এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৬

0
1253

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৬
সন্ধ্যার পর তিতির ও মাশরিফ ময়মনসিংহতে ফিরল। সারাদিন জার্নি শেষে অবসন্ন শরীর এখন বিশ্রাম চাইছে। তিতির নিজের ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় নিয়ে মায়ের ঘরে চলে গেল। মাশরিফ কিছু সময় সোফার ঘরে বসে থেকে শরবত খেয়ে একটু রেস্ট করতে গেল। মহিমা বেগমও ছেলের সাথে কথা বলতে ছেলের পিছু গেলেন। মাশরিফ বিছানার উপর বসা মাত্রই মহিমা বেগম ছেলের পাশে এসে বসলেন তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,

“হ্যাঁ রে, ওখানে কোনো ঝামেলা হয়নি তো? সব ঠিক ছিল?”

মাশরিফ ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“হয়েছিল। মিটেও গেছে।”
“কী হয়েছিল?”
“মেজর রাহানের বোন উলটা-পালটা কথা বলছিল। বাদ দাও সেসব। ওসব মনে করলেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”

মহিমা বেগম আর ঘাটালেন না। তিনি এবার উৎসাহী কণ্ঠে বললেন,
“আমি নাজমার সাথে কথা বলেছি।”

মাশরিফ ফোন স্ক্রল করতে করতে বলল,
“কী ব্যাপারে?”
“তোর ও তিতিরের বিয়ের ব্যাপারে।”

প্রথম দফায় পাত্তা না দিলেও দ্বিতীয় দফায় আচমকা ঘুরে তাকায়। অতঃপর বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
“কী বললে?”

ছেলের প্রতিক্রিয়াতে মহিমা বেগম হাসলেন। তিনি বললেন,
“তোর খালা তো রাজি। এখন তিতির রাজি হলেই হলো। তারপর ঘরোয়া ভাবে বিয়ে পড়িয়ে রাখব। তোদের যখন সময় হবে তখন তোদের মতো ভাববি।”

মাশরিফ তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আগে থেকেই এতোকিছু ভেবে রাখছ যে! মেইন মানুষটাই তো রাজি হবে না। তুমি দেখো, তিতির রাজি হবে না। বাদ দাও ওসব।”

“আগে থেকে নেগেটিভ ভাবিস কেন? রাজিও তো হতে পারে।”

“দেখা যাক। কাল সকালে কিন্তু জলদি বের হতে হবে। খুব সকালে বের হবো।”

মহিমা বেগম বললেন,
“সব গুছিয়ে রাখ তবে। আমার তো ক্লাসও আছে।”

“এই গোঁছানোর ঝামেলাই হতো না যদি গতকালকেই চলে যেতাম। আজ নাহয় ওখান থেকে এসে তিতিরকে নিয়ে বেরোতাম। থাকার জন্যই শপিং করতে হলো, এখন সেগুলোও টানতে হবে।”

“থাক। দুইটা দিনই তো। কাছাকাছি থাকলে সম্পর্ক গভীর হয়।”

_________
এদিকে নাজমা বেগম ও হিয়া তিতিরের দুইপাশে বসে ওই বাড়িতে কিছু হয়েছে কীনা জানতে চাইছে। তিতির অনেকটাই ক্লান্ত। তাও মা ও ভাবির আগ্রহে বলতে শুরু করে,

ফ্ল্যাশব্যাক,,
রোকেয়া বেগম যখন রুমিকে চলে যেতে বলেন তখন রুমি রেগে কান্নারত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ওহ! এখন বড়ো ছেলের বউকে দেখে দরদ উতলে ওঠছে? এখন আর আমাকে লাগে না তাই না? তোমার বড়ো ছেলের বউ! তোমার লক্ষী বউ! কত লক্ষী দেখো, এখনই পরপুরুষ সাথে নিয়ে করে ঘুরছে! নির্লজ্জ মেয়ে। সে যে বিধবা সেটা মনে হয় ভুলেই গেছে। এভাবে চলাফেরা করলে কে বলবে সে বিধবা? চরিত্রহীনা একটা।”

রুমি কথাগুলো বলে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। রোকেয়া বেগমেরও চোখ দিয়ে পানি পরছে। মাশরিফ প্রতিবাদ করে বলে,
“আমি বুঝতে পারছি না, আপনার কী সমস্যা হচ্ছে? তিতির কীভাবে চলবে না চলবে এটা সম্পূর্ণ ওর ব্যাপার। আপনি ওর চরিত্রে আঙুল তুলতে পারেন না। রাহান স্যারের মৃত্যুর অনেকটা সময় হয়ে গিয়েছে। টে*রো*রিস্টদের বলা সময় অনুযায়ী প্রায় দেড় বছর! আর স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর ইদ্দতকাল ৪ মাসের মতো। বহু আগেই তিতিরের ইদ্দতকালও শেষ। রাহান স্যারের মৃত্যুর খবর জেনেছে সেটাও ছয় মাসের মতো হয়েছে। তাহলে কেন সে নিজের মতো থাকতে পারবে না? আপনাদের বাসায়ও তো থাকার মতো পরিবেশ রাখেননি। এখন আপনি কী চান? ও ম*রে যাক?”

রুমি চোখ মুখে ফুঁসতে ফুঁসতে চিৎকার করে বলে,
“ও আমাদের বাড়িতে আসবে কেন? ওর জন্য আমার ভাই আজকে আমাদের সাথে নাই। অ*পয়া, অ*লক্ষী একটা! আমাদের পরিবারটা তছনছ করে দিয়েছে।”

রুমির অযৌক্তিক অভিযোগে মাশরিফ প্রচণ্ড বিরক্ত হয়। এদিকে তিতিরের দিকে নজর গেলে দেখে তিতির চোখ বন্ধ করে দাঁত দাঁত চেপে কান্না আটকে রাখার চেষ্টায় আছে কিন্তু বে*ই*মান লোচন বিরোধিতা শুরু করছে। কপোল বেয়ে দুঃখের দরিয়া বইয়েই চলেছে।
মাশরিফ তিতিরের এই অশ্রসিক্ত নেত্রপল্লব দেখে নিজের রাগ সংবরণ করতে পারল না। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করে,

“আপনাদের পরিবার তছনছ হয়েছে? কিন্তু, আমার তো মনে হয়, এই মেয়েটার (তিতিরকে দেখিয়ে) জীবন তছনছ হয়েছে! একবার নিজেকে ওর জায়গায় কল্পনা করে দেখুন তো! দম আটকে ম*রে না যান! প্রথমেই বলা হয়েছে, তিতির আজকে এখানে এসেছে আপনার মায়ের বিশেষ অনুরোধে। তিতিরকে যা তা বলে আপনি যে বিবেক বুদ্ধিহীন সেটাই বারবার প্রমাণ করছেন। আর সাদিক সাহেব, আপনার স্ত্রীকে এখান থেকে দয়া করে নিয়ে যান। যতক্ষণ আমরা এখানে আছি ততক্ষণ দয়া করে আপনার স্ত্রীকে আমাদের থেকে দূরে রাখুন। এবার অন্তত তার বেপরোয়া জবানে লাগাম টানুন!”

রুমির স্বামী সাদিক আর একটুও অপেক্ষা করলেন না। রুমিকে জোর করে টেনে নিয়ে যান। রুমি চলে যাওয়ার পর রোকেয়া বেগম চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিতিরের হাত নিজের মুঠোবন্ধি করে অনুনয়ের স্বরে বলেন,

“আমাকে মাফ করে দিস রে। আমি তোকে আসতে বলেছি বলে তোকে আজ এত কথা শুনতে হয়েছে। আমার মেয়েটা যে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু দোষ তো আমারই। আমিই প্রথমে ওর লাগাম টানিনি। ওর কোন কথা মনে নিস না।”

কথাগুলো বলতে বলতে রোকেয়া বেগমের চোখ আবারও ভিজে ওঠে। তিতির নিজের এক হাত ছাড়িয়ে রোকেয়া বেগমের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,

“আমার সব সয়ে গেছে মা। রুমি আপুর ব্যবহার যে এরকম আমি জানি। কমতো আমার সাথে এরকম ব্যবহার করেনি! দোয়া করি, আল্লাহ উনাকে হেদায়েত দিক। ”

রোকেয়া বেগম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলেন,

“তুই তোর জীবনটা নতুন করে শুরু কর। সুন্দর করে শুরু কর। কোন কালো ছায়া যেন তোর জীবনে না আসে। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। একজনের জন্য জীবনকে থামিয়ে রাখা মানে বোকামি। জীবন তার নিজ গতিতে চলে। সময়, প্রয়োজন ও মনের তাগিদে জীবনে কিছু মানুষের আনাগোনা ঘটে। তোর বাবা (শ্বশুর) আমাকে বলে গিয়েছিলেন, আমি যেন তোর জীবনটা গুঁছিয়ে দেই। তিনি হয়তো আগেই সবটা বুঝে গিয়েছিলেন। তুই তো জানিস, মানুষটা তোকে কখোনো পুত্রবধূর দৃষ্টিতে দেখেননি। নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার এই মেয়ের জীবনটা সুন্দর হোক। আমিও হয়তো খুব বেশিদিন বাঁচব না। তোর জীবনটা সুন্দর হয়েছে দেখে ম*র*তে পারলেও শান্তি।”

তিতির চোখ মুছে ভাঙা কণ্ঠে অভিযোগ করে ওঠে,
“এসব অশুভ কথা বলবেন না। আপনি অনেক বছর বাঁচবেন। আপনার এই মেয়ের সুন্দর জীবন মন ভরে দেখবেন। কিচ্ছু হবে না আপনার।”

রোকেয়া বেগম অশ্রুস্নাত চোখেই হালকা হাসেন। অতঃপর বলেন,
“নারে, মন থেকে সাড়া পাই না। তোর সুন্দর, সুখী জীবন দেখার তৃষ্ণা নিয়ে দুনিয়া ছাড়তে চাই না।”

তিতিরের কাছে চোখের জল ছাড়া আর কোনো জবাব দেওয়ার মতো নেই। যতোটা সময় এখানে থাকবে ততো তার হাঁসফাস লাগবে তাই জলদি বিদায় নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।

ফ্ল্যাশব্যাক শেষ,,

সব শুনে নাজমা বেগম ও হিয়ার চোখেও পানি জমে ওঠেছে। তিতির মুখ ঢেকে কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। হারাতে হারাতে সে খুব ক্লান্ত। রোকেয়া বেগম তাকে কষ্ট দিয়ে অনেক কথা বললেও তার ভালোবাসার পরিমানও তিতির ঠাওর করতে পারে না। তিনি যখনই কষ্ট দিয়ে কথা বলেছেন, তা যে এক সন্তানহারা মায়ের ক্ষোভ ছিল, তিতির ওটাই মানে।

নাজমা বেগম বলেন,
“আমারও মনে হয় এবার তোর নিজের জীবনটাও গোঁছানো দরকার। হায়াত-মউতের কোনো বিশ্বাস নাই। আমিও তো ম*রে যেতে পারি!”

কথাটা শোনামাত্রই তিতির উচ্চরব করে ওঠল,
“তুমিও! তোমরা শুরুটা করেছ কী হ্যাঁ! এরকম অশুভ কথা বলেই যাচ্ছ।”

“মিথ্যা বলতেছি নাকি? সত্যিই তো। আজ আছি, কাল থাকব কীনা কে জানে? আমারও তো তোকে, হিয়াকে, হায়াতকে নিয়ে চিন্তা হয়।”

“তাহলে ইনডাইরেক্টলি শুধু আমাকে বোঝাচ্ছ কেন? হিয়াকেও বলো।”

হিয়া তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আমাকে বলে না তোকে কে বলল? আমার একটা বাচ্চা আছে। মা যেমন আমাদের কথা ভাবেন তেমনি নিজের আগে আমারও ওর কথা ভাবতে হয়। আমার তো তাও একটা বাচ্চা আছে যাকে ঘিরে আমার চলে যাবে। কিন্তু তোর? কিসের টান তোর? বিনা সংসারে বিধবা তুই। অতীতকে ভুলে সামনে আগা। তোর পীড়াদায়ক অতীত ভুলতে হবে। আমাকে দেখ! অতীতটাই সুখময়। আমার অতীতটাই আমার বাকি জীবন বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। নিজের জন্য আমি কিছু করছি না, আমি নিজেকে নিজের মেয়ের জন্য গোঁছাচ্ছি। মেয়ের আইডল হতে চাই। আমার মেয়ের বিয়ের আগে ওর একটাই বাবা হবে। সেটা তিয়াস। আর কেউ না।”

তিতির হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। নাজমা বেগম হুট করে বলেন,
“শোন না, তোর মহিমা খালা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি তো রাজি। তুইও রাজি হয়ে যা না। মাশরিফ কিন্তু ছেলে হিসেবে খুব ভালো। আর তোর মুখে আজকের ঘটনা শুনে বুঝলাম, তোর জন্য ওই সেরা। উন্নতমনা ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারী। তোকে সবসময় আগলে রাখবে। তাছাড়া চেনা-জানার মধ্যে। রাজি হয়ে যা না মা!”

তিতির হতচকিত হয়ে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়। উপস্থিত শব্দবাণে সে বাকরুদ্ধ।

________

সুজন ও পলাশের সহচরদের একজন সন্ধ্যার পর যখন সুজনের ফোন খোলা পায় তখন ফোন করে বলে,
“ওস্তাদ, একটা খাসা খবর আছে। আপনে হুনলে আপনার পরান ঠান্ডা হই যাইব।”

সুজন গ্লাসে নে*শাপানি ঢালতে ঢালতে বলে,
“তো কার লাইগ্যা বইয়া রইছস ******! ক তাড়াতাড়ি।”

“আপনের ময়নাপাখি তো আজকা ফরিদপুরে আইছিল!”

কথাটা শুনে সুজন সোজা হয়ে বসে। প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলে,
“কস কী? কখন?”

“আমি তো দুপুর দেখছি মেডিকেল কলেজের গেইটে। তয় লগে একটা বেডাও আছিল। আমি আবার ছবি তুইল্লা রাখছি। ”

“দে জলদি ছবি দে। আবার কোন ভা*তার জুটাইছে এই ছেঁ*ড়ি!(অনেক অশ্রাব্য শব্দ আমি এড়িয়ে গেলাম)”

সুজনের সেই সহচর ইমোতে ছবি পাঠালে সুজন ছবি জুম করে তিতিরের সাথের ব্যাক্তিটির চেহারা বুঝার চেষ্টা করছে। সে মোটামুটি বুঝতে পারছে তাও এর সত্যতা বিচার করতে পলাশকেও দেখায় তারপর দলের এমন কেউ যে নে*শা করেনি তাকেও দেখায়। তারা বুঝতে পারে সাথের ব্যাক্তিটি কে!

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here