এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ৩৬+৩৭

0
379

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৩৬+৩৭

দালানকোঠার ফাকফোকর দিয়ে পশ্চিমাকাশের বিকেলের রোদ কিঞ্চিত দেখা যায়। তবুও শীতের জড়তায় আশপাশ কিছুটা চুপচাপ। পাশের রোডটায় একদল ছেলে ব্যাডমিন্টন খেলছে,তাদের আওয়াজ পাওয়া যায়। তবে এ পথ দিয়ে মানুষের আনাগোনা কম। জ্যাকেটের সামনের খোলা চেইন দুবার উপরনিচ করলো আরাব। তারপর টেনে একেবারে খুলেই ফেললো জ্যাকেটটা। পাশেই রাখা বাইকের উপর রাখলো ওটা। পকেটে হাত গুজে উকিঝুকি দিতে দিতে হাটতে লাগলো। দোয়ার আসার অনেক আগেই পৌছে গেছে ও। আগেরদিন তাজীনের সাথে কথা বলে রীতিমতো নিশ্চিত ও,আজ দোয়া ওকে ভালোবাসি বলবে। তাই আগেআগেই চলে এসেছে। যদিও জানতো,দোয়া নিজের কাজ সেরে তবেই আসবে। তবুও!

বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর দেখা মিললো দোয়ার। সাদা কামিজ,কালো চুরিদাড়,কালো ওড়না,মলিন বিনুনি,চপ্পল। আরাবের প্রথম প্রেমের শিহরনজাগানো সেই সাধারন মেয়েটা। মাথা নিচু করে ওর দিকেই এগোচ্ছে দোয়া। আরাব মুগ্ধচোখে দেখতে লাগলো ওকে। দোয়া নিরবে ওর সামনে এসে দাড়ালো। ওর কপালের সামনে থাকা কিছু ছোট চুল মৃদ্যু বাতাসে উড়ে উঠলো। আরাব নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো শুধু। আর ওড়না খামচে দাতে দাত চেপে রইলো দোয়া। তাকিয়ে রইলো আরাবের হাতের ঘড়িটার দিকে। আরাব বললো,

-সেদিন পুরো কথাটা বলিনি। বললেও সেটা তোমার সামনে বলিনি। আজ বলবো।

-তার আগে আমি বলতে চাই।

-উহুম। কথা ছিলো আমার ভালোবাসি বলার বিপরীতে তুমি ভালোবাসি বলবে। তাই আগে আমিই বলবো!

ছলছল চোখে আরাবের দিকে তাকালো দোয়া। আরাব একমুহুর্ত দেরি না করে বলে দিলো,

-তোমাকে ভালোবাসি দোয়া। আই লাভ ইউ!

টুপটাপ দু ফোটা চোখের জল বেরিয়ে এলো দোয়ার চোখ থেকে। কপাল কুচকে এলো আরাবের। নিজেকে দুর্বল হওয়ার সুযোগ দেয়নি দোয়া। একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-ভালোবাসি না।

পাশে থাকা ল্যাম্পপোস্টটা ধপ করে একহাতে ধরলো আরাব। চোখ বন্ধ করে একটা জোরে শ্বাস নিলো। দোয়া পাথর হয়ে আছে। শুধু অনুভবের চেষ্টা করছে,ঠিক কতোটা কষ্ট দিয়েছে ও আরাবকে। আরাব চোখ মেলে সোজা হয়ে দাড়ালো। জোরপুর্বক হেসে বললো,

-প্লিজ দোয়া। আজ না। আজকে আমি তোমার লাজুকতায় হারাবো বলে এসেছি। আজকে কঠোর হয়ো না প্লিজ। আজকে কিন্তু আমি কোনো আপোষ করতে পারবো না!

দোয়া একটা জোরে শ্বাস নিলো। আবারো বললো,

-আমি সত্যিই‌ ভালোবাসি না আপনাকে আরাব। হ্যাঁ মানছি,অনেক আগেই আমার কথাটা বলে দেওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সময় আর পরিস্থিতি…

কথা শেষ করতে পারলো না দোয়া। আরাবের হাসিটা দেখে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। আরাব শান্তভাবে বললো,

-আন্টি,দিয়ানের কথা ভাবছো?

বিস্ময়ে তাকালো দোয়া। আরাব ভ্রু নাচিয়ে জবাব চাইলো নিজের। দোয়া চোখ নামিয়ে বললো,

-না। বিষয়টা আপনি।

-আমার অপরাধ?

দোয়া আটকে গেলো। আরাবের সেই মুচকি হাসিটাই। ইতস্তত করতে করতে বললো,

-আ্ আমাকে জানান নি কেনো? আপনিই টুইঙ্কেলের মামা। তৌফিকা আপু আপনার বোন।

আরাব শব্দ করে হেসে দিয়ে বললো,

-এটা কারন?

দোয়ার চাওনি দেখে হাসি থামালো আরাব। চেহারায় গম্ভীরতা আনার চেষ্টা করে বললো,

-স্টুডেন্টের মামা বিষয়ে তোমার এক্সপ্রেশন,এক্সপেরিয়েন্স দুটোই জানি আমি দোয়া। বললে তখন থেকেই ঘৃনা করতে আমাকে। আমি জানি।

-এটা কি ঠকানো নয় মিস্টার আরাব?

-না। এটা ভালোবাসা!

দোয়া দমে গেলো। একটা শুকনো ঢোক গিলে আবারো বললো,

-আ্ আপনি আমার জন্য,শুধুমাত্র আমার জন্য ভার্সিটিতে স্কলারশিপ,বাস গ্রান্ট করিয়েছেন।

-হুম। মুখ্য কারন তুমি ছিলে। তবে তাতে শুধু তোমার উপকার হয়েছে,এমনটাও নয় দোয়া!

-এটা কি দয়া দেখানো নয় মিস্টার আরাব?

-না তো! এটাও ভালোবাসা!

-আপনি রনোককে মেরেছেন। গুন্ডামো করেছেন একপ্রকার!

-সেটাও ভালোবাসা ছিলো!

-একটা রেপড্ মেয়ের প্রতি ভালোবাসা,ভালোবাসা হয় না আরাব। ওটাকে দয়াই বলে।

আরাব দোয়ার দিকে তাকাতেই ভেতরটা ধুক করে উঠলো দোয়ার। এতোগুলো দিনের পরিচয়ে,এতোগুলো কথার ভীড়ে কোনোদিনও এমন দেখেনি ও আরাবকে। ওর চোখজোড়া রক্তলাল হয়ে আছে। দোয়া শুকনো ঢোক গিললো। আরাবের এই রুপের সাথে ও পরিচিত নয়। রাগে গলার,কপালের রগগুলো অবদি ফুটে উঠেছে আরাবের। আরাব দাতে দাত চেপে বললো,

-তোমাকে কোথায় এই কথাটা শুনতে হয়েছে দোয়া?

দোয়া একবার আরাবের মুঠো করা হাতের দিকে তাকালো। ওইটুকো সময়েই যেনো ঝড় বয়ে গেলো ওর চারপাশ দিয়ে। আরাব চেচিয়ে বাইকটা লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে। ঘুরে উঠে পাশের এক দেয়ালে দুটো পান্চ মেরে চুলগুলো দুহাতে উল্টে ধরলো নিজের। আবারো দোয়ার দিকে ফিরে বললো,

-এসব কে বলেছে তোমাকে দোয়া?

আরাবের শীতল স্বরে শিরদাড়া হিম হয়ে উঠলো দোয়ার। ভীতগ্রস্ত হয়ে বলে দিলো,

-আ্ আমি চাইনা আমার জন্য আপনার পরিবারে কোনো অশান্তি নেমে আসুক।

আরাব শান্ত হলো। একটা বৃহৎ শ্বাস ফেলে মৃদ্যু হাসিতে দোয়ার সামনে দাড়িয়ে বললো,

-এটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না দোয়া। আমি জানি তুমি পবিত্র। আমার পরিবার জানে তুমি পবিত্র!

-আপনার মুখের কথায়…

-আমার মুখের কথায় নয় দোয়া! আমি নিজে রনোক আর সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ওই মহিলাকে…

চেচিয়ে বলতে গিয়েও থেমে গেলো আরাব। দোয়া নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। একটা মানুষে এতোটা গভীর চিন্তাভাবনা কি করে সম্ভব? আরাব মুচকি হেসে ওরদিক এগিয়ে একহাতে কোমড় জরিয়ে ধরলো ওর। কাছে টেনে নিলো অনেকটাই। দোয়া একবার আরাবের হাতের দিকে তাকিয়ে আবারো ওর দিকে তাকালো। ওভাবেই মুচকি হাসছে আরাব। আরেকহাত দোয়ার গালে রেখে আরাব বললো,

-আমার পরিবার অধীর অপেক্ষা করে আছে,তোমাকে আপন করবে বলে। ওই শব্দটা যে তোমার জন্য নয়,তা অনেক আগেই বুঝে গেছে ওরা।

….

-আমাকে দুরে সরনোর কোনোদিনও তু‌মি কারন খুজে পাবে না দোয়া! প্লিজ ডোন্ট ট্রাই টু ডু ইট!

কিছুক্ষন মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো দোয়া। তখনই ওর চোখ গেলো আরাবের বুকপকেটে থাকা আইডি কার্ডটায়। ঝারা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো তখনই। আরাব ভ্রুকুচকে তাকালো। দোয়ার চোখ ছলছল করছে। আরাব বোঝার চেষ্টা করছে,কি এমন হয়েছে দোয়ার। ভালোবাসা স্বীকার করবে বলে এসে এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেনো করছে ও? একটু চুপ থেকে দোয়া একপ্রকার চেচিয়ে বলে উঠলো,

-কারন শুনতে চান আপনি? কারন? তাহলে শুনুন! কোনোদিনও আপনাকে ভালোবাসবো না আমি! কারন…কারন আপনি একটা খুনি! যাদের জন্য আমি পিত্যৃহারা,যাদের জন্য আমার মা বিধবা,যাদের জন্য আমার পুরো পরিবার সর্বহারা,তাদের মধ্যে আপনিও একজন!

আরাব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো দোয়ার দিকে। দোয়া কাদতে লাগলো এবার। ও জানে,আরাবের কোনো দোষ ছিলো না ওর বাবার মৃত্যুতে। এতোদিন যে ঘৃনা পুষে এসেছে বায়োমেডির প্রত্যেকটা সাইন্টিস্টের উপর,আরাবের ভালোবাসা আর সুমনের ধোকা,দুটোতেই ও মানতে বাধ্য হয়েছে,আরাব তো নিজের দায়িত্বপালন করেছিলো মাত্র সেদিন। তবুও আজ ফিরিয়ে দেবে ও আরাবকে। দিতেই হবে! ও চায়না ওর জন্য আরাবের পরিবারে কোনো অশান্তি নেমে আসুক। তাই যে করেই হোক,আরাবকে ওর জীবনে আর জড়াতে দেবে না ও। দোয়া কাদতে কাদতেই বললো,

-আপনাদের মতো কিছু সাইন্টিস্টের জন্য আমি অনাথ আরাব! আমি অনাথ!

…..

-মনে পরে মিস্টার আরাব? ডক্টর সাফাত রওশনের ভুল এন্টিডোড তৈরীর স্বপক্ষে আপনারা…আপনারা যারা তার টিমে ছিলেন,সবাই স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। ওই আটজন বাচ্চার মৃত্যুর জন্য আপনারা সবাই তাকেই দায়ী করেছিলেন। কিছু মনে পরে ডক্টর তাহসানুল আরাব?

আরাব নিশ্চুপ। দোয়া কাদতে কাদতে বললো,

-মনে নেই? হ্যাঁ ভুলে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক! কেনো মনে রাখবেন আপনি সাফাত রওশনের কথা? যে কিনা নিজ দোষে শাস্তিভোগ করেছিলো! তাইনা? কিন্তু তার অবর্তমানে তার পরিবার,তার স্ত্রী সন্তান কেমন থাকতে পারে সেটা ভেবেছেন একবারও? ভেবেছেন কখনো,তাকে ছাড়া কিভাবে বেচে আছে তার পরিবার? ভেবেছেন?

দোয়া আরো জোরে কাদতে লাগলো। আরাব হাত বাড়িয়ে একপা এগোলো ওর দিকে। দোয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

-ভাবেননি। আজ দেখে নিন মিস্টার আরাব। আমিই সেই হতভাগী মেয়ে,যে নিজের বাবার উপরের এতোবড় মিথ্যে অপবাদ এতোদিনেও মেটাতে পারিনি। নিজের মা,ভাইকে তাদের প্রাপ্য দিতে পারিনি! কিছুই করতে পারিনি আমার নিজের পরিবারের জন্য। আমিই সাফাত রওশনের সেই অক্ষম মেয়ে,তাকওয়াতুল দোয়া!

চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস ফেললো আরাব। দোয়া বলতে লাগলো,

-যার সাথে এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন আপনারা,তাকে চিনতেন না আপনারা মিস্টার আরাব? জানতেন না উনি কেমন মানুষ? তবুও! তবুও একটাবারও ভাবেন নি,ডক্টর রওশনের মতো লোক জেনেবুঝে কখনোই আট আটটে নিস্পাপ শিশুর প্রান নিয়ে খেলার মতো মানুষ নন! একবারও ভাবেন নি আপনারা। আপনারা আপনাদের মতো বলে দিলেন,এক্সপেরিমেন্ট ভুল হয়েছিলো তার,ফর্মুলায় ভুল ছিলো তার,ওই আটটে বাচ্চার মৃত্যুর জন্য সে দায়ী! কিন্তু সত্যি তো এটাই,আপনাদের মধ্যেরই কেউ তার এন্টিডোড তৈরীর ফর্মুলা চুরি করে নিয়েছিলো। আপনাদের মধ্যেরই কেউ এক্সপেরিমেন্টের সময় বাচ্চাগুলোকে ভুল কোনো ডোজের এন্টিডোড পুশ করেছিলো। সত্যিটা তো এটাই,ল্যাবের তার বিশ্বস্ত টিমমেম্বার্সই তার পেছন থেকে তাকেই ফাসানোর চেষ্টা করছিলো। আর সেই‌টিমে আপনিও ছিলেন ডক্টর তাহসানুল আরাব! আপনিও ছিলেন এক্সপেরিমেন্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে! আমি নিজে আপনার সাক্ষ্য দেওয়া কাগজের সাইন দেখেছি!

আরাব চুপচাপ শুধু শুনছে। দোয়া চোখ মুছে নাক টেনে বললো,

-ডক্টর সাফাত রওশন দোষী ছিলো না। তবুও তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়,তার বাসা সরকারী হেফাজতে নিয়ে সিল করে দেওয়া হয়। সারাদেশে ওই‌ নির্দোষ মানুষটাকে নিয়ে ছি ছি কার পরে যায়। আর তারপর…তারপরদিনই শোনা যায়,অপমান সইতে না পেরে ল্যাবে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন ডক্টর সাফাত রওশন! আপনিই বলুন ডক্টর আরাব,আদৌও কি সুইসাইড ছিলো সেটা? নাকি আপনারা…আপনারা খুন করেছেন আমার বাবাকে? বলুন ডক্টর আরাব? আপনাদের সবার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমার নির্দোষ বাবাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে কি তার মৃত্যুর জন্য আপনারা দায়ী নন মিস্টার আরাব? বলুন? জবাব দিন? তাকে তো…

দোয়াকে শেষ করতে দেয়নি আরাব। চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো,

-তুমি ঠিকই বলেছো দোয়া। সে আত্মহত্যা করে নি দোয়া। তাকে খুন করা হয়েছিলো।

দোয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যেভাবে আঘাত করেছে আরাবকে,ওর জীবনে আর এরপর আরাবের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। যতোদুর ও আরাবকে চিনেছে,বাবার খুনি সম্বোধনের পর আর কোনোভাবেই আরাব সামনে আসবে না ওর। ওকে অবাক করে দিয়ে আরাব ওর দু হাত মুঠো করে ধরলো। ওর হাতে চুমো দিয়ে আরাব বলতে লাগলো,

-সেদিন তুমি তাজীনকে ঠকানো নিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলে,আমি ডক্টর সুমনকে চিনি কিনা,তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিলো তোমার পরিচয় নিয়ে। কৌতুহল মেটাতে খোজ লাগাই তোমার ভার্সিটিতে। ওখানে তোমার যে বায়োডাটা আছে,সেখান থেকে জানতে পারি,তুমি রওশন স্যারের মেয়ে।

দোয়া চোখ সরিয়ে নিলো। আরাব বলতে লাগলো,

– ডক্টর সাফাত রওশন! বায়োমেডির সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট থেসিস যার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম আমরা। আমিসহ টিমের বাকি সবাইকেই অনেক ভালোবাসতেন উনি। কিন্ত তার মাঝেও কিছুটা স্পেশাল ছিলো,ডক্টর সুমন। লোকমুখে শুনেছিলাম,রওশন স্যারের ভবিষ্যৎ মেয়েজামাই সুমন। তাই এতো স্পেশালিটি তার। সবকিছুই ঠিক ছিলো দোয়া। স্যারের নতুন এন্টিডোড নিয়ে রাতের পর রাত জেগে করা সমস্ত এক্সপেরিমেন্ট,তার ফর্মুলা,সবকিছুতেই আমরা সাফল্যের এক অন্যরুপই খুজে পাচ্ছিলাম। তার পরবর্তী আবিষ্কার যে বায়োমেডিকে আরো উচু পর্যায়ে নিয়ে যেতে চলেছে,কোনো সন্দেহই ছিলো না আমাদের তাতে।

কিন্তু আচমকাই সব উল্টেপাল্টে যায়। বিভিন্নপ্রকার প্রানীদেহে এন্টিডোডের কার্যকারীতা দেখে,আমাদের বায়োমেডির কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর বডিতে এন্টিডোড পুশ করা হয়। কথা ছিলো পরদিন নিউবর্ন বেবিদেরকে এন্টিডোড পুশ করা হবে। আর সেদিনই আমিসহ টিমের আরো তিনজনকে অন্য এক্সপেরিমেন্ট এনালাইসিস করার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। দিনশেষে খবর আসে,এন্টিডোডের ভুল প্রয়োগের ফলে আটটি বেবিই মারা গেছে। সাইড ইফেক্ট হিসেবে বায়োমেডির কর্মচারীরাও নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। স্যারের টিম‌মেম্বার্স সবাই নাকি সাক্ষ্য দিয়েছে,ওই আটটে বাচ্চার মৃত্যুর জন্য দায়ী রওশন স্যার। তার ভুল ফর্মুলার এন্টিডোড,তার ভুল এক্সপেরিমেন্ট!

বিশ্বাস করো দোয়া,আমরা চারজনের কেউই মানতে পারছিলাম না বিষয়টা। তারপর জানতে পারি,ডক্টর সুমন নিজেই রওশন স্যারের এনালাইসিসের ভুলগুলো তুলে ধরেছে। সমস্ত প্রমান ছিলো ওর কাছে স্যারের বিরুদ্ধে। বায়োমেডি নিজের সম্মান বাচাতে স্যারের বিরুদ্ধে চলে যায়। আমরা যারা বিদেশে ছিলাম,তাদের নোটিশ পাঠানো হয়,টিমমেম্বার হিসেবে আমরা যেনো স্বীকারোক্তি দেই,স্যারের ফর্মুলা ভুল ছিলো। ওই বাচ্চাগুলোর দোষী যেনো শাস্তি পায়।
কোনো উপায় ছিলো না আমাদের দোয়া। সমস্ত প্রমান রওশন স্যারের বিরুদ্ধে ছিলো। আমরা চারজনই চেয়েছিলাম দেশে ফিরে স্যারের স্বপক্ষে সত্যিটা বের করার চেষ্টা করবো। লন্ডন থেকে ফিরেও আসি,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু…কিন্তু ততোদিনে রওশন স্যার…

দোয়া হুহু করে কেদে দিলো। আরাব ওর হাত ছেড়ে চোখজোড়া মুছিয়ে দিলো ওর। দোয়া সরিয়ে দিলো ওর হাত। আরাব বললো,

-পাঁচবছর আগে তার মৃত্যুর সাথে সবাই সবটা ভুলে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি থেমে ছিলাম না দোয়া। দেশে ফিরে অনবরত ফলো করতে থাকি সুমনকে। যে কিনা রওশন স্যারের সবচেয়ে প্রিয় ছিলো,কেনো সেই স্যারের বিরুদ্ধে এতোসব প্রমান দিলো পুলিশকে। আর ওকে ফলো করার পর জানতে পারি,রওশন স্যারের এতো কষ্টে তৈরী করা এন্টিডোডের আসল ফর্মুলা বিদেশী এক ফার্মাকেমিক্যালস্ কোম্পানির কাছে কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলো ও। এজন্যই স্যারের কাছ থেকে ফর্মুলাটা হাতিয়ে নিয়ে,ভুলভাল এক্সপেরিমেন্ট আর তার থেসিস জমা দিয়েছিলো ও পুলিশকে। তোমাদের বাসা সিল করানোর পেছনেও সুমন জড়িত ছিলো দোয়া। সবটা প্রমানের জন্য আমার সুমনের কাছে থাকা কিছু ডকুমেন্টের প্রয়োজন ছিলো। এটা বুঝে গিয়ে পাঁচ পাঁচটে বছর হলো ও গা ঢাকা দিয়ে আছে। সেদিন তাজীনের বিষয়ে যখন তুমি আমাকে বললে,আমার প্রথম ফোকাস ছিলো সুমনকে ধরা। কিন্তু জানোয়ারটা আবারো পালিয়ে গিয়েছিলো!

দোয়া আরাবকে দেখে চলেছে। আরাবের চেহারায় সুমনের জন্য রাগ,নিজের কাজের জন্য অনুতাপ,অনুশোচনা সুস্পষ্ট। দোয়া জানতো,সবকিছুর জন্য কোনো না কোনোভাবে সুমন দায়ী। কিন্তু আরাব এভাবে সবটা নিজের উপর নেবে,একবারও মনে হয়নি ওর। আরাব বললো,

-হ্যাঁ,আমরা…আমি তোমার আর তোমার পরিবারের এই অবস্থার জন্য দায়ী। সেদিন আমাদের উচিত ছিলো,রওশন স্যারের ফর্মুলা নিয়ে আরো বেশি খোজ লাগানো। এটা পুরো বায়োমেডির উচিত ছিলো। কিন্তু ওইযে বলে না,তোমার সাফল্যের কৃতিত্ব সবাই নেবে। বদনামের কৃতিত্ব কেউই নেবে না দোয়া। ঠিক এমনটাই বায়োমেডি করেছে রওশন স্যারের সাথে। আমরা তার টিমমেম্বার্সরা,আমি করেছি রওশন স্যারের সাথে।

মাটিতে পরে থাকা বাইকের পাশে কিছু ফাইল তুললো আরাব। দোয়ার হাতে গুজে দিয়ে বললো,

-সেদিনের স্বীকারোক্তি আজ অবদি কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে দোয়া। নিজের ভুল শুধরানোর চেষ্টা করে চলেছি এই পাঁচ বছর হলো। আজ তোমাকে এখানে এনে সবটাই বলার ছিলো তোমাকে। আমি জানতাম,বায়োমেডির প্রতি যে ঘৃনাটা আছে তোমার,তা আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাকে বাস্তবতায় রুপ নিতে দেবে না। তাই আজ রওশন স্যারের সব সত্যির প্রমান তোমার হাতে তুলে দিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করবো বলে তোমায় ডেকেছিলাম। যা ঘটেছিলো,তা আমার আয়ত্ত্বে ছিলো না দোয়া। বিশ্বাস করো! তবুও তার শাস্তি হিসেবে আজ যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও,আমার কোনো অভিযোগ নেই। কোনো অভিযোগ নেই।

মাথা নিচু করে রইলো আরাব। দোয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। অনেকটা সময় কেটে গেলো নিরবতায়। সন্ধ্যের আবছা আধার নামতে শুরু করেছে। দোয়া দেখলো আরাব লুকিয়ে চোখ মুছছে অন্যদিক ঘুরে। একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে আস্তেধীরে গিয়ে আরাবের আরো সামনে দাড়ালো ও। আরাবের বুকে মাথা রেখে ধীর গলায় বললো,

-আমার কোনো কান্নার জায়গা নেই আরাব। এই এখানটায় একটু কান্না করার জন্য জায়গা দেবেন প্লিজ? কথা দিচ্ছি,এই এটুকোতেই পৃথিবীর সব সুখ খুজে নেবো আমি। আর কিছুই চাইনা আমার। আর কিছুই না।

আরাব খানিকক্ষন থে‌‌মে থেকে দুহাতে জরিয়ে ধরলো দোয়াকে। দোয়া আবেশে বন্ধ করে নিলো চোখ। আর কি করে আটকাবে নিজেকে? কি করে ফিরিয়ে দেবে আরাবকে? ওর আছে সে যোগ্যতা? আরাবের ভালোবাসার কাছে নিজের অস্তিত্বকে নত করাতেই হয়তো ওর জীবনের সার্থকতা। আরাব ওর চুলে চুমো দিয়ে বললো,

-ভালোবাসি দোয়া। খুব ভালোবাসি তোমাকে। আর কান্না নয়! কথা দিচ্ছি,এই এখানটাতেই আমি পৃথিবীর সব সুখ এনে দেবো। শুধু এভাবেই এখানে নিজেকে লুকিয়ে রেখো তুমি! এভাবেই আজীবন কাছে থেকো আমার! তাতেই হবে! আর কিছুই লাগবে না! কিচ্ছু নাহ্!

দোয়া নিজেও জাপটে জরিয়ে ধরলো আরাবকে। ওর বুকে মুখ গুজে রেখে বললো,

-এ গোধুলী আমার জন্য সার্থক আরাব। আপনার ভালোবাসি বলার বিপরীতে নয়,আপনার ভালোবাসার একই জোয়ারে গা ভাসিয়ে,আমিও বলছি,আমি আপনাকেই ভালোবাসি। ভালোবাসি!

#চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here