক্ষরাজির সবুজ পাতাগুলো ঝিনুকের বুকে মুক্তোর মতো চিকচিক করছে। পুকুরের নিতল, নিস্তব্ধ,নিস্তরঙ্গ জলে সার-সার বৃক্ষরাজির ঝাপসা প্রতিচ্ছবি। আকাশে এখনো কালো মেঘের ঘনঘটা। আাবারো বৃষ্টি নামবে…।
মিনিট দশেক পর সাফুরা এলো। ওর পরনে সাদাসিধে একটা কামিজ। বুকের ওপর ভাঁজ করে রাখা ওড়নাটা পেঁচিয়ে মাথায় ওপর এনে ছেড়েছে আলতো করে। ঘাটের এককোণে ও এসে দাঁড়াল পাহাড়সম জড়তা নিয়ে। আমি চট করে মূল কথায় চলে গেলাম,
– সাফুরা,আম্মার অসিয়ত নিয়ে তোমার কী মত?
সাফুরাকে বিভ্রান্ত দেখাল। ঢোক গিলে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে, চোখের মনিজোড়াকে সন্ত্রস্ত করে ঘুরিয়ে ও সহসা কোনো উত্তর দিতে পারল না। দুর্বোধ্যভাবে শুধু মাথা নাড়ল কেবল। আমি বললাম,
– কী? ভয় পাচ্ছ কেন? তোমার কোনো মত বা পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে না?
সাফুরা অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
– আমার কোনো কিছু বলার নাই। আপনি যা করবেন তা-ই হবে।
– কিন্তু আমি তো অন্য একজনকে পছন্দ করি, সাফুরা। ঢাকায় থাকে সে। সানজানা নাম। আমার কলিগ,জার্নালিস্ট। মিডিয়াতেও কাজ করছে টুকটাক, চিনবে হয়তো দেখলে।
সাফুরা যেন একটু চমকে উঠল। ওর শান্ত চোখের তারায় একটা অবরুদ্ধ বেদনা ঝলসে উঠে নিভে গেল কি? নাকি ভুল দেখলাম! এবারও সাফুরা মাথা নাড়ল,
– ঠিক আছে। আমি মা’কে বলব বুঝিয়ে।
– মা কষ্ট পাবে। আমি চাই না, শেষমুহুর্তে এসে মা কষ্ট পাক।
সাফুরা চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল,
– মা’র কিচ্ছু হবে না। সুস্থ হয়ে যাবেন, আমি জানি।
বলেই দৃষ্টি নত করে উদ্গত অশ্রুবারি মুছে নিল সাফুরা।
ওর বিশ্বাস দেখে আমার মনের কোথাও মৃদু ব্যথা টনটনিয়ে উঠল। সত্যটা এখনো মেনে নিতে পারছে না সাফুরা। বললাম,
– মা’কে খুশি করার জন্য হলেও আমরা বিয়ে করব সাফুরা। পরে নাহয়…
– পরে মা কি উপর থেকে সব দেখবেন না?
– দেখলেও তিনি তখন আমাকে বুঝতে পারবেন। কিন্তু এখন জাগতিকভাবে চিন্তা করতে গেলে মা কষ্ট পাবে।
– ঠিক আছে, আমি রাজি। এমনিতেই আমাকে বিয়ে করতে আসবে না কেউ। মিছেমিছি না-হয় একটা বিয়ে হোক! আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
– ভেবে বলছ তো? পরে ডিভোর্সের সময় কোনো সমস্যা করবে না তো?
সাফুরা অনড় দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। কাটাকাটাভাবে বলল,
– সেই অধিকার আমার নাই৷ চিরকাল আপনাদের খেয়ে আপনাদের ছায়ায় বড় হইছি। বেঈমানী করব না। যা বলবেন তা-ই হবে।
-তাই হোক।
কিন্তু বিধিবাম! সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই আমার আর সাফুরার হাত একমুঠোয় ধরে পরলোকগমন করেন আমার জন্মদায়িনী মা। সাফুরা গলা ফাটিয়ে মাতম করে মূর্ছা গেল। আমি জীবনে প্রথমবারের মতো স্বজনহারা বেদনায় হাউমাউ করে কাঁদলাম। সেই কান্নার মধ্যেই শুনলাম, কে যেন বলছে,’ছেলেদের এভাবে কাঁদতে নেই,শক্ত হও।’ আমি শক্ত হলাম। দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করলাম। মায়ের লাশটা খাটিয়ায় করে যখন বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে তখনও সাফুরা মূর্ছিতা। চৈতন্যলাভের পর সে দেখল, মা নেই তখন সে ছুটে গেল পুকুর পাড়স্থ গোরস্তানের দিকে। মহিলারা তাকে টেনেহিঁচড়ে ঘরে এনে একটা কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখল৷ সবার কাছে সাফুরার পাগলামি অসহ্যকর ঠেকছে। নিজের মেয়ে হলে একটা কথা ছিল! একে তো পরের মেয়ে, তার ওপর জারজ! এদের কি দয়ামায়া থাকে নাকি? নিশ্চয় কিছু একটা হাসিল করার জন্য অভিনয় করছে মেয়েটা। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নিজ কক্ষে ফিরে এলাম। উঃ,মহিলারা পারেও বটে!
পরেরদিন ফজরের নামাজ পড়ে মায়ের কবরে পানি দিতে গিয়ে দেখি কবরের একপ্রান্তে উপুড় হয়ে বসে নীরব অশ্রুপাত করছে সাফুরা। কাকডাকা ভোরের আনকো আলোয় দেখা যাচ্ছে,নিঃশব্দ কান্নার দমকে ওর দোহারা দেহটি উত্তাল সমুদ্রের মতো ফুলেফেঁপে উঠছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ও ঈষৎ সরে বসল,কিন্তু কান্না থামল না। আমি কবর জেয়ারত করে পানি দিয়ে ওকে বললাম,
– চলো। ঘরে চলো। নামাজ পড়ে দোয়া করো আম্মার জন্য। এভাবে কবরস্থানে এসে না কাঁদাই ভালো।
সাফুরা উঠল না। আমি দু-হাতে ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে ধীরে ধীরে ঘরমুখো টেনে বললাম, এসো।
সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। সবকিছুই এখন স্বাভাবিক। কিন্তু মৃত্যুর শীতলতা এখনো এই বাড়ির চৌহদ্দিকে অদ্ভুত নীরবতার চাঁদোয়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যতই সময় গড়াচ্ছে ততই কেমন একটা বিষণ্ণতা ভর করছে বাড়ির প্রতিটি অন্ধ্রেরন্ধ্রে। এবারে বাড়িতে বসে থাকাটা সমীচীন মনে হলো না। কাজে ফিরলে হয়তো বেদনাটা প্রশমিত হবে। ভেবে,অষ্টমদিনের মাথায় আমি তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিলাম। বাবা এসে বললেন,
– চলে যাচ্ছ?
– হ্যাঁ
– সাফুরার কী হবে?
– আমি কি জানি?
– তুমি কি জানো মানে? তোমার মায়ের ইচ্ছে…
– আমি মায়ের ইচ্ছেকে সম্মান করি ঠিক আছে। কিন্তু ইতোমধ্যেই অন্যজনের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাফুরাও এই বিষয়টা জানে৷
বাবা ভুরু কুঁচকে বললেন,
– তোমার কলিগ মেয়েটা? ও মেয়ে সুবিধার না হাবিব।এই বলে দিচ্ছি তোমাকে। ধরা খেয়ে পরে আফসোস করবে দেখো…।
– বাবা,এটা আমার পার্সোনাল লাইফ! আই ক্যান হ্যান্ডেল ইট! তুমি বরং সাফুরাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো। ওর রিপ্লেসমেন্ট,রিফ্রেশমেন্ট দু’টোই দরকার।
– হু শিউর। ওকে তো আমি বিয়ে দেবই,যেভাবেই হোক।
-হু।
বাবা বেরিয়ে গেলেন। একটু পর সাফুরা ট্রেতে করে হরেকরকম নাশতা সাজিয়ে নিয়ে এলো। সকাল থেকে ওকে এক মিনিটের তরে দেখা যায়নি। আমার চলে যাবার খবর শুনে হেঁসেলঘরে এসবই করছিল বোধহয়। নাশতাগুলো টিপয়ে রেখে দুহাত সামনে রেখে দাঁড়িয়ে রইল সে।
-কিছু বলবে? আমি বললাম।
ও না-সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। একটু পর ফিরে এল একটা ব্যাগ হাতে করে। ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– এখানে চালতার আচার আর আমের আচার আছে। আম্মা বলছিল,আপনি পছন্দ করেন।
আমি স্মৃতিকাতর হয়ে ব্যাগটা নিয়ে ওকে ছোট করে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ির ফটক অবধি নিঃশব্দে এগিয়ে এল ও আমার সঙ্গে। ওর হাবভাব দেখে মনে হলো,কিছু একটা বলবার জন্য আইঢাই করছে মেয়েটা! কিন্তু কীভাবে জানতে চাইব বুঝতে পারলাম না। অগত্যা ফটক পেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই আমি হালকা পেছনে ঘুরে জিজ্ঞাসু সুরে বললাম,
– কিছু বলবে তুমি?
সাফুরা একছটাক বিব্রত হেসে মুখটা স্বভাবজাত মলিন করে বলল,
– না, এমনিই আসলাম। আল্লাহ হাফেজ।
চলবে…