কলা পাতায় বাঁধিব ঘর পর্ব ৮

0
668

#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৮

হরিদশ্বের নতুন আগমনে বিদায় নিলো একটি কালো রাত। জন্ম হলো নতুন ভোর। ভোরের মিষ্টি রোদ, পাখির কলতানে মুখরিত প্রকৃতি জানান দিলো ‘শুভ সকাল’।

হসপিটালের ওয়েটিং রুমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বসে আছে পুষ্প। গতরাত থেকে এই পর্যন্ত কয়েকশত কল, মেসেজ করা শেষ। কিন্তু রেসপন্স শূন্য। তাই সকাল সকালই এক দারুণ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। ডাক্তারের রাগ ভাঙাতে আঁট হয়ে নামলো। এমনিতে বললে এই লোক তার দুটো কথা শোনার জন্য আসবেনা। তাই ঠিক করলো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই তার চেম্বারে প্রবেশ করবে।

★★★

অন্যদিনের মতো আজ আর রাউফুনের ঠোঁটে হাসি নেই। রোগীদের সাথে কোমল স্বরে কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু চেহারায় কোমলতার লেশ মাত্র নেই।
দেখতে দেখতেই পুষ্পর সিরিয়াল আসলো। পার্সটি হাতের মুঠোয় চেপে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো।
হঠাৎ পুষ্পকে হসপিটালে দেখে চমকে উঠলো রাউফুন। সে এতটা প্রত্যাশা করেনি৷ দরজা চেপে পুষ্প চেয়ার টে’নে রাউফুনের কাছ ঘেষে বসলো।

রাউফুন শান্ত রইলো। তার চোখের দৃষ্টি জলের মতো স্বচ্ছ। স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলো,
-“কি সমস্যা বলুন।”

পুষ্প অস্থির গলায় বলল,
-“সমস্যা তো অনেক কিছু। কিন্তু কোনটা থেকে শুরু করবো ডাক্তার?”

রাউফুন তীক্ষ্ণ চোখে একবার পরোখ করে বলল,
-“মূল সমস্যা থেকে শুরু করুন।”

পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“সমস্যা হচ্ছে আমার হাজবেন্ড।
না মানে আমার একটা ভুলের কারণে তিনি আমার উপর রেগে আছেন। ভীষণ ভয়ঙ্কর সেই রাগ। এখন তিনি আমার ফোন ধরছেননা, মেসেজ সিন করছেননা। কিন্তু আমিতো শান্তি পাচ্ছি না। আমার বক্ষস্থলে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছি, বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করে, মাঝেমাঝে চিনচিনে ব্যথা হয়। এখন কি করলে আমার রোগ সেরে যাবে বলুন ডাক্তার।”

রাউফুন ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“আপনি হার্টের ডাক্তার দেখাতে পারেন। ভুল করে নাক,কান, গলার ডাক্তারের কাছে চলে এসেছেন। হার্টের চিকিৎসা আমি করিনা।”

রাগে,দুঃখে ভীষণ কান্না পাচ্ছে পুষ্পর। কি দরকার ছিলো তার রাগ ঝাড়ার? এখনতো ডাক্তার তার সাথে স্বাভাবিকই হচ্ছেনা। করুণ চোখে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে পুষ্প বলল,
-“সরি! আমি আর কখনো অযথা আপনার উপর রাগ দেখাবোনা ডাক্তার। এবারের মতো ক্ষমা করুন।”

রাউফুন যেনো আকাশ থেকে পড়লো। তার রোগী কি বলছে? কেনো বলছে যেনো কিছুই তার বোধগম্য হলোনা এমন এক প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলল,
-“শুনুন মিস, আপনার বোধহয় হার্টের সাথে সাথে ব্রেনের ডাক্তার ও দেখাতে হবে।”

এটা হাসপাতাল। এখানে সিনক্রিয়েট করা সাজেনা। পুষ্প এখানে কিছুই করতে পারবেনা। বড়জোর হাতটা ধরতে পারবে। তাই করলো সে। ঝট করে রাউফুনের হাত চেপে ধরে আকুতি করে বলল,
-“প্লিজ ডাক্তার! ক্ষমা করে দিননা। আমি সত্যিই অনুতপ্ত।”

রাউফুন হাতটা সরিয়ে নিয়ে মুঠোফোনে কারো নাম্বারে ডায়াল করলো,
-“পরবর্তী রোগীকে পাঠিয়ে দাও।”

পুষ্প হতাশ হলো। অন্যের সামনে নিজেদের মনমালিন্য নিয়ে কথা বলে স্বামীর নাম খারাপ করতে চায়না সে। বেরিয়ে ওয়েটিং রুমে এসে বসলো। আজ সে এখান থেকে নড়বেনা। রাউফুনের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত এখানে বসে থাকবে। সে ঠিক করলো বাথরুমে চাপ দিলেও সে যাবেনা। প্রয়োজনে কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলবে তবুও আজ এক পা ও নড়বেনা।

আধাঘন্টা পেরোনোর পর রাউফুনের অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে বলল,
-“ম্যাম এখানে বসে আছেন কেনো? বাড়ি চলে যান।”

পুষ্প ছেলেটির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনাকে কি আপনার স্যার এখানে পাঠিয়েছে?”

ছেলেটি দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,
-“না ম্যাম, আপনাকে অনেকক্ষণ যাবত বসে থাকতে দেখেই বললাম বাড়ি চলে যান। আপনারতো ডাক্তার দেখানো শেষ।”

পুষ্প উদাসীন হয়ে বলল,
-“আজ আমি সারাদিন এখানে বসে থাকবো। আপনার স্যারকে বলে দেবেন আমি এখান থেকে নড়ছিনা।”

ছেলেটি বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে কে’টে পড়লো। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেই রাউফুনের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

-“স্যার, ম্যাম তো কঠিন আন্দোলনে নেমেছে। উনি আজ এখান থেকে নড়বেননা।”

রাউফুনও একইভাবে নিচু স্বরে জবাব দিলো,
-“বলে দাও আমি হসপিটাল থেকে পেছনদিকের সিঁড়ি বেয়ে বেরিয়ে গিয়েছি।”

ছেলেটি একমুহূর্ত ও দাঁড়ালোনা। পুষ্পকে বলল,
-“ম্যাম আপনি কিছু খাবেন?
না মানে খালি পেটে কতক্ষণ বসে থাকবেন? স্যার তো পেছনের সিঁড়ি দিয়েই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়েছেন।”

পুষ্প মলিন চেহারায় বলল,
-“আমি কিছু খাবোনা।”

এরপরই উঠে পড়লো। পার্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো হাসপাতাল থেকে। ছেলেটি রাউফুনকে পুষ্পর বেরিয়ে যাওয়ার খবর দিলো। সামনের রোগীটি দেখে রাউফুন উঠে দাঁড়ালো। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে দিলো। পকেটে একহাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ালো। পুষ্প হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠছে। গাড়িটি চলে যেতেই রাউফুন আগের জায়গায় এসে বসলো।

★★★

পুষ্প বাড়ি যেতেই রেহানা খালা এসে সামনে দাঁড়ালেন। তার দাদুর নামে বিচার দেওয়া শুরু হয়ে গেলো। দুজনে আজও বোধহয় কিছু নিয়ে ঝগড়া করেছেন। এমনিতেই পুষ্পর মন-মেজাজ ভালো নেই। তার উপর এদের প্যানপ্যান। রুক্ষভাষী হয়ে বলল,
-“আজ অর্ধবুড়ী আর ওই পুরো বুড়ীকে পঁচা ডোবায় নিয়ে ফেলবো। কিছুদিন বাড়িটা শান্তিতে থাকবে।”

কথাটি শুনেই পুষ্পর দাদু বিলাপ করে কান্নাকাটি শুরু করলেন,
-“হায়! হায়! হায়! ঘরে দুধ দিয়ে কালসাপ পুষছিলাম। আইজ কালসাপে আমারে ডোবায় ফালাইতে কয়।
দূর কর, দূর কর। শয়তান দূর কর। যেহানের মাছমূল সেহানে নিয়া উঠা। এই ছেরিরে জামাইর বাড়িতে উঠা। এহানে থাইকা আমারে বাড়ি ছাড়া করবো। ও বাবাগো, তোমরা কোথায় আছো গো? দেইখা যাও তোমাগো আদরের কালসাপ আমারে বাড়ি থেইকা বাহির করতে কয়।”

পুষ্প ফোঁসফোঁস করে উঠে বলল,
-“ভেবেছিলাম তিনচারদিনের জন্য পঁচা ডোবায় ফেলে আসবো। কিন্তু এখন মুখ না বন্ধ করলে একবছরের জন্য ডোবায় ফেলে আসবো। সাঁতার কাটতে কাটতে শক্তি বাড়বে তোমার।”

রেহানা খালা এবার দাদুর পক্ষ নিলেন। দুজনে একতাল হয়ে কিছুক্ষণ পুষ্পর গুষ্টিসহ ধুয়ে শুকাতে দিলেন। পরক্ষণেই পুষ্পর দাদু আর রেহানা খালা আবার ঝগড়া করে বসলেন। পুষ্পর দাদু বললেন,
-“অই কুটনির ঘরের কুটনি তুই আমার পোলাগো বংশ লইয়া গাইল্লাস ক্যান? আমরা নাতনি কি আর স্বাদে তোরে ডোবায় ফালাইতে কইছে? আমিই তোরে ডোবায় ফালামু।”

রেহানা খালার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এতক্ষণ এই মহিলাই পুষ্পর গুষ্ঠি ধরে গা’লাগা’ল করলো। এখন আবার পাল্টি খায়। কটমট করে রেহানা খালা বলল,
-“তবেরে কুটনি বুড়ি, আইজ পান চেঁচতে কইও, একটু গরম পানি চাইও? দিমুনি তোমায় গরম পানির ছ্যাকা।”

পুষ্পর দাদু আরেকদফা চিল্লাফাল্লা করে বললেন,
-“ওরে পুষ্পরে। আমার বুবুজান দেইখা যা, এই কুটনি নাকি আমারে গরম পানি ড্যাগে(পাতিল) চুবাইবো।”

পুষ্প শুনতে পেলেও গা দিলোনা। দুজনে যে এতক্ষণ তাকে সহ তার গুষ্টি শুদ্ধো গরম পানির ড্যাগে দিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। দুজনের কাজই হলো খোঁচাখুঁচি করা। তবে এদের একজন বাড়ি না থাকলে বাড়িটা একেবারে শুনশান, ম’রাবাড়ির মতো নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। পুষ্প এদের দুজনকেই ভালোবাসে।

★★★

এতবার কল, মেসেজ করার পরও যখন রাউফুন রিপ্লে করলেনা। তখন নিরুপায় হয়ে রিশার নাম্বারে ডায়াল করলো। রিশা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-“আরে ভাবি কেমন আছো? জানো তোমাকে কত মিস করছিলাম? কবে আসবে আমাদের কাছে?”

পুষ্প ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
“এ দেখছি ভাইয়ের মতোই হয়েছে। একটা কথার উত্তর দিতে সময় না দিয়েই একশটা প্রশ্ন করে।”

পুষ্প উদাসীন হয়ে বলল,
-“আমার আর ভালো। তোমার ভাই আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে কই?”

রিশা বিস্মিত হয়ে বলল,
-“সে কি ভাবি? ভাইয়া কি তোমায় মা’রধর করেছে? তুমি বলতে পারো আমাকে, কোনো ভয় নেই। আমি বাবা মাকে বলবো আর তারা ভাইয়াকে জুতাপে’টা করবে।”

পুষ্পর কাশি উঠে গেলো। ত্বরিত গতিতে বলল,
-“আরে না না। তোমার ভাই আমাকে মা’রতে যাবে কিসের জন্য? সে তো আমার উপর রাগ করে আছে। তাই আমি ভালো থাকতে পারছিনা। এখন রাগ ভাঙাবো কিভাবে? আমি বুঝতে পারছিনা।”

রিশা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
-“ওহ, এটা কোনো ব্যাপারই না। ভাইয়ার রাগ দুমিনিটে উড়ে যাবে। কিন্তু তারজন্য তোমাকে আমাদের বাড়ি আসতে হবে।”

পুষ্প বলল,
-“কি বলছো? এখনো কি আমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে? আমি কিভাবে নাচতে নাচতে চলে যাবো?”

রিশা আশ্বস্ত করে বলল,
-“তুমি এসব আমার উপর ছেড়ে দাও তো। বিনিময়ে তোমার ছোট ভাইকে চাই। নাবিল ছাড়া আমি বাঁচবোনা।”

পুষ্প ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
-“শুধু নাবিল না, আমার উমায়ের ভাইয়াকেও দিয়ে দেবো। তুমি শুধু আমার কাজটা করে দাও।”

★★★

হসপিটাল থেকে বেরিয়েই কারো ডাকে চমকে উঠলো রাউফুন। পেছনে তাকিয়ে দেখলো তার শশুর দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে। মহোদয়কে দেখে বোঝার উপায় নেই তার একটা ২২ বছরের মেয়ে আছে। এখনো শরীরের গঠন কতটা পোক্ত। রাউফুন হাসিমুখে এগিয়ে যেতেই তিনি বলল,
-“কেমন আছো ইয়ং ম্যান?”

রাউফুন সহাস্যে উত্তর দিলো,
-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

উত্তরে পুষ্পর বাবা মীর হোসেন চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“ভালো। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। চলো গাড়িতে বসা যাক।”

রাউফুন শশুরের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলল।

#চলবে…….
(আজও ১২০০ এর বেশি শব্দ দিয়েছি। তবুও আপনারা বলছেন ছোট হচ্ছে৷ আমি পুরোদিনে লিখার সময় পাইনা। ব্যস্ততায় সময় পার হয়। প্রতিদিন চাইলে এতটুকুর বেশি লিখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হ্যাপি রিডিং।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here