কাছে কিবা দূরে পর্ব ৪

0
1707

#কাছে কিবা দূরে
পর্ব-৪
গত রাত টা নির্ঘুম কাটায় ট্রেনে উঠেই তানি ঘুমিয়ে পড়লো। তানি বাসে চড়তে পারে না, বমি হয়। তাই ওরা ট্রেনে করে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে। তানি ঘুমানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে শুভ্র’র কাঁধ টা’কে। শুভ্র সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে একমনে ম্যাগাজিন পড়ছে। ম্যাগাজিন টা কিনেছে প্ল্যাটফর্ম থেকে। সারা পথ কিভাবে সময় কাটাবে এই ভেবে কেনা হয়েছে। অভ্র বসেছে বাম দিকের প্রথম সিটে। শুভ্র আর তানি ডান দিকের সিটে। অভ্র খোঁচা মেরে বলল, ভাইয়া ভাবী তো দেখি ঘুমিয়েই যাচ্ছে।

শুভ্র অন্যমনস্ক হয়ে বলল, হু?

অভ্র মিটিমিটি হেসে বলল, অথচ তুমি সকালে কী ভাব টা’ই না করেছিলে?”

শুভ্র ম্যাগাজিন রেখে অগ্নিদৃষ্টিতে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, এইসব অশ্লীল কথাবার্তা কোথায় শিখেছ?

অভ্র হাসি চেপে বলল, যাহ বাবা! আমি কী করলাম!

শুভ্র চোখ গরম করে বলল, ইরার মা’কে বলি যে তার মেয়েকে এখন থেকে যেন একটু দেখেশুনে রাখে। রাত বিরাতে বখাটে ছেলেরা আজকাল খুব ডিস্টার্ব করছে।

“এরমধ্যে ইরা কোত্থেকে এলো?”

শুভ্র দৃষ্টি সরিয়ে ম্যাগাজিনে মনোযোগ দিলো। বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। ট্রেন ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য চলছে। কয়েক মিনিটের জন্য স্টেশনে থামছে, সেই সময় শোনা যায় হকারদের হাকডাক। তানি বেহুশের মতো ঘুমুচ্ছে। শুভ্র এক নজর তানিকে দেখলো। মেয়েটার কতো বয়স হবে! শুনেছিল চব্বিশ বছর বয়স। অথচ এই বয়সেই হোচট খেয়ে বসে আছে! শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাকে কী বলছে! তানি যেমন হোচট খেয়েছে, তেমনি ও তো খেয়েছে। অবন্তীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ইউনিভার্সিটি তে পড়া অবস্থায় ই। অবন্তী উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলো। অবন্তীর বাবা জেদ করলেন ইউনিভার্সিটি তে পড়া অবস্থায় মেয়ের বিয়ে দিবেন। পাশ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে দেরি হয়ে যাবে। সেদিন দু’চোখে কেবল অন্ধকার ই দেখেছে শুভ্র। বাবা মারা গেছে। মায়ের চাকরি আর বাবার পেনশনের টাকা মিলিয়ে তিন ভাই বোনের পড়ার খরচসহ বাসা ভাড়া, সংসার চালাতে হয়। এরমধ্যে অবন্তীকে বিয়ে করাটা বোকামি। শুভ্র অবন্তীর বাবার কাছে সময় চেয়েছিলো কিন্তু সে সময় দিতে রাজি ছিলেন না কোনোভাবেই। এদিকে অবন্তীও শুভ্র কে না পেলে আত্মহত্যা করবে। উপায়ন্তর না পেয়ে মায়ের অনুমতি ছাড়াই অবন্তী কে বিয়ে করেছিল। মা অসন্তুষ্ট হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। অবন্তীকে নিজের মেয়ের মতো ই মানতেন। কিন্তু অবন্তী ছিলো নিম্ন মধ্যবিত্ত মানসিকতার। সে বিয়ের পর একটা নিজস্ব জীবন চেয়েছিল যেখানে শাশুড়ী, দেবর, ননদ কেউ থাকতে পারবে না। বৈবাহিক জীবনের দুটো বছর শুভ্র’র তিক্ততায় কেটেছে। এই তিক্ততা শুধু শুভ্র না, তার ফ্যামিলিকেও ভোগ করতে হয়েছে। তাই দ্বিতীয়বার বিয়ের জন্য শুভ্র রাজী ছিলো না। কিন্তু মায়ের অনুরোধ ফেলাও সম্ভব হয় নি।

তানি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে। কেউ একজন তাকে এক নাগাড়ে ডেকেই যাচ্ছে। কিন্তু তানি লোকটা’কে চিনতে পারছে না। এর আগে দেখেও নি অথচ এমন ভাবে ডাকছে যেন কতো আপন। হঠাৎ মাথায় ধাক্কা লাগায় তানির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ কচলে এদিক ওদিক চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কোথায়?

“এটা এ্যাওয়ার্ড ফাংশনের ট্রেন। এক্সপার্ট ঘুম কাতুরে যারা তাদের সেই ফাংশনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে”।

তানি বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। অভ্র হেসে ফেলে বলল, ভাবী আপনি কিছু মনে করবেন না। ভাইয়া মজা করেছে। আসলে ভাইয়া গম্ভীর হয়েও পেটে খিল ধরানো কথা বলে! ”

শুভ্র তানিকে বলল, ঘুমকন্যা আপনি কী আমাদের সাথে যাবেন নাকি গিনিস বুকে নাম লেখাতে চলে যাবেন?”

তানি লজ্জায় মাথানিচু করে ফেলল। এতক্ষন ঘুমিয়েছে!

******

শুভ্র’র মায়ের নাম মাহফুজা রহমান। মাহফুজা একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেন। স্বামী মারা গেছেন বছর দশেক হবে। এরপর একা হাতে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। শুভ্র, অভ্র ছাড়াও তার একটি মেয়ে আছে। যার নাম আনিকা। আনিকা এবার ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে।

তানিকে দেখে আনিকা ছুটে গেল। বলল, ভাবী আমি কিন্তু তোমার একমাত্র ননদ। পরীক্ষা চলছিলো তাই যেতে পারিনি।

মাহফুজা তানিকে হাত ধরে ঘরে আনলেন। বারবার জিজ্ঞেস করলেন পথে কোনো সমস্যা হয়েছে কী না! বিয়েতে দেরি করে পৌছানোর জন্য ক্ষমাও চাইলেন। তানি নত মস্তকে সব টা শুনলো আর নিচু গলায় দুই একটা কথা বলল।

আনিকা তানির পাশে এসে বসে বলল, ইশ! তুমি কতো সুন্দর! ছবি দেখে ভেবেছিলাম সব ক্যামেরার কেরামতি।

অভ্র ফোড়ন কেটে বলল, আরে জানিস না তো, ভাবীকে সালোয়ার কামিজে কতো সুন্দর লাগে।

তানি প্রথমে না বুঝতে পারলেও পরে বুঝলো অভ্র কোন অর্থে কথাটা বলেছে। যখন বুঝতে পারলো তখন তানি লজ্জা পেল শুভ্র’ও নিশ্চয়ই ব্যাপার টা লক্ষ্য করেছে!

মাহফুজা খাবারের বন্দোবস্ত করতে গেছেন। শুভ্র এসেই ভেতরের ঘরে চলে গেল। আনিকা আর অভ্র দুজনেই তানির সামনে বসে আছে।

আনিকা মন খারাপ করে বলল, ভাবী তুমি কী কথা কম বলো?

তানি ইতস্তত করে বলল, না মানে….

অভ্র বলল, সবাই কী তোর মতো ফাজিল হবে! ভাবী নতুন তো তাই কথা কম বলছে। আর যদি কথা কম বলার অভ্যাস থাকে তো কোনো ব্যাপার ই না। আমরা শিখিয়ে নেব।

তানি মৃদু হাসলো। আনিকাও হেসে ফেলল।

অভ্র বলল, ভাবী তোমাকে কিন্তু আপনি আজ্ঞে করতে পারব না। স্ট্রেইট তুমি। তাছাড়া বয়সে আমি তোমার চেয়ে এক বছরের বড় তাই তুই ও বলতে পারি।

মাহফুজা এসে বললেন, কী রে তোরা কী মেয়েটা’কে একটু হাত মুখ ধুতেও দিবি না। আসো তানি হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিবে।

তানি মাহফুজা কে অনুসরণ করে। তানির চোখে পানি এসে গেছে। এরকম একটা পরিবার ও মনে মনে চেয়ে এসেছে কিন্তু প্রথমবার যেভাবে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে তাতে আর কোনোদিন বিয়ের স্বপ্নও দেখে নি। অথচ যা চেয়েছে তা পেয়েছে। দেরি হয়েছে ঠিকই, তবুও পেয়েছে তো। তানি চোখ মুছলো। মাহফুজা হেসে বললেন, ধুর বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেন? বাড়ির জন্য মন কেমন করছে?

তানি কিছু বলল না। হঠাৎই মন খারাপের পাল্লা ভারী হতে লাগলো। আচমকাই মাহফুজা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মাহফুজা পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, পাগল মেয়ে।

শুভ্র’র সাথে তানির আর দেখা হলো না। একসাথে খেতেও বসে নি। নিজের ঘরে বসে ঘুমিয়েছে। তারপর পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। সন্ধ্যা বেলা আনিকার কাছে চা চেয়ে খেয়েছে কিন্তু ঘর থেকে বের হয় নি। তানি লজ্জায় ও ঘরে যায় ও নি। আনিকার ঘরেই বিশ্রাম করেছে। সন্ধ্যায় একসাথে সবাই মিলে চা খেয়েছে। বারবার তানি শুভ্র’র ঘরের দিকে তাকাচ্ছিলো। এক একটা জিনিসের জন্য শুভ্র যখন একে ওকে ডাকে তখন তানি কান খাড়া করে থাকে। এইটুকু সময় না দেখতে পেয়ে ভিতরে ভিতরে জ্বলে যাচ্ছে। এর নাম কী ভালোবাসা! তানি তা জানেনা। শুধু জানে আর ওর পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব না। এখন যদি শুভ্র কে না দেখতে পায় তাহলে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবে।

শুভ্র’র সাথে দেখা হলো তানির রাতে৷ শুভ্র পা দুলাতে দুলাতে ম্যাগাজিন পড়ছিল। তানিকে দেখে চমকে উঠে বলল, ও তানি তুমি এই ঘরে ঘুমাবে?

তানি বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। শুভ্র বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন! বসো।

তানি জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসলো। মুখ থমথমে। অপমান আর রাগে ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। শুভ্র স্থির চোখে তানিকে দেখতে লাগলো। তারপর শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, রাগলে তো তুমি পুরো টমেটো হয়ে যাও।

তানি একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো। শুভ্র হেসে বলল, আসলে কাল রাতে তুমি একটুও ঘুমাও নি। তাই মনে হয়েছে যে তুমি কমফোর্টেবল হবে না এক বিছানায় ঘুমাতে। এইজন্য জিজ্ঞেস করলাম।

তানি অবাক ও বিস্মিত হলো। তার মানে কাল যে ও জেগে ছিলো সেটা শুভ্র জানে!

শুভ্র বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে তুমি শুয়ে পড়ো। আমি মাঝখানে কাটাতাড়ের ব্যবস্থা করছি।

তানি শব্দ করে হেসে ফেলল। শুভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, যাক বাবা তুমি হাসতে পারো। আমি ভেবেছি তোমার দুই একটা দাঁত কম আছে বলে ঝিম মেরে থাকো, হাসো না। এখন তো দেখি সব দাঁত ঠিকঠাক ই আছে। একদম মজবুত, টেকসই।

তানি এবার আরও জোরে শব্দ করে হাসতে লাগলো। তাল মিলিয়ে শুভ্র’ও হাসলো কিন্তু তাতে শব্দ হলো না।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here