এক.
‘হাসপাতাল থেকে বাবা ও ছোটো ভাই ইমাদের মৃতদেহ বুঝিয়ে দেওয়ার পর দ্রুত আজিমপুর কবরস্থানে তাদেরকে দাফন করা হয়। ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, “লাশ খুব জলদি দাফন করতে হবে। লাশের অবস্থা ভালো না। বাজে গন্ধ ছুটছে!”
এমন কী তাদেরকে ফরজ গোসল অবধি করানো হয় না। লাশের অবস্থা বারোটা!’
বলেই হো হো করে হেসে উঠে ফাইয়ায।
*****
ফাইয়ায আহমেদ। হোসাইন সাহেবের বড়ো ছেলে। সাহেব আর তার বিবি তাসনিয়ার সুখের ঘরে ফাইয়ায বড়ো ছেলে হিসেবে আগমন ঘটায়। এরপর এক এক করে আভা, নিয়ায আর ইমাদের জন্ম! বড়ো ভাই হিসেবে সে যথেষ্ট সচেতন, দায়িত্বশীল! বয়স আটাশ চলে। দায়িত্বের বোঝা অবশ্য অনেক আগেই ঘাড়ে চেপেছিল…
*****
‘ডাক্তারের কথামতো দ্রুত তাদেরকে দাফন করা হয়। কোনো বিলম্বতা ছিল না। বাকি দু’জনকে নিয়ে আমি বাসায় এসে পড়ি। আমার ভালো লাগছিল না কিছু। কেমন অস্বস্তি লাগে। মাথা ভন ভন করছিল। আভা, বোনটা আমাকে খুব বুঝে। আমার ধারে কাছেও আসেনি সে। জানে, সে যদি কাছে আসে আমি কিছু এটা অবশ্যই করে ফেলব। যেটা শুধুমাত্র আমার মস্তিষ্ক বিয়ার করে, আমি না!’
দশ মিনিটের মতো ব্রেক নেয় ফাইয়ায। কথা বলতে ভালো লাগছে না তার। কপালে ভাঁজ জমেছে। সামনে তাকায় সে। সেদিকে স্থির চোখ রেখে মুচকি হাসলো। তৃতীয়বারের মতো সিগারেটে আগুন জ্বালায় ।
‘মানুষের ধারণা, সিগারেট খেলে মনের অশান্তি দূর হয়। মগজের দুশ্চিন্তাগুলো দূর হয়। কিন্তু সত্যিই কি তা? তাহলে সিগারেট ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই কেন যা লাউ তাই কদু?
ক্ষণিকের শান্তি মানুষকে উল্টো বিকারগ্রস্ত করছে। অথচ মানুষ জেনেও তাতেই অভ্যস্ত! মুখে বলা হয়, মানুষ মাত্রই ভুল!’
সিগারেটের শেষ অংশটুকু জানালা দিয়ে ফেলে দেয় ফাইয়ায। আর খাবে না। প্রচুর ঘুম টানছে তার! রুম অন্ধকার করে গেট লাগিয়ে শুয়ে পড়লো সে। দিনের বেলাতেও তার রুমটা কী ঘুটঘুটে আঁধারে ভরা!
বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা হেলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই ফাইয়াযের চোখ নিভে আসে। দু’চোখের পাতায় যেন রাজ্যের ঘুম ছিল! মাথার উপর সিলিং ফ্যান লো স্পীডে ঘুরছে। গরম লাগার কথা তো! কিন্তু তার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা!
*****
দুই.
কোথা থেকে আভা ছুটে আসে। ফাইয়ায কম্পিউটারে কিছু লিখছে। কোনো শব্দ, ডাক, অনুমতি চাওয়া ছাড়াই আভা তার রুমে ঢুকে পড়লো। ফাইয়ায ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তার চোখ দু’টো ভয়াবহ লাল! ইদানিং অল্পতেই সে ভীষণ রেগে যাচ্ছে। মুহূর্তেই ভাইয়ের এরকম অবস্থা দেখবে আভা ভাবেনি। এখন ভাবার সময়ও নেই। ভাইয়ের কাছ ঘেঁষে খাটে বসে বলল,
“আম্মুর ফোন সুইচ অফ। কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না।”
ফাইয়াযের চোখের দৃষ্টি স্থির। এমনিতে ও সে কম কথা বলে। আভার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
“কিছুক্ষণ পর আবার ট্রাই করে দেখ। হয়তো নেট পাচ্ছে না।”
একমুহূর্ত চুপ থেকে আভা ভেজা গলায় বলল,
“ভাই, আধাঘণ্টা ধরে ট্রাই করছি!”
ফাইয়ায চুপ থাকে। প্রত্যুত্তর না করে আবারও কম্পিউটারে মনোযোগ দিলো। আভার জন্য সে লিখতে পারছে না। তার ওয়ার্ড মিনিমাইজ করা। আভা গেলেই ওটা ওপেন করবে। আপাতত সে খালি স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। আভা উঠে যায়। দরজার কাছে যেতেই ফাইয়ায বলল,
“নেক্সট টাইম বিষয়টা মাথায় রাখবি। আমি আর মাফ করব না।”
আভা বুঝতে পারে ভাই কী বুঝিয়েছে। উত্তর দিলো না সে। দরজা লাগিয়ে চলে যায়।
আভা চলে যেতেই ফাইয়ায নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সে পারছে না। সব দোষ এই মেয়ের! এই মেয়েটার জন্য সে নিজ ইচ্ছায় কিছুই করতে পারে না।
*****
দুপুরের দিকে আভা আবারও রুমে নক করলো। এবার আর আগের মতো ভুল করেনি সে। ফাইয়াযের অনুমতি নিয়েই রুমে ঢুকে। তখন তাড়াহুড়ো করায় তার মাথায় বিষয়টা খেয়ালে ছিল না। আভার মনে পড়ে, একবার শুধুমাত্র ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া নিয়ায ওর রুমে ঢুকায় ভাই তাকে কষিয়ে থাপ্পড় মেরেছিল। যার দরুণ নিয়ায আজও ভাইয়ার সাথে কথা বলতে ভয় পায়। আট বছরের একটা বাচ্চা নিজের বড়ো ভাইয়ের সামনে দাঁড়ালে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে।
আভা রুমে ঢুকেই ধীরকণ্ঠে বলল,
“ভাইয়া, দুপুর হয়ে গেছে। নিয়ায কিচ্ছু খায়নি। ফ্রিজেও কিছু নাই। কী দিব?”
কিছু না বলেই উঠে দাঁড়ায় ফাইয়ায। রুম থেকে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে। ডাইনিং-এ নিয়ায বসেছিল। ভাইকে আসতে দেখেই দৌড়ে বোনের রুমে চলে যায়। খাটে উঠে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে থাকে।
পাশে দাঁড়িয়ে বড়ো ভাইয়ের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে আভা। ভাই এক চুলায় ভাত বসিয়ে আরেকটায় ডিম ভাজছে। আভাকে দেখে ফাইয়ায বলে উঠলো,
“শুধু গাধার মতো তাকিয়ে না থেকে কাজ শিখে নাও। ক’দিন পর এমনিই কাজে আসবে।”
মুখ ফসকে আভা বলে ফেলল,
“আমি কেন? আম্মু আছে না?”
ফাইয়াযের বলতে ইচ্ছে করলো, “তার চেহারাও আর কোনদিন দেখতে পাবা না।”
বলল না সে। আভার থেকে চোখ সরিয়ে ফ্রাইপেনের ডিম উল্টিয়ে বলল,
“কথার পিঠে কথা বলা আমার পছন্দ না। এটা হয়তো জানা আছে! অযথা কোনো কথা আমি বলি না।”
আভা চুপ রইলো। আগের মতো দাঁড়িয়ে ভাইয়ের কাজ দেখে।
*****
নিয়ায ফাইয়াযের সামনে খাবে তো দূরে থাক, দেখাও দেয় না। তার জন্য খাবার বেড়ে আভা রুমে যায়। ভাইকে উঠিয়ে মুখে লোকমা এগিয়ে দিতেই নিয়ায বলল,
“আপু, আম্মু কই?”
আভা মিথ্যে আশ্বাস দেয়। ভরসা দিতে হেসে বলল,
“এসে পড়বে আম্মু। তুমি খেয়ে ঘুম দেও। উঠে দেখবে আম্মু হাজির!” নিয়ায অন্ধের মতো বোনের কথা বিশ্বাস করে। বাচ্চা মন বড়োরা যেটা বলবে তাই মেনে নেয়!
*****
সন্ধ্যা অবধি মায়ের কোনো খোঁজ পায়নি আভা। ভাইকেও আর বিরক্ত করতে চাইলো না সে। আভা তার বড়ো ভাইয়ের মতো এরকম স্ট্রিক্ট, রুড বিহেভড পারসন দেখেনি। তার ভাই-ই কীভাবে এরকম হলো? আভার যতদূর মনে পড়ে, সে গত ছয়/সাত বছর ধরেই তার ভাইকে এরকম দেখছে। এর আগে তার ভাই এমন ছিল না! মোটেও না!
নিয়ায ঘুম থেকেই উঠেই মাকে খুঁজছে। আভা কোনোরকম তাকে শান্ত করে বলল,
“আম্মু রাস্তায়। জ্যামে আটকে আছে। ঢাকার জ্যাম সম্পর্কে জানো না তুমি? কত ভিড়! তুমি অপেক্ষা করো নিয়ায।” এবারও নিয়ায বিশ্বাস করলো। শান্ত হয়ে বোনের সাথে সময় কাটায়।
*****
রাত সাড়ে বারোটা।
দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছে না আভার। নিয়াযকে একনজর দেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। হলরুমের সোফায় বসে থাকে চুপচাপ।
পানির বোতল খালি দেখে ফাইয়ায ক্ষেপে উঠে। বিড়বিড় করে কিছুক্ষণ অযথা গালিগালাজ করলো। কাকে গালি দিলো, সেটা সে নিজেই জানে! ওর পানির বোতল খালি থাকবে কেন?
পানির বোতল নিয়ে রুমের বাহিরে আসতেই সে আভাকে দেখতে পায়। না দেখার ভান করেই আভার পাশ দিয়ে ডাইনিং-এ গেল। বোতলে পানি ভরে রুমে আসার সময় আভাকে বলল,
“যে যায়, তাকে আটকানো যায় না! এটা যত দ্রুত মেনে নিবি, তত তোর জন্য ভালো।”
আভা চমকে উঠে। ভাইয়া কী বলল? এর মানে কী? হলরুমে নিয়ন আলোর বাতি জ্বলছে। ওটুক আলোতেই ফাইয়াযের গম্ভীর মুখটা স্পষ্ট বুঝা যায়। যাওয়ার সময় ফাইয়ায আবার বলল,
“পাঁচ মিনিট পর যেন আমি তোকে এখানে না দেখি!”
ভাইয়ের আদেশ, মানে সাথে সাথে পালন করতে হয়। আভা বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজের রুমে না গিয়ে বাবা মায়ের রুমে গেল।
*****
তিন.
খালি রাস্তায় অদম্য গতিতে গাড়ি ছুটছে। গাড়ির ড্রাইভার স্বয়ং হোসাইন। পাশে তার ছোটো ছেলে ইমাদ বসে আছে। ছয় বছরের বাচ্চা। বাকি সন্তানদের ক্লাস থাকায় আর তাসনিয়ার শরীর খারাপ দেখে তিনি শুধু ছোটো ছেলেকে নিয়েই কলিগের বিয়ে খেতে যান।
দূরবর্তী শহর। বিয়েবাড়ি থেকে বের হতে আর রাস্তার ঘণ্টার পর ঘণ্টার জ্যাম; সবমিলিয়ে আসতে আসতে রাত হয়ে যায় তাদের। ছেলে ইমাদ পাশের সিটেই ঘুম! বাচ্চা ছেলে কতক্ষণই বা জেগে থাকবে?
হোসাইনের নিজেরও ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু এরকম সুনসান এলাকায় তিনি থামতে চাইছেন না। যতদ্রুত সম্ভব গাড়ি ছুটিয়ে ঢাকায় পৌঁছুতে পারলেই হয়!
গাড়ি ঘুরিয়ে বড়ো রাস্তায় উঠেন হোসাইন সাহেব। ছেলের গায়ে সিট বেল্টটা ঠিকমতো বাঁধা আছে কিনা দেখে গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দেন। তিনি স্পষ্ট দেখেন, সামনে একদম খালি রাস্তা। একহাতে চোখ কচলে গাড়ি টান দিতেই সামনে থেকে বিশাল ট্রাক ছুটে আসে। তিনি কিছুই বুঝলেন না। মুহূর্তেই জীবনের প্রদীপ নিভে যায় বাবা ছেলের। ইমাদ বাবার দিকে কাঁত হয়ে শুয়ে থাকায় আর গাড়ির কাঁচ ভেঙে সরাসরি তার গলায় লেগে যায়। রগ কেটে যাচ্ছে তাই অবস্থা! অর্ধেকের বেশি গলা কেটে ঝুলে পড়ে। খানিক পর সেটাও ছিঁড়ে পিছনে নিচে পড়ে যায়। হোসাইন সাহেব নিজের ছেলের দিকে তাকানোর সুযোগ পান না। একসাথে দশ বারোটা কাঁচের টুকরো তার বুক পেটে ঢুকে লেগে থাকে। গলগল করে রক্ত বেরোয়। গলার একপাশেও মোটা কাঁচ ঢুকে বিঁধে আছে। হয়তো বরাবর পড়েনি বলেই তিনি এখনও নিঃশ্বাস নিতে পারছেন। কিন্তু ঘাড় নারাতে পারছেন না।’
ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে নিয়ায। উঠেই বোনকে খুঁজতে থাকে। পায় না। দৌড়ে রুম থেকে বেরোয় সে। সোজা বাবা মায়ের রুমে। আপু সেখানে শুয়ে আছে। দেখতে পেয়েই নিয়ায আভার পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলো। আভার ঘুম ভেঙে যায়। নিয়াযকে কাঁপতে দেখে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে?” নিয়ায কথা বলার সাহস পায় না।
আভাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। ঘটনার শুরু শেষ কিছুই বুঝতে পারে না আভা। শুধু ভাইকে বুকে জড়িয়ে রাখলো।
‘ইজ ইট আ ডিজঅর্ডার?’
পর্ব:- ০১
কলমে; সায়ীদা নুহা।