উপহার ১

0
1854

উপন্যাস — উপহার
~ সবুজ আহম্মদ মুরসালিন

সূচনা কথাঃ
আপনার মন খারাপ!
ধরুন, তখনি আপনার প্রিয় মানুষটা আপনাকে কিছু একটা উপহার দিলো। উপহার পেয়ে তাৎক্ষণিক কি আপনার মন ভালো হবে? অবশ্যই, মন ভালো হতে বাধ্য। উপহার এমন একটা জিনিস, যা শত মন খারাপকেও তাৎক্ষণিক ভালো করে দেয়। মানুষের জীবনে নিয়ে আসে সুখ, হাসি এবং আনন্দ। উপহার আলোর মত, যা জীবনের শত অন্ধকার কেও দূর করে দিতে সক্ষম। সেভাবেই রাগ, অভিমান, অভিযোগ— এক নিমিষেই ভুলি দেয় আমাদের, প্রিয় মানুষের সামান্য উপহারটা।

উপহার এমন একটা গল্প যেখানে মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা দিক দেখানো হয়েছে। আমাদের জীবনে এমন কেউ একজন থাকে কিংবা হঠাৎ চলে আসে, এবং সে এসে আমাদের সম্পূর্ণ একটা নতুন জীবন উপহার দেয়। বাঁচার শেষ অবলম্বনটুকু যখন ফুরিয়ে যায় তখন সে উপহার হয়ে আসে আমাদের কাছে। বেঁচে থাকার আশা জোগায়।

এই উপন্যাসটা অর্না এবং নিরবকে দিয়ে শুরু হলেও ক্রমশ গল্পটা ছড়িয়ে গেছে এবং এভাবেই অনেকগুলো মানুষের গল্প উঠে এসেছে। ফজলুল হল, ফাতেমা, তরিকুল, নাজেরা সহ রাহাত, মিরা, তানিয়া, মারিয়া এবং ভয়ংকর সোহাগের মত মানুষ একসূত্রে বাঁধা পড়েছে। অর্না, নিরব এবং বাকীদের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা দিক নিয়েই আমার এই উপন্যাস, উপহার! আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে এবং পড়তে পড়তে গল্পের ভেতর হারিয়ে যাবেন।

১.
দুপুর থেকে আকাশ মেঘলা৷ সবকিছু অদ্ভুত ভাবে থমকে আছে৷ সারাক্ষণ উড়তে থাকা শহরের ব্যস্ত ধুলোবালি এই মুহুর্তে একদম নিশ্চুপ। বড় কোনো ঝড় শুরু হওয়ার আগে যেভাবে নিশ্চুপ হয়ে যায় সবকিছু, সেভাবে মেঘ ভর্তি আকাশটা ঝিমিয়ে আছে। এই বুঝি ঘুম ভেঙে মস্ত বড় আকাশটা নেমে আসবে পৃথিবীতে। বৃষ্টিতে ডুবিয়ে দিবে শহরের অলিগলি, রাস্তাসহ সম্পূর্ণ শহরটা! নিরব অনেকটা সময় ধরে একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷ সে চাচ্ছে একটা ঝড় এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিক। বুকের ভেতর এলোমেলো হওয়া মনটাকে সে একা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত। সে সত্যিই বড্ড ক্লান্ত!

ভাগ্য বলতে কি কিছু আছে? নিরব কখনো ভাগ্যে বিশ্বাস করেনি। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, ভাগ্য বলতে আসলে কিছুই নেই৷ সবকিছু আমাদের সিন্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। আমরা এই মুহুর্তে যা সিন্ধান্ত নিবো, সেটাই ভবিষ্যতে আমরা কর্মফল হিসাবে পাবো। তবে আজ তার বিশ্বাসের সাথে সে কিছুতেই একমত হতে পারছে না। সে আবার নিজেকে প্রশ্ন করল, ভাগ্য বলতে কি আসলেই কিছু আছে? সবকিছুই কি আগে থেকে নির্ধারণ করা থাকে?
নিরব এই মুহুর্তে আবার সবকিছু নিয়ে ভাবতে চাচ্ছে না। তবুও সে ভাবছে। সে কিছুতেই তার ভাবনাগুলোকে থামিয়ে রাখতে পারছে না। সে তার এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনটার কথা কয়দিন ধরে ভেবেই চলেছে। সে শতবার ভেবেও কিছুতেই তার নিজের মত করে সবকিছু গুছিয়ে আনতে পারছে না।

নিরব যতই ভাবছে সে ততই নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছে৷ যদি সবকিছু আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে তাহলে তাদের কেনো বিচ্ছেদ হলো? অর্নার সাথে কেনো আবার দেখা হলো? তারা কেনো আগের থেকেও অনেকটা কাছে এলো? তারা আবার কেনো একে অন্যের ভালোবাসায় ডুবে গেলো? কেনো-ই বা ছয় বছর আগে সবকিছুর সমাপ্তি হয়েছিলো? নিরবের কাছে এই সব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সে ভাবছে, তখন ভুলটা কার ছিলো? নিরবের নাকি অর্নার? তরিকুলের নাকি ফজলুল হকের? ভুল যারই থাকুক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে নিরবকে। অর্নাও কি নিরবের মত কষ্ট পেয়েছে? নিরব অর্নার কথা জানেনা, তবে নিরব এই ছয় বছর এক মুহুর্তের জন্যও অর্নাকে ভুলে যেতে পারেনি। তাইতো সে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারেনি। অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারেনি। হ্যাঁ, নিরবের দুইটা রিলেশন হয়েছিলো, কিন্তু তার মেয়ার সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ ছিলো। সে কখনো অন্য কাউকে অর্নার জায়গায় বসাতে পারেনি। সে বসাবেই বা কী করে? তার বুকের বাঁ পাশের আকাশটা সে-তো অর্নাকে দিয়েই দিয়েছে। সে এখন চাইলেও অন্য কাউকে দিতে পারবে না। কারণ তার নিজের আকাশটা নিজের কাছেই নেই। তাইতো সবটুকু সময় জুরে সে শুধু অর্নার কথাই ভেবেছে।

নিরব একমুহূর্তের জন্য জোর করে সবকিছু মেনে নিলো। কিন্তু, যদি এসবকিছু আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে তাহলে এই মুহুর্তের বাস্তবতা, পরিস্থিতি এতো জটিল আর এলোমেলো কেনো? যে গল্প শেষ হয়ে গিয়েছিলো ছয় বছর আগে, সেটা কেনো ছয় বছর পর আবার শুরু হলো? এই একটা প্রশ্নের উত্তর নিরব কয়দিন ধরে খুঁজে চলেছে। সে চেয়েছিলো, অর্নার সাথে তার আবার দেখা হোক কিন্তু এরকম পরিস্থিতির কথা সে কল্পনাও করেনি। এখন এ গল্পের শেষটা বড্ড বিশৃঙ্খল, অগোছালো, বিক্ষিপ্ত এবং বড্ড ভয়ংকর। নিরব কয়েকদিন ধরে ভাবছে, আসলে সে কি করবে? আকাশের মত চাইলেই কি যখন তখন মেঘ থেকে বৃষ্টি নামানো যায়? নিরবের বুকের মেঘগুলো জমাট বেঁধে আছে। শক্ত বরফের মত জমে আছে। কালো মেঘগুলো জমে জমে আজ বরফের একটা পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে বুকে। এখানে বৃষ্টি নামাতে চাইলে কারো উষ্ণতা লাগবে। ভালোবাসার উষ্ণতা!

নিরব ভেবে আজকেও কিছুতেই কোনো সলিউশন বের করতে পারছে না৷ সে যতই ভাবছে ততই সে সবকিছু জট পাকিয়ে ফেলছে। তার জন্য সবকিছু দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে। সে বিরক্ত তার জীবনের উপর। তার জীবনের সবকিছু এতো জটিল কেনো? সে কি করবে এখন? তার কি করা উচিত সেটাও সে বুঝে উঠতে পারছে না। একবার ভাবে সে সবকিছু ভুলে যাবে? কিন্তু আবার ! সে কীভাবে ভুলে যাবে? আগেরবার কি সে সত্যিই অর্নাকে ভুলে যেতে পেরেছিলো? না, সে কিছুই ভুলে যেতে পারেনি। পুরনো দিনগুলো এখনো তার মনে আছে। অর্নার বলা প্রতিটা কথা, তাদের একসাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত এবং প্রতিটা সেকেন্ড, সে কিছুই ভোলেনি। নিরব অনেকবার ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তবে সে প্রতিবার ব্যর্থ হয়েছে৷ হেরে গিয়েছে নিজের কাছে, নিজের মনের কাছে। তবুও একটা সময় সে নিজেকে সামলে নিয়েছিলো। নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে সুন্দর ভাবে। সব পিছুটান ছেড়ে নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছিলো। কিন্তু সবকিছু আবার এভাবে ফিরে আসবে তার জীবনে সেটা সে কখনো কল্পনাও করেনি। এখন তার কাছে নিজেকে বোঝানোর মত কোনো শব্দ নেই। নিজেকে জোর করে থামিয়ে রাখার মত শক্তি নেই। এই মুহুর্ত থেকে সে সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলো। নিরব এখন শুধু দেখতে চায় ভাগ্য শেষ পর্যন্ত তাকে কোথায় নিয়ে যায়। যেখানেই তাকে নিয়ে যাক, সে যাবে। তার যতই কষ্ট হোক, সে এখন থামতে পারবে না।

‘স্যার, একটা সমস্যা হয়েছে?’
তামিমের কথা শুনে নিরব ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো। সে সাথে সাথে জানতে চাইলো, ‘কী সমস্যা হয়েছে?’
‘বৃষ্টির কারণে আশেপাশে চলন্ত মানুষগুলো ক্যাফের মধ্যে ঢুকে পরেছে। সবাইকে একসাথে বসতে দেওয়ার মত আমাদের এখানে জায়গা নেই। এদিকে যাদের খাওয়া শেষ হয়েছে তারাও বৃষ্টি কারণে বের হতে পারছে না। নতুন যারা এসেছে তারা খাবার অর্ডার দিতে চাচ্ছে এবং এই জন্য তারা তাদেরকে বসার জায়গা করে দিতে বলছে। এখন কি করবো?’
‘আমাদের স্টোর রুমে অতিরিক্ত কতগুলো চেয়ার আছে?’
‘পনেরোটার মত আছে, স্যার।’
‘আচ্ছা, সেগুলো বের করো। আর যাদের খাওয়া শেষ হয়েছে তাদের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে বলো, বৃষ্টি থেমে যাওয়া পর্যন্ত৷’
‘আচ্ছা স্যার।’

তামিম চলে যেতেই নিরব বাইরে তাকালো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। কখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে? সে একটু আগেইতো মেঘ ভর্তি আকাশ দেখেছে। সে এতোটা সময় বাইরে তাকিয়েই ছিলো কিন্তু সে এতোটাই ডুবেছিলাম ভাবনায় যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে কখন সে সেটা খেয়ালই করিনি।
একটা কাক ভিজতে ভিজতে নিরবের সামনে দিয়ে উড়ে গেলো৷ মেঘ ডাকছে। মেঘের গর্জনে শহরটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য আলোকিত হচ্ছে। নিরবের দারুণ লাগছে৷ হঠাৎ করে তার ভেজার ইচ্ছেটা মনে জাগ্রত হলো। তবে একটা সময় পর মানুষ চাইলেই যখন তখন সবকিছু করতে পারে না। সেই সময় মানুষ তারদের ইচ্ছেগুলোকে খুব সহজে মেরে ফেলে। মানুষ কতকিছু চায়, কিন্তু তার অর্ধেকও সে প্রকাশ করে না। আসলে ভয় পায়। সমাজ এবং সমাজের মানুষের জন্য তারা ভয়ে ডুবে থাকে। সবাই ভয়ে ভয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেয় তার নিজের খুব একান্ত ইচ্ছেগুলোকে হত্যা করে। একেই কি বেঁচে থাকা বলে?

বৃষ্টি থেকে বাঁচতে, হ্যাপি ক্যাফে আন্ড রেস্টুরেন্টে রাস্তার চলন্ত মানুষগুলো আশ্রয় নিচ্ছে ৷ ধানমন্ডিতে বর্তমানে সবচে’ জনপ্রিয় ক্যাফে এন্ড রেস্টুরেন্টের মধ্যে এটি একটি। এখানে ডেকোরেশন থেকে শুরু করে খাবার সবকিছু পারফেক্ট । মূলত সবকিছু সম্ভব হয়েছে নিরবের কারণেই । এটা তার স্বপ্নের জায়গা এবং স্বপ্নের ব্যবসা । অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সে এটা চালু করেছে । নিরবের একমাত্র ইচ্ছে, সারাদেশে একদিন তার খাবার পৌঁছে যাবে । মানুষ সবচেয়ে বেশি খুশি হয় তখন যখন সে কোনো খাবার খেয়ে তৃপ্তি পায় । তাই সে তার ক্যাফে নাম রেখেছে হ্যাপি ।

সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটিয়ে রাত এগারোটার দিকে নিরব বাসায় ফিরলো । সে অনেকটা ভিজে গেছে। বৃষ্টি ঘন্টাখানেক পর থেমে গিয়েছিলো । কিন্তু সম্পূর্ণভাবে থামেনি । কিছুক্ষণ পরপর হুটকরেই শুরু হচ্ছে, আবার হুট করেই থেমে যাচ্ছে । এভাবেই চলছে সন্ধ্যার পর থেকে । এই অদ্ভুত বৃষ্টিটা মানুষের জন্য ভোগান্তি বয়ে আনে । একাধারে ঘন্টাখানেক বৃষ্টি হয়ে শহরটা ভিজিয়ে দিয়ে, সবকিছু শান্ত করে থেমে যাবে এটাই নিরবের পছন্দ । কিছুক্ষণ পর পর বৃষ্টিটা একদমই পছন্দ না নিরবের ৷

বড় একটা ফ্লাটে নিরব একাই থাকে । এতো বড় ফ্লাটে একা থাকার একমাত্র কারণ মাঝে মাঝে তার বাবা-মা রংপুর থেকে এসে তার সাথে থাকে । আগে সে মেসে ছিলো, যখন ব্যবসাটা শুরু করেছিলো । পরে ধীরে ধীরে যখন সবার কাছে ক্যাফেটা পরিচিত হয়ে গেলো, মানুষ আসতে শুরু করলো, সেই সাথে লাভটা ভালই আসা শুরু করলো, তখন সে এই ফ্লাট নিয়ে এখানে উঠেছে ।

এখন বারান্দায় বসে আছে নিরব । তার একটা সিন্ধান্তে আসতে হবে । কিন্তু সে কোনো সিন্ধান্ত নিতে পারছে না । অর্না বলেছে, এখন আর কোনো কিছুই সম্ভব না । আমাদের মধ্যে এখন অনেক দূরত্ব । অনেক বাধা । এরচে বড় কথা আমার জীবন অন্যকারো সাথে জড়িয়ে আছে । নিরব জানে সবটা । কিন্তু সে জেনেও কিছুই বুঝতে চাচ্ছে না । আসলে সে নিজেকেই বুঝাতে পারছে না । অর্নাকেও বুঝাতে পারছে না, নিরব কতটা ভালোবাসে তাকে। নিরব শুধু অর্নাকে ভালো, সুন্দর, স্বাভাবিক, গোছালো একটা জীবন উপহার দিতে চায় । এই নিষ্ঠুর সমাজে একা একটা মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে? এটুকুই সে অর্নাকে বোঝাতে পারছে না । অর্নার নিজের জেদ ধরে বসে আছে ৷ মেয়েটার জেদ একটুও পরিবর্তন হয়নি, সেই ছয় বছর আগের মতই রয়ে গেছে ।

বাইরে ক্রমশ অন্ধকার নেমে আসছে । একটা একটা করে নীভে যাচ্ছে আলো । আকাশে অবশেষে মেঘ কেটে চাঁদের দেখা মিলেছে, তবে তার বুকের আকাশে এখনো মেঘ ভর্তি । এই মেঘটুকু বয়ে বেড়াতে বেড়াতে সে সত্যি ক্লান্ত । খুব ক্লান্ত । মানুষ ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে । কিন্তু সে সবার মত বাতী নিভিয়ে দিয়ে ঘুমাতে পারে না । ঠিকমতো ঘুমিয়েছে কবে নিরব নিজেই জানেনা । তার একটা দীর্ঘ ঘুম দরকার । খুব দীর্ঘ ঘুম । কিন্তু ঘুমাতে গেলেই ঘুম চলে যায় অচিন পুরে । তার চিন্তা ভাবনা একটা বিন্দুতে আটকে থাকে । এবং সে একা একা রাতভর বিচ্ছিরি ভাবে জেগে থাকে। সেই সাথে খুব সহজে পুরনো স্মৃতিগুলো একটা একটা করে চলে আসে চোখের সামনে । হাঠাৎ নিরবের সেই প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। ছয় বছর আগের একটা দিন । কোনো কিছুই সে ভুলতে পারেনি আজও । সেদিন ছিলো বুধবার । তার স্পষ্ট মনে আছে ।

সেদিন ছিলো বুধবার । নভেম্বর মাস । হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে মাত্র । সন্ধ্যা হলেই বাতাসের সাথে কেমন একটা ঠান্ডা অনুভূতি গা ঘেঁষে চলে যায় । ভারী জামা কাপড় শরীরে না জড়ানো থাকলে অনেকটা ঠান্ডা হয়ে আসে শরীর । রংপুরে প্রতিবছরই প্রচন্ড শীত পড়ে । এবারও পড়বে বোঝা যাচ্ছে ।
সবাই অপেক্ষা করছে । আজকে কোচিং এর রেজাল্ট দিবে । স্যার বলেছে, এই পরীক্ষায় যে প্রথম হবে তার জন্য থাকবে পুরস্কার । সবার মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে । সবাই চিন্তিত । তবে একজনের মধ্যে কোনো উত্তেজনা, চিন্তা, বিচলিত কিছুই দেখা যাচ্ছে না । সে চুপচাপ বসে আছে রুমের এক কোনে জানালার পাশে ।

তার ঠিক উলটোপাশে জানালার কাছে বসে আছে আরেকজন । সে রীতিমতো ঘমছে। মুখে চিন্তার ভাব ফুটে উঠেছে । সে ভাবছে, আজকে কোনো রকম পাশ করতে পারলেই মানসম্মান রক্ষ পাবে এই যাত্রায়৷ তার মতে পাশ করার সম্ভাবনা অনেক কম । তার কাছে দুনিয়ায় সবচে কঠিন এবং জঠিল সাবজেক্ট হলো হিসাববিজ্ঞান । সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। আর যখন মনে করে বুঝে ফেলেছে ঠিক সেই সময় তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় । সে খুব বিরক্ত এই সাবজেক্টের উপর।

স্যার রুমে এসে রেজাল্ট জানিয়ে দিলো ৷ রেজাল্ট শুনে সবাই হতবাক ৷ এটা কি করে সম্ভব? কি ঘটেছে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না । সবাই নিরবের দিকে সন্দেহের চোখে তাকালো । সবাই মনে মনে ভাবছে, ও কীভাবে প্রথম হতে পারে? যে সবসময় কোনো রকম ভাবে শুধু পাশ করে যায়, আজ হঠাৎ প্রথম হয়ে গেলো! কীভাবে সম্ভব?
নিরবকে স্যার অনেক প্রশংসা করলো । সেই সাথে স্যারের পছন্দের একটা কলম নিরবকে উপহার দিলো । কিন্তু তাতে যে সবাই খুশি হলো তেমন না । নেহাত স্যারের সামনে কিছু বলা সম্ভব না তাই কেউ কিছুই বলল না । নিরবকে বলেও কোনো লাভ হবে না। ও সবার সাথে তেমন একটা কথাবার্তা বলে না । ক্লাস করতে আসে ক্লাস শেষ হলে চলে যায় চুপচাপ । নামের মতই মানুষটা নিরব ।

নিরবের জন্ম রংপুরে । সেখানেই বেড়ে উঠা । স্কুল শেষ করে কলেজে উঠেছে ৷ জীবনের একমাত্র লক্ষ ব্যবসা করা । এমন কোনো ব্যবসা করতে চায় যেটার মাধ্যেমে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব । সে একটু মোটাসোটা । বেশি মোটা বললে ভুল হবে এইযে একটু স্বাস্থ্যবান । নাদুসনুদুস চেহারা ৷ গায়ের রং ফর্শা । চুপচাপ থাকে সব সময় । নামের মতই কাজেও নিরব । প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে তেমন একটা কথা বলে না। সপ্তাহে চারদিন কলেজের হিসাববিজ্ঞান স্যারের বিকালের ব্যাচে পড়তে আসে । ব্যাচে মোট ছেলে মেয়ে মিলিয়ে পঁচিশ জনের মত পড়ে ৷ নিরব কারো সাথেই তেমন কথা বলে না । সে পড়তে আসে, পড়া শেষ হলে চলে যায় ।
স্যার প্রতি সপ্তাহে একটা করে ক্লাস টেস্ট নেয় । তবে সামনে অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার জন্য একটা ফাইনাল টেস্ট নিয়েছিলো গত পরশু । নিরবের ক্লাস টেস্ট এর ফলাফল মোটামুটি । অতোটা ভাল কিংবা অতোটা খারাপ নয় । সে কোনো রকম পাশ নাম্বার উঠায় । সেই জন্যই আজ এতো ভাল করার কারণে সবাই তাকে সন্দেহ করছে । সবাই অদ্ভুত ভাবে তাকে দেখছে । নিরবের এটা একদমই পছন্দ হচ্ছে না । সে-তো কোনো চুরি করেনি, নকল করেনি কিংবা বাটপারি করেনি । তবুও সবাই তাকে নকল বাজ ভাবছে । নিরব মনে মনে হতাশ হলো ৷ বিরক্ত হলো অনেকটা । সবার প্রতি একটা রাগ জন্মালো । আজকাল কেউ কারো ভাল দেখতেই পারে না । আজব সবার চিন্তাভাবনা । মানুষ ভালো করলে সেটার প্রশংসা না করে উলটো সমালোচনা করতেই মানুষ বেশি পছন্দ করে । ধুর! নিরব পড়ায় মনোযোগ দিলো।

যথারিতি ক্লাস শেষ হবার সাথে সাথেই নিরব চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল । সে আজকে এখানে একমুহূর্ত থাকতে চাচ্ছে না । সবাই এসে এখন এটা সেটা বলবে । সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নিরবের এখন ইচ্ছেই করছে না । সে জানে, সে যা বলবে সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না এখন ৷ সে যাওয়া জন্য হাঁটা শুরু করতেই সেই মুহুর্তে পিছন থেকে একজন বলল,
‘কনগ্রাচুলেশন!’
‘ধন্যবাদ ।’
‘আমি অর্না ।’
‘আমি নিরব ।’
‘হুম জানি, আজকে স্যার তোমার নাম বলল । সেই সাথে তোমার অনেক প্রশংসাও করলো ।’
‘আসলে অতোটা প্রশংসার মত আমি কিছুই করিনি ।’
‘আচ্ছা, হঠাৎ করে কীভাবে এতো ভাল রেজাল্ট করলে? না আসলে, আগের সব পরীক্ষা গুলোতে তো ভাল করতে দেখিনি সেই জন্য জিজ্ঞাসা করলাম । আসলে আমিও না ম্যাথে একদম কাঁচা । অনেক কম বুঝি । তাই জানতে চাচ্ছিলাম আর কি ।’
‘আসলে আগের পরীক্ষাগুলোতে ইচ্ছে করেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতাম না । প্রথম হতেই হবে এরকম কোনো ইচ্ছে আমার মধ্যে নেই । কোনো রকম পাশ নাম্বার উঠলেই আমি উত্তর পত্র জমা দিয়ে চলে যেতাম।’
‘এমন করার কারণ?’
‘আসলে কোনো কারণ নেই । প্রথম হতেই হবে, আমি সবকিছু পারি সেটা সবাইকে দেখাতে হবে, এসব ভাল লাগে না আমার । আমি নিজের মত থাকতে অনেক পছন্দ করি । শুধু শুধু লোক দেখানো কোনো কাজ করতে ভাল লাগে না । আমিতো জানি আমি কি পারি আর কি পারিনা । শুধু শুধু সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে হবে এমন তো না!’

নিরবের কথাগুলো শুনে অর্না খানিকটা অবাক হলো । এমন ও মানুষ আছে যার মধ্যে নিজেকে জাহির করা বা লোক দেখানো বেপারটা একদমই নেই , নিরবের সাথে আজকে কথা না বললে জানতেই পারতো না সে । অর্না অনেকটা ইম্প্রেস্ট । ছেলেটা বড্ড ভাল মনের মানুষ অর্না ভাবল ।
অর্না বলল, ‘আমাকে হেল্প করবে?’
নিরব জানতে চাইলো, ‘ আমি কি হেল্প করবো? আচ্ছা বল, কীভাবে হেল্প করতে পারি? যদি সম্ভব হয় অবশ্যই করবো ।’
অর্না বলল, ‘তেমন কিছুই না । আসলে আমি অন্য সব সাবজেক্ট খুব ভালোই পারি । শুধু এই একটা সাবজেক্ট এ আমার যত সমস্যা । তাই যদি কোনো সমস্যা না থাকে এবং তোমার সময় থাকে তাহলে আমাকে একটু এই বিষয়ে সাহায্য করলে খুশি হবো ।’
নিরব কিছু একটা ভাবছে । ভেবে কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আচ্ছা, আমার কোনো সমস্যা নেই । তুমি চাইলে আমার কাছ থেকে যে ম্যাথগুলোতে তোমার সমস্যা সেগুলো দেখে নিতে পারো ।’
অর্না মুখে হাসি ফুটে উঠলো । হাসি জড়ানো ঠোঁটে নিরবকে ধন্যবাদ দিয়ে জানতে চাইলো, ‘আচ্ছা কখন তুমি ফ্রি থাকবে ।’
এবার নিরব চিন্তায় পড়ে গেলো । টিউশনি, কলেজের ক্লাস, কোচিং মিলে দিনের মধ্যে ফ্রি সময়ই পাওয়া যায় না । কিছু একটা ভেবে তারপর বলল, ‘তুমি চাইলে স্যারের কাছে আমরা যে চার দিন পড়তে আসি সেই চার দিন একটু আগে এসে একসাথে বসতে পারি । ধরো ৩০ মিনিট বসলাম । তুমি যে ম্যাথ গুলোতে কনফিউজিং সেগুলো বুঝিয়ে দিলাম ধীরে ধীরে ।’
অর্না এবার আগের থেকে বেশি খুশি হয়ে গেলো । তারও এই সময়তে কোনো কাজ নেই । একদিন ফ্রি থাকে । অর্না বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে । ভালই হবে আমার জন্য । আবারো ধন্যবাদ ।’
নিরব এবার মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল, ‘এতো ধন্যবাদ দেওয়া কিছু নেই । আমার জন্যও ভাল হবে । তোমাকে বোঝাতে গিয়ে আমার আরেকবার রিভিশন দেওয়া হয়ে যাবে ।’
অর্না বলল, ‘আচ্ছা তাহলে আমরা কাল থেকে শুরু করি । আমি কাল ৩০ মিনিট আগে চলে আসবো । তুমি দেরি করো না কিন্তু!’
নিরব বলল, ‘আচ্ছা । তাহলে আজ চলি । কাল দেখা হবে ।’
অর্না বলল, ‘আচ্ছা, বাই । টাটা!’

এই বলে অর্না চলে গেলো । অর্নার বাসা বেগম রোকেয়া ভার্সিটির কাছেই ৷ তাই হেঁটে রওনা দিলো ।
নিরব একটা রিকসা ঠিক করে বাসার দিকে যাচ্ছে । মেয়েটাকে নিরব আগে কখনো লক্ষ করেনি । তার মনে হচ্ছে অর্নাকে আজকেই প্রথম দেখেছে সে । ছয় মাসের মধ্যে আজকেই প্রথম দেখল ভেবে হেসে দিলো মনে মনে নিজের অজান্তেই।
অর্নাকে কেমন লাগতেছিলো ভাবলো নিরব। অর্না দেখতে হ্যাঙলা পাতলা । গায়ের রঙ কালোও না আবার অতিরিক্ত ফর্সাও না । তবে চোখগুলো অদ্ভুত রকম সুন্দর । কাজল পড়েছিলো কি? নিরব মনে করতে পারলো না । লজ্জাতে ভাল করে তাকাইনি অর্নার দিক একবারও । এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে আসলো নিরব।

চলবে…

বি.দ্র—
১.গঠনমূলক কমেন্ট করে আপনাদের মতামত প্রকাশ করুণ।
২. ভুলক্রটি হলে ক্ষমা প্রার্থী
৩. কপি করা যাবে না। চাইলে শেয়ার দিতে পারেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here