এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৪১

0
1083

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪১
আরও দুটো দিন পেরোল। গতকালকে পৌঁছে মাশরিফরা আজ থেকে সিলেটে ত্রাণের বাহানায় নিজেদের লক্ষ্যের নিকটে এগুচ্ছে। এদিকে প্রায় ৪ দিন যাবত মাশরিফের কোনো খবরাখবর না পেয়ে তিতিরের মনের মধ্যে সার্বক্ষণিক অস্থীরতা বিরাজ করছে। ক্লাসে অমনোযোগীতার কারণে মাত্রই প্রফেসর ওকে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। তিতির বিনা প্রতিবাদে চুপচাপ মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছে। ক্লাসে বসা ওর বন্ধুরা অবাক নয়নে তিতিরকে বেরিয়ে যেতে দেখল। ওরা বুঝতে পারছে না, হুট করে কয়েকদিন ধরে তিতির কেমন মনমরা হয়ে থাকে। মন খারাপ কীনা জিজ্ঞেসা করলেও কথা কাটিয়ে যেত। আর আজ ক্লাসে এতোটা অমনোযোগী যে প্রফেসর ওকে ক্লাস থেকে বের করে দিল! নেহাত একটা গুরুত্বপূর্ণ টপিক পড়াচ্ছে, তাই ওরা কেউ বের হতে পারছে না।

তিতির ক্লাসরুমের থেকে বের হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার একাকি কোনো খোলামেলা জায়গায় যেতে ইচ্ছে হলো বলেই সে লেক পাড়ে গেল। সেখানে ঘাসের উপর বসে এক ধ্যানে শান্ত জলের দিকে নিমগ্ন হয়ে আছে। প্রায় ঠিক মাথার উপর সূর্যটা অবস্থান করছে করছে অবস্থা। তপ্ত রোদে মিনিট খানিক দাঁড়ালেই ত্বক পু*ড়ে যাওয়ার দশা হয়, সেখানে তিতির প্রায় অনেকটা সময় নীরবে এক ধ্যানেই বসে আছে। হঠাৎ উড়ন্ত পাখির মুখ থেকে কংকর শান্ত জলধিতে পতিত হওয়ার দরুণ শান্ত জলাশয় আন্দোলিত হয় যার বদৌলতে তিতিরের ধ্যান ভঙ্গ হয়। তিতির নিজে নিজেই করুণ স্বরে স্বগতোক্তি করে,

“খুব জলদি ফিরে আসুন। আমার এই আশংকা, ভয়-ভীতি, অস্থিরতার সমাপ্তি টানুন। আর তো হারাতে চাই না। আমার এখন নিজের ভাগ্যকে নিয়েই শংকা! আমার ভাগ্যের জন্য না আবারও এক মায়ের কোল খালি হয়! আমি জানি এসব ভাবা ঠিক না কিন্তু না চাইতেও আমার অবচেতন মনের ভীতি আমার চেতনাতে আ*ঘা*ত করছে। আমি কিছুতেই মন লাগাতে পারছি না। আমার সকল প্রার্থনাতে আপনি রাজ করছেন। প্লিজ ফিরে আসুন।”

বলতে বলতেই তিতির হাঁটু মুড়ে নিয়ে তাতে মুখ গুঁজে নিজের অশ্রধারা লুকাতে ব্যাস্ত।

ক্লাস শেষে কিছুক্ষণ পর তিতিরকে খুঁজতে খুঁজতে ওর বন্ধুরা শেষমেশ লেক পাড়ে উপস্থিত হয়। নাদিয়া ছাতা মা*থায় তিতিরের পাশে বসে বলে,
“এই তীব্র রোদের মধ্যে তুই বসে আছিস! তোর কি মা*থা খারাপ হয়ে গেছে? তুই এখানে বসে আছিস আর আমরা তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গিয়েছি। একটু বলে তো দিবি! মেসেজ তো করে দিবি যে কোথায় আছিস।”

তিতির জবাব দিল না। চুপচাপ লেকের পানির দিকে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। ওকে এরকম চুপ করে থাকতে দেখে জারিন মৃদু ধা*ক্কা দিয়ে বলল,

“কী-রে কী হয়েছে তোর? এমন করে বসে আছিস কেন? দুইদিন ধরে লক্ষ্য করছি তুই কেমন মনমরা হয়ে আছিস! তোকে জিজ্ঞাসা করলেই কিছু জবাব দিচ্ছিস না আবার বলছিস কিছু হয়নি। আর আজকে ক্লাসে এতটাই অমনোযোগী হয়ে গেলি যে স্যার তোকে ক্লাস থেকে বের করে দিতে বাধ্য হলো! বুঝলাম না আমি কিছু। আমাদের সাথে শেয়ার কর। শেয়ার করলে তোর মনটা হালকা হবে। বল কি হয়েছে?”

তাও তিতিরের কোন ভাবান্তর হলো না দেখে ফাইজা কিছুটা আইডিয়া করে বলল,
“তুই কি কোন ভাবে মাশরিফ ভাইয়ার জন্য চিন্তিত? উনি যাওয়ার পর থেকেই তুই কেমন খোয়া খোয়া ভাব! মানে বিয়ের পর থেকেই। এতো চিন্তা করছিস কেন?”

তিতির লেকের শান্ত জলের থেকে এ অবিরত আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল। এক তিক্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার মন থেকে। সে বলল,
“শূণ্য কলসিই বুঝে তার শূণ্যতার মানে।”

“হেয়ালি করিস না। আমাদের সাথে শেয়ার কর।”

জারিনের সাথে তাল মিলিয়ে জুলিয়া আদুরে কণ্ঠে বলল,
“কী হয়েছে তিতির? হোয়া হ্যাপেন্ড ডিয়ার?”

ইমরান ঘাসের উপর গা এলিয়ে দিয়ে নিজের দুই হাত মাথার নিচে রেখে আয়েশি ভঙ্গীতে বলে,
“স্বামীর বিরহে রমণী মূর্ছা যাবে যাবে অবস্থা। রমণী এখন দিন দুনিয়া ভুলিয়া তৃষ্ণার্ত ফটিকের ন্যায়… এই ফটিকই হবে না?”

ইমরান নিজেই নিজের পঙক্তির ভুল ধরে মা*থা চু-লকাতে চু*লকাতে উঠে বসে। রণক ওর মাথায় চা*টা মে*-রে বলে,
“চাতক পাখিটা বেশি যায় তবে তিতির পাখিও বলতে পারিস।”

লিরা সাবধানী সুরে বলে ওঠে,
“নো নো নো! তিতির পাখিতো কারও পারসোনাল রাইট। উই শুড কেয়ারফুল এবাউট দিস।”

“ওহহো! মাশরিফ জিজুওও!”

নাদিয়ার রম্য টানে তিতির মুখ ঢেকে হেসে ওঠে। তিতিরের বন্ধুরা এখনকার মতো ওর দুঃখী ভাব শূণ্যে উড়িয়ে দিয়েছে। আবারও হাসি-খুশি হয়ে ওঠেছে।

________
পরের দুই দিন আবারও ত্রাণ বিতরণ চলছে। আইডিকার্ডের নাম্বার ভ্যালিড কী-না সব চেক করে তবেই দেওয়া হচ্ছে। তাই জন্য দেরীও হচ্ছে। তিন দিনে কার্যকর্ম প্রায় শেষ। ঝড়-বৃষ্টির কারণে একদিন পর মুক্ষোম জায়গায় অ্যা*টাক করতে অগ্রসর হচ্ছে। মাশরিফরা প্রথমে দিনের বেলায় ওদের পজিশন বুঝে নজরে নজরে রেখেছে। তাছাড়া কাশফা, সুজন, পলাশের ফোনের মাধ্যে তথ্য জানা তো আছেই। টেরো*রিস্ট*রা যাতে লোকেশন ট্র্যাক না করতে পারে তাই অতিদ্রুত ওদের লোকেশন ঠিক রাখা হয়েছে। তারপর গভীর রাতের দিকে সেইসব ঘরে আ*গু*ন দিয়েছে। তার আশেপাশের বাড়ি ঘরের মানুষজন ভয়ে সরে গেছে। তাদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেও আসা হয়েছে। তারপর শুরু হয় গো*লা বর্ষণ!

গভীর রাত হওয়াতে টে*রো*রি-স্টরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তাছাড়া যেই হোটেল ঘর থেকে ওদের খাবার সাপ্লাই গেছে সেটাতেও কিছুটা নে*শা দ্রব্য মেশানো হয়েছিল। হোটেলের মালিক বুদ্ধিমান বলেই মাশরিফদের টিমকে সাহায্য করেছেন। বেশ কয়েকজন টে*রো*রি*স্টের স্পট ডে*থ হয়েছে। আর বাকি কয়েকজনকে আ*ট*ক করা হয়েছে।

________

সিলেট থেকে ষষ্ঠ দিনের মিশন শেষে ওরা সেনানিবাসে ফিরে আসে। সময় কম লাগার কারণ এবার আর্মি সদস্য প্রতিবারের তুলনায় বেশি ছিল এবং গুপ্তচ*রবৃত্তি!
টে*রো*রি*স্টদের রা-ষ্ট্রদ্রো-হীতার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়। আর আর্মি সদস্যদের দুই দিনের জন্য সেফটির জন্য সেনানিবাসে থাকার জন্য বলা হয়।(আমি জানিনা কতোদিন থাকতে হয় বা হয়তো থাকতে হয়ই না!)

মাশরিফ তার মাকে প্রথমে ফোন করে জানিয়ে তারপর তিতিরকে ফোন করতে উদ্দত হয়। মনের মাঝে এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে ব্যাপারটাতে। তিতিরের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা তাকে কল্পনা করাচ্ছে। নানারকম কল্পনা-ঝল্পনা শেষে মাশরিফ ফোন করেই বসে।
তিতির তখন আনমনে জানালা দিয়ে বাহিরে দেখছিল। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে ঘোর ভাঙে। ফোনটা হাতে নিয়ে কাঙ্খিত নাম্বার থেকে কল দেখে মন আনন্দে নেচে উঠে আবার পরক্ষণেই ভয় হতে শুরু করে। ঝড়-বৃষ্টির জন্য টিভির ঢিশ ঠিক নেই। ফোনেও নেটওয়ার্ক সমস্যা তাই খবরটা সে জানেনা। ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করে একদম চুপ হয়ে থাকে। দুই পক্ষেই কট্টর নিরবতা বিরাজমান। প্রায় মিনিট খানেক এভাবেই অতিবাহিত হওয়ার পর তিতিরের অস্থির নিঃশ্বাস যেন ক্রমবর্ধমান। মাশরিফই প্রথমে নিরবতা লঙ্ঘন করে।

“কেমন আছো তিতির?”

সাথে সাথে তিতির তার নয়ন জোড়া বন্ধ করে নেয়। সরু জলধারা মূহুর্তেই কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরে। তিতির নিজেকে ধাতস্থ করে ভাঙা স্বরে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন মেজর?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌। এখন তোমার কণ্ঠস্বর যেন আরও স্বস্থি দিচ্ছে। আমার অনুপস্থিতিতে যে কারো কণ্ঠ স্বরে তার হৃদয়ের লুকানো অনুরুক্তি প্রকাশ পাবে তা কেবল আমার কল্পনাতেই ছিল।”

মাশরিফের এহেনো সম্বোধনে তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। মাশরিফ আবারও বলল,
“আমার নামের প্রেম তোমার হৃদয় ও সর্বাঙ্গে বর্ষিত হোক তিতিরপাখি! যখন আমার আলতো ছোঁয়ায় তা অনিন্দ্য আবির রাঙা হয়।”

তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড ব্রীড়াতে ফোনটা কানে রাখাও যেন অসম্ভবপ্রায় হয়ে পরেছিল। খট করে কল কে*টে দিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here