একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৬+৭

0
987

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৬+৭
গাঢ়ো অনুভূতিতে পিষ্ট হয়েছে মন।অদ্ভূতভাবে কেমন যেন এলোমেলো লাগছে সবকিছু অর্থ’র।হৃৎস্পন্দের গতি অধীর দ্রুততার সাথে বাড়ছে।মস্তিষ্ক আর মন দুটো স্থানেই একটাই মুখশ্রী বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে।কেন এমন হচ্ছে অর্থ’র সাথে?কিসের এতো ব্যাকুলতা?কেন এতোটা টান অনুভব করছে সে ওই মেয়েটার প্রতি?এ কেমন যন্ত্রনা?মেয়েটার নাঁচের প্রতিটা মুহূর্ত কিছুতেই ভুলতে পারছে না অর্থ।কি সুন্দর অমায়িকভাবে নাঁচছিলো।কালো গাউনে যেন কোন হুরপরী লাগছিলো।একটা মেয়ের প্রতি এতোটা আকৃষ্ট কোনদিন হয়নি অর্থ?তবে আজ কেন? নিজের প্রতি নিজেরই অসম্ভব রাগ লাগছে অর্থ’র।যে অর্থ কিনা এতো বড় একটা বিজন্যাস সামলাচ্ছে।সেখানে নিজের মনের অনুভূতি,ব্যাকুলতা,অস্থিরতা সামলাতে পারছে।কিন্তু আদৌ কি বিজন্যাসের সাথে এইসব কিছুকে তুলনা করা কি বোকামি নয়?বিজন্যাস তো টাকায় চলে।কিন্তু? কিন্তু অনুভূতিগুলো কি টাকার ইশারায় চলে?নাহ! একদম না?তারা তো নিজেদের মন মর্জি মতো চলে।তাদের উপর কেউ নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা।কেউ না।কিন্তু আজ এতো বুদ্ধিমান অর্থ এই অনুভূতির পরিক্ষায় একেবারে শূন্যের কাঠায় দাঁড়িয়ে।নিজেকে সামলাতে না পেরে ড্রিংস সেক্টরে চলে যায় অর্থ।ওয়েটারকে একটা রেড ওয়াইন দিতে বলে মাথা চেপে ধরে বসে থাকে সেখানে।এদিকে অর্থকে অনেক্ষন ধরে খুজে চলেছে প্রাহি।অবশেষে অর্থকে দেখতে পেয়ে নিজেও সেদিকে এগিয়ে গেল।অর্থ’র থেকে খানিক দূরত্ব রেখেই বসলো।তারপর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ওর ভালোবাসার মানুষটিকে।লোকটাকে কালো রঙে ভীষন সুদর্শন দেখাচ্ছে।আজ যেন প্রাহির চোখ ফেরানো দায় হয়ে পরেছে।লোকটার নেশাক্ত চোখ যেন গভীর এক সমুদ্রে। ওই সমুদ্রে নিজের খেই হারিয়ে বসে আছে প্রাহি তো সেই কবেই। কালচে লাল ঠোঁটজোড়ার দিকে তাকালেই তীব্রেভাবে ঝংকার তুলে ওর মনে।সারা শরীরে অদ্ভুৎ শিহরন অনুভব হয়। ঘনকালো সিল্কি চুলগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে লোকটাকে। প্রাহি যখন নিজের মতো অর্থকে নিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত।ঠিক তখনই ওর সামনে এসে থপ করে বসে পড়ে কেউ।ধ্যান ভাঙ্গতে সামনে তাকাতেই।হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে প্রাহির।এ কাকে দেখছে সে? এতোক্ষন যে ভালোলাগার নেশায় মত্ত ছিলো প্রাহি। সেটা কেটে গিয়ে এখন একরাশ ভয়েরা এসে দানা বাধলো ভীতর ঘোরে।ঘোলাটে হয়ে আসলো দু-চোখ। আবার? আবার এই লোক ফিরে এসেছে?কেন এসেছে? ভয়ের তাড়নায় প্রাহি নড়তেও ভুলে গিয়েছে।সামনের ব্যাক্তিটি প্রাহিকে এতোটা ভয় পেতে দেখে ক্রুর হাসলো।অশ্লীলভাবে প্রাহির পা হতে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে নিয়ে বললো,

-‘ কিরে প্রাহি?আগের থেকে আরো বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছিস।ইউ আর লুকিং সো হট ইন ব্লাক ড্রেস।’

কথাগুলো আবারও প্রাহিকে বাজে নজরে দেখতে লাগলো।প্রাহির চোখ থেকে একফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।চোখ মুছে জলদি সেখান থেকে যেতে নিলেই হাত চেপে ধরে প্রাহির ব্যাক্তিটি।প্রাহি কলিজায় পানি শুকিয়ে যায়।ব্যাক্তিটির হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।শেষে না পেরে কেঁদে দেয় প্রাহি।ক্রোদন স্বরে বলে উঠে,

-‘ জয় ভাইয়া।প্লিজ ছেড়ে দেও আমায়।কেন এসেছো আবার ফিরে?কেন এসেছো আবারও আমার কাছে?আবার কেন আমাকে জ্বালাতন করছো?প্লিজ ছাড়ো আমাকে।’

জয় শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,

-‘ কেন ফিরে এসেছি?জানিস না কেন ফিরে এসেছি?তুই খুব ভালোভাবেই জানিস আমি কেন এসেছি আর ঠিক কি চাই আমি। ‘

জয়ের প্রতিটি কথায় কেঁপে উঠে প্রাহি।কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-‘ ছেড়ে দেও হাতটা!’

জয় আবারও হাসলো।হেঁসে আরেক হাত প্রাহিzর দিকে বাড়েতে নিলেই একটা শক্ত পুরুষালি হাত এসে আটকে দেয় জয়কে।জয় বিরক্ত হয়ে বললো,

-‘ আরে কে রে?কেন বিরক্ত করতে এসেছিস?’

কথাগুলো বলে তাকাতেই।হালকা ভয় পায় জয়।আস্তে করে প্রাহির হাত ছেড়ে দেয়।প্রাহি ছাড়া পেয়েই সেই লোকটার পিছনে গিয়ে লুকায়।লোকটা আর কেউ না অর্থ। অর্থ’র রাগে চোখ লাল হয়ে উঠেছে,কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে।অনেক্ষন যাবত দেখছিলো মেয়েটাকে এই ছেলে ডিস্টার্ব করছে।রাগ তো লাগছিলোই কিন্তু যখন দেখলো মেয়েটার হাত চেপে ধরেছে। আর মেয়েটা বার বার হাত ছেড়ে দেওয়ার জন্যে বলছিলো এতেই বুঝেছে অর্থ।ছেলেটা ওকে জ্বালাতন করছে।রাগে ভারি নিশ্বাস নিতে লাগে অর্থ।ছেলেটা আবারও হাত বাড়াতে নিতেই দ্রুত গিয়ে বাধা দেয় ও।

জয় দাঁতেদাঁত চিপে বলে,

-‘ হেই মিষ্টার হোয়াটএভার। হুয়াই আর ইউ ডিস্টার্বিং হার!’

জয় হাসলো।প্রাহির দিকে বাঁকা নজরে তাকাতেই প্রাহি ভয়ে আরো সিটিয়ে গেলো অর্থ’র দিকে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে জয় বলে,

-‘ সি’জ মাই কাজিন।আ’ম নট ডিস্টার্বিং হার মিষ্টার শিকদার।’

ভ্রু-কুচকে আসে অর্থ’র।ছেলেটা ওকে চিনে তাহলে।আর এই মাত্র কি বললো মেয়েটার কাজিন হয় এই ছেলে?তাহলে কেন বারবার ওকে ছেড়ে দেওয়ার কথাগুলো বলছিলো কাঁদতে কাঁদতে।ওই চোখের অশ্রুরা কেন এসে ভীর জমিয়েছিলো।কেন সেই চোখে অসীম ভয় দেখতে পেয়েছিলো অর্থ।
রাগ আরো বারলো অর্থ’র।ঘুরে প্রাহির দিকে তাকালো।মেয়েটার চেহারা ভয়ে একটুখানি হয়ে আছে।অর্থ রাগি কন্ঠে বলে,

-‘ এই ছেলে কি কাজিন হয় আপনার?’

এই প্রথম।এই প্রথমবার প্রিয় মানুষটি কথা বললো প্রাহির সাথে।প্রাহি কি অনেক খুশি হবে?হ্যা খুশিই তো হওয়ার কথা।কিন্তু জয়ের উপস্থিতি ওকে এতোটাই ভয়ে কাবু করেছে যে ও ওর খুশিটা প্রকাশ করতে পারছে না।অর্থ প্রাহিকে কথা বলতে না দেখে প্রচুর বিরক্ত হলো।প্রায় ধমকের স্বরে বলে উঠে,

-‘ কি হলো কথা বলছেন না কেন?আই আস্কড ইউ সামথিং আন্সার দ্যাট ড্যাম ইট!’

কেঁপে উঠলো প্রাহি অর্থ’র ধমকে।কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

-‘ হ্যা আমার কাজিন হয়।কিন্তু……!’

প্রাহিকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো জয় আর কিছু বলতে দিলো না।জয় আগ বারিয়ে বলে উঠলো,

-‘ দেখেছেন মিষ্টার শিকদার।আমি বলেছি আপনাকে ও আমার কাজিন হয়!’

-‘ তাহলে উনি কাঁদছিলেন কেন?কাজিন হলে কাঁদছিলেন কেন উনি?’

অর্থ’র কথায় হাসলো জয়।কিন্তু মনে মনে প্রচুর বিরক্ত হলো।মনে মনে বলে, সালা কি জাসুসিগিরি শুরু করলো। জয় কিছু বলতে নিবে।তার আগেই হেমন্ত কোথা থেকে এসে জয়কে টেনে দুগালে এলোপাথাড়ি চড় দিতে লাগলো।জয়ও রেগে পালটা আঘাত করতে লাগলো।কিন্তু হেমন্ত’র সাথে পারছে না।হেমন্ত দিগ বেদিগের হুশ হারিয়ে জয়কে মারছে।এদিকে অর্থ অবাক?হলো কি এটা।হেমন্ত কোথা থেকে এমন উল্কাপিণ্ডের মতো এসে জয়কে মারা শুরু করলো কেন?হচ্ছেটা কি?অনুষ্ঠানের এরশাদ সাহেব আর রাবেয়া বেগম জয়কে দেখে আৎকে উঠলেন।জলদি প্রাহিকে খুজতে লাগলেন। দেখে প্রাহিকে ইশি ধরে আছে।সেখানে অর্থও আছে।এদিকে শিকদার বাড়ির প্রতিটা মানুষ স্তব্ধ।হেমন্ত’র এমন আচড়নে।হেমন্ত জয়কে মারতে মারতে বলে,

-‘ তোর সাহস কিভাবে হলো কুত্তারবা**।জা*নোয়ার তোর হাত কেটে দিবো আমি।তোর সাহস কিভাবে হলো প্রাহির দিকে হাত বাড়ানোর।তোকে মেরে ফেলবো আমি আজ।কুকুরের জাত কোনদিন ভালো হয়না।তুইও ঠিক তেমন।তোকে না মেরে আজ শান্তি পাবো না।’

জয়ের প্রায় অবস্থা নাজেহাল।নাক মুখ দিয়ে রক্ত পরছে।হিয়াজ শিকদার আর হিয়ান্ত শিকদার হেমন্তকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু কিছুতেই পারছে না।এদিকে অর্থ ভ্রু-কুচকে সবটা দেখছে।ওর ভাইতো এমন না অকারনে কাউকে তো ওর ভাই মারে না।তাহলে আজ কেন এই এমন করছে?নিশ্চয়ই এর পিছনে কোন কারন আছে।তাই অর্থ এগিয়ে যাচ্ছে না হেমন্ত’র কাছে।এদিকে প্রাহি আর এইসব সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে চলে যায় হেমন্ত’র কাছে।হেমন্ত’র একহাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-‘ হেমন্ত প্লিজ ছেড়ে দে ওকে।প্লিজ হেমন্ত ছেড়ে দে।তোকে আমার কসম ছেড়ে দে।’

থেমে গেলো হেমন্ত রাগি চোখে তাকালো প্রাহির দিকে।ঠাস করে চর লাগিয়ে দিলো প্রাহির গালে।বাড়ির সকলে আকস্মিক হেমন্ত’র প্রাহিকে মারতে দেখে অবাক হয়ে যায়।এদিকে চর খেয়ে গালে হাত দিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে দিলো প্রাহি।প্রাহিকে কাঁদতে দেখে হেমন্ত চিল্লিয়ে বলে,

-‘ সাট -আপ। জাস্ট সাট-আপ।একদম কাঁদবি না আমার সামনে একদম কাঁদবি না।তোর সাহস কি করে হলো এই কুত্তারবা*চ্চার জন্যে কসম দেওয়ার।তোর জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলবো আমি।’

-‘ আমার কথা একটু শুন হেমন্ত….’।

প্রাহি বলতে পারে না তার আগেই হেমন্ত রাগি গলায় বলে,

-‘ কথা বলবি না আমার সাথে।কথা বলবি না।’

রাগে হনহন করে উপরে নিজের রুমে চলে গেলো হেমন্ত।প্রাহির কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে।আজ ওর আনন্দের দিন ছিলো।কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো এটা? রাবেয়া বেগম দৌড়ে এসে প্রাহিকে জড়িয়ে ধরলেন।মেয়েকে বুকের সাথে ঝাপ্টে ধরলেন।মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে মা’কে ঝাপ্টে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে প্রাহি।কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-‘ আম্মু ও আবার কেন এসেছে আম্মু।ওকে চলে যেতে বলো আম্মু।আমার সকল আনন্দ, খুশিকে এই লোকটা এক মুহূর্তে সব ধ্বংস করে দেয় আম্মু।ওকে যেতে বলো আম্মু।যেতে বলো! আমার সহ্য হচ্ছে না ওকে আম্মু। সহ্য……!’

আস্তে আস্তে শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দেয় প্রাহি।রাবেয়া বেগমের গায়ের উপরেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পরে।এরশাদ সাহেব মেয়ের এমন অবস্থা দেখে দিশেহারা হয়ে গিয়েছেন।জয়কে টেনে তুলে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,

-‘ আবার কেন এসেছিস চলে যা এখান থেকে।নিজের ভালো চাইলে চলে যা।নাহলে তোকে এক্ষুনি আমি পুলিশে দিবো চলে যা।’

জয় উঠে দাড়ালো।সবার বাড়ির প্রতিটা মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখলো।তারপর যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো।সদর দরজার সামনে গিয়ে আবারও পিছনে ফিরে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,

-‘ ভালো করলি না তোরা কেউ এসব।পস্তাতে হবে তোদের বড্ড পস্তাতে হবে।মনে রাখিস আমার এই অপমানের হিসাব আমি সুদে আসলে উশুল করে নিবো।’

অর্থ রাগি চোখে তাকালো জয়ের দিকে।গার্ড্সদের উদ্দেশ্য করে বললো,

-‘ গার্ড্স কুকুরদের রাস্তায় মানায়।তাই এই কুকুরটাকেও রাস্তায় ফেলে আসো।’

গার্ড্সরা কথামতো তাই করলো।জয়কে নিয়ে চলে যেতেই।অর্থ রাবেয়া বেগমের দিকে এগিয়ে গেলো।গলার স্বর নরম করে বললো,

-‘ আন্টি উনাকে আমার কাছে দিন।রুমে দিয়ে আসি।উনার উপর অনেক ধকল গিয়েছে।উনার রেস্ট দরকার।’

রাবেয়া বেগম মাথা নাড়ালেন।অর্থ এগিয়ে এসে প্রাহিকে কোলে তুলে নিলো।সাথে সাথে সারাশরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো।শিরশির করে উঠলো দেহটা।ভালোলাগার ছোয়ায় মাখোমাখো হলো।শীতলতায় হৃদয়টা ছেয়ে গেলো।মেয়েটার শরীরটা কি নরম! কি খায় এই মেয়ে তুলোটুলো খায় না-কি?নাহলে এমন নরম কেন?প্রাহির ছোট্ট দেহখানা যেন অর্থ’র প্রসস্থ বুকের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে।অর্থ প্রাহির মুখের দিকে তাকালো।কি স্নিগ্ধ মায়াবি মুখখানা। কান্নার কারনে চোখের কাজলগুলো লেপ্টে আছে এতে যেন চেহারাটায় মায়া আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।অর্থ দৃষ্টি সরালো। নিজেকে সংযত করলো।তারপর প্রাহিকে নিয়ে গেস্টরুমে সুইয়ে দিয়ে ডক্টরকে ফোন করে আসতে বললো।আবারও একপলক প্রাহির দিকে একপলক তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। এখন ওকে জানতে হবে কেন হেমন্ত ওই ছেলেটাকে মারলো।হেমন্ত এখন রুমবন্দি করে আছে এখন আর ওকে পাবে না অর্থ।এখন উপায় অর্থ’র আরেকটা বেষ্টফ্রেন্ড।ওর থেকেই জানতে হবে সব।তাই অর্থ খুজতে চলে গেলো ওকে।

#চলবে__________

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৭
ইশি চুপচাপ বসে আছে সোফায়।ওর সামনেই গম্ভীরমুখে অর্থ বসে আছে।ইশি এইবার মিনমিন কন্ঠে বলে,’ কিছু দরকার ছিলো ভাইয়া?আমাকে ডেকে পাঠালেন যে?’

অর্থ নড়েচড়ে বসলো।নিজেকে খানিকটা সামলালো।এইভাবে কোন কারো লাইফ নিয়ে ঘাটাঘাটি করা তার মোটেও ভালো লাগে না।তবে আজ কেমন যেন ও নিজের কৌতুহল দমাতে পারছে না।প্রাহির ওই জয়কে এতোটা ভয় পাওয়ার কারন জানার জন্যে ওর মন মস্তিষ্ক দুটোই অস্থির হয়ে উঠেছে।অর্থ প্রশ্ন করে ফেললো, ‘ আমাকে সব বলবে তুমি।প্রাহি কেন এতোটা ভয় পাচ্ছিলেন উনার কাজিনকে দেখে?আই নিড ইচ এন্ড এভ্রি ডিটেইলস ওফ দ্যাট!’

ইশি শুকনো ঢোক গিললো। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছে।সামনের টি-টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢোকঢোক করে খেয়ে ফেললো।এখন একটু ভালো লাগছে।আস্তে আস্তে বলা শুরু করলো ইশি, ‘ প্রাহি আমি হেমন্ত সবে মাত্র কলেজে উঠেছি।একদিন প্রাহির আব্বু মানে আঙ্কেলকে জানান উনাকে মিশনে যেতে হবে।তাও পুরো একবছরের জন্যে।আঙ্কেল আবার আর্মি ছিলেন।আঙ্কেল প্রাহিকে আর আন্টিকে একা এতো বড় বাড়িতে রেখে যাবেন এটা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন।তাই তিনি সিদ্ধান্ত ছিলেন প্রাহি আর আন্টিকে তার বাবার বাড়ি রেখে আসবেন।এতে আর আন্টি আর প্রাহিকে আর এতোটা খারাপ লাগবে না।অবশ্য তখন প্রাহির নানুভাই বেঁচে ছিলেন।তাই তারাও রাজি হয়ে যায়।এটাই ছিলো আঙ্কেলের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত।প্রথম ৬ মাস ভালোই কাটছিলো।হঠাৎ একদিন প্রাহির কাজিন মানে ওর মামাতো ভাই জয় বিদেশ থেকে আসে।প্রাহির সাথে কেমন যেন অন্যরকম আঁচরন করতো।প্রাহি প্রায় আমাকে আর হেমন্তকে বলতো যে জয় ওর দিকে কেমন যেন বাজে দৃষ্টিতে তাকায় আবার মাজে মাজে ওকে বাজেভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করে।হেমন্ত তো একদিন রেগেমেগে জয়কে মারার জন্যে যেতে চাচ্ছিলো।প্রাহি ওকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে থামায় যে আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর তো আঙ্কেল এসেই পরবেন। একদিন হঠাৎ জানতে পারলাম প্রাহিকে হোস্পটিলাইজ্ড করানো হয়েছে।আমি প্রায় ছুটে যাই প্রাহির কাছে।ওর জ্ঞান ফিরতেই আমাদের সবকিছু খুলে বলে ও।সেদিক নাকি ওর মা আর মামি সোপিংয়ে গিয়েছিলেন।আর প্রাহির মামা তো কাজে থাকেন।বাকি থাকে প্রাহির নানুভাই তিনি প্রায় শয্যাশায়ী মানুষ।অসুস্থ থাকেন প্রায় বারো মাসকাল।জা*নোয়ারটা সেই সুযোগটা লুফে নেয়।একলা ঘরে প্রাহির সাথে জোড়জবরদস্তি শুরু করে প্রাহি চিৎকার করাতে প্রাহির গায়ের ওড়না কেরে নিয়ে ওর মুখ বেধে দেয়।বিছানার চাদর দিয়ে ওর হাতপা বেধে দেয়।সেদিনই হেমন্ত প্রাহির থেকে কেমিস্ট্রি সাবজেক্টের নোট্স নিতে এসেছিলো।অনেকক্ষণ কলিংবেল বাজাচ্ছিলো কিন্তু কেউ দরজা খুলছিলো না। উপায় না পেয়ে দারোয়ানকে বললো এক্সট্রা চাবি দিয়ে গেট খুলে দিতে।দারোয়ান যেহেতু হেমন্তকে চিনে তাই আর বেশি দ্বিমত করলো নি।বাড়ির ভীতরে ডুকে হেমন্ত সারাবাড়ি খুজেও প্রাহিকে পাচ্ছিলো না।অবশেষে গেস্টরুমের কাছ থেকে যেতে নিতেই।কেমন যেন শব্দ পায় হেমন্ত।দরজা ঠেলে ঢুকতে নিলে দেখে দরজা বন্ধ।হেমন্ত আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দরজা ভেঙ্গে ভীতরে ঢুকে দেখে যা দেখে তা তো বুঝতেই পারছেন।হেমন্ত সাথে সাথে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করে জয়কে।জয় যখন জ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। ওকে ছেড়ে প্রাহির কাছে যায় হেমন্ত।প্রাহির অবস্থা দেখে কেঁদে দেয় হেমন্ত।প্রাহির হাতপা খুলে দিয়ে চাদর দিয়ে ওকে ঘুরে দেয়।অল্পর জন্যে প্রাহি সেদিন বেঁচে যায়।হেমন্ত ওকে নিয়ে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যায়।সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দেয় সবটা। আঙ্কেলকে সবটা বলাতে তিনিও সব ফেলে সেদিনই ছুটে চলে আসেন।জয়কেও ওর বাবা হাস্পাতালে ভর্তি করেন।এতো কিছুর পরেও জয়ের বাবা মা নিজের ছেলের কুকির্তী মেনে নেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন না। তাদের ভাষ্যমতে প্রাহিই নাকি তাদের ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এসব করার জন্যে আহ্বান করেছে।আর জয় ছেলে মানুষ একটু তো বেসামাল হবেই।প্রাহির নানুভাই প্রিয় নাতনির এই অবস্থা মেনে নিতে পারেননি।জয়কে সবাই পুলিশে দিতে চায়।হেমন্ত তো বার বার জয়কে মারার জন্যে যেতে চাচ্ছিলো। আমরা অনেক কষ্টে সামলিয়েছিলাম।প্রাহির মামা মামি পায়ে ধরে বলেন ওনার ছেলেকে যেন জেলে না দেয়।উনাদের কুমিরের কান্না দেখে মেনে নেয় সবাই। কিন্তু প্রাহির নানুভাই তৎক্ষনাৎ প্রাহির মামা, মামি আর জয়কে তেজ্য করে দেন। এমন একটা ঘটনা প্রাহির নানুভাই কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি।কিছুদিন পর তিনি মারা যান।এটা যেন প্রাহিকে আরো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়।একে সেই ঘটনা আবার ওর নানুভাই মারা যায়।এতে অনেক বড় একটা শক খায় প্রাহি। তিনমাস নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখে।আমি আর হেমন্ত অনেক চেষ্টা করে ওকে সুস্থ করেছি।কতো যে পাগলামি করতো।অনেক কষ্টে আবার ওকে আগের মতো করতে সফল হয়েছি আমরা।সেই থেকেই ও জয়ের নাম শুনলেই ভয়ে অস্থির হয়ে যায়।’

একনাগাড়ে সব বলে দম নিলো ইশি। এদিকে সবটা শুনে অর্থ’র সারাশরীর থরথর করে কাঁপছে।রাগে চোখ লাল হয়ে আছে ওর।হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে।ইশি অর্থ’র দিকে তাকালো।অর্থ’র এমন ভয়ংকর রূপ দেখে ভয় পেলো।মিনমিনে কন্ঠে বলে, ‘ ভাইয়া আমি প্রাহির কাছে যাই।’

ইশির কথায় কোনরূপ প্রক্রিয়া করলো না অর্থ।ইশি নিজেও আর কিছু না বলে উঠে চলে যায়।এখন ওর বোধহয় একটু হেমন্ত’র কাছে যাওয়া উচিত।ছেলেটা না জানি কি করছে।রাগ উঠলে তো আবার এই ছেলের হুশ থাকে না।

এদিকে অর্থ নিজের মোবাইলে কারো নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগালো। ফোন রিসিভ হতেই গম্ভীর গলায় বললো, ‘ আই এম সেন্ডিং আ পারসোন্স নেম এন্ড পিকচার।আই ওয়ান্ট ওল হিস ডিটেইলস। এন্ড ব্রিং হিম ফ্রোম হোয়ারএভার ইউ ক্যান।গোট ইট?’

ফোন রেখে আজকের পার্টির সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জয়ের ছবি নিয়ে সেন্ড করে দিলো।তারপ উঠে চলে গেলো। এখন গিয়ে প্রাহিকে দেখে আসতে হবে।মেয়েটার অবস্থা কেমন কে জানে?মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে আছে।

————-
মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে আছে প্রাহি।চেহারাটা কেমন মলিন আর শুকিয়ে আছে। চোখজোড়া কান্নার কারনে ফুলে ঢোল হয়ে আছে।ঠোঁটজোড়াও হালকা ফুলে আছে।চুলগুলো এলোমেলো।তারপরেও যেন মেয়েটার চেহারায় এক সমুদ্র সমান মায়া জড়িয়ে আছে।অর্থ তাকিয়ে আছে প্রাহির দিকে।মেয়েটাকে একবার দেখা শুরু করলো আর চোখ সরানো যায়না। এরশাদ সাহেবের কথায় প্রাহির থেকে চোখ সরায় অর্থ।

‘ আমরা এখন বিদায় নিতে চাচ্ছি মিষ্টার শিকদার।’

হিয়াজ সিকদার বললেন, ‘ আজ থেকে যান মিষ্টার রহমান।’

‘ না মনে দুঃখ নিয়েন না প্লিজ।আমাদের আজ যেতে হবে।বিদায় দিন আমাকে।’

এরশাদ সাহেবের করুন কন্ঠ শুনে কেউ আর জোড় করলেন না উনাদের।

প্রাহি উঠে দাড়াতে নিতেই মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়।অর্থ দ্রুত পায়ে এসে প্রাহিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সামলে নেয়। এদিকে অর্থ’র স্পর্শ পেয়ে সারা শরীর ঝংকার দিয়ে উঠে।থরথর করে কেঁপে উঠে সারা দেহ।অর্থ নরম কন্ঠে বলে, ‘ ঠিক আছেন আপনি?’

প্রাহি দূর্বল চোখে তাকালো অর্থ’র দিকে।আস্তে করে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো ঠিক আছে।অধীক উত্তেজনায় মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছে না ওর। এরশাদ সাহেব আর রাবেয়া এগিয়ে এসে মেয়েকে আগলে নিলেন।বাড়ির সবাই উনাদের বিদায় জানালেন।সবার থেকে বিদায় নিয়ে প্রাহিরা রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। ইশিও চলে যায় উনাদের সাথে।

—————–
ঘটনার চক্করে ডিনার করা হয়নি শিকদার বাড়ির কারোরই। সবাই ডিনার করতে বসেছে।হেমন্তকে অনেক ডাকা হয়েছে কিন্তু ও জানিয়ে দিয়েছে যে ও খাবে না।তাই আর বেশি কেউ জোড় করেনি।হেমন্ত ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না।ক্ষিদে লাগলে নিজে এসেই খেয়ে নিবে।সবাই যখন খাওয়ায় ব্যস্ত তখন হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে আসে হেমন্ত। অনেকটা ব্বিধস্ত দেখাচ্ছে ওকে।হেমন্তকে এই অবস্থায় দেখে অর্থ জিজ্ঞেস করে,’ হেমন্ত হোয়াট হ্যাপেন্ড?এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে।’

হেমন্ত যা বললো তা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না কেউই।শিকদার বাড়ির প্রতিটা সদস্য স্তব্ধ হয়ে আছে শুনে।হেমন্ত বলেছে, ‘ প্রা..প্রাহি! প্রাহিদের গাড়ি নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে।ওদের সবাইকে হাস্পাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।সবাই আইসিইউ তে ভর্তি।জলদি যেতে হবে আমাকে।আমি আসি ভাইয়া।’

হেমন্ত আর কাউকে কিছু না বলে।দ্রুত পায়ে চলে যায় বাড়ি থেকে।এদিকে বাড়ির সবাই খাবার রেখে তারাও রওনা হয় হাস্পতালের উদ্দেশ্যে।অর্থ’র বুকটা ধরাসধরাস করছে।হাতপা মৃদ্যু কাঁপছে।একটু আগেও মেয়েটাকে বুকে নিয়েছিলো অর্থ।অদ্ভূত ভালোলাগা কাজ করছিলো মনে।আর এখন এই খবর শুনতে হলো ওকে। এ কেমন ভাগ্যের পরিহাস।অর্থ’র গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিলো।যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হাস্পাতালে পৌছাতে হবে। সবাই যেন ভালো থাকে মনে প্রানে তা প্রার্থনা করলো।

#চলবে__________

ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।রি-চেইক করেনি।তাই ভুল থাকতেও পারে।সেগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here