এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১

0
3150

শ্বশুরবাড়িতে আজই শেষদিন তিতিরের। শেষমেশ বাধ্য হলো দুই বছরের সংসার ছেড়ে আসতে। বিয়ের দুই বছর পেরোলেও তিতিরের স্বামী রাহান সেই যে বিয়ের তিনদিনের মাথায় হঠাৎ বার্তায় মি’শনের খবরে বাড়ি ছেড়েছিল আর ফেরেনি। সে একজন আর্মি অফিসার। তার কোনো খবরও কারও জানা নেই। সেদিনটা ছিল তিতির ও রাহানের বৌভাতের দিন। শ্বশুরবাড়ির আশেপাশের প্রতিবেশিরা প্রতিনিয়ত কানাঘুষা করে এমনকি তিতিরের চরিত্র নিয়ে প্রশ্নও তুলে! এতোদিন মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল কারণ তার বাবা সমতুল্য শ্বশুর ছিলেন তার মনোবল কিন্তু সেই মানুষটা যে আর নেই! গতকালই যে তাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে! অন্ধকার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করে রেখে এসেছে। তাই এই বাড়িতে আর থাকার মতো শক্তি বা আশা পেলো না। কার আশায়ই বা থাকবে? রাহানের? যে কীনা নতুন বউকে বিয়ে করেই ফেলে রেখে গেছে আর খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজোন বোধ করেনি! তার অপেক্ষায়? শাশুড়িমা, ননাশও সুযোগ পেলে কথা শোনাতে ছাড়ে না। বাড়িতে দেবরের বিয়ে ঠিক হয়েছে। দেবরের বউ বিয়ে করে বাড়ি এলে হয়তো সেও সেই দলে যোগ দিবে! তাই চলে আসাই সমীচীন মনে করল।

তিতিরের শ্বশুরবাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই তার শাশুড়ি বিগত ছয়মাস যাবত উঠতে বসতে খুঁত ধরে ও খোঁটা দেয়। তাদের নজরে হয়তো তিতির অপয়া, অলুক্ষুনে মেয়ে। হবে নাই বা কেনো? সবার চোখে তো তাই! নয়তো বিয়ে করে আসার পর বৌভাতের দিনই স্বামী লাপাত্তা হয়? শ্বশুর শয্যাশায়ী হয়? বাবার বাড়িতেও বাবা-ভাই বেঁচে নেই। মা ও ভাবী আছে। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিধবা ভাবী জীবিত হয়েও যেনো মৃ’তের মতো। আর মা তো হাইপ্রেশার ও ডাইবেটিসের রোগী। তাদের খরচ তিতির দুইটা টিউশন করে চালায়। এই টিউশন করা নিয়েও কম কথা শুনতে হয় না। রাত করে বাড়ি ফিরে বলে আশেপাশের মানুষজন কু’ৎসা রটায়,

“স্বামী নিঃখোঁজ আর বউটাকে দেখো! ঢেং ঢেং করে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। রাত-দিন নেই বাড়ি ফেরার। দেখো গিয়ে নতুন আশিক জুটিয়েছে হয়তো! নাহলে স্বামীর জন্য কষ্ট তো দেখা যায় না। দিব্যি আনন্দে আছে। ভাগ্য করে এমন শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে বটে। মেডিকেলে পড়াচ্ছে আবার এমন অপয়া মেয়েকে বাড়িতেও রেখেছে। আমি হলে কবে ঘাড় ধরে বের করে দিতাম।”

এসব শুনতে শুনতে তিতিরের আর গায়ে লাগে না। প্রথম প্রথম দরজা লাগিয়ে চিৎকার করে কাঁদত তখন শাশুড়ি রোকেয়া বেগম এসে বুকে আগলেও নিতো কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আশেপাশের বাহিরের আবরণ বিচারক মানুষদের মতো সেও তিতিরের ভিতরটা দেখা ছেড়ে দিলেন। পাড়া-প্রতিবেশিদের তো যাতায়াত লেগেই থাকে বাড়িতে। তারা সান্ত্বনা দেওয়ার বাহানায় পুরোনো ঘা*তে লবন লাগিয়ে যায়। আস্তে আস্তে শাশুড়িমাও বদলে গেলেন। শ্বশুরবাবা ব্যাতিত তিতিরের দিকটা বুঝার যেনো কেউ চেষ্টাই করত না। হাতের মেহেদীর রঙ শুকানোর আগেই বিচ্ছেদ! তখনও তো জানত না, তার অদৃষ্টে সাময়িক বিচ্ছেদকে দীর্ঘস্থায়ীতে রূপান্তর করা হবে। অপেক্ষা তো সে কম করেনি! এক-দেড় মাস পেরোতেই হাসি-খুশি তিতিরের ঠোঁটকোলের হাসি যেনো মূর্ছে যেতে লাগল। সারাদিন মনম’রা হয়ে থাকা ও বিকেল হলেই ছাদে গিয়ে হাঁটু ছড়ানো চুলগুলো ছেড়ে নির্নিমেষ অম্বরপানে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। এসব দেখে তিতিরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ওর শ্বশুরবাবা ওকে পড়াশোনায় ব্যাস্ত করার কথা ভাবে। পড়ালেখা নিয়ে ব্যাস্ত থাকলে সব ভুলে থাকবে তাছাড়া তিতিরে এইচএসসির রেজাল্টও খুব ভালো। এক প্রকার জোড় করেই তিতিরের শ্বশুর মোঃ ওসমান আলী তিতিরকে মেডিকেল কলেজের ফর্ম ফিলাপ করায়। লেখাপড়ায় ভালো হওয়াতে শেষ সময়ে রাত-দিন এক করে পড়ালেখা করে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা দেয় অতঃপর মংমনসিংহ মেডিকেল কলেজে চান্স পায়। সেসময় জোড় করে মেডিকেলে ভর্তি করেছিল বলেই তার পড়ালেখার সুযোগ হয়েছে। এইচএসসির পরেই বাবা-মা, ভালো ছেলে ও ঘর পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। তাই তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় শত অবহেলা, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনার শিকার হয়েও থেকে গেছিল। এখন সেই মানুষটা জীবিত নেই। তার শেষ সময়ে তিতির যেটুকু পেরেছে সেবা-শুশ্রূষা করেছে। মময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েও ভর্তির আগেই ফরিদপুরের মেডিকেলে এসে পরেছিল।

পেছন ঘুরে বাড়িটা দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিতির ট্রলি হাতে বেরিয়ে এলো। তার এখানের সময় যে ফুরিয়ে গেছে।
__________

আধঘণ্টার মধ্যে নিজের বাবার তৈরি করা এক তালা বাড়িটির সামনে রিকশা থেকে নামে। কলিংবেল চাপ দিলে তিতিরের মা নাজমা বেগম দরজা খুলে মেয়েকে ট্রলি হাতে দেখে মলিন হেসে দরজা ছেড়ে দাঁড়ান। তিতিরও মাকে জোরপূর্বক হাসি উপহার দেয়। তিতির ট্রলিটা রেখে বলে,
“হিয়া কই মা?”
“একটু ঘুমিয়েছে। মেয়েটা খেতে পারে না জানিসই তো। খেলেই বমি হয়।”
“ওহ আচ্ছা। আমি ওর জন্য কিছু রান্না করি তবে।”

তিতিরের মা মেয়েকে নিষেধ করে বললেন,
“মাত্রই এসেছিস একটু রেস্ট কর। আজ তো ক্লাসে যাসনি। রেস্ট কর। আমি একটু পর রিয়ার জন্য সবজি দিয়ে নরম খিচুড়ি রান্নাই করতাম।”

তিতির হালকা হেসে মাকে সোফায় বসিয়ে বলে,
“কিছু হবে না। তুমি গিয়ে রেস্ট করো। আমি রান্না করছি।”
“পারবি তুই?”
“আরে হ্যাঁ মা। ওই বাড়িতে প্রতিদিন রাতের জন্য রান্না ও শুক্রবার আমিই তো রান্না করি।”

তিতির মুখ ফসকে বলে ফেলে এখন নিজেই চুপ হয়ে গেছে। আর তো যাওয়া হবে না সেখানে। সব ছেড়ে এসেছে যে। নাজমা বেগম মেয়ের মাথায় হাত রেখে মলিন কণ্ঠে বলেন,
“আমাদের জন্যই আজ তোকে এই দিনটা দেখতে হলো। তোর বাবা তখন অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন বলে সময় থাকতে কন্যা বিয়ে দিতে চাইছিলেন। কে জানত? এতো ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়ার পরেও…”

“বাদ দাও মা। সব কিছু সবার জন্য হয় না। আমি যাই ডাল-চাল-সবজি ঠিক করি।”

“তোকে লোকমুখে অনেক বাজে কথা শুনতে হয় তাই না?”
মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে এই পী’ড়াদায়ক প্রশ্নের জবাবে বলে,
“লোকমুখে তো কতোকিছুই বলে। সব কি আমরা করি?”
“আশেপাশের মানুষ রাস্তায় দেখলেই বাজে কথা বলে। পাড়ার মোড়ের ব*খাটে সুজনও কথা শোনায়। সে তো এখন ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। ভয়ই হয়। হিয়া আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এখন তুইও এসেছিস। দুইটা যুবতী মেয়ে নিয়ে একা থাকাটা যেনো সমাজের চক্ষুশূল! বাড়ির আশেপাশে প্রায়ই সুজন, পলাশদের ঘুরতে দেখা যায়।”

“তুমি চিন্তা করো না মা। ওদের কাজই এসব। এই সুজনের হু’ম’কি-ধা’ম’কির জন্য বাবা আমার বিয়ে করিয়েছিলেন তাও জানি আমি। এখন আজকে আসার পথেও সে অ’শ্লীল ভাষা প্রয়োগ করছিল।”

নাজমা বেগম চিন্তিত হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
“আমার ভয় যে আরও বেড়ে গেল। কি করব আমি? তোদের নিয়ে এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে পারলে শান্তি পেতাম। কে জানত? আমার ছেলে-মেয়েদের জীবনেই যে এমন হবে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।”
“মা বাদ দাও। যা হয়ে গেছে তা গেছেই। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। হিয়াকে ঘুম থেকে তুলো।”

তিতির হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে চাল-ডাল ধুয়ে চুলোয় চড়িয়ে দেয়। তারপর সন্ধ্যা হলে মাগরিবের নামাজ পড়ে রান্নাঘরে যাওয়া ধরলেই কলিংবেল বেজে ওঠে। নাজমা বেগম আচমকা আঁৎকে ওঠেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
সূচনা পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here