এক কাপ চায়ে পর্ব ৫

0
183

#এক_কাপ_চায়ে : ০৫
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

শুভর বিক্রিবাট্টা ভালোই চলছে। একদল সাংবাদিকের চোখে আসায় মানুষ আজকাল উঁকিঝুকি দিয়ে দেখছে। স্নাতক পাশ করা ছেলেটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ব্যবসা করে শুনে কেউ কেউ আফসোস করে বলে, “বুভুক্ষের দেশে তাই সই”। কপালের পাশ বেয়ে তরতর করে ঘাম নামে। শুভ সময় পেলে আকাশের দেখে। সুবিশাল, বিস্তীর্ণ আকাশের কাছে নিজেকে পিঁপড়ের মতো মনে হয়। পিঁপড়েরা তো তাও একা থাকে না।

শুভ বিষাদ মুখে কাজ করতে থাকে সকাল থেকে দুপুর, বিকেল হতে সন্ধ্যা। কখনো রাত থেকে মধ্যরাত। শুভর এসব ভালো লাগে না। বইয়ের পাতা গড়গড় করে মুখস্থের বদলে সেই পাতায় ঝালমুড়ি বেচবার মতো দুঃখ বোধ হয় পৃথিবীতে অনেক আছে।

পুষ্পকে ইদানীং ওর অদ্ভুত লাগে খুব। আশেপাশে কোনো ছেলে দেখলেই মুখটা ভোঁতা করে ফেলে। আগেও খুব একটা সখ্যতা করেছিলো বলে মনে পড়ে না। পুষ্প কী কোনো প্রেম ভালোবাসা জনিত দুঃখ পেয়েছে? হতে পারে। প্রজন্ম বদলে যাচ্ছে। শুভ যে বয়সে হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াতো, ওই বয়সে এখন ছেলেরা মেয়ে পটানোর ধান্দা করে।

প্রেম, প্রেম, প্রেম — শব্দটা তিনবার আওড়ালো সে। প্রেম মানে কী? প্রেম বলতে কী আসলেই কিছু হয়?
.
.
এহসান সাহেব ঔষধ খেয়ে ভুরভুর করে নাক ডাকছেন। নবীন পাশে বসে আছে। সহকারী হিসেবে ইদানীং তাই কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এহসান আজ খুব অদ্ভুত ভাবে কথা বলছিলেন। চোখগুলো অস্বাভাবিক রকম লালচে দেখাচ্ছিল।

এহসানের স্ত্রী নাকি খুবই ধার্মিক নারী ছিলেন। স্বামীর প্রতি অগাধ যত্নের হতে পারে এটিই একটি কারণ। একই সাথে রুচিবোধ ছিল উন্নত। নোংরামি একদমই পছন্দ করতেন না। একবার হলো কি, এহসান মানুষ রূপে এক পরীর সাক্ষাৎ পান। অসম্ভব সুন্দর, নীল চোখ। স্ত্রীকে বলার পর তিনি খুব রাগ করেন। স্বামীর সঙ্গে পরনারীর ঘনিষ্ঠতা একদমই সহ্য করতে পারেন না। হোক সে মানুষ বা জ্বীন।

প্রথমে ধৈর্য নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেও দিনে দিনে তার ব্যবহার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। পরী ব্যাপারটি লক্ষ্য করে রাগ করে। জ্বীন পরীদের রাগ ভালো কোনো বিষয় নয়। পরবর্তীতে তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। একদিন মারা যান। মৃত্যুর সময় তার চেহারা ভয়াবহ আকৃতি ধারণ করে। জিহ্বা একহাত বের হয়ে আসে। চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসতে চায়। গলায় কালচে দাগ।

এতটুকু বলে থামেন তিনি। নবীন ধৈর্য নিয়ে শুনলো। ঔষধের প্রভাবে গল্প আর এগুলো না। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। নবীন ঠায় বসে রইলো। পর্দাটা হঠাৎ করে নেচে উঠলো। রান্নাঘরে খট খট করে কারো হাঁটার শব্দ। দখিনা জানালার দৈবাৎ হাওয়া তীব্র হয়ে গায়ে লাগলো। বাতাসে মৃত ঘরের সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে।

নবীন ভেতরে ভেতরে নিজেকে সাহস দিলো। আয়াতুল কুরসী পড়ে বুকে ফুঁ দিলো অনবরত। যেসবের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন যাচ্ছে, যেকোনো দিন হার্টে অসুখ করে মরে যাবে বোধ হয়।
.
.
রোদের সঙ্গে মেঘের আজ বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি মুষলধারে রূপ নিলো। শুভ গালে হাত দিয়ে চেয়ে আছে সেদিকে। দোকানে ভীড় কম। পথের মধ্যিখানে হঠাৎ একটা মেয়ে হোঁচট খেলো। কাদায় পরনের জামা মাখামাখি। বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার। শুভ চমকে উঠলো।

একটা ছাতা হাতে এগিয়ে গেলো। টেনে উঠিয়ে দোকানে বসার জায়গা করে দিলো। মেয়েটা জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। একটা শব্দও নিজ থেকে বললো না। শুভ মেয়েটিকে স্বস্তি দিতে বলল,
— “নাম কী আপনার? কই থাকেন?”
মেয়েটা অস্পষ্ট গলায় বললো,
— “বৃষ্টি, বাসা দক্ষিণ ক্যাম্পাসে।”

শুভ বিড়বিড় করে বললো, “যেমন নাম তেমন কাম। এইজন্যই বাপ-মা রে আকিকা বুঝে শুনে দিতে হয়।”
ক্যাম্পাসের মেয়েরা এত আনাড়ি ধরনের হয় ওর জানা ছিল না। হাত ধরতেই থরথর করে কেঁপে উঠেছিলো। শুভ আর কিছু বললো না। মেয়েটা হয়ত অস্বস্তি বোধ করছে। খাতায় দিনের সব হিসাব তুলতে গিয়ে হঠাৎ ভাবলো মেয়েটা কী ভান করছে? ভালো মেয়ে সেজে সহানুভূতি পাওয়ার আকাঙ্খা?

শুভর প্রাক্তনও ঠিক এমন ছিলো। বন্ধু থাকাকালীন মেয়েটা ছিলো মুরগীর মতো, প্রেমিকা হবার পর হয়ে গেলো শকুন। অবশ্য ও এখন মেয়েমানুষ থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে, বন্ধু বানানোর জন্য ছেলের আকাল পড়েছে নাকি? শুভর অশালীন গালি মনে করতে গিয়েও ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করলো।

এরিমধ্যে মালের গাড়ি এলো। কেকের প্যাকেট উল্টে পাল্টে দেখে ও চোখ বড় বড় করে বললো,
— “নাপা ট্যাবলেট সাইজের একটা কেক দশ টাকা! মগের মুল্লুক নাকি? নাকের ফাঁক দিয়েই ঢুকে যাবে অনায়াসে। মানুষ খাবে কি?”

বৃষ্টি মুখ চেপে ধরলো হাসি আটকাতে। শুভ দোকানে নতুন মাল ভরছে। সুন্দর করে গুছিয়ে দোকানটা সাজিয়ে ফেললো। বৃষ্টি মনোযোগ দিয়ে দেখল। আকাশের বৃষ্টি থেমে আসছে। যাওয়ার সময় হচ্ছে।

কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে আমাদের আর দ্বিতীয়বার দেখা হয় না, দু মুঠো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার জন্য পরবর্তী কোনো বর্ষনমুখর দিনে তাদের মনে পড়ে যায়। কেউ মুখে সৃষ্টিকর্তার দরবারে তার জন্য মঙ্গল কামনা করে, অথবা কারো আত্মার তুষ্টিতে সৃষ্টিকর্তা নিজেই বুঝে নেন। বৃষ্টি ঠিক কোন দলে বোঝা গেল না।
.
.
আজ শুক্রবার। এই একটা দিনে ঘরের সব মানুষকে একসাথে পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় তনু ঝাল বড়া বানালো। পুষ্প চা করে সবার হাতে হাতে বিলাচ্ছে। শুভকে ঘরে পাওয়া গেল না। পুষ্প বারান্দায় উঁকি দিলো। আশ্চর্য! কিছুক্ষণ আগেই তো বসেছিলো এখানে। কোথায় গেল!

মাথায় ঘোমটা টেনে যেতে যেতে বললো,
— “ভাবী, আমি ছাদে যাচ্ছি।”
তনু এঁটো বাসন ধুতে ধুতে বললো,
— “এই রাত্রে ভাইবোন কী শুরু করেছিস?”

পুষ্প জবাব দিলো না। যেভাবে শশব্যস্তের মতো বেরিয়ে গেলো, জবাব দেয়ার কথাও নয়। পুষ্প ছাদে এসে দেখলো, শুভ মাথার নিচে দু হাত পেতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। উদাস চাহুনি, আকাশের পানে চেয়ে বিরহে কাতর যেন।

পুষ্প ওর পাশে বসে বললো,
— “দেবদাস হয়েছিস? পার্বতী কই তোর?”
শুভ ভাবলেশহীন চোখে তাকালো। প্রশ্ন এড়িয়ে বললো,
— “বস এখানে।”
পুষ্প ভ্রু কুঁচকে মেঝেতে বসলো। মাথার উপর রাতের কালো আকাশ। ঝিকিমিকি অগুনতি তারার মেলা তাতে। শুভ বললো,
— “তারাদের সঙ্গে রাত কাটানোর একটা মজা আছে, জানিস?”
— “না, তুই যে দার্শনিক সাজার চেষ্টা করছিস তা জানি। ছ্যাঁকা খেলে ছেলেরা এমন দার্শনিক বনে যায়।”
কী নিদারুন বিরক্তি তার কন্ঠে! অথচ সে এসেছে স্বেচ্ছায়, ভাইয়ের মন খারাপের সঙ্গী হতে। শুভ তাল হারালো না।

— “আকাশে কখনো সপ্তর্ষি, কালপুরুষ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছিস? বেশ দারুন। নিজেকে দরবেশ দরবেশ মনে হয়। আচ্ছা পুষ্প, তোর কাছে প্রেমের কোনো মানে আছে? সুন্দর কোনো সংজ্ঞা?”

পুষ্প শক্ত গলায় বললো,
— “না।”
— “না?”
— “প্রেম হচ্ছে একটা শারিরীক আকর্ষণ, শরীরের টানে বাজে বকে কবি-সাহিত্যিকরা।”
শুভ অবাক হয়ে গেল।
— “তুই আধাইঞ্চি সাইজের মেয়ে, অথচ কথা বলছিস দুশো মিটার মানুষের মতো। আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না! এই রাতে জ্বীনটিন ধরেছে তোকে?”
পুষ্প কথা ঘুরিয়ে বললো,
— “তুই বিয়ে করবি ভাইয়া?”
— “এইমাত্র বললি না প্রেম শারিরীক আকর্ষণ? বিয়ে কী এর ব্যতিক্রম হবে তাহলে?”
পুষ্প কিছুক্ষনের জন্য চুপ থাকল।
— “ভাইয়া?”
— “হুঁ?”
— “তুই জানিস? আমি ছেলেদের একদমই পছন্দ করি না? ওদের দিকে তাকালে আমার নিজের প্রতি ঘেন্না হয়?”
কাঁপা কাঁপা কন্ঠ ওর।
— “আমিও তো ছেলে।”
— “তুই তো আমার ভাই।”
— “সেই ছেলেটা কে?”
ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে শুভর বাহুতে। শুভ শক্ত হয়ে আছে। রক্ত বোধ হয় গরম হয়ে যাচ্ছে।
পুষ্প হেসে দিয়ে বললো,
— “কাল তোর জন্য আমরা মেয়ে দেখতে যাচ্ছি।”

কান্না কান্না চোখের হাসি সুন্দর হয়। পুষ্পকে খুব সুন্দর লাগছে হয়ত। শুভ কাঠ কাঠ গলায় বললো,
— “তুই ছেলেটার নাম বল।”
— “মানুষ কী আর মহাপুরুষ হয় বল? সবাই বলে ভুল, আমি সেই ভুল ক্ষমা করেছি। কিন্তু ভুলতে পারছি না কেন, ভাইয়া?”
শুভ ওর বাহু চেপে অদ্ভুত শান্ত গলায় বললো,
— “তুই নাম বল। আমি কিন্তু রাগ কন্ট্রোল করে পারছি না।”

পুষ্প খিলখিল করে হেসে ফেলল। এলোমেলো খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। শুভ কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বললো,
— “ভাইয়া? চল, তারাদের সঙ্গে রাত্রাভিযানে যাই। আমরা ইতিহাস গড়ব, ভ্রাতা-ভগ্নির নক্ষত্রমন্ডল আবিষ্কারের গল্প হবে। চমৎকার না?”

হাসিতে ওর গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। শুভর মনে হলো ওর বুকের বাঁ পাশের হৃদপিণ্ডটায় কেউ ধারালো ক্ষত বসিয়েছে। হাসির শব্দগুলো কানে ঠেকছে কোনো মৃত্যুপুরীর কান্নার মতো, যেখানে প্রতিনিয়ত নিষ্পাপ হৃদয়দের মৃত্যু হয়।

চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here