এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৪

0
1592

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
তিতির ভ্রুঁকুঞ্চন করে উুঁকিঝুঁকি দিলো তবুও লোকটির মুখদর্শন হলো না। ঝড়বৃষ্টির রাত। মনে ভয় ভীতি যেনো ঝেঁকে বসেছে। তারউপর পুরুষালী কণ্ঠস্বর! সিঁড়ির ঘরের বাতিটাও টিমটিম করে জ্বলছে। বোঝাই যাচ্ছে, যেকোনো সময় ফিউজ হয়ে যেতে পারে। তিতিরের কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে আসছে। মনে কিঞ্চিত সাহস সঞ্চার করে নিভে যাওয়া কণ্ঠস্বরকে হালকা জোড়ালো করল,
“মাশরিফ ইকবাল কে?”

অপরপক্ষ থেকে জবাব এলো,
“ম্যাম আমি বিপদে পরেছি। আমার জিপটার ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না। কাছেই ম্যাকানিকের কাছে দিয়ে এসেছি। এখন এই ঝুম বৃষ্টিতে পুরোদস্তুর ভিজে গেছি। প্লিজ যদি একটু সাহায্য করতেন।”

তিতির ভাবনায় পরে গেলো। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বৃষ্টি প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত লাগাতার হচ্ছে। লোকটা ভিজে গেছে বুঝতে পারছে কিন্তু এক অচেনা লোককে বাড়িতে কিভাবে আশ্রয় দিবে? যেখানে বাড়িতে পুরুষ কেউ নেই! তিতিরের ভাবনার মাঝেই লোকটা পরপর দুইবার হাঁচি দিয়ে ফেলেছে। লোকটা জড়ানো স্বরে বলে ওঠে,

“ঠিক আছে ম্যাম সমস্যা নেই। আমি গেইটের কাছে এখানেই বৃষ্টি থামা অবধি দাঁড়াই। এখানে বৃষ্টির ছাঁট কম লাগছে।”
তিতির কিছুক্ষণ নিরব থাকে। লোকটার কথাবার্তায় ভদ্রতা পরিলক্ষিত। তাই কিছুটা মায়া লাগল। তিতির বলল,
“আপনি গেইটের ভিতরে এসে অপেক্ষা করতে পারেন। বৃষ্টির তেজ খুব তীব্র। আমি চাবি নিয়ে আসছি।”

তিতির বাড়ির ভিতরে ঢোকে ফ্রিজের উপর থেকে চাবি নিয়ে যাওয়া ধরলে ওর মা জিজ্ঞেসা করেন,
“কে এসেছে? তুই চাবি নিয়ে কই যাচ্ছিস?”
“একজন লোক বৃষ্টিতে ভিজে একটু আশ্রয় চাইছে। তাকে সিঁড়ির ওখানে চেয়ার নিয়ে দিবো। বৃষ্টি থামলে চলে যাবেন।”

নাজমা বেগম অবাক হয়ে বলেন,
“পা*গল হইছিস তুই? বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নাই আর তুই এক লোককে বাড়িতে আনতে চাইছিস?”
তিতির ওর মাকে বোঝাতে চাইলেন,
“মা বোঝার চেষ্টা করো। উনি ভিজে চুবচুবে পুরো। বাহিরেই তো বসবেন। একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে উনি যাতে অসুস্থ না হয় সেদিকটা দেখাও আমার দায়িত্ব।”

“তুই আছিস তোর দায়িত্ব নিয়ে। সে তোর প্যাশেন্ট না।”
“উফ মা থামো। অতো চিন্তা করো না। বাহিরেই বসাব। দরজা লাগানো থাকবে। লোকটা সাহায্য চেয়েছেন এখন সামান্য আশ্রয় না দিলে কেমন দেখায়।”
“যা মন চায় কর।”

নাজমা বেগম আবার রান্নাঘরের দিকে গেলেন। তিতির কেচিগেইটের তালা খুলে লোকটাকে ভেতরে ঢোকার জন্য বলতেই সিঁড়ির ঘরের বাতিটা ফিউজ হয়ে গেল! আলো আঁধারিতে মুখোমুখি দুইজন। তিতির অপ্রস্তুত হয়। ধীর কণ্ঠে বলল,
“আমি একটা চেয়ার আর মোমবাতি এনে দিচ্ছি। আপনি অপেক্ষা করুন।”

মাশরিফ এই অন্ধকারেই মৌন সম্মতি দেয়। তিতির বাড়ির ভিতরে ঢুকে একটা চেয়ার দিয়ে যায় সাথে ছোট কাঠের চৌকি। মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে আসে অতঃপর কাঠের ছোট চৌকিতে রেখে বলে,
“আর কিছু লাগলে জানাবেন।”
মাশরিফের কণ্ঠ এমনিতেও রুদ্ধ হয়ে গেছে। ভদ্রতা সূচক জবাব দেয়,
“জি।”
তিতির বাড়ির ভিতরে চলে এসে দরজাটা হালকা ফাঁকা করে রাখে। তিতিরের মা রাতের খাবারের জন্য ডাক দিলে তিতির মাকে আস্তে করে বলে,
“মা দেখো, বাহিরের লোকটাকে কিছু খাবার দিলে ভালো হতো। আমরা খাচ্ছি সে খাচ্ছে না। কেমন দেখা যায়। অতিথির মতো তো।”

নাজমা বেগম ব্যাপারটায় ভাবলেন অতঃপর বললেন,
“মাছ তো আমি তিন পিসই রান্না করেছি। এখন দিবো কিভাবে?”

“আচ্ছা। আমার পিসটা দিয়ে দেই। আমি নাহয় তরকারি দিয়ে খেয়ে নিবো।”

তিতিরের কথা শুনে ওর মা বলে,
“না। আমারটা দে। তোর প্রোটিনের দরকার আছে।”
“না। আমার এমনিতেও রাতেরবেলা মাছ খেতে ভালো লাগে না। আমারটাই দেই।”

তিতির মাশরিফকে ডাক দিয়ে বলে,
“আপনি ভিতরে এসে কিছু খেয়ে নিন।”
“না না। আমি কিছু খাব না। বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।”

তিতির এবার ওর মাকে পাঠায়। নিজে গিয়ে হিয়ার রুমে হিয়ার কাছে বসে। নাজমা বেগম বুঝিয়ে নিয়ে এসেছে তারপর রাতের খাবার খাইয়ে নিজেও চেয়ার নিয়ে মাশরিফের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। সাথে বৃষ্টির মধ্যে রংচাও করে নিয়েছে। নাজমা বেগমের স্বভাবই মিশুক প্রকৃতির। তিনি মাশরিফের সাথে জমজমাট আড্ডা বসিয়েছেন। কথা বলার মধ্যে মাশরিফ বলে,

“আন্টি আপনি বললেন, আপনার মেয়ে মেডিকেলে পড়ে। ময়মনসিংহতে চান্স পেয়েছিল। ভর্তির আগেই এখানে ট্রান্সফার হয়েছে। তাছাড়া এখানে কিছু মা*স্তানদের উৎপাতের কথাও বললেন। তাহলে আপনারা সবাই ময়মনসিংহতে চলে গেলেই পারেন। কিছু মনে করবেন না। তিনজন মেয়ে মানুষ একা থাকেন আবার মা*স্তা*নদের নজর পরেছে। আমার মনে হয় আপনাদের সব বিক্রি করে চলে যাওয়া উচিত।”

তিতিরের মা অবাক হয়ে ভাবলেন। তারপর চিন্তিত সুরে বললেন,
“কিন্তু বাবা, এই জায়গা জমি কে কিনবে বলো? আমরা অতো কিছু বুঝিও না। এই সুজন, পলাশদের জন্য সারাদিন ভয়ে ভয়ে থাকি। ছেলেটাও বেঁচে নাই। বউটার কয়দিন পর বাচ্চা হবে। বুঝতেই পারছ কিসের মধ্যে আছি।”

“জি আন্টি। আমার পরিচিত একজন আছে। যে এলাকায় খুব একটা জানাজানি না করেই সব মিটিয়ে ফেলতে পারবে। তার আগে আপনাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। আমি এই এলাকায় আগামীকালই শেষ। এসেছিলাম একটা কাজে। ফরিদপুর ক্যান্টনমেন্টে আমার পরিচিত আছে। আপনি আপনার মেয়ে-বউয়ের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন। আমি আমার নাম্বার দিয়ে যাচ্ছি। যোগাযোগ করলে আমি যথাসম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করব।”

“আচ্ছা বাবা। আমরা ভেবে দেখি। তুমি ভিতরে এসে বসো নাহয়।”
“না আন্টি। এখানেই ভালো আছি। আমার পকেটে মেডিসিন ছিল, খেয়ে নিয়েছি। তাছাড়া বৃষ্টিও কমে এসেছে। ম্যাকানিকের থেকে জিপটা নিয়েই চলে যাব।”
“যতক্ষণ আছে ভেতরে এসে বসতে।”

নাজমা বেগমের কথায় হাস্যজ্জল প্রত্যুত্তরে বলে,
“না আন্টি। আপনাদের ঝামেলাও আমি বুঝি। আপনারা যে আমায় একটু আশ্রয় দিয়েছেন তাতেই আমি কৃতঙ্গ।”

নাজমা বেগম আর জোড় করেন না। বৃষ্টি প্রায় থেমে গেলে মাশরিফ চলে যায়। নাজমা বেগম বাড়ির ভেতরে এসে হিয়া ও তিতিরকে খাওয়ার জন্য ডাকে। সুযোগ বুঝে পরে মাইগ্রেশনের কথা বলবে।

_________

পরেরদিন সকালে তিতির মেডিকেলে যাওয়ার জন্য একটু জলদিই বের হয়। বাড়ির বাউন্ডারির কাছে এসে দেখে ভেজা ঘাষের উপর একটা খাম পরে আছে। তিতির আশেপাশে কৌতুহলী হয়ে চেয়ে দেখল কেউ নেই অতঃপর কালক্ষেপণ না করে খামটা তুলে নিয়ে রওনা করে।
বাসে উঠে ব্যাগ থেকে খামটা বের করে পড়তে থাকে,
“কেমন আছেন তিতিরপাখি? আমি যে ভালো নেই! আপনি নামক এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আমি প্রচণ্ড রকমের আক্রান্ত। আমার চাওয়াটা অযৌক্তিক জেনেও অবচেতন মন তো মানে না। মনকে নিজের বশে রাখার চেষ্টাতে ব্যার্থ হয়ে আবারও তোমার শহরে এসেছি আপনাকে এক ঝলক দেখতে। আবার কাজের ব্যাস্ততায় চলে যাব। নিজেকে প্রচুর ব্যাস্ত রাখতে হবে যাতে আপনায় নিয়ে অন্যায় ইচ্ছা মনে না আসে। ভালো থেকো তিতিরপাখি।”

তিতির চিঠিটা পড়ে নির্নিমেষ চেয়ে আছে। কোনো অনুভূতি বুঝতে পারছে না। সে যে বিবাহিতা। এসব ভেবে নিজ মনে অন্যায় অনুভূতির জন্ম দিতে চায় না। এই বয়সে স্বাভাবিক এসবে আপ্লুত হওয়ার কিন্তু নিজের জীবনে যা ঘটে গেছে তাতে সে সবকিছুকে নজর-আন্দাজ করতেও প্রস্তুত।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here