কঠিন প্রেমের গল্প শেষ পর্ব

0
1636

কঠিন প্রেমের গল্প (শেষ পর্ব)
ফারাহ তুবা

নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে ভালোবাসি বলার আগে বুকের মধ্যে এমন ধড়াস ধড়াস করবে তা কোনদিনও ভাবিনি। নীতু আরাম করে বই পড়ছে আর বারান্দার দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি। জ্বিহবা কেমন করে জানি শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি লম্বা একটা স্পিচ রেডি রেখেছি। কিন্তু মুখ খুললেই কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করলাম। জোড়ে একটা নিশ্বাস নিয়ে খুব জোড়ে বললাম,

“নীতু তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।”

নীতু স্বাভাবিকভাবে তাকিয়ে বললো,

“বিয়ে করা স্বামীকে ছেড়ে কোথায় যাবো?”

কথাটা বলার পর আমারও নিজেকে কেনজানি খুব বেকুবের মতো লাগছে। আমি খুব ভালো স্পিচ রেডি করেছিলাম। কিন্তু এখন পুরোটাই বোকা বোকা লাগছে। আমি ধপ করে সোফায় বসে গেলাম। নীতুর উত্তর শুনতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সে স্বাভাবিকভাবে বই পড়ছে। কিছুক্ষণ একই পাতা খুলে তাকিয়ে থাকলো। এরপর হুট করে বই বন্ধ করে তাকিয়ে বললো,

“বলো কি বলবে?”

“মানে তোমাকে আমার খুব পছন্দ।”

“পছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক। আমাকে অপছন্দ হওয়ার কি আছে!”

“না মানে তোমাকে স্ত্রী হিসাবে আমার আরও ভালো রাখা উচিত। সামনে ভালো রাখবো। এতদিন ভালো রাখিনি।”

“রাখো ভালো। বলতে এসেছো কেন? খারাপ তো আমি নাই।”

“এত রাগ করছো কেন? আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি।”

“দুঃখিত।” বলে নীতু অনেকক্ষণ অপরদিকের দেয়ালে তাকিয়ে থাকলো। অনেকক্ষণ মানে অ-নে-ক-ক্ষণ। কিন্তু আমিও শত সহস্র বছর অপেক্ষা করতে পারি।

অনেকক্ষণ পর আমার দিকে তাকিয়ে নীতু বললো,

“বলো। হঠাৎ করে কেন ভালবাসছো?”

“আগে কেন এত ভালোবাসিনি আমি জানি না। তুমি আলাদা। খুবই আলাদা। আমি আগে বুঝিনি।”

“আমার কাছ থেকে কি শুনতে চাও?”

“জানি না।”

“তাহলে যাও। আমাকে বই পড়তে দাও।”

আমি উঠতে গিয়েও বসে গেলাম। জেদের স্বরে বললাম,

“না তোমাকে বলতে হবে।”

নীতু হেসে দিলো। অনেকদিন পর এই হাসিটা দিলো।

“বলো কি শুনতে চাও।”

“তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”

“খুব একটা না। আর কোন প্রশ্ন আছে?”

“আমার মধ্যে কি নেই? কেন ভালোবাসো না?”

“এমনিতেই। ভালোবাসার বা ভালো না বাসা এসবের কারণ থাকে না।”

“তুমি কি আমার উপর রেগে আছো? হাফসা মানে লিটা ম্যামের সাথে সম্পর্কের জন্য।”

নীতুর চেহারার একদিক থেকে আরেকদিকে বিষাদের একটা ঝিলিক বয়ে গেলো। নীতু ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,

“সাত বছর পার হয়ে গিয়েছে। এখন আর রাগ নেই। তখনও রাগ ছিলো না। অভিমান ছিলো। কিন্তু এতদিনে তাও নেই।”

নীতু কিছুক্ষণ বইটা নাড়াচাড়া করে বলতে শুরু করলো,

“আমাদের লাভ ম্যারেজ না হলেও দুইজন দুইজনকে চিনতাম। তোমার সাথে দুইদিন টি এস টি তে দেখা হয়েছিলো। দুইদিনই তোমার তাকানোটা কেমন জানি আলাদা ছিলো। এত আকর্ষণ করেছিলো আমাকে। মনে হয়েছিলো যে এত অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে জীবন পার করে দেওয়া সম্ভব। এরপর বিয়ে হলো। বিয়ের পর অল্পকিছুদিন খুব প্রেম ভালোবাসায় পার হলো। এরপর তোমার কি হলো আমি জানি না। তুমি তাকাও না। কথা বলো না। ধ্রুব পেটে আসার পর আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। ইচ্ছা করতো তোমাকে মেরে ফেলি। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না,বসতে পারি না ঠিকমতো। সব দেখাশোনা শাশুড়ি করে। তুমি রাতে ঘুমাও বা নিজের মতোই থাকো। চেচামেচি করে একসময় ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কতভাবে যে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। কি যে পাগলামি করতাম।”

নীতু কিছুক্ষণ থামলো। স্বাভাবিক কথাই আজকে আমার এত নতুন লাগছে। নীতু আবার বলতে শুরু করলো,

“এরপর লিটার ঘটনা বুঝতে পারলাম। লিটা নিজেও ঘটনা বোঝাতেই আগ্রহী ছিলো। আমি বুদ্ধি করে তোমাকে আটকাতে রুদ্রকে পেটে নিয়ে চলে আসলাম।”

এবার নীতুর চোখ দিয়ে পানি পরতে শুরু করেছে।

“রুদ্র হলো। তোমার আর লিটার সম্পর্ক আরও গভীর হলো। যদিও লিটা আর সাব্বির ভাইয়ের বিষয়টা আমি বুঝতাম তবুও আমার ভয় লাগতো। তোমাকে হারাবার ভয়। সারাদিন ফটোগ্রাফি করে পার করতাম। ধীরে ধীরে ভাবলাম তোমার থেকে দূরে সরে যাই। তাহলে তুমি নিশ্চয়ই আমার অভাব বুঝবে। কথা বলতাম না, সামনে আসতাম না। তুমি টেরও পেতে না। এরপর একদিন রুদ্রকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে দেখি সে দুধ পাচ্ছে না। হঠাৎ করে আমার মনটা বদলে গেলো। আমি কয়েক মুহূর্ত রুদ্রের দিকে তাকিয়ে মাফ চাইলাম। আমার বোকামির জন্য, অকারণ রাগ জেদের জন্য। ঠিক করলাম আর এক সেকেন্ড মন খারাপ করে থাকবো না। সেই সপ্তাহেই তোমার বেতন বেড়ে গেলো, আমিও প্রথম এওয়ার্ড পেলাম।

এসব নিয়ে খুশি হওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম। তোমার ভালো গুণ দেখার চেষ্টা শুরু করলাম।”

এই পর্যন্ত বলে নীতু চোখ মুছলো। আবার কিছুক্ষণ নীরবতা।

“আমি চিন্তা করে দেখলাম তোমাকে আমি ভালোবাসি না। তুমিও অন্যদিকে চলে গিয়েছো। অতএব ভালোবাসার ব্যাপারটা উড়ে গিয়েছে অনেক আগেই কিংবা কোনদিনও হয়তো ছিলো না। কিন্তু তোমার অনেক ভালো গুণ আছে। তুমি মা-বাবা মানে তোমার মা-বাবার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক রেখেছো, টাকা পয়সা ঝরঝর করে দিয়েছো, সত্যি কথা বলতে বিরক্ত হওয়া ছাড়া খুব একটা খারাপ ব্যবহারও করোনি।

ছেলেরা বড় হতে লাগলো। প্রতিদিন মজার মজার ঘটনা ঘটায়। কিংবা বলা যায় অঘটন ঘটায়। এত ভালো লাগে দেখতে। চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। সারাদিন বাচ্চাদের দেখি আর সংসার করি। চামচ রাখার গ্লাসটা তোমার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করলো। একসময় তোমার প্রতি ওরকম ভালোবাসা নাই হয়ে গেলো। কিন্তু স্বামী হিসাবে শ্রদ্ধা কমেনি। মনে হয়েছে ভালোবাসা থাকতেই হবে এসব বাড়াবাড়ি।

এদিকে দিন দিন ছোটখাটো সবকিছু ভালোলাগা শুরু করলো। তরকারি কাটার ছন্দ, ছেলেদের কাধে কোলে নেওয়ার আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। টাকা আর শখ থাকলে যা যা করা যায় সব করতে শুরু করলাম।”

নীতু এবার মুখ আবার স্বাভাবিক করে বললো,

“এই হলো আমার ঘটনা।”

“এখন আমি ঠিক কি বলবো বুঝছি না।”

“আদি শুনো, আমার মনে হয় কি তোমার এসব আবেগ সাময়িক। আজকে আছে কালকে আবার নাই হয়ে যাবে। তখন তুমি পা নাচাবে আর একা একা ক্রিকেট খেলা দেখবে।”

আমি চুপচাপ বসে আছি। কি বলবো উত্তরে জানি না। বলতে ইচ্ছা করছে এই প্রেম কমলে আবারও আমি তোমার প্রেমে পড়বো, এরপর আবারও তোমারই প্রেমে পড়বো। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছি না। কেমন একঘেয়ে লাগছে সবকিছু। মনে হচ্ছে সব শেষ হয়ে গিয়েছে। নীতু ঘরে চলে গিয়েছে। আমি কি করবো জানি না। ইচ্ছা করছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আবার দাঁড়াতেও কেমন জানি দুর্বল লাগছে। এতদিন ধরে বুকে যে পাথর নিয়ে বেড়াচ্ছি তার ভার কমার বদলে বেড়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। আমি আস্তে করে উঁকি দিয়ে ঘরের দিকে তাকালাম। এরপর উঠে গিয়ে বিছানায় শুতেই নীতু ডাক দিলো। বুকের মধ্যে কৈশোরের প্রেমিকা ডাক দিলে যে অনুভূতি হতো ঠিক সেরকম বাজনা শুরু হয়েছে।

“আমার মতো তোমার এরকম কোন গল্প আছে নাকি ধুম করে প্রেমে পড়েছো আর ঠুশ করে প্রেম আবার উড়ে যাবে।”

আমি মনে মনে আহত হলেও নীতুকে বুঝতে দিলাম না। চুপ করে থাকলাম। নীতু আবার বললো,

“আমি বসছি। তুমি আমার ঘাড়টা টিপে দাও।”

আমি একটু উঁচু হয়ে বসে নীতুর ঘাড়টা টিপে দিচ্ছি। নীতু খুশি মনে কথা বলে যাচ্ছে। অদ্ভুত সব কথাবার্তা। শুনতে তবুও ভালো লাগছে।

“সাময়িক প্রেমে যখন পড়েছোই এ সময়টা আমি কাজে লাগাই। হি হি। তোমাকে দিয়ে প্রেমিকের মতো কাজ করিয়ে নেই। হি হি হি। একবার আমার বান্ধবীর এক পাড়াতো প্রেমিককে দিয়ে আমরা হি হি হি গাছের ফল চুরি করাতাম হি হি হি হি। সে একবার ফল চুরি করার সুবিধার্থে লুঙ্গি পরে এসেছিলো। আমরা দেখে……….”

নীতু হাসতে হাসতে শুয়ে পড়লো। ওর চোখে পানি চলে এসেছে। ভোর হয়ে আসছে। বাচ্চাদের নামাজের জন্য আমার বাবা ডাকছে। আমার মা চেচিয়ে বাবাকে কি বলে জানি বকাবকি করছে। নীতু কয়েক সেকেন্ডে ঘুমিয়ে গিয়েছে। আমি খুব সাবধানে নীতুর গায়ে হাত দিলাম। আজকে আমি বরফ গলাতে পারিনি। কিন্তু চেষ্টা করতে করতে একদিন নিশ্চয়ই সবজি কাটতে গিয়ে হাত কেটে যাবে বা গাছে উঠতে গিয়ে পা ভেঙে যাবে। সেদিন নীতুর মন গলে যাবে। আমাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠবে। ব্যাস তখন থেকে আমার মন শান্ত হয়ে যাবে। এরপর আমরা মিলেমিশে সংসার করবো। আসন্ন সুখের কথা ভেবে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। জীবনের চুয়াল্লিশ বছর লেগেছে এই গাঢ় গভীর সুখ খুঁজে বের করতে। আর হাতছাড়া করার কোন প্রশ্ন উঠে না। আমি চোখ বন্ধ করে নীতুর কাছাকাছি গিয়ে শুয়ে পড়লাম। এতকাছে যতটা আগে কোনদিনও আসিনি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here