এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ৫

0
1410

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৫

“আরু শরীরে ১০৩° জ্বর বাঁধালি কীভাবে? রাতে তুই দিব্যি সুস্থ ছিলি। হঠাৎ কী এমন হয়েছে যে, কিছু ঘণ্টার ব্যবধানে এমন জ্বর বাঁধিয়েছিস?” বলে অপূর্ব ভাই জ্বর পরীক্ষা করলেন। দাঁতের ব্যথায় উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হলাম বাক্যটি। জবাব না পেয়ে ধৈর্যহারা হয়ে গেলেন তিনি। তিয়াস ভাই-কে আদেশ দিলেন ছোটো করে, “ট্রাভেলিং ব্যাগের ভেতরে ছোটো একটা ব্যাগ আছে। তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।”

তিয়াস ভাই পা বাড়ালেন। মাঝপথে থেমে গেলেন। ‘উফ্’ – মৃদু স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন। পায়ে হাত দিয়ে বসলেন মেঝেতে। পায়ের পাতায় গেঁথে যাওয়া ছোটো দানার মতো বস্তুটা হাতে নিল। ওদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে শব্দ করেন, “এটা দাঁতের মতো দেখাচ্ছে না?”

“কোথায় দেখি।” তিয়াস ভাই অপূর্ব ভাইয়ের হাতে বস্তুটা দিলেন। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “দেখ তো আরও আছে কি-না?”

সবাই একসাথে খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠল। তুর বিছানার নিচে রক্তমাখা সুতা পেল। শেফালী পেল জমাটবাঁধা রক্তের হদিশ। তিস্তা খুঁজে পেল আরও দুটো দাঁত। অপূর্ব ভাইয়ের নিকট এগিয়ে দিয়ে বলে তিস্তা, “ভাই এগুলো দাঁতের মতো লাগছে। কাঁচা দাঁত। মনে হচ্ছে কেউ তার শক্তপোক্ত কাঁচা দাঁত সুতা দিয়ে টেনে তুলেছে।”

অপূর্ব ভাই ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেন, “আরুর হাত পা চেপে ধর, যাতে একটুও নড়তে না পারে।”
বাক্য শেষ হওয়ার পূর্বেই আমাকে চেপে ধরল সকলে। জ্বর শরীর নিয়ে পেরে উঠলাম না। অপূর্ব ভাই স্পর্শ করলেন ওষ্ঠদ্বয়। মৃদু ফাঁক করে দেখলেন আমার দাঁতগুলো। সামনের দাঁত উধাও দেখে তার সন্দেহ পাকা পোক্ত হলো। গালটা চেপে ধরে রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন, “দাঁতগুলো ফেলেছিস কেন?”

ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম। চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কাঁতরাতে লাগলাম ক্রমাগত। ছেড়ে দিলেন। ব্যাগ থেকে ইনজেকশন সিরিজ বের করলেন। ওষুধ বের করতে করতে বললেন, “পেছনে ঘুরে শুয়ে পড়। আজ তোর পেছনে গরুর ইনজেকশন দিবো। মানুষের চেয়ে তিন লাইন বেশি বুঝিস তুই। গরুকে গরুর ইনজেকশনে মানায়।”

লাফ দিয়ে মামির কোলে উঠে গেলাম। ঝাপ্টে ধরে বললাম, “আমি গরুর ইনজেকশন দিবো না মামি। ওটা দিলে আমার পিছন শেষ হয়ে যাবে।”

শেফালী বিদ্রুপ করে বলে, “পাঁচ আটা চল্লিশ। (৫×৮=৪০)”

আমি রাগান্বিত দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। তেজ দেখিয়ে বললাম, “তোরটা চল্লিশ।”

অপূর্ব ভাই নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, “ওয়াক, থু, থু। এগুলো কোন দেশের ভাষা আরু? বাংলা নয়।”

কাঁচুমাচু মুখ করে ঠোঁট উঁচিয়ে বললাম, “আমি কিন্তু গরুর ইনজেকশন দিবো না।”

মামি আমার কান্না সহ্য করতে পারলেন না। বেলা তখন নয়টা বাজে। অপূর্ব ভাইকে নির্দেশ দিলেন তৈরি হতে। আমাকে নিয়ে সদরে জেতে ডাক্তার দেখাতে। মামুনি ধরে ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। মগে পানি নিয়ে ছাই দিয়ে দাঁত মেজে পরিষ্কার করলাম। মেজো চাচি মাটির চুলায় লাকড়ি দিচ্ছেন আগুন ধরাতে। ছোটো চাচি শিলপাটায় চাল পিষে এনেছেন। মেজো চাচির কাছে দিয়ে বলে, “ভাবী আমি ক্ষেত থেকে টাটকা কইল শাক তুলে আনি। খেতে বেশ লাগবে। তুমি গোলায় এক চিমটি হলুদ দিও, ঠান্ডা দূর হবে।”

চলে গেলেন ক্ষেত থেকে কলই শাক তুলতে। মুখ ধুয়ে বসলাম মাটির চুলার কাছে। শীত শীত লাগছে। গরম গরম খেতে ও তাপ পোহাতে সবাই চুলার কাছাকাছি বসেছে। আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম, “মামি তোমার সাথে আমিও যাই।”

“চুপ.. এখানে বসে থাক। কুয়াশা পড়ছে, গেলেই ঠান্ডা লাগবে। আরেকটু বেলা হলে অপুর সাথে সোজা ফার্মেসিতে যাবি।”

মামি চলে গেলেন। তাল দিয়ে চাপটি খেতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক পর মামি হাজির হলেন আমার স্কুল ফ্রক ও জুতা নিয়ে। গ্রামীণ শাড়ির আঁচলে কলই শাক। মাটিতে বসে বলে, “এগুলো তোর না-কি দেখ তো।”

আমি এপাশ ওপাশ করে বললাম, “হ্যাঁ, মামি। দুইটাই আমার। কোথায় পেলে তুমি, ঘর খুঁজে ফাতাফাতা করছি। পাইনি।”

খুঁজতে খুঁজতে ছেঁড়া পেলাম দু জায়গায়। যেন দাঁত দিয়ে কে/টে/ছে‌। মামি কলই শাক কুচি করতে বসলেন। বললেন, “কইল ক্ষেতে ইঁদুরের ধুলের ভেতরে। ইঁদুরেই এই কাজ করেছে। জামা কাপড় যেখানে সেখানে ফেলে রাখিস।”

ফ্রক রেখে জুতা হাতে নিলাম। তলা কেটে ফেলেছে। গালে হাত দিয়ে গান ধরলাম, “আমার জামা কাইট্টা করলি কী? জুতা কাইট্টা করলি কী? ওরে আমার ওন্দুর বাবা ঝিঁ..
আমি হাইকোর্টেতে বিচার দিমু, হাইকোর্টেতে বিচার দিমু, সাক্ষী রাখমু টিকটিকি। ওরে আমার ওন্দুর বাবা ঝিঁ।”

অপূর্ব ভাই ব্রাশ করে বসলেন টুল টেনে। চাপটি পেঁচিয়ে খেতে খেতে বলেন, “ওন্দুর বানান টা কী, জানিস?”

“অবশ্যই, ইঁ-দু-র = ওন্দুর।”

অপূর্ব ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কোন গ্ৰুপে পড়িস তুই?”

“বিজ্ঞান গ্ৰুপ।”

“তুই যদি ক্লাস নাইনে পড়তি, তাইলে এক্ষুনি গ্ৰুপ চেঞ্জ করতাম। কী দেখে বিজ্ঞান শাখা নিলি?”

“মামা বলেছে তোমার মতো ডাক্তার হতে।”

“আচ্ছা। না পড়েই আমার মতো বড়ো ডাক্তার আর হাতির পাঁচ পা দেখা সমান।”

__

গ্ৰামীণ হাটবাজার। এক কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। অপূর্ব ভাই গেলেন বাজার করতে। একদল যুবক দেখে রীতিমতো ভীত হলাম আমি। হাতে ক্রিকেট ব্যাট বল। ওড়না টেনে ঝোপঝাড়ের আড়ালে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে শিষ দিল। অন্যজন হেসে বলে, “দেখেছিস মেয়েটাকে? ঝাক্কাস কিন্তু।”

পাশে অন্য একটি ছেলে‌। বয়স কম নয়, আমার চেনা। তবে আমাকে চেনে কি-না, জানা নেই। গতবার হওয়া চেয়ারম্যানের ছেলে। আমাদের শ/ত্রু পক্ষ। আমাদের এলাকায় ক্ষমতাসীন দুই দল রয়েছে। এক দলে আমাদের আহসান বাড়ি, অন্যপক্ষে মৃধা বাড়ি। ছেলেটি কিছুক্ষণ অনুভূতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, “নাম কী তোমার?”

ভীত হয়ে প্রত্যুত্তর করলাম না। ততক্ষণে অপূর্ব ভাই ফিরে এসেছেন বাজার সমেত। থমথমে গলায় বলেন, “এখানে এতো ভিড় কীসের? যাও..

ছেলেটিকে দেখে খানিকটা সময় থমকে গেলেন। আমার হাতটা মুঠো করে ধরে মৃদু স্বরে বললেন, “আরু চল।”

অবাক করে ছেলেটি বলে, “ও আমাদের সেই আ..

অপূর্ব ভাই ফট করে বললেন, “ও তোমাদের কেউ না। ও আমাদের বাড়ির মেয়ে, আমাদের বোন।”

ভ্যানগাড়ি থামল বড়ো রাস্তার মোড়ে। শহর থেকে ফিরেছি। ইনজেকশন পুশ করার দরুন জ্বর কমেছে। অপূর্ব ভাই পাশাপাশি হাঁটছে আমার। হাতে ওষুধপথ্য। গায়ের শাল জড়িয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই, চুলের তেল ফুরিয়ে গেছে। কিছুটা তেল নিতে হবে।”

অপূর্ব ভাই পাশের মোদি দোকানে গেলেন। দোকানদার চাচার কাছে তেল চাইলেন। গ্ৰামে বোতলজাত করা তেল নেই, খোলা তেল। অপূর্ব ভাই চিন্তাগ্রস্থ হয়ে বললেন, “তোদের জন্য বোতলজাত ‘প্যারাসুট নারিকেল’ তেল কিনেছিলাম। ভুলে ঢাকাতে রেখে এসেছি। কাউকে পেলে পাঠিয়ে দিবো।
তুই কি এখন এই তেল নিবি, না-কি কালকে সদর থেকে এনে দিবো?”

“ছোটো থেকে খোলা তেল ব্যবহার করে আসছি। আপনি এটাই আধ কেজি নিয়ে নিন।” অপূর্ব ভাই আধ কেজি তেল নিলেন। তেলে কোনোক্রমে কেক পরেছে। কেকের গন্ধ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে খেয়ে নেই।
পথ ধরলাম বাড়ির। মাটির রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় খেজুর গাছের সামনে দাঁড়ালেন অপূর্ব ভাই। খেজুরের রস নামাচ্ছে চাষিরা। অপূর্ব ভাই হাড়ি হাতে তুলে অনুমান করলেন। কেজি খানেক আছে। উৎফুল্লিত মনে বলেন, “কেজি কত চাচা?”

“টাকা লাগবে না, আপনি এমনেই নিয়ে যান। টাটকা আছে। রাতে শরীরটা ভালো ছিল না, তাই নামাতে পারিনি।”

অপূর্ব ভাই হাতে টাকা গুঁজে দিলেন। চাষা হাসলেন। হাড়ি নিয়ে অগ্ৰসর হলাম। কিছুটা থেমে পিছিয়ে গেলেন। চাষাকে উদ্দেশ্যে করে অপূর্ব ভাই বললেন, “আমি দুটো খেজুরের পাতা নিতে পারি?”

“জি সাহেব।”
আপু ভাই খেজুর পাতা ছিঁড়ে চড়কি বানালেন। হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি ফুঁ দিলাম। ঘুরছে।
পাশ দিয়ে একটি যাত্রীবাহী ভ্যানগাড়ি অতিক্রম করল। অপূর্ব ভাই দাঁড়িয়ে আমাকে তুলে দিলেন ভ্যানে। তিনিও চড়লেন। মুক্ত বাতাসে খেজুর গাছের চড়কি ভনভনিয়ে ঘুরতে লাগল।

[চলবে .. ইন শা আল্লাহ]
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here