এক কাপ চায়ে পর্ব ১১

0
161

#এক_কাপ_চায়ে : ১১
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

নবীনের ঘুম ভেঙেছে পুষ্পর কাশির শব্দে। বারবার নাক টানছে। বিয়ের দিন ঢং করে একটু বৃষ্টিতে ভিজেছিলো। এখন বালিশ থেকে মাথা উঠাতেই পারছে না। বৃষ্টিতে সর্দি কাশি হওয়ার ওর ধাঁতে নেই। তবুও কাল অনেকদিন বাদে বৃষ্টি ভেজা তার। নবীন মাথায় হাত রাখলো। গরম গরম লাগছে। পুষ্প থাকবে ঠিক আড়াই দিন। এর মাঝেই অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছে। ফ্যান বন্ধ থাকা সত্ত্বেও মাঝেমাঝে কেঁপে উঠছে। পুষ্প ছোট ছোট করে চোখ মেলে তাকালো।

— “আরে কী করছেন আপনি!”
— “হা করো, থার্মোমিটার এটা।”
— “এতটুকুতে কিচ্ছু হয় না। একটা ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যায়।”
— “তোমার কাছে পরামর্শ চেয়েছি?”

পুষ্প কথা বলার শক্তি পেলো না। থার্মোমিটার টা মুখে নিয়ে দু’মিনিট চুপ থাকলো। নবীন পারদ দেখছে। পুষ্প ভাঙা গলায় বলল,
— “আপনাদের দেশের বাড়ি কোথায়?”
— “সন্দ্বীপ।”
— “ছোট থেকে তো ওখানেই ছিলেন না? মানে এই মোটামুটি বড় হওয়া পর্যন্ত?”

নবীন ভ্রু কুঁচকালো। পরক্ষণেই উত্তর দিলো,
— “হুম। প্রায় ১৬-১৭ বছর পর্যন্ত।”

পুষ্প বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ালো। আচমকা বলে উঠলো,
— “সামনে তো পূজার বন্ধ। আপনারা বাড়ি যাবেন না?”
— “আমি না মা যাবে।”
পুষ্প চট করে বলে বসলো,
— “আমিও যাব মায়ের সঙ্গে।”

নবীন অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। সে দৃষ্টিতে বিস্ময়ের কারণ পুষ্পর যেতে চাওয়া নাকি নবীনের মাকে ‘মা’ সম্বোধন করা বোঝা গেলো না। পুষ্প সন্দেহভাজন হবার আগেই বলে ফেললো,
— “আরে, ওখানে তো আমারও নানু বাড়ি। ভাবছি অনেকদিন যাই না। কলেজেও নতুন নতুন পড়ার চাপ নেই। ঘুরে আসি।”

নবীন ওর জন্য ঔষধ খুঁজতে ব্যস্ত। জ্বরের ঘোরে মেয়েটা হয়ত বেশিই কথা বলছে। নবীন গুরুত্বের সাথে কিছুই শুনলো না। অন্যদিকে পুষ্পর নিজেকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। সবকিছু কীভাবে সামাল দেবে সে পরিকল্পনায় বিভোর সে। বাসর রাতে নাকি জীবনসঙ্গীকে কিছু উপহার দিতে হয়, পুষ্পর উপহারটা একটু অন্যরকম।
.
.
— “আপনারা পুলিশ কেস করেননি কেন?”
— “এহসান বলছিলো, কেস করলে শুধু শুধু লাশটা কাটাছেঁড়া করবে, কী দরকার?”
— “আপনারা সন্দেহ করেননি?”
— “সন্দেহ করব কীভাবে? ওর রিডিং রুমে সত্যিই একটা চেয়ার ছিলো। চেয়ারের ভেঙে যাওয়া টুকরাও ছিলো। মুক্তার গলায়ও কালো কালো চিহ্ন দেখেছি।”
— “মুক্তা — এহসান সাহেবের স্ত্রীর নাম?”
— “জ্বি।”
— “সুইসাইডের কারণ জানতে চাননি?”
— “বলেছিলো, ওর মেয়ের জন্য। মেয়ে নাকি যোগাযোগ করছে না, তাই খুব চিন্তা করতো।”
— “মেয়ে?”
— “হ্যাঁ। মুক্তা একটা এতিম মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলো। এহসান মেয়েটাকে পছন্দ করতো না। তাই মুক্তা ওকে এক প্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে দেয়। ওর হাজবেন্ড পরে মেয়েটাকে বিদেশ নিয়ে যায়।”
— “সুইসাইডের এত সাদামাটা কারণ? আপনার বোন তো নাকি খুব বিশ্বাসী ছিলেন। আল্লাহকে যে এত মানে, তার সুইসাইড এত সহজে করার কথা না।”
— “কী করবো বলেন? লোকের নানা কথা ধামাচাপা দেওয়ার দরকার ছিলো, তাড়াহুড়ো করে কবর দিয়ে মিটিয়ে দেই। এহসানের সঙ্গে এখন তো সম্পর্ক নেই বললেই চলে।”

মাহবুব শান্ত চোখে দেখতে লাগলো সামনে বসা এক বোনের ভাইকে। বোনের জন্য একটু চিন্তাও সে করেনি। লোকের মুখের দুচার খানি বুলি বোনের মৃত্যুর উপরে প্রাধান্য বিস্তার করেছে।

মাহবুব উঠতে উঠতে বলল,
— “আপনি থানায় একটি মামলা করুন। জীবিত থাকতে বোনের যে দ্বায়িত্ব পালন করতে পারেননি, অন্তত মৃত্যুর পর তা করার সাহস দেখান। বিচারের দিন কী লোকের কথার অজুহাত দেখাতে পারবেন খোদ সৃষ্টিকর্তাকে?”

পেছনে বসা লোকটি কাচুমাচু করতে লাগলো। মাহবুব পেছন ফিরে তাকালো। চেহারায় চলনে বলনে বেশ সুপুরুষ দেখালো তাকে। জ্বলজ্বলে কঠিন চোখ নিয়ে বলল,
— “পুরুষ হবেন দয়া করে। নাহলে পৌরুষের গর্ব করা ভুলে যান। ঘরের মেয়েদের উপর সে দূর্বল কাপুরুষতা দেখানোর কী প্রয়োজন?”

শান্ত পায়ে ঠিক আগের মতোই চলে গেলো সে। পায়ের শব্দে কোনো দাম্ভিকতা নেই। অথচ কথাগুলো যেন হৃৎস্পন্দন বাড়ালো খানিক। সামনে থাকা পানির গ্লাস হাতে নিলো লোকটা। স্ত্রীকে ডেকে বলল,
— “মানিব্যাগ আর শার্ট দাও তো। একটু থানায় যাব।”
.
.
সকাল সকাল মাহবুবের খবর নেই। তনু আনমনে রান্নাঘরের জানালায় চেয়ে আছে। বৃষ্টি খুশি মনে রুটি ভাজছে। বিয়ের পরবর্তী দিন প্রতিটি মেয়ের জন্য সংকোচ আর ভীতির। ঠাকুমার ঝুলির গানটার মতো, ‘গা ছমছম, কী হয় কী হয়!’
বৃষ্টি রুটি ভেজে শুভর সামনে রাখলো। শুভ কাটায় ধরে দু’মিনিট রুটিগুলোর দিকে চেয়ে থাকলো।

প্রতিক্রিয়াহীন চোখে তাকিয়ে বলল,
— “রুটি গুলো এত ছোট কেন?”
বৃষ্টি ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
— “নাকের ফাঁক দিয়ে ঢুকে যাবে, তাইতো?”

শুভ অবাক হলো না। কূটনীতির ক্ষেত্রে মেয়েদের মাথা ভালো হয়। শুভ দুহাতে রুটির দুপাশ ধরে ভালোমতো তাকালো। মাঝ বরাবর পুড়ে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টি প্রশ্ন করলো,
— “কী দেখছেন অমন করে?”
— “আমার ভবিষ্যৎ।”

বৃষ্টি হাসতে লাগলো। ওমনি দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে পুষ্প বলল,
— “ভাবী, ভেতরে চলে যাও, কুইক!”

শুভ পেছন ফিরে তাকালো। পুষ্প মুখে হাত রেখে কাশতে কাশতে চেয়ার টেনে বসলো। প্লেট হাতে নিয়ে অনায়াসে শুভর হাত থেকে রুটি খেতে লাগলো। নবীন এসে বসেছে পাশে। শুভ কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল,
— “নবীন?”
নবীন হেসে বলল,
— “জ্বি ভাইয়া।”
— “তোকে কী বউ কন্ট্রোল কীভাবে করতে হবে সেও শিখিয়ে দিতে হবে?”
নবীন কিছু বললো না। পুষ্প খাওয়া থামিয়ে বলল,
— “আরে শোন, আমার শাশুড়ী তো স্কুলে গিয়েছে। যাবার আগে এত নাস্তা দিয়ে গেছে। আমার বর আমাকে রংচা করে খাইয়েছে। নম্র ওর ভাগের চকলেট দিয়ে গেছে।”
— “তো?”
— “এমনি বললাম আরকি, ধর নে, রুটি খা।”

রুটির প্লেটটা এগিয়ে দিলো সে। আদতে কোনো রুটি নেই। ও এঁটো বাসন হাতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। শুভ নবীনকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে বলল,
— “সব ঠিকঠাক?”
— “জ্বি ভাইয়া।”
— “জ্বি ভাইয়া কী, হ্যাঁ? এসব বিয়েশাদি হচ্ছে অনলাইন কেনাকাটার মতো। ছবিতে দেখবি ফকফকা, সুন্দর। কেনার পর গালি দিবি। গালি দে এখন?”
— “ছিহ্, ভাইয়া। গালি কেন দেব?”
— “মেয়েদের মতো ছিহ্ ছিহ্ করছিস কেন? কী চা করে খাওয়াচ্ছিস বউকে। মাইয়া মাইনষের ঔষধ হচ্ছে লাঠি। আমার দাদা প্রতি সকালে রিমাইন্ডার দিতো, বুঝলি?”
— “ও একটু অসুস্থ, ভাইয়া। ওকে কীভাবে মারবো আমি! মেয়েদের মারা যায়? অসম্ভব।”

শুভ ওর কাঁধে হাত রাখলো। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
— “পাশ,পাশ, তুই পাশ। আমার দাদা একবার কী করেছিলো জানিস? ঘুষি মে*রে দাদীর নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলো। শালা, খচ্চর লোক ছিলো। আসলে আমার আসল দাদা না, নকল দাদা। নকল দাদা বুঝিস?”

ওদের দীর্ঘক্ষণ বিবাহিত জীবন নিয়ে আলাপ আলোচনা চললো। শুভ অভিজ্ঞ বিবাহিত পুরুষের ন্যায় বক্তৃতা দিতে লাগলো। মনে হলো, তার কত বছরের বিবাহিত জীবন! অথচ বিয়ে হয়েছে সবে দু’দিন।
.
.
পুষ্প ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। আকাশের গর্জন বাড়ছে। মনে হচ্ছে আকাশপথে গাড়ির আসা-যাওয়া আছে। ও হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁতে লাগলো।

নবীন স্থির কন্ঠে বলল,
— “পুষ্প?”
— “হুম?”
— “আচ্ছা, তুমি তো আমাকে প্রথমে একদমই পছন্দ করতে না। হঠাৎ কীভাবে এত মিশে গেলে?”

পুষ্প হেসে উঠলো। বৃষ্টি পড়ার শব্দের সঙ্গে হাসির সুর মোহনীয় শোনাচ্ছে। চুড়ির ঝুনঝুন শব্দ তুলে চুল গুলো কানে গুজলো সে।

জ্বরে ভেঙে যাওয়া গলায় বলল,
— “দেখুন, আপনাকে এমন লুক দিয়েও আপনি বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছেন। যদি নরম সরম ভাব দেখাতাম, তাহলে কী হতো!”
— “তার মানে?”
— “আমি সত্যিই এমনিতে ছেলেদের এড়িয়ে চলি। যেকোনো কারণেই হোক। তার মানে এই না যে, একদম ঘৃণা করি বা কিছু।
আমি বিশ্বাস করি, এই মনের জায়গাটা একজনের প্রাপ্য। আমার বয়স যেহেতু কম, অবশ্যই সঠিক কাউকে নির্বাচন করার মতো বুদ্ধি হয়নি। এজন্য সবসময় ইগনোর একটা ভাব নিয়ে থাকতাম। এতে কেউ কষ্ট পাবে না, সুযোগও খুঁজবে না। তবে প্রেম বিষয়টা আমার কাছে ক্রিঞ্জ লাগে, আমি কিছুটা কনফিউজড।”

নবীন মাথা চুলকে বলল,
— “তুমি দেখি আমার চেয়ে ভালো বোঝো।”
পুষ্প দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,
— “ভালো বুঝলে দুলাইনে উত্তর দিতাম। আমি বেশি বোঝার ভান করি, আসলে গাধা।”
নবীন হেসে ফেললো।
— “তুমি কথা বলো এমন করে যেন কত বছরের সংসারী মেয়ে তুমি!”
— “আমি না, আমার বড় ভাবী। আমি তার একমাত্র শিষ্য। আপনি ভাইয়ার দেয়া বইটা পড়ছেন না কেন?”
— “তুমি চাও পড়ি?”

পুষ্প হেয়ালি গলায় বলল,
— “আমাকে বিশ্বাস-অবিশ্বাস করে কোনো ফায়দা নেই। আমি তো আমিই থাকব।”
— “তাহলে পড়বো না। বই পড়তে আমার ভালো লাগে না।”
— “আমার তো লাগে।”

নবীনও এবার হেয়ালি করলো। ভাব নিয়ে বলল,
— “বলা আছে, পড়ুয়া মেয়েকে বধূয়া করো। বধূয়া করতে নিজেকেও পড়ুয়া হতে হবে, এমন কোনো কথা বলা নেই।”

পুষ্প হাতের বৃষ্টিপানি গুলো ছুঁড়ে মারলো ওর দিকে। দুজনে একসাথে হেসে উঠলো।

চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here