#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব_২১
#সাবিকুন_নাহার_নিপা
শুভ্র বাস স্ট্যান্ড গিয়ে যখন পৌছালো তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ কাউন্টারে বসে অপেক্ষা করলো বাস আসা অবধি। বুকের ভিতর কেমন যেন অদ্ভুত এক ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এই ব্যথা কী কারনে হচ্ছে সেটা শুভ্র জানে, কিন্তু ওর জানায় তো কোনো লাভ নেই। যার জানার দরকার সে তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কোনোকিছু শুনতেই নারাজ। শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শরীরে ক্লান্তিরা ভর করেছে। আজ সারাদিনে কম ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয় নি। এই মেয়েটার কেন যে এতো জেদ! একটু বুঝদার হলে লাইফ টা কতো ইজি হতো!
বাস এসে গেছে। অনিচ্ছাস্বত্তেও কাউন্টার ছেড়ে বাসে উঠে বসলো। বাস ছাড়তেই লম্বা ঘুম দিবে, তাহলে যদি শরীর টা একটু ঝরঝরে লাগে। বাসে উঠে বসতেই ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। সাধারণত বৃষ্টি এলে মানুষের মন ভালো হয় কিংবা বিরক্ত হয়। কিন্তু শুভ্র’র মন খারাপ হয়ে গেল। এতোটা মন খারাপ হলো যে চোখে পানি এসে গেল।
ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে তানি ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। রাতে কোনোরকম ক’টা খেয়ে সেই যে ব্যলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে আর ভিতরে যায় নি। বৃষ্টি শুরু হতেই চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে শুরু করেছে। হঠাৎ কিছু না বলে চলে আসায় বাড়িতে একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। একমাত্র তানির মা ছাড়া আর কেউই ব্যাপার টা’য় খুশি হয় নি। খাওয়ার সময় সাবিনা খোঁচা মেরে বলেছে, ক’দিনের জন্য এসেছ নাকি একেবারে চলে এসেছ তানি?
তানি খাওয়া বন্ধ করে স্থির চোখে ভাবীর দিকে তাকিয়ে রইলো। সাবিনা বলল, না মানে তোমার সংসারে তো সবসময় ই ঝামেলা হয় তাই জিজ্ঞেস করলাম।
তানির মা পরিস্থিতি সামলাতে বলেছে, এসেছে ভালো করেছে। অসুখ, বিসুখ গেছে এবার ক’টা দিন আমার কাছে থাকুক।
সাবিনা থামার মতো মেয়ে না। ঝাঝালো গলায় বলল,
“আম্মা একটা সত্যি কথা বলেন তো? আমরা কী শ্বশুর, শাশুড়ী, ননদ দের নিয়ে সংসার করছি না! এই যে আপনার ঘরে আরও দুটি দামড়ি মেয়ে শুয়ে বসে খায় সেটা কী সহ্য করছি না! তাহলে আপনার মেয়ের এতো সমস্যা কিসের!
তানির মা বড্ড অসহায় হয়ে পড়েন।এই দজ্জাল টাইপের মেয়ের সাথে সে পারে না। তাই চুপ করে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। কিন্তু তানি চুপচাপ থাকে না। কঠিন গলায় বলল, ক’টা দিন থাকতে এসেছি বলে তোমার এতো জ্বলছে কেন ভাবী! নাকি এবার আসার সময় হাতে করে শপিং ব্যাগ আনিনি বলে খুব কষ্ট পাচ্ছ?
সাবিনা এতে আরও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তানির বাবাকে ডেকে তুলে বলল, খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনার মেয়ে আবারও বিয়ে ভাঙতে চলেছে কি না! এই মেয়ে সংসার করার না। বাপ, ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাবে।
তানি চুপ করে থাকলো না। একসময় অনেক চুপ করে থেকেছে কিন্তু এখন আর পারলো না। সাবিনার কথার পিঠে নিজেও অনেকগুলো তিক্ত কথা শুনিয়ে এসেছে।
তানি বুঝতে পারলো এখানেও ওর বেশীদিন থাকা ঠিক হবে না। কিন্তু ও বাড়িতেও ফিরে যাওয়া সম্ভব না। শুভ্র যা করেছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য। এরপর আর শুভ্র’র সঙ্গে থাকা সম্ভব না।
গভীর ভাবনার ছেদ ঘটলো অভ্র’র ফোনকল পেয়ে। তানি চোখ মুছে ফোন ধরে বলল,
“হ্যালো।”
“ভাবী তোমাদের খবর কী?”
“আমার খবর বলতে পারব। আমি এখন বাড়িতে আছি।”
“আর ভাইয়া?”
“জানিনা।”
অভ্র চিন্তিত গলায় বলল, ভাবী ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাইয়া রওনা হয়েছে কি না সেটাও জানতে পারছি না।
তানিরও এবার খুব টেনশন হলো। নরম গলায় বলল, আমাদের বাড়ি থেকে তো দশটার একটু পর ই বেরিয়ে গিয়েছিল।
“তারপর আর তোমাদের কথা হয় নি? ”
তানি কিছু সময় থেমে রইলো। তারপর বলল, না হয় নি।
অভ্র কোমল গলায় ডাকলো, ভাবী!
“জি।”
“ভাইয়াকে কী সেকেন্ড চান্স দেয়া যায় না? ”
তানি সেকথার জবাব দিলো না। কী ই বা জবাব দেবে! তানির মা জিজ্ঞেস করেছিল, কী নিয়ে ঝগড়া করেছিস?
তানি উত্তর দিতে পারে নি। আর তাছাড়া উত্তর ই বা কী দেবে! এই ছোট কারনে তানি ঘর ভাঙতে চাইছে সেটা তো লোকে শুনলে হাসাহাসি করবে। অবশ্য তানির কাছে কারণ টা মোটেও ছোট না। চরিত্রের উপর আঙুল তোলা মোটেও তুচ্ছ ব্যাপার না।
অভ্র বলল, ভাবী শুনছ?
“হ্যাঁ শুনছি। ”
“ভাবী উই অল আর মিস ইউ এন্ড লাভ ইউ।”
তানির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। বলল, আমিও।
“ভাবী ভাইয়াও তোমাকে খুব ভালোবাসে।”
তানি চুপ করে থাকলো। অভ্র বলল, ভাবী ভাইয়া এখন যা করছে তোমার জন্য সেগুলো কিন্তু তার পার্সোনালিটির সাথে যায় না। তবুও কিন্তু….
“এখন রাখছি।”
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে তানির গলা ভারী হয়ে এলো।
*******
রাত একটার দিকে ভিজতে ভিজতে শুভ্র এসে তানিদের বাড়িতে হাজির হলো। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে দেখলো, শুভ্র কাকভেজা হয়ে ফিরেছে। শীতে থরথর করে কাঁপছে। তানির বাবা এগিয়ে গিয়ে বললেন, বাবা তুমি?
শুভ্র লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, বাস মিস করে ফেলেছি আঙ্কেল।
তানি বুঝতে পারলো যে শুভ্র মিথ্যে কথা বলছে। অভ্র’র কাছে শুনেছে বাস ছাড়ার সময় ছিলো সাড়ে এগারোটা। অথচ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সাড়ে দশটার দিকে। বাসা থেকে বাস স্ট্যান্ড যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ দশ মিনিট। তাই বাস মিস করার কোনো প্রশ্ন ই আসে না।
শুভ্র জামাকাপড় ছেড়ে ঘরে ঢুকতেই তানি বলল,
“বাস মিস করার ব্যাপার টা মিথ্যে ছিলো না?”
শুভ্র নির্লিপ্ত গলায় বলল, হ্যাঁ।
“এতো বড় ডাহামিথ্যে টা কী কারনে বললেন?”
“কারণ শ্বশুরবাড়ির আদর আপ্যায়ন না নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো না তাই।”
তানি কঠিন গলায় বলল, একটা কথা মন দিয়ে শুনুন।
শুভ্র বিছানায় শুয়ে পড়লো। একটা হাত দু’চোখের উপর রেখে বলল, এখন মন দিয়ে শোনার সময় নেই। আমি খুব ই ক্লান্ত।
“আপনি যদি ভেবে থাকেন যে আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যাবেন, মানে সে উদ্দেশ্য যদি ফিরে এসে থাকেন তাহলে ভুল করছেন। কারণ আমি কোনো অবস্থায় ই আপনার সাথে ফিরে যাব না।
শুভ্র উঠে বসে হাত ধরে তানিকে টেনে কাছাকাছি নিলো। তানির সব কথা বন্ধ হয়ে গেল শুভ্র’র কাছাকাছি এসে। শুভ্র তানির কানে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ডিসিশন চেঞ্জ করে ফেলেছি। তোমাকে এখানেই রেখে যাব। যেতে চাইলে যাবে, না চাইলে না। আমি তো এমনিই ফিরে আসলাম।
তানি আর কিছু বলল না। শুভ্র সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। একটু আগে তানিকে সবচেয়ে বড় মিথ্যেটা বলেছে। ও তানির জন্যেই ফিরে এসেছে। বাসে বসে হঠাৎই মনে হলো ঢাকা গেলে ও দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। এই চারটে দিন কোনোভাবেই তানিকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না। তাই ফিরে এসেছে।
বিছানায় শুয়ে তানি নীরবে চোখের পানি ফেলছে। এই লোক টা বিশ্বের এক নম্বরের মিথ্যুক। ও যে তানির জন্য ফিরে এসেছে সেটা তানি ঘরে ঢুকে চোখ দেখেই বুঝে গেছে। চোখ দুটো’ও লাল ছিলো, হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে এই দশা হয়েছে। এতো বড় একটা বুড়ো মানুষ সে কী না এমন পাগলামি করছে! তানির চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। কেন এতো কান্না পাচ্ছে! একটু আগেও ম্যাসেজে লিখে পাঠিয়েছিল, গো টু হেল। আর এখন সেই মানুষ টা এভাবে ফিরে আসায় এতো আনন্দ কেন হচ্ছে! এসবের কোনো মানে হয়! এই বেহায়া মন কে কীভাবে নিয়ন্ত্রন করবে তানি!
চলবে…..
(গল্প শেষের দিকে তাই পর্বগুলো ধৈর্য্য ধরে পড়ার অনুরোধ)