#পর্ব_সাত
#একটা_সাধারণ_গল্প
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
-এই তুই ভাট বকিস না। কি করতে এসেছিস বল?
-ও আপনার কানে ঢোকেনি? বেশ জবরদস্ত প্রেম তো!
-বেশি বকিস না। কি চাই তোর?
-তোর হেডফোনটা দে।
-দেব না ফোট এখান থেকে, শালা তোর কোনো যত্ন নেই তুই নষ্ট করে দিস। তখন আমি গান শুনবো কি করে?
-ফোনটা তোর না মায়ের, আমারো সমান অধিকার।
-দেবো না যা..
ঘরে হেডফোন খুঁজতে শুরু করল প্রভদ।
-এই দাদা আমি কিন্তু দেব না।দেব না…
শুভদ এক কিল মারল প্রভদকে।
-হাত তুলবি তুই,দাঁড়া আমি মাকে একটা কথা বলছি। ও মা,তোমার ছোট ছেলের আর পড়াশুনা হবে না। প্রেমে পড়েছে ও।
-দাদা বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু!
খ্যাপা ষাঁড়ের মতন তেড়ে গেল শুভদ।
মুহূর্তে খন্ডযুদ্ধ বেধে গেল দুই সহদোরের মধ্যে..
ছুটে এল ওদের মা।
-এখনো অব্দি যদি তোদের মারপিট সামলাতে হয় তাহলে কিছু বলার নেই। দুটোর যত বয়েস বাড়ছে তত গোল্লায় যাচ্ছে।
মায়ের মধ্যস্হতায় শুভদ হেডফোন দাদার হাতে তুলে দিতে বাধ্য হল।
-ইয়ে কালা রঙ ক্যব মুঝে ছোডেগা..
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল প্রভদ।
তখনো রাগে গড়গড় করছে শুভদ।
মাথার টুপিটা খুলে ফেলল ও।
মনে মনে একটা মোক্ষম পরিকল্পনা করল ও।
-আমার সব বন্ধুদের নিজস্ব ফোন আছে, আমারো ফোন চাই!
আলুর পরোটাটা এক টুকরো মুখে দিয়ে বললো শুভদ।
-কেন মায়ের ফোনটা তো বগলদাবা করে রেখে আবার ফোন চাই?
-পার্সোনাল ফোন চাই।যার হেডফোন চার্জার শুধুমাত্র আমার কাছেই থাকবে।
মনে মনে আহত হল প্রভদ। শুধু হেডফোন নেওয়ার জন্য ছোট ভাই এইভাবে খোটা দিতে পারে!
-মায়ের ফোন যে তোর কাছে থাকে।
-না বাবা,মাও যে মাঝেমাঝে হোয়াইট অ্যাপ করে। সবসময় কোথায় থাকে?
-হ্যাঁ রে শয়তান,সংসারে কাজ সামলে আমার যেন কত সময় থাকে!
মুখ ঝামটা দিল শুভদের মা কৃষ্ণা।
বেগতিক দেখে বেজার মুখে বললো,
-বাবা আজকাল জেরক্স এর যুগ নেই হোয়াটসঅ্যাপে স্যার পাঠিয়ে দেয়। তাই আর কি!
-সে তো তোর নম্বর মানে মায়ের নম্বর দেওয়া আছে।
গম্ভীর স্বরে বলল শুভাশিষ ঘোষ ।
-সবার নিজস্ব ফোন আছে আমারো চাই।
-বাবা তুমি জানো না এখন ভাইয়ের ব্যক্তিগত ফোনের প্রয়োজন আছে।আর তুমি ভাইয়ের কালো টুপিটা দেখনি? ওটা পরে কি সুন্দর লাগছে ভাইকে..
মাথায় রক্ত চড়ল শুভদের।
-তবে রে!
চেয়ার ছেড়ে উঠে তেড়ে গেল প্রভদের অভিমুখে।
-তোদের আবার শুরু হল!
চিৎকার করে উঠল কৃষ্ণা।
-বেশ ফোন পেয়ে পড়াশোনা আবার শিকেই তোলো না। কাল সকালে দাদার সাথে গিয়ে কিনে আনবে।
-বাবা 5000 এর বেশি ওঠো না..
প্রতিবাদ করল না শুভদ। বাবার কথাটা শুনে ঘোরে আছে ও। একটা ব্যক্তিগত ফোন হলেই হল।
জল যেদিকে বইছে তাতে মনেই হচ্ছে পর্ণার বন্ধু হয়ে উঠছে ক্রমে ক্রমে..
ছিল সহপাঠী, এখন বন্ধু। ভবিষ্যতে প্রেমিকের জায়গাটা পাকা হয়ে যেতেই পারে। মুচকি হাসল শুভদ।
-এই হাসছিস কেন? খাবারটা যে পড়ে আছে খা।
কৃষ্ণা তাড়া লাগল ছোট ছেলেকে।
-মা যাই বলো ভাইয়ের কালো টুপিটা বেশ লাগছে। এমা ভাই তুই এখন টুপিটা পরিসনি কেন?
খাওয়ার শেষে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল প্রভদ।
প্রত্যুত্তরে শুধু মুখ বেঁকালো শুভদ।
পরেরদিন সকালে আবারো স্কুল কামাই করে ফোন কিনে আনল শুভদ।
শোরুমে গিয়ে বারো হাজারের নিচে ফোন মনে ধরল না শুভদের।
জেদাজেদি করে, হায়ার সেকেন্ডারীতে ভালো রেজাল্টের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাবার কাছে আদায় করল ফোনটা।
বন্ধুর নতুন ফোনের খবর পেয়ে স্কুল কামাই করে ছুটে এসেছে মহিম।
-অরিব্বাস তোর ফোনটা তো দারুণ! দেখি একটা ফটো তুলে দেখি।
ক্যামেরাটা অন করল মহিম।
-এই খবরদার ওতে তুই ফটো তুলবি না।
বলে মহিমের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিল শুভ।
অবাক হল মহিম।
-দাঁড়া একটু কাজ আছে।
পর্ণার হোয়াইট অ্যাপ অ্যাকাউন্টের ডিসপ্লে পিকচারটা স্ক্রিনশট নিয়ে রাখল শুভ। টুপিটা পরে পাঁচ ছয়টা কেত মেরে ফটো তুলে মহিমের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিল।
-নে এবার যত ইচ্ছা ফটো তোল। আসলে প্রথম ফটো আমার ডার্লিং এর থাকবে না সেটা কি হয়?!
পর্ণার কথা ভাবতেই ওষ্ঠ প্রসারিত হল শুভদের। দুহাত ছড়িয়ে চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল ও।
-ঢং!
মৃদু স্বরে বলল মহিম।
সেলফি গুলো থেকে অনেক বিবেচনা করে একটা ফটো পাঠালো পর্ণাকে ।
“দ্যা ফার্স্ট সেলফি অফ মাই নিউ ফোন”
সঙ্গে সঙ্গেই দুটো নীল দাগ দেখালো স্ক্রিনে..
“কনগ্রাচুলেশন ”
ঐ প্রান্ত থেকে উত্তর দিল।
“এখুনি নিয়ে এলাম, এসেই প্রথমেই তোকে মেসেজ করলাম”
মেসেজটা দেখলেও ঐ প্রান্ত কোনো উত্তর দিল না।
“কি হল পর্ণা? এনি থিং রঙ?”
এরপর একটা স্যাড ইমোজি এল শুভদের ফোনে।
বিচলিত হয়ে পড়ল শুভদ,সাথে সাথেই পর্ণার নম্বর ডায়াল করল ও।
রিসিভ করল পর্ণশ্রী সেন।
-কি হল পর্ণা?
উত্তর দেয় না ও।
-কি হয়েছে বল না!
তর সইছে না শুভর। পর্ণার মন খারাপের কারণ যে ওর এখুনি জানাতে হবে।
-সুমির স্কুটির পিছনে নিলয়কে দেখলাম। আমি সহ্য করতে পারিনা যে!
কি কষ্ট হয় তোকে বলে বোঝাতে পারব না।
কেঁদেই ফেলল পর্ণা।
-চুপ কর পর্ণা! নিজেকে সামলা।নিলয় কোনোদিন তোর যোগ্য ছিল না।
-সবচাইতে খারাপ লাগে কাকিমার ব্যবহারে..
নাক টেনে বলল পর্ণা।
-কিরকম!
-কাকিমা আমাকে আগে মেয়ের মত ভালবাসত কিন্তু এখন এমন ভাব দেখায় যেন আমাকে চেনেই না।
-তাই!
-আসল কথা কি জানিস। কিছু মনে করিস না,তোকে বলছি।
একটু থামল পর্ণা।
আমাদের অবস্থা ওদের থেকে বহুগুণে ভালো। আমার সাথে ভবিষ্যতে সম্পর্ক হলে নিলয় ভবিষ্যতে লাভবান হত। এই আশাতে আমাকে প্রশ্রয় দিত। সুমিও অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। তাই কাকিমার দল বদলাতে সমস্যা হয়নি..মানুষ এত বদলে যায় কেন বলত?
পর্ণার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে কোনো সদুত্তর খুঁজে পেল না শুভদ।
ফোন-মেসেজ চালাচালি হতে থাকে ওদের। পর্ণার মনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে শুভদ।সম্পর্কের নামটা অবশ্য কাছের বন্ধুতে আবদ্ধ আছে।
একমাস কাটল এইভাবেই। মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথির সময় আগত হল।
রথীন স্যারের কোচিং-এ বড় করে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
-পর্ণা সরস্বতী পুজোতে তুই কি স্কুলে যাস?
-নারে বাড়িতে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর ঘরে থাকি কোথাও আর যাওয়া হয় না।
-এবার আসবি তো?
-নারে সেরকম কোনো ইচ্ছে নেই..
-ইচ্ছে নেই বললে হবে ইচ্ছে তৈরি করতে হবে। তুই আসবি আর শাড়ি পরেই আসবি না..
-নারে আমার হবে না। শাড়ি সামলাতে আমি পারবো না।
-সব পারবি। একটু চেষ্টা করনা।
দুধারে গজ দন্ত বিকশিত করে হাসল পর্ণা।সেটা অবশ্য ফোনের ওপার থেকে শুভদ অনুমান করতে পারল না। ও স্থির করেছে এবার সরস্বতী পূজোতে রথীন স্যারের কোচিং যাবে,শাড়িও পরবে।তবে ও মনে মনে চাইছে সেই ছেলে আরো একবার, আরো একবার ওকে জোর করুক। তাহলে ও রাজি হবে।
-তুই স্কুলে যাবি না? ওখানে তো কত জ্যান্ত সরস্বতী দেখতে পাবি।
-আমি কাউকে দেখতে চাই না।প্রতিবছরই তো যায় এবারের স্যারের পুজোর কাছে থাকবো। তুই আসবি ব্যাস এটাই আমার শেষ কথা। নাহলে তোর সাথে ফ্রেন্ডশিপ থাকবে না।
-তুই না খুব জেদ করিস। আচ্ছা বাবা যাব।
-শাড়ি পরতে হবে কিন্তু!
-আবার আবদার!
-হুম যাব। আর শাড়ি পরেই যাব। এমন পেতনি দেখাবে চিনতে পারবি না।
-সেরা দেখাবে।
রক্তিম বর্ণ ধারণ করল পর্ণার দুই গাল।
শুভদ ছেলেটার মধ্যে এমন কিছু আছে যাতে সহজে বশীকরণ হয় ও। ওকে বেশ আগলেও রাখে। মা-বাবা ছাড়া কেউ যেটা করেনি।বেশ ভালো লাগে পর্ণার। তবে এটা কখনো ভালোবাসা নয়,ভালোলাগাও নয় শুধুমাত্র বন্ধুত্ব।
নিজের মনকে শাসালো পর্ণা।
শুভদও ততক্ষণে শাড়ি পরিহিত পর্ণাকে কেমন দেখাবে সেই অবয়ব মস্তিষ্কে আঁকছিল,মনও সায় দিচ্ছিল তাতে..
ও দেখছে একটা লাল শাড়ি পরে খোলা চুলে পর্ণা এগিয়ে আসছে ওর দিকেই..চোখে দিয়েছে গাঢ় কাজল,ঠোঁটে..
-এই শুভদ কি ভাবছিস?
পর্ণার কথায় বাস্তবে ফেরে শুভদ। শেষ পর্যন্ত পর্ণার সাজ আর দৃশ্যমান হল না!
-ভাবছি সেদিন আমারা সিনেমা দেখতে যাব।
-কী!
-আরে সম্পূর্ণ কথাটা শোন তারপর আঁতকে উঠবি। মহিম-মাম্পি মানে আরো সবাই যাবো। ঘরে বলেই আসবি। প্রয়োজনে আমাদের সবার নাম বলবি। দেখ মিথ্যা বলে কখনো কোনোকাজ করবি না। এতে বাড়ির লোক তোর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। সত্যি বললে ওনারাও যেতে দেবে।বুঝলি?
একটা লম্বা চওড়া জ্ঞান দিয়ে থামলে শুভদ।
কথাগুলো বেশ ভালো লাগল পর্ণার।
-আচ্ছা আমি মা-পাপাকে বলে দেখব। যদি পারমিশান দেয় তো অবশ্যই যাব। চল এখন রাখি,এখন আমাকে সংস্কৃত পড়া করতে হবে।কাল টিউশন আছে..
-গুডনাইট পর্ণা।
-বাই,গুডনাইট..
ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায় শুভদ। বিদ্যার দেবীর পুজো পাঁচ দিন পর।
অপেক্ষা আর পাঁচদিনের..
একটা ভালো লাগার আবেশে চোখ বন্ধ করে ও।
চলবে: