#একটা_সাধারণ_গল্প
পর্ব ছয়
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
-বল!
গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এল ঐ প্রান্ত থেকে।
হাওয়াই দুলতে দুলতে অনেকটাই উপরে উঠে গিয়েছিল গ্যাস বেলুনটা, পাখির ঠোঁটের সামান্য স্পর্শে চুপসে ধীরেধীরে মাটিতে পড়লো। যতটা দ্রুততার সাথে উড়ছিল,ঠিক সেইরকম ভাবে পতন হল।
মুখে কথা যুগালো না শুভদের।
-ফোন কেন করেছিস?
-পর্ণা আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো ভাষা নেই, আমি ভুল করেছি স্বীকার করছি। তোর সম্পর্ক ভেঙে যাওয়াতে আমি মর্মাহত।প্রয়োজনে আমি নিলয়ের কাছেও ক্ষমা চাইতে পারি। আমি আবার তোদের সম্পর্ক ঠিক করে দেব।
শুভদের কথাগুলো একনিষ্ঠ শ্রোতার মতনই শুনছিল পর্ণা। কাল থেকে যে ও শুনেই যাচ্ছে। তবে শুভদের শেষ বলা কথাটাতে জ্বলে উঠলো ও।
-তোর বলা হল তো ফোনটা রাখ!
-আমি তোর ভালোর জন্য বললাম।
-আমার ভালো কেউ চাই না।কেউ না..
-আমি জানি তোর মনটা ঠিক নেই,তবে কেউ তোর ভালো চাই না এই অভিযোগটা ঠিক নয়।
কেউ গোপনে তোর জন্যই প্রার্থনা করে।
-কে সে?
-ধর আমি..
নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরল শুভদ।
ফুলছে,ফুলছে..মনে আশার বেলুনটা আবার ফুলছে।
-হ্যাঁ দুমাস পরিচয়ে,দুই একবার স্কুল থেকে ফলো করলে শুভাকাঙ্খি হওয়া যায়?তোর গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, এরপর তো আমাকে প্রপোজ করে ফেলবি।
-যদি তাই করি!
-উত্তরটা না হবে শুভদ।কেননা আমার পক্ষে আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। সে ধোকা দিতেই পারে, কিন্তু..
কথাটা সম্পন্ন করতে পারলোনা পড় না তোর গলা বুজে এলো ওর।
শুভদের মনে তখন প্রশ্ন জাগছে,ধোকা দিল কথার অর্থ কি! পর্ণাকে সামলে নেওয়ার কিছুটা সময় দিয়ে আবারো প্রশ্ন করল শুভদ।
-আমার জন্য কি সম্পর্কটা তোদের শেষ হল?
-নারে তুই তো ছিলিস নিমিত্ত মাত্র।আসল কারণটা অন্য। নিলয় অন্য কাউকে ভালোবাসে..
-কী!!
-যেটা শুনলি সেটাই সত্যি।
শীতল শোনালো পর্ণার কন্ঠস্বর।
-এটাই হয় জানিস তো। আমার জন্য অনেক ছেলে মরে। স্কুলের বাইরে কতজন অপেক্ষা করে।ফুল গ্রীন কার্ড উপহার দিতে চাই আমাকে। অচথ আমি যাকে ভালোবাসি সেই আমাকে ভালোবাসে না।
প্রত্যুত্তরে মৌণ থাকে শুভদ।
-ছাড় তোকে মনের অনেক কথা বলে ফেললাম তোকে।এখন রাখছি।
ছোট্ট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল শুভদ।
মুখে বললো,
-আচ্ছা!
-বাই দ্যা ওয়ে,তোর শরীর কেমন আছে?
-নাও বেটার।
-গ্রেট! সাবধানে থাকিস। চল পরশু দেখা হবে..
-পর্ণা!
-কি?
-শক্ত হ একটু।
-শুভদ এতদিনের সম্পর্ক ভেঙে গেলে মনের দিক থেকে কি যায় তুই বুঝতে পারবি না। সব স্বপ্ন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে..
ফোনের লাইন ডিসকানেক্ট করে দিল পর্ণা।
শুভদ অনুমান করল পর্ণার উপর দিয়ে কি ঝড় বইতে পারে। তবে এটা ভেবে স্বস্তি পেল ওর কারণে ওদের সম্পর্ক শেষ হয়নি।
শরীরটা চনমনে লাগছে ওর। কাল রাত থেকে শরীরের উষ্ণতাও বাড়ে নি। এখন শুধু পরশুর অপেক্ষা,কখন পর্ণাকে দেখতে পাবে।
ইচ্ছা তো করছিল পর্ণার নম্বর ডায়াল করতে কিছু কথা বলতে। নিজ ইচ্ছা দমন করে একটা টেক্সট মেসেজ করল শুভদ।
মাথা চুলকে চুলকে চার লাইনের লিখল ও।
“তোর দুঃখের ভাগীদার হব,
সর্বদা পাশটিতেই রব
কোন চাওয়া-পাওয়া আমার নাই
শুধু আমি বন্ধু হতে চাই।”
রিপ্লাই-এর আশায় চাতক পাখির মতন বসে রইলো শুভদ। দিন যেন কাটছেই না..
খেয়ে ঘুমিয়ে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না।
আবারো টাইপ করল “কিরে তুই ঠিক আছিস?”
এবারেও আগের অবস্থা বহাল থাকল।
তারপর এল সেই রথীন স্যারের কাছে পড়তে যাওয়ার দিন।
সাড়ে পাঁচটা থেকে রেডি হয়ে বসেছিল শুভদ। অপেক্ষা করছিল ছয়টা কুড়ি বাজার। ইচ্ছা করছিলো ঘড়ির কাঁটা গুলোকে নিজের হাতে ছয়টা কুড়ি অবস্থানে আনতে..
একদৃষ্টিতে ঘরে নিজের ঘরের দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকল ও। বাইরে তখনো কালো চাদরে মোড়া, প্রকৃতি ফরসা হতে কিছুটা সময় লাগবে।
-শুভ! এই শুভ আজও কি পড়তে যাবিনা?
দরজা ধাক্কা দিচ্ছে মহিম।
শুভর রুমটা প্রধান আবাস মানে দোতলা ঘর থেকে দশহাত দূরত্বে অবস্থিত। জয়েন্ট ফ্যামিলীতে থাকে ওরা।ঘোষভবনের উপরতলা ভাগে পেয়েছে শুভর বাবা। নিচে থাকে ওর কাকু।
শুভ ও ওর দাদা এক ঘরে এক সাথেই শুত। যতদিন যেতে থাকল একটা আলাদা ঘরের প্রয়োজন হয়ে পড়লো ওদের। তাই বাড়ির গা ঘেষে উঠোনে একটা অ্যডবেস্টটরের ঘর করা হয়েছে। ভিত করা থেকে নিজের জন্য বুক করে রেখেছিল শুভদ। ঘরটা সম্পূর্ণ হওয়ার পর গেঁড়ে বসেছিল ও।
কোন এক দূর থেকে নিজ নামটা ভেসে ভেসে আসছে ওর কর্ণকুহরে..
-এই শুভ দরজা খোল!
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো শুভদ। জ্যাকেট পরেই বিছানায় ঢলে পড়েছিল ও। ঘড়ির কাটাটা তখন মুখ ভেংচে ছয়টা পঁচিশ দেখাচ্ছে।
ব্যাগটা গোছানোই ছিল।দ্রুততার সাথে ব্যাগটা নিয়ে বাইরে এল ও।
-চল চল অনেক দেরী হয়ে গেল।
চোখ কচলাতে কচলাতে বললো শুভদ।
এলেমেলো চুলে শুভদ যখন রথীন স্যারের কোচিং -এ এল তখন ক্লাস ভর্তি হয়ে গেছে। এমনকি পর্ণাও তখন চলে এসেছে।
ওর এলোমেলো চেহারা দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো পর্ণা। কিছু বলতেও যাচ্ছিল তার আগেই রথীন স্যার ঢুকলো।
অন্যদিনের মতনই শুভদের বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল পর্ণার অভিমুখে।
-এই তোর না জ্বর এসেছিল,কানে কিছু দিসনা কেন?
আরো তো জ্বরে পড়বি..
ক্লাস শেষ হওয়ার পর এই একটা কথায় বললো পর্ণা
ক্যাবলা হাসলো শুভদও।
সেদিনই বাজারে গিয়ে প্রায় চোদ্দটা টুপি ট্রায়াল দিয়ে একটা মনে ধরলো ওর। টুপিটা পরে বেশ হ্যান্ডসম দেখাচ্ছে ওকে..
এবার ঐ কন্যাকে দেখানো বাকি। যদি কোনো প্রশংসা ভেসে আসতেই পারে ঐ তরফ থেকে।
পরশু দিনের অপেক্ষা করতে লাগলো শুভদ। অপেক্ষার প্রহর এত দীর্ঘ কেন হয় কি জানি!
সেদিন সকালে টুপিটা পরে গেল রথীন স্যারের কোচিং।
কিছু কথা ভেসে এলনা পর্ণার তরফ থেকে।
নিজের কালো টুপিটা খুলে,আবার পরে পর্ণার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিল।
এবারেও সফল হল না ও..
নিরাশ হল শুভদ।তবে আশা ছাড়লো না।
-পর্ণা তোর খাতাটা দিস তো!
-কেন?
-সেদিন অ্যবসেন্ট করলাম না,তাই নোট টুকব। মহিমের খাতাটাই নিতাম, ওর হ্যান্ডরাইটিং খুব খারাপ তাই তোরটা দিলে খুব ভালো হয়।
মনে চার অক্ষরের গাল দিয়ে বড় বড় চোখ করে শুভদের দিকে তাকাল মহিম।
মাম্পিও মুচকি হাসছে।
মহিমের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে শুভদ আবার বললো,
-দিবি তো পর্ণা?
-হ্যাঁ নিস..
ওষ্ঠ প্রসারিত হল শুভদের।
ক্লাস ছুটির পর খাতা নিল শুভদ।
-তোকে টুপিটাতে ভালো মানিয়েছে..
বলছে বলেছে..
সেই কন্যার কাছ থেকে প্রশংসা শুনেছে। ওর টুপি পরা সার্থক। এমন করে বললে ওর জন্য বা ঐ কন্যার কাছে আজীবন টুপি পরতে ও ইচ্ছুক।
স্কুলে গেলনা শুভদ। সারাদিন মাথায় জড়িয়ে রাখলো ওর টুপিটা। যেটা মাত্র কিছু ঘন্টা আগে ওর প্রিয় হয়ে উঠেছে।
দুপুরে মাথা ঢুল না শুভদ, খাওয়ার সময়ও তাই।
ওর মা আড়চোখে তাকাতেই আগেভাগে বলে উঠলো,
-খুব ঠান্ডা লেগেছে তো তাই পরে আছি।
খাওয়ার পর দুইগালে হাত দিয়ে উপুড় হয়ে খাটে শুয়েছিল শুভদ।
মনে সেই কন্যারই আনাগোনা।
-ভাই তোর হেডফোনটা দে তো।রাতে দিচ্ছি..
ঘরে ঢুকে বলল শুভদের দাদা প্রভদ।
কথাটা কর্ণগ্বহরে প্রবেশ করেনি শুভদের,তখনো ও ধ্যানে মগ্ন।
ভাইয়ের এমন অঙ্গভঙ্গি দেখে অবাক হল প্রভদ।
-ভাই!
অতর্কিতে চারবছরের বড় দাদাকে ঢুকতে দেখে চমকে উঠলো শুভদ।
-কিরে ব্যাপারটা মনে হচ্ছে সিরিয়াস।প্রেম-ট্রেম করছিস নাকি!
চলবে: