#এক_কাপ_চা
#পর্বঃ৪৫+৪৬
# সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(২১৩)
শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের শীতল পরিবেশেও ঘেমে অস্থির হলো সাগরিকা।হুট করেই এত বড় খবর পেয়ে নিজেকে সামাল দিতে পারছে না সে।
স্নেহাকে দেখেই ডক্টর জানিয়েছেন তার হার্টে ছিদ্র রয়েছে এবং এই কথাটা অনেক দিন পূর্বেই তার অভিভাবক কে জানানো হয়েছে।
অথচ এমন কথায় জান পরাণ অবাক হলো সাগরিকা। তারা এ বিষয়ে কিছু জানে বলে মনে পড়লো না তার।
তৎক্ষনাৎ রাশেদকে কল দিলো সে।
“কাকা তুমি কোথায়?”
“বাড়ি ফিরছি।ভাবীর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আগামীকাল দিবে। আচ্ছা সাগরিকা তুই কি জানিস? ভাবীর হৃদ রোগ ছিল কী না?”
“কেন?”
“অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে হৃদ রোগে ব্যবহৃত কোনো মেডিসিন কে।যে মেডিসিন হৃদরোগীদের দেওয়া হয় তাদের রক্ত তরল করে সঠিক ভাবে প্রবাহিত করার জন্য।”
“কিন্তু কাকীর কোনো হৃদরোগ ছিল না।”
“অথচ ডাক্তার যা বলল এমন হতে পারে।দীর্ঘ সময় যাবত নিয়ে আসছিল এটা।”
“কাকা আমি যে জন্য কল দিয়েছিলাম।স্নেহার যে হার্টে ছিদ্র রয়েছে এটা তুমি জানতে?”
” মানে?কবে হলো?”
“ডাক্তার বলছে এটা জন্মগত। আর স্নেহার অভিভাবক না কি এই বিষয়ে জানে।”
“না,আমরা তো জানি না। আর তুমি এখন কোথায়?”
“জ্বরে স্নেহার গা পুড়ে যাচ্ছিল। হুট করেই বমি করছে। তাই পাশের ক্লিনিকে এসেছি আমরা।”
“তাশদীদ কে ফোনটা দেও তো!”
“আমি আর শুভ্র ভাই এসেছি। উনি পায়ে ব্যথা পেয়েছেন।”
“আচ্ছা,আমি আসবো?”
“না, কিছু সময়ের মাঝে আমরা ফিরছি।”
“সাবধানে এসো।কলটা কাটো। মিয়া ভাই কল দিচ্ছে।”
সাগরিকার কল কেটে দিয়ে রাশেদ তাশদীদের বাবার কল রিসিভ করলো।তাশদীদের বাবা তাকে শুধু এটুক বললেন,
“ছোটো, সাগরিকার কাছে দ্রুত পৌঁছে যা। আর তাশদীদকে বল বাড়ির সবার খেয়াল রাখতে। আমার শরীর ভালো লাগছে না।আমি ড্রাইভ করার শক্তি পাচ্ছি না।”
“আপনি এত রাতে বের কেন হয়েছেন?”
“ছোটো আমি বিপদে পড়েছি।কিন্তু আমার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সাগরিকা, স্নেহা।সাগরিকার কিছু হলে তাশদীদ বাঁচবে না। আর স্নেহা আমাদের ভাইয়ের শেষ আমানত।”
কথা বলতে বলতে রাশেদ গাড়ি ঘুরিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিয়েছে। তাশদীদকে ম্যাসেজ করলো বাড়িতে থাকতে আর তাজবিদ এবং শুভ্রকে জানালো সাগরিকাদের খেয়াল রাখতে।
(২১৪)
আরো একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভোর। যে ভোর কেউ আশা করেনি।ভোরের আলোর সাথে বাড়িতে আরো একবার শোক এলো।এই শোক কাটিয়ে উঠবে পরিবারের এমন মানসিক শক্তি আদৌও ছিল কী না কেউ জানে না।
তাশদীদের বাবা হুট করেই গাড়ি চালানোর সময় ব্রেইন স্ট্রোক করেছিলেন।তার সাথে কথা বলতে বলতেই রাশেদ পৌঁছে যায় তার কাছে।ভদ্রলোক গাড়ির ভিতর স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলেন।তার হাত পা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল।
রাশেদ পৌছানোর পর তাকে বললেন,
“একা কেন এসেছো?আমাদের একা থাকা উচিৎ না।শত্রু ঘরেই রয়েছে। তারা আমাকে ছাড়েনি।আমার ঘাড়ে দেখো কিছু একটা দিয়ে ইনজেকশন দিয়েছে। হয়তো খুব দ্রুত আমি মরে যাবো।তবে সত্যিটা শুনে রাখো।এসবের পিছনে কে আছে।শুনো হয়তো পুলিশ প্রমাণ চাইবে।তুমি বরঙ তোমার ফোনের ভিডিও টা চালু করো তো।আমি নিজ মুখে বলে যাচ্ছি।”
রাশেদ দ্রুত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। তাদের পারিবারিক ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষার পর জানায় তাকে উত্তেজিত করার জন্য কোনো ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে যা তার হৃদ স্পন্দন বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। গড়ে একজন মানুষের ২৪ ঘন্টায় লাখ খানেক বার হৃদ স্পন্দন হয়। এটা বাড়িয়ে করা হয়েছে প্রায় দেড় লাখের বেশি।সে যে জীবিত আছে এটাই অনেক রহমত। তবে বয়স হয়েছে তার।এজন্য তার শরীর সবটা নিতে পারেনি।
সাময়িক প্যারালাইজড হয়ে আছে সে। হয়তো কয়েক দিন তার শরীর ঠিক কাজ করবে না, কথা বলবে না।তবে চিকিৎসা নিয়ে ঠিক হবে এমনটাই তারা আশা করছেন।
বাবাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার পাশে বসল তাশদীদ। ভিডিওটা দেখার পর থেকে রাগে গা পুড়ে যাচ্ছে তার।কিন্তু এই মুহুর্তে কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না তারা। কারণ তাদের পুরো পরিবার বিপদের মুখে রয়েছে।বিষয়টা আজ সকালেই মালুম করতে পেরেছে সে।তাদের প্রতিটা কক্ষে লাগানো রয়েছে বিভিন্ন ক্যামেরা এবং স্পীকার। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় এই বাড়ির অনেক তথ্য জানে তারা। এমনকি তাদের বাড়ির দারোয়ানটাও তাদের দলে।
ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভাবতে হচ্ছে তাদের। এই সময়টা তাদের পরিবারের জন্য সব থেকে দুর্বল সময়। এই সময় একটু বোকামী মানে আরো একজন প্রিয় মানুষকে হারানো।
জুলি দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশে। তাশদীদের মা তাকে দেখে কাঁদতে বলল,
“তোর ভাইজানের জন্য কিছু খাবার বানিয়ে দে রে জুলেখা। তোর হাতের চা মানুষটা খুব পছন্দ করতো।সেদিন ও বলছে মায়েরে নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরলে কচুর মুখির ডাল রান্না করতে বলবে
তোকে। আর আজ!”
জুলি দৌঁড়ে এসে তাশদীদের মায়ের হাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।তার কান্না দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে সে খুব শোক পেয়েছে। তার কান্নার দিকে তাকিয়ে তাজবিদের ইচ্ছে হলো হলো লাথি দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে। কিন্তু বড় ভাইয়ের আদেশে সে চুপ করে রইল।
তাশদীদ জুলিকে ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ করুন।আর বাবা কিছু খাবেন না এখন।যা খাবে সব সেঝ মা বানিয়ে দিবে। এবং বানানোর পর সে নিজে খাইয়ে দিবে।ডাক্তার আংকেল যেভাবে বলবে বাবাকে সে ভাবেই চলতে হবে।”
তাশদীদের কথায় তার মা রেগে গিয়ে বলল,
“সাগরিকার মা কেন আমার স্বামীর সেবা করবে? আমি কী মরে গেছি?”
তাশদীদ কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো।শক্ত হাতে মায়ের মাথাটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।তার মা প্রথমে ছোটাছুটি করার চেষ্টা করছিল কিন্তু পরবর্তীতে শান্ত, বাধ্য হয়ে কাঁদতে লাগলো তাশদীদকে আকড়ে ধরে।
তাশদীদ নিজেও জানে এই মানুষটা তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু মাঝে মধ্যে কেন যে পাগলামো করে এটা সে বুঝে না।বুঝতে চায় না।থাকুক না কিছু বিষয় না জানা।
(২১৫)
গতকাল রাতে সাগরিকার সাথে বাজে কিছু হতে পারতো।নারীর সম্মানে হাত দিলে সে নারী কখনো বাঁচতে চায় না।সমাজটা তাকে বাঁচতে দেয় না।তাশদীদের ভয় সেখানে নয়, তার ভয় হচ্ছে মেয়েটাকে তার কাছ থেকে কেউ আলাদা করে নিলে সে কী করতো।চায়ের কাপ হাতে সাগরিকা সামনে এসে দাঁড়াতেই তাশদীদের ধ্যান ভঙ্গ হলো।তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ক্লান্তি।সাগরিকা তার পাশে বসে তার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে বলল,
“একটু আসবেন?পাশে বসবেন?মনে হচ্ছে আপনার ব্যাটারি ডাউন হয়েছে।চার্জ করে দিচ্ছি।”
মেয়েটার কথায় তাশদীদের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। অথচ দু ঠোঁট প্রসারিত হলো না।তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাগরিকা তার হাত ধরে টান দিয়ে বলল,
“এই সময় আমাদের পরিবারে থাকবে না।খুব দ্রুত সময় কেটে যাবে।”
তাশদীদকে নিজের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে সাগরিকা কথা গুলো বলছিল।তার পিঠে হাত রাখতেই তাশদীদের হুট করে মনে হলো তাদের বাড়িতে লাগানো স্পাই ক্যামেরার কথা।নিশ্চয়ই এসব ভেসে উঠবে মনিটরে।সাগরিকাকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“তৈরী হয়ে নে।তুই,সীমা,দাদী, রাঙামা, তুলি এবং স্নেহা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিস।”
“কোথায়?”
“আমি যেখানে বলবো সেখানে। তোদের সাথে মুনির আর তাজবীদ যাবে।”
“বাকীরা?”
“বাবা -মা, সেঝ কাকা আর সেঝ মা চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে যাবে।”
“আর আপনি?ছোটো কাকা?”
“আমাদের এখানে দরকার আছে।”
সাগরিকা কিছু বলল না।চুপচাপ সিদ্ধান্ত মেনে নিলো।বিকেলবেলা তাদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু পারলো না।দুপুরের খাবার খাওয়ার পর বাড়ির চারপাশে পুলিশ এসে ভরে গেল।পুলিশ প্রধান সমেত কয়েক জন এসে বসলো ড্রয়িং রুমে। দারোয়ান,সিকিউরিটি গার্ডকে আগেই আটক করা হয়েছে।জানালা দিয়ে তাকিয়ে তুলি দেখলো।গাড়িতে আরো কয়েকজন আসামীকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে রাখা হয়েছে।
কুশলাদি বিনিময় করে তাশদীদ বলল,
“মেঝ কাকীর মৃত্যু, দাদীর উপর হামলা এবং আমার বাবাকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে জুলেখার উপর। আজ তাকেই গ্রেফতার করার জন্য এত আয়োজন।”
তার দাদী উচ্চস্বরে বললেন,
“তোর মাথা খারাপ দাদাভাই?জুলেখা আমার বাড়িতে পনেরো বছর যাবত কাজ করে আর ও এসব বুঝে না।”
“যদি বলি এই সেই জুলিয়া আহমেদ। যাকে ঠিক পনেরো বছর আগে তুমি না দেখেই ফিরিয়ে দিয়েছিলে বাড়ির সামনে থেকে। আর এই সেই জুলি যে মেয়েটা তোমার সম্মতির জন্য পুরো রাত দাঁড়িয়ে ছিল বাহিরে আর তুমি গেটের ভিতর থেকে তাকে যাচ্ছে তাই অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছিলে?”
চলবে,,,
#এক_কাপ_চা
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ৪৬
(২১৬)
“এত নাটকের প্রয়োজন কী আদৌও ছিল?”
জুলির প্রশ্নে তাশদীদের অধর প্রসারিত হলো।ক্রুর উপহাস ফুটে উঠলো তার অধরে।দাঁড়িয়ে থাকা জুলির সম্মুখে চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা রাখলো।
“আপনি আমার বাসার কাজের মানুষ হলেও আপনাকে কখনো অসম্মান করে কথা বলিনি।কখনো আপনার সম্মুখে পায়ের উপর তুলে বসিনি।কারণ এটাকে আমার পরিবার শিখিয়েছে বেয়াদবি। তবে আজ বসলাম,কেন জানেন?আপনার বুদ্ধিকে টেক্কা দিতে পেরে।”
“অনেক দেরী হয়ে গেলো না?”
“নাহ্, সব সময়ই উপযুক্ত সময়।”
“এসবের পিছনে আমি এর কোনো প্রমাণ আছে?যার কথাটা তুমি বলছো সে মেয়ে আমিই হবো এর নিশ্চয়তা কী?”
“আপনি বড্ড বেশিই অধৈর্য্য। আমাদের বাড়িতে কাজ করা জুলির খালার ভাষা এবং আপনার বচন ভঙ্গি।”
“এটাতেই কিছু প্রমাণ হয় না তাশদীদ।”
“আপনার কী মনে হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়াই পুলিশ কর্মকর্তারা এসেছে?”
জুলি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।শেষ মুহুর্তে এসে এভাবে তার সব কিছু হারিয়ে যাবে এমনটা চিন্তাও করেনি সে। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী
আগামীকাল সামিনার লাশ দাফনের পর সে স্নেহাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেত। এবার তার সবটা স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।তাশদীদ পুরোটা বেশ পাকাপোক্ত ভাবে প্ল্যান করেই করেছে।সে একদিকে বলেছে সাগরিকা ওরা অন্য কোথাও যাবে অন্য দিকে তার বিরুদ্ধে সাজিয়েছে দাবার শেষ চাল।এবং শেষ চালে সে কিস্তিমাত করেছে। আর জুলির সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
তাশদীদের দাদী এগিয়ে হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে এলেন।তাশদীদের হাত ধরে বললেন
“দাদা ভাই কও তো কী হইছে?এই জুলেখা কী করছে?আর ওই মেয়ার লগে ওর কী সম্পর্ক?”
“দাদু তোমার মনে আছে মেঝ কাকার একবার বিয়ের সম্বন্ধ এলো।মেয়ে বাড়ি থেকেই পাঠিয়েছিল।মেয়ের বাবা বিদেশের ডাক্তার। তার মেয়েকে পছন্দ করে বসলো মেঝ কাকা।”
বৃদ্ধা নাতীর দুই হাতে হাত রেখেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তার মনে আছে সব। এখনো দিব্যি চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
বিকেল বেলা গরুর গোয়ালের সামনে খড় বিছিয়ে রাখছিলেন তিনি।গাভীটার প্রসবের সময় এসে পড়েছে। তাশদীদ, তাজবিদ তখনো ছোটো, সাগরিকার বয়স মাত্র চার।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো।গাভী জন্ম দিয়েছিল এক অন্ধ বাছুর। গাভী প্রসবের কিছু সময় পূর্বেই তার মেঝ ছেলে এসে তার আশপাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করছিল।ছেলের স্বভাব খুব ভালো করেই জানে। দুই বছর বিদেশ থেকে এবার মাস খানেকের ছুটিতে এসেছে।
মায়ের মন সন্তানের কথার ধরণ বুঝে। কাজ করার সময় সে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
“বাজান, কিছুই কইবা?”
আমতা আমতা করে ছেলে জবাব দিলো,
“মা আমি সাহায্য করি?”
“না, বাজান।আমি পারবো এসব তোমাগো কাম না।তুমি কিছু না কইলে এহেন থেকে যাও, ফ্যানের নিচে বওগা।”
“আসলে আম্মা একটা কথা।”
হাত থেকে খড় ফেলে দিয়ে ভদ্রমহিলা ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলের মুখ কোনো কারণে লাল আভা ছড়াচ্ছে। তার কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দিয়ে তিনি বললেন,
“আমার কাছে কীসের এত দ্বিধা আব্বা?কও কী কইবা।”
“আপনি রাগ করবেন না তো?”
” না গো আব্বা কও তুমি।”
“আম্মা, বিদেশে আমি যে হাসপাতালে চাকরি করি,সেই হাসপাতালের এক ডাক্তার আছে। বাঙ্গালী ডাক্তার, তার পরিবার নিয়ে বিদেশ থাকে। তার দুই মেয়ে, স্ত্রী মারা গেছেন।ছেলে নেই,যা আছে সব বলতে দুই মেয়েই”
“তাতে কী?”
“আম্মা আসলে আমি তার বড় মেয়েরে পছন্দ করি। তার মেয়েও আমারে পছন্দ করে। আর ডাক্তার টা এটা জানতে পারছে। সে আজ আমারে কল দিয়ে সব বলছে।তার কোনো আপত্তি নেই। সে চায় আপনার সাথে কথা বলতে। বিয়ের ব্যাপারে।”
ভদ্রমহিলা কিছু বলার সুযোগ পেলো না।গাভীটি প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছিল।সে ছেলেকে বলল রাতে কথা হবে এই বিষয়ে।গাভীর যন্ত্রণা উপশম করার চিন্তা মাথায় থাকলেও কানে অনবরত বাজছিল ছেলের বলে যাওয়া কথা গুলো।
মিনিট দশেক পর গাভীটি একটা অন্ধ বাছুর জন্ম দিলো।আর রাতে খাওয়ার সময়ের আগেই বাছুরটা মারা গেল।
গ্রামের মানুষ হিসেবে এসব খুব ভালো ভাবে নেয়নি সে। যে মেয়ের কথা জানতেই তার এত বড় ক্ষতি হলো সে মেয়ে ভালো হবে বলে তার মনে হলো না।এই মেয়ে সংসারে অশান্তি আনবে।
ছেলেকে ডাক দিয়ে এনে নিজ মাথায় হাত রাখিয়ে নিয়ে ওয়াদা করিয়েছিলেন।সে আর ওই মেয়ের সাথে যোগাযোগ করবে না।বাধ্য ছেলের মতোন সবটা মেনে নিয়েছিল কায়সার। তার দুই চোখ ছল ছল করতে দেখেছিল তার মা কিন্তু সে জানে ক্ষণিকের কষ্ট পেলেও তার ছেলে সামনে সুখী হবে।কারণ ছেলেকে ছাড়া তার থাকাটা সম্ভব নয় আর ছেলে যদি ওই মেয়ের কাছে থাকে তবে জীবনে কোন না কোন এক সময় আঘাত পাবেই।বিদেশ শহরের উচ্চশিক্ষিত মেয়ে গ্রামের এইট পাস ছেলেকে নিয়ে ঘর করতে চাইলে এটা মাত্র আবেগ ছাড়া কিছুই নয়।
ছুটি শেষ হলেও ফিরে যাওয়া হয়নি কায়সারের।অন্য দেশে ভিসা লাগালেন তার মামা।বিদেশ চলে যাওয়ার জন্য যে দিন বিকেলবেলা কায়সার বাড়ি থেকে বের হলো সেদিন সন্ধ্যে বেলা একটা গাড়ি এসে থামলো তার গেটের সামনে। বাড়ির বাইরে দাঁড়ানো গাড়িটি ছিল বিদেশী ডাক্তারের। বাইরে থেকে ভদ্রলোক অনেক অনুনয় করলেও তার কথা কানে তুলেনি কায়সারের মা।গ্রামের মানুষের মুখে শুনেছিল মেয়েটা না কী পুরো রাত বসেছিল গেটের বাইরে। অপরূপ সুন্দরী ছিল মেয়েটা।যেমন রঙ তার তেমন ঢঙ। পরদিন সকালে গ্রামের লোকের থেকে জানতে পারে কায়সার গতকাল বিদেশে চলে গেছে এরপর তারাও চলে যায়।
এত কিছু তার বাড়ির সামনে হলেও মেয়েটিকে চোখে দেখেনি তাদের বাড়ির কেউ।কারণ তার কড়া আদেশ ছিল কেউ যেন তার ধারে কাছে না যায়।
তাশদীদের দাদীর দুই চোখ ছল ছল করে উঠলো।শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“জুলেখা?তুই সেই মেয়ে?”
অশান্ত জুলি এবার শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।তাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন বৃদ্ধা।
হিসহিসিয়ে বললেন,
“তবে আমি তো ভুল কিছু করিনি।তুই তো আস্ত এক সাপ। আমার কথা সব সত্যি করে দিলি।”
দীর্ঘ সময় চুপ থাকার পর জুলি বলল,
“আপনার ছেলের অনাদর আমি কখনো করিনি।তবে আপনি আমাকে কেন মেনে নেন নি?অনেক খোঁজ করে আপনার ছেলের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম।সে শুধু বলেছিল আমার মা কে রাজি করাও। এরপর আপনার ছেলেকে পাওয়ার লোভে আমি সব ছেড়ে ছুটে এলাম আপনার কাছে।আপনার মতো করে নিজেকে গড়ে নিতে চাইলাম।আমার মতো একজন মেয়ের নখে সামান্য ময়লা সহ্য করতে পারতো না, পেয়াঁজের গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো অথচ সেই আমি গোবর ফেলেছি, পঁচা পাঁটের আঁশ ছাড়িয়েছি।আপনি কী করলেন? ছেলে বিদেশ থেকে আসার আগেই সামিনার সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন।আমার চোখের সামনেই সে বৌ নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।তবুও আমার শান্তি ছিল, তাকে আমি চোখের দেখা দেখতাম।আমি চলে যেতাম কিন্তু রয়ে গেলাম। সামিনার প্রতি আপনার মন নষ্ট করার জন্য। অথচ যার জন্য এসব সে নিজেই তো মরে গেল।
আমার জীবনের সব রঙ নিয়ে সে পুড়ে ছাই হলো।কিন্তু এমন হতো না।যদি আপনি আমাকে মেনে নিতেন আপনার ছেলে এভাবে মরতো না।আজো।বেঁচে থাকতো।তাই আমি থেকে গেলাম আর আমার মন কে শান্ত করার জন্য যখন যা করতে ইচ্ছে করেছে আমি করেছি।আপনার হাতের নিচে থেকে আপনাকে ব্যবহার করেছি।সামিনাকে ব্যবহার করেছি।”
“আর স্নেহা?ও আপনার কী ক্ষতি করেছিল?বাচ্চা মেয়েটাকে ধর্ষণ করার জন্য আপনি টাকা দিয়েছিলেন?”
শুভ্রের প্রশ্নে জুলি ভ্রান্তের মতো হাসলো। এরপর বলল,
“আমি ওর ক্ষতি করতে চাইনি।কিন্তু ও আমার কথা পর পর দুই বার শুনেছিল।আর চেষ্টায় ছিল অন্যদের জানানোর।”
“আপনি আপনার দোষ স্বীকার করছেন তবে?”
“হ্যাঁ। আমিই সব করেছি।আমি স্বীকার করে নিচ্ছি।”
জুলিকে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।তাকে নিয়ে যেতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল স্নেহা।তাশদীদের গলা আঁকড়ে ধরে সে বেরিয়ে এলো বাড়ির বাইরের গেটে। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার পর পরই তাদের বাড়ির গেটে এসে থামলো লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি।
গাড়িটা দেখে স্নেহা কী বুঝলো কে জানে। তবে তার মা মা বলে চিৎকার করা শব্দে মুহুর্তেই ভারী হয়ে গেল চার পাশের পরিবেশ।
চলবে,,,