এক কাপ চায়ে পর্ব ১

0
838

— “তুমি কখনো প্রেমে পড়েছ নবীন?”

নবীন ঝাঁকড়া চুলগুলো নাড়িয়ে সহাস্যে বলল,
— “পড়েছিলাম, স্যার। মেয়েটা আমার ডিপার্টমেন্টেরই ছিল, স্কুল-কলেজও একসঙ্গে পার করেছি। বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই।”

এহসান গম্ভীর দৃষ্টে শুনলেন।
— “তোমার কখনো মনে হয়নি এটা তোমার ভুল?”

নবীন মাথা চুলকে লাজুক হয়ে বলল,
— “প্রেমে পড়া সুন্দর একটি অনুভূতি, স্যার। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আগেকার দিনের মতো যদি নাবালক থাকতে আমাদের ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো, কত ভালো হত! বিয়েটা একটা প্যারার মতো মনে হয় এখন। অথচ প্রেম করা হয়ে গেছে টিস্যু পেপারের মতো স্বস্তা, উপভোগ করলাম আর ছুঁড়ে মারলাম। আমি ভাবছি স্যার দ্বিতীয় প্রেমটা বিয়ে করা বউয়ের সঙ্গে করব। সাদামাটাভাবে বিয়ে হবে, যে আমার সব দারিদ্র্যতা মেনে নেবে, তাকেই আমার সব বিলাসিতা উৎসর্গ করব।”

এহসান উদাস গলায় বললেন, “প্রেম কী পবিত্র? তোমার কী মনে হয়?”

নবীন ভ্রু উঁচিয়ে খানিক ভেবে বললো, “প্রেম পবিত্র হতে পারে যদি আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রেমে পড়ি। এটাই সবচেয়ে বিশুদ্ধতম প্রেম। নারী প্রেম কিছুটা ভয়ংকর, স্যার। সবাই এক্ষেত্রে পবিত্র প্রেমে পড়তে পারে না। বেশিরভাগই নয়। মানবিক প্রেমে দ্বায়িত্ব থাকতে হয়, যত্ন করতে হয়, বৈধতার দরকার হয়, মনের মিল থাকতে হয়। সম্ভবত, পবিত্র জিনিসে কষ্ট করতে হয় তাই আমরা স্বস্তার পেছনে ছুটি। মানুষ আরামপ্রিয়,স্যার।”

এহসান সাহেব মৃদু হাসলেন। নিশ্চিন্তে আরাম কেদারায় ভর দিয়ে বললেন,
— “তোমার চিন্তা ভাবনা খুব সুন্দর, নবীন। আই এ্যাম ইমপ্রেসড।”
নবীন বুকে হাত রেখে দুষ্টুমির সুরে বলল,
— “মাই প্লেজার, স্যার। আপনার মেয়েটেয়ে থাকলে সুবিধা হতো। আমি জামাতা হিসেবে খুব একটা খারাপ হতাম না বোধ হয়।”

এহসান পুলকিত বোধ করলেন হয়ত কিংবা না। ধূসর চশমার এপাশ থেকে বিষন্ন চোখে চেয়ে রইলেন দূরে। বার্ধক্যের এই করুণ একাকিত্বে ছেলেটা এক পশলা চঞ্চল বৃষ্টির মতো। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে তার সহকারী পদে যোগদান করেছে। ওর নাকি বাঁধাধরা নিয়মে কিছু করতে ভালো লাগে না, সবসময় চায় নতুন কিছু জানতে, শিখতে। খেয়াল রাখায় পটু, মাঝেমাঝে ভুল করে নিজের ছেলে ভেবে ফেলতে ইচ্ছে হয়।

এহসান সাহেব হারিয়ে গেলেন অতীতের মিশেলে। যখন একটা নিশ্চুপ সংসার ছিল তার। আট দশটা গৃহস্থ ঘরের পুরুষদের মতো নিজের ঘাড়েও আস্ত এক পরিবারের দায় ছিল।

অশুভ শক্তি পৃথিবীকে ঘিরে ফেলছে ক্রমাগত। কে জানে হয়ত মানুষগুলোই সরলতার পথবিমুখ হয়ে অনাচারের দিকে হাঁটছে। রাত গভীর হলে এহসানের ভীষণ ভয় করে, মনে হয় মৃত্যু বুঝি তাড়া করলো বলে! তিনি আতঙ্কে ভাবতে বসেন, “মৃত্যুকে ভয় পায় কারা?”
.
.
চায়ে চুমুক দিতেই তনুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কি বিদঘুটে লাগছে খেতে! পানসে চা খাইয়ে এতগুলো মানুষের সন্ধ্যা নষ্ট করাতে ওর খুব খারাপ লাগছে। অথচ মাহবুবকে যখন চা দিয়ে গুরুতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল খেতে কেমন হয়েছে, সে মাথা নাড়িয়ে বলেছিল, “ভালো।”
ঘর শুদ্ধ লোক চা খেয়ে কোনো মন্তব্য করলো না। তনুর ইচ্ছে করছে এক মুহুর্তের জন্য বেদুইন হয়ে যেতে।

পুষ্প গুন গুন করে গান গাইছে। পুষ্পর গানের গলা বেশ ভালো। ও হচ্ছে পারিবারিক জনপ্রিয় গায়িকা। মাঝেমধ্যে সবাই মিলে বসলে ও দারুণ কন্ঠে গান শুনিয়ে সবার মন ভালো করে ফেলতে পারে। রমজান মাসে ইফতারির আগে ওর দ্বায়িত্ব থাকে চমৎকার করে কুরআন পাঠ করা। মাহবুব আর সিরাজ সাহেব তখন কেঁদে ফেলেন হুট করে। এত বিষণ্ণ সুর থাকে তাতে!

তনুর মন ভালো হয়ে গেল চট করে। ভাবলো আজ পোলাও করবে। এই রাত্রিবেলা আয়োজন করা একটু কঠিন হবে, তবুও করবে। মেয়েদের রান্নার প্রশংসা শুনলে বেঁচে থাকার ইচ্ছা কয়েকগুন বেড়ে যায়।

শুভ নিজের ঘরের মেঝেতে আধশুয়ে পা উপরে উঠিয়ে রেখেছে। পোলাওয়ের গন্ধ পেয়ে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো,
— “পেটের ভেতর কেমন যেন পোলাও পোলাও করে!”
রাবেয়া শলার ঝাড়ু হাতে ওর ঘরে উঁকি দিলেন,
— “টাকা তো দুইটা আয় করতে পারোস না। শুইয়া শুইয়া তোর পেট পোলাও পোলাও করে। তুই এমনেই থাকিস, তোরে আমি বিয়া করাইতাম না তো! তুই পড়ালেখা শেষ কইরা চা’র দোকানে কামলা দিবি। তোর ঘরে ভাত বন্ধ।”

অতঃপর চিরচেনা পুরোনো সুর ধরলেন, “এত টাকা খরচ কইরা ছেলেরে শিক্ষিত করছি, ভার্সিটি ভর্তি করাইছি, এক টাকা ঘরে ইনকাম কইরা আনতে পারলো না। আল্লাহ আমার কপালটাই এমন লেইখা রাখছে। মাইনষের পোলা-মাইয়া মায়রে কামাই কইরা আইনা দেয়। আর আমারটা বাপের হোটেলে খায়।”

তনু অসহায় গলায় বলল,
— “আম্মা প্লিজ!”
রাবেয়া তাকালেন না ওর দিকে। উনার ধারণা এই মেয়েটার অতিরিক্ত আহলাদে এরা গচ্চা যাচ্ছে। বউ হয়ে আসার পর থেকে সবার ভোল পাল্টে গেছে। সব বেলা ভাত পাচ্ছে এরা। সংসারের খরচ তরতর করে বাড়ছে। তবুও এই মেয়েটার মায়া মায়া চেহারার দিকে তাকিয়ে নিরব থাকতে হয়, আজকালকার বউদের কী এত ভালো হতে আছে?

মাহবুব ঘর অন্ধকার করে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। এ জীবনে ওর শান্তির ঘুমের কারণ এই অসম্ভব চমৎকার মেয়েটা। তাই এই চমৎকার মেয়েটির পানসে চা খেয়ে ওর মেজাজ খারাপ হয় না। ওর এলোমেলো পরিচ্ছদে মন খারাপ লাগে না। রাস্তায় চলতে ফিরতে গিয়ে খুঁতহীন রূপবতী রমণী দেখে ওর আফসোস হয় না। নিশ্চিন্তে মাথা গুঁজে ঘরে ফেরার তাড়ায় থাকে মন। এই মায়াবতী মেয়েটাকে মাহবুব কোন গুনে পেয়েছিল?

মাহবুব আর ভাবার ফুরসত পায় না। বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমানোর প্রয়াস চালালো সে। মোবাইলে টুং টাং ম্যাসেজের আওয়াজ আসছে। হুজাইফা ছেলেটার এ ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই। ওর একমাত্র কাজ মাহবুবকে বিরক্ত করা। মাহবুব ফোন সুইচ অফ করে দিল।
মৃদু গলায় ডেকে বলল,
— “মৃত্তি শুনো? আজান হলে একটু ডেকে দিও।”
পুষ্প চিৎকার করে বলল, “ভাবী রান্না করছে, ভাইয়া। তোমাকে বকছে, তুমি নাকি মিথ্যা কথা বলো।”
— “বউয়ের মিথ্যা প্রশংসা করা জায়েজ আছে।”
পুষ্প খুশি খুশি গলায় বলল,
— “ভাইয়া তাহলে আমার রান্না না শিখলেও তো চলবে, কী বলো? মিথ্যা প্রশংসা শুনতে রাজি আছি।”
মাহবুব কাঁথা মুড়ি দিয়ে বলল,
— “বউকে প্রয়োজনে হালকা প্রহার করাও জায়েজ।”

কি যেন ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। এই মেয়েটার এত রাগ!
.
.
— “তোতা গাছে আতা পাখি,
মউয়ের ঢালে ডালিম,
নবীন ভাইয়ের বিয়ে দাও মা,
আমি খাব হালিম।”

নম্র মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ছড়া কাটছে বেখেয়ালে। গোলগাল চেহারা, ছোট ছোট হাত পা মেলে ঘুমে ঝিমিয়ে উঠছে বারবার। আফরোজা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন,
— “তোকে কিন্তু আমি মাইর দেব নম্র! ঠিক করে পড়।”

নবীন ভাইয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,
— “এত দুষ্টুমি কই থেকে শিখেছিস বলতো?”
নম্র মাথা নাড়িয়ে বলল,
— “ভাইয়া, কবিতায় মানুষ মনের কথা বলে। এটা আমার মনের কথা। তুমি কিন্তু বিয়ে করলে ঘরের মেয়ে বিয়ে করবা। আমার সঙ্গে থাকতে হবে, মা’র মতো বাইরে গিয়ে আমাকে একা করে দিবে না। বুচ্ছো?”
নবীন হেসে ওর মতো করে মাথা নাড়িয়ে বলল,
— “বুচ্ছি।”
আফরোজা ব্যস্ত হাতে খাবার নিয়ে এলেন। ভাত মাখাতে মাখাতে করুণ গলায় বললেন,
— “তুই আমার এত মাথা খাস কেন বলতো, নম্র? আমি কী ইচ্ছে করে বাইরে যাই? তোদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে না?”

নম্র অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বলল, “মা, আমি কী নরখাদক যে তোমার মাথা খাব?”
আফরোজা ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে রাখেন। তার অতিরিক্ত পন্ডিত ছেলেটার দুগালে কষে চড় বসাতে মন চাইছে। বাপমরা এই ছোট ছেলেটার মায়া মায়া চেহারা দেখে নিজেকে শান্ত রাখেন, রাখতে হয়।

নবীনকে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন,
— “তোর খেয়েদেয়ে কী কাজ নেই? নিজের বাচ্চা পালার বয়সে ভাইকে বসে বসে আজগুবি বিদ্যে শেখাস। নরখাদকের মানে তো আমিও বুঝি না।”

নবীন হেসে ফেলল। এত সুন্দর করে বকে মা!
— “মা, তুমি চাইলে নিজের বাচ্চাকেও শেখাব।”
বলতে না বলতেই এহসান সাহেবের কল। আফরোজা মুখ বাঁকিয়ে বলছেন, “তোর মতো ভাতে মরা অ্যাসিস্ট্যান্টকে কে মেয়ে দেবে শুনি?”

নবীন কথা না বাড়িয়ে কল রিসিভ করল। এহসান সাহেবের ভীত সন্ত্রস্ত গলা।
— “নবীন! তুমি কোথায়?
— “জ্বী স্যার, বাসায়। কোনো সমস্যা হয়েছে?”
— “নবীন, আমার মেয়েটা, আমার মেয়েটাকে কে যেন…”
তার গলা জড়িয়ে আসছে বারবার। তিনি হুট করে কেঁদে ফেললেন।
— “নবীন আমার মেয়েটাকে কারা যেন মেরে ফেলেছে। আমার ঘরে লাশ পেয়েছি। আমার শরীর কাঁপছে, মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি।”

নবীন কিছু না ভেবেই বলল, “আমি আসছি, স্যার। আপনি ওখানেই থাকুন।”
ওর কপাল বেয়ে ঘাম বেয়ে পড়ছে। এতদিনের চাকরিজীবনে এহসান কখনো তার মেয়ের কথা বলেননি। তার ঘরেও তিনি একাই থাকতেন। হঠাৎ মেয়ে এলো, তাও মৃত হয়ে!

নবীন অনুভব করলো ওর বুকের কাঁপন বাড়ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু সামনে অপেক্ষা করছে ভেবে ভেবেই উতলা হলো মন। জীবন এত জটিল!

চলবে ~

#এক_কাপ_চায়ে : ০১
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

(একটু সেনসিটিভ টপিক, কতটুকু কী লেখি দেখা যাক। অবশ্যই সমালোচনা করবেন, খুশি হব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here